Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

যারা হারিয়ে যায়

আদিবাসী

শুচিস্মিতা সেন চৌধুরী

 

একশো কোটির দেশ ভারতবর্ষ। এর মধ্যে মাত্র ৮.৬ শতাংশ মানুষ আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। সংখ্যাটা নেহাৎ কম নয়। দশ কোটির কিছু বেশি। এদের মধ্যে এমন অনেক জনগোষ্ঠী আছে যারা সংখ্যায় নগণ্য। আন্দামান-নিকোবরে বসবাসকারী অনেক জনগোষ্ঠী মানচিত্র থেকে ক্রমশ নিশ্চিহ্ন হতে বসেছে। যেমন– ওঙ্গি, শম্পেন, সেন্টিনেলিস, জারোয়া এবং আরও অনেক আদিবাসী ছড়িয়ে আছে ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে। পশ্চিমবঙ্গে বসবাসকারী আদিবাসীর সংখ্যা ৫২,৯৬,৯৫৩ অর্থাৎ সমগ্র জনসংখ্যার প্রায় ৫.৮ শতাংশ (২০১১ সেনসাস)। এখানে চল্লিশটিরও বেশি বিভিন্ন সম্প্রদায় সরকারি তালিকাভুক্ত। এর বেশ কিছু জনগোষ্ঠীর সংখ্যা এতই কম যে এদের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী বলে চিহ্নিত করা যেতে পারে। যেমন– অসুর, বিরজিয়া, ম্রু, নাগেশিয়া, লোহরা, শবর, পারহাইয়া, গোরাইত, হো এবং অন্যান্য। এই জনগোষ্ঠীর মানুষ পশ্চিমবঙ্গের মানচিত্র থেকে ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে। এদের জনসংখ্যা রাজ্যের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সাপেক্ষে ১ শতাংশেরও কম। এরা প্রান্তিক। প্রশ্ন হল, কেন এরা প্রান্তিক? প্রথমত, জনসংখ্যা কম। দ্বিতীয়ত, এদের দশকীয় বৃদ্ধি (Decadal growth rate) ঋণাত্মক; তৃতীয়ত, এরা শিক্ষার দিক থেকেও পিছিয়ে। এরা সামাজিক বর্জনের (social exclusion) শিকার। শিক্ষার অভাব থাকায় সচেতনতার অভাব। এসব জনগোষ্ঠীর ক্রমশ হারিয়ে যাওয়ার পিছনে রয়েছে নানান কারণ। আন্দামান-নিকোবর অঞ্চলের আদিবাসীদের ক্ষেত্রে কারণটা ভিন্ন। আন্দামান-নিকোবরের ভৌগোলিক অবস্থান ভারতবর্ষের মূল ভূখণ্ড থেকে পৃথক। স্বভাবতই যুগ যুগ ধরে এই অঞ্চলের আদিবাসীদের বহির্জগতের সঙ্গে মেলামেশার সুযোগ কম। এরা এখনও প্রথাগত চিন্তাধারা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। উপরন্তু, এইসব জনগোষ্ঠীর প্রজনন প্রধানত নিজেদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। ফলে এদের মধ্যে জিনগত অসুস্থতা বা ব্যাধি (disorder) ছড়িয়ে পড়ে বংশানুক্রমিকভাবে, এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে। এবং একসময় শেষ হয়ে যায় একটা জনগোষ্ঠী। একই সাথে মৃত্যু হয় একটি সংস্কৃতির।

ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলের সমস্যা বিভিন্নরকম। ভৌগোলিক বা প্রাকৃতিক বৈচিত্রের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক বৈচিত্রকেও মনে রাখতে হবে। সুতরাং আমরা এখন মনোসংযোগ করব পশ্চিমবঙ্গের ওপর এবং বিশেষভাবে একটি গোষ্ঠীতে। এই আদিবাসী জনগোষ্ঠীর নাম ‘পারহাইয়া’।

এবার একটি গল্প বলার পালা। একটি অনুসন্ধানের গল্প। ২০১৫ সালে কর্মসূত্রে পারহাইয়া সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদের খুঁজে বার করার নির্দেশ আসে, একটি সরকারি প্রকল্প অনুসারে। সেনসাসের (২০১১) তথ্য অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গে মাত্র ৯২১ জন এই সম্প্রদায়ভুক্ত। এর মধ্যে ৪৫১ জন পুরুষ এবং ৪৭০ জন মহিলা। আরও জানা যায় যে পারহাইয়া সম্প্রদায়ের মানুষ প্রধানত নদীয়া জেলায় বাস করেন (৩৫.৬ শতাংশ), এরপর মালদা (১৪.৬ শতাংশ) এবং পর্যায়ক্রমে আরও ১৩টি জেলায়। কিন্তু মজার ব্যাপার হল, ক্ষেত্র সমীক্ষায় নদীয়া বা মালদা কোথাও পাওয়া গেল না এই জনগোষ্ঠীর মানুষ। তাহলে কীভাবে খোঁজা যায়? একটা উপায় পাওয়া গেল। তা হল, বিভিন্ন সময় পারহাইয়া সম্প্রদায়ের মানুষদের দেওয়া জাতির শংসাপত্রের নথি (caste certificate)। এই তথ্যের সংরক্ষক অনগ্রসর কল্যাণ দপ্তর। তথ্য অনুযায়ী দেখা গেল, শংসাপত্রের ঠিকানা দার্জিলিং জেলা। সুতরাং আমরা পাড়ি দিলাম দার্জিলিঙে। না, পাহাড়ে নয়। শিলিগুড়ি। কারণ ঠিকানাটি শিলিগুড়ি মহাকুমার অন্তর্গত। আমাদের ধারণা ছিল না, এই অনুসন্ধান কীভাবে হতে পারে বা এর রূপরেখাই বা কেমন হবে। পুরনো তথ্য ঘেঁটে দেখা গেছে পারহাইয়া সম্প্রদায়ের ৪ জন ব্যক্তি শংসাপত্র পেয়েছেন শিলিগুড়ি সংলগ্ন এলাকা থেকে। বাকি যা দু-এক জনের তথ্য পাওয়া গিয়েছিল তা ভুল প্রমাণিত হয়। ভুলটা নিয়ে আলোচনায় না যাওয়াই শ্রেয়।

এবার দ্বিতীয় পর্যায়ের অনুসন্ধান। প্রসঙ্গত বলে রাখা দরকার যে দার্জিলিং জেলায় পারহাইয়া জনসংখ্যা ১৪ জন এবং জলপাইগুড়ি জেলায় ৬২ জন। এবার ঠিকানা খুঁজতে যেতে হল মহাকুমা শাসকের অফিস। সেখানে অনেক ফাইলপত্র ঘেঁটেও ঠিকানা পাওয়া গেল না। অগত্যা গোডাউনে রাখা বহু বছরের পুরানো আবেদনপত্র খুঁজতে বলা হল। সেখানে উইয়ের বাসস্থান সরিয়ে, ধুলো ঝেড়ে অবশেষে পাওয়া গেল সেই মহামূল্যবান ঠিকানা। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হল, এই চারজন যাদের শংসাপত্র ধরে আমাদের এগোনো তারা একই পরিবারের।

পারহাইয়া সম্প্রদায়ের মানুষ মূলত ঝাড়খণ্ডের বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাস করেন, যেমন গয়া, গুমলা, হাজারিবাগ এবং পালামাউ। ‘পারহাইয়া’ অর্থাৎ ‘পাহাড়ী’। কারও কারও মতে প্রাচীনকালে এরা পাহাড়ে ঝুম চাষ করে জীবনধারণ করত বলে এই নামকরণ। আবার কারও মতে ‘পারহাইয়া’ শব্দটি এসেছে ‘পারেই’ থেকে, অর্থাৎ একধরনের ঢোল যা মৃত্যুর সময় বাজানো হত। পারহাইয়ারা নিজেদের নকুলের বংশধর মনে করেন, তাই এদের একটি অংশ পাণ্ডবংশী নামে পরিচিত। এছাড়াও আরও তিনটি ভাগ দেখা যায়, যেমন নারকাৎমা, পাকফোর এবং চেরোয়ান। এরা নানান রকম গোত্রে বিভক্ত এবং সব গোত্রেরই কোনও না কোনও টোটেম আছে।

পারহাইয়া সম্প্রদায়ের একটা অংশ বৃটিশ আমলে চলে আসে উত্তরবঙ্গে। চা শ্রমিক হিসেবে শুরু করে কাজ। আমাদের খুঁজে পাওয়া একমাত্র পরিবার– এর প্রধান কৃষাণ পারহাইয়া। বয়স ৬০ পেরিয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারি চাকরি থেকে সদ্য অবসরপ্রাপ্ত। তার কাছেই শুনলাম কীভাবে হারিয়ে যাচ্ছে পারহাইয়া সম্প্রদায়। কীভাবে তারা ভুলে যাচ্ছেন আদিম সংস্কৃতি। কৃষাণ পারহাইয়াদের পরিবার থাকেন শালবাড়ি অঞ্চলে। তার বাবা একসময় বিহার ছেড়ে এখানে বসবাস শুরু করেন। বাবা ছিলেন পূজারী, ওদের ভাষায় ‘বায়গা’। রাজপরিবারের সঙ্গে নাকি সংযোগ ছিল এই পরিবারের। কৃষাণ পারহাইয়ার খুড়তুতো ভাই থাকেন গুমলা চা বাগানে। সেখানেও হানা দেই আমরা। কৃষাণ পারহাইয়া মনে করতে পারেন না তাঁর গোত্র। শুধু এটুকু বলতে পারেন যে তারা পাণ্ডবংশীয়। কৃষাণ পারহাইয়া বিয়ে করেছেন একজন স্থানীয় নেপালি মহিলাকে। তার ছেলে মেয়েরাও অন্য সম্প্রদায়ের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছেন। এই প্রজন্ম পারহাইয়া সংস্কৃতি সম্পর্কে জানে না কিছুই। কৃষাণ পারহাইয়ার ভাই বিয়ে করেছেন এক ওঁরাও সম্প্রদায়ের মহিলাকে। ফলে তার সংস্কৃতিও মিশে গেছে অন্যদের সাথে। এই দুই পারহাইয়া পরিবারের সূত্র ধরে আমরা খুঁজে পেলাম আর এক পারহাইয়া পরিবার। জলপাইগুড়ি জেলার মাল অঞ্চলে। এরা এলেনবাড়ি চা বাগানে বাস করছেন বহু বছর। এখানেই থামতে হল। কারণ পশ্চিমবঙ্গে আর কোনও পারহাইয়া পরিবারের ঠিকানা পাওয়া যায়নি।

আদিবাসী-দের সংস্কৃতির একটি প্রধান বৈশিষ্ট স্বজাতিতে বিবাহ। সেটা এই পারহাইয়া সম্প্রদায় ধরে রাখতে পারেনি। ফলে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছেন এরা আত্মীয়স্বজন থেকে। সংস্কৃতির মেলবন্ধন এমন পর্যায়ে পৌছে গেছে যে আলাদা করে কোনও জাতির সংস্কৃতি ধরে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। হয়তো আরও কোনও পরিবার ছিল এখানে, এই উত্তরবঙ্গে ,তারাও কালচক্রে হারিয়ে গেছে। কেউ ফিরে গেছে তাদের আদি বাসভূমে, আবার কেউ থেকে গেছে অন্যদের সাথে একাত্ম হয়ে। এভাবেও হারিয়ে যায় এক একটা জনগোষ্ঠী ভৌগোলিক ও সামাজিক মানচিত্র থেকে। এভাবেই ক্রমাগত বিপন্ন হয়ে পড়ে একটা সংষ্কৃতি। যেমন, গত একশো বছরে ৬৭২ জন ‘ওঙ্গি’ থেকে কমতে কমতে ১০০-তে ঠেকেছে জনসংখ্যা। যেমন পশ্চিমবঙ্গে আর খুঁজে পাওয়া যায় না ‘ম্রু’দের। তাই একবার আমরা চেষ্টা করে দেখি যদি সম্পূর্ণ হারিয়ে যাওয়ার আগে ধরে রাখতে পারি এদের পদচিহ্ন।