Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

অজিত ওয়াদেকর এবং জোড়া সিরিজ জয়

অজিত ওয়াদেকার | ক্রীড়াবিদ

শুভাশিস রায়চৌধুরী

 

১৯৭১ সালের ২২শে ফেব্রুয়ারি। স্থান জামাইকার কিংস্টন শহরের সাবাইনা পার্ক ক্রিকেট স্টেডিয়ামের ড্রেসিংরুম। একটু আগে এরাপল্লি প্রসন্ন আর শ্রীনিবাস ভেঙ্কটরাঘবনের স্পিনের দাপটে নিজেদের ঘরের মাঠে শক্তিশালী ওয়েস্টইন্ডিজ গুটিয়ে গেছে মাত্র ২১৭ রানে। কোথায় দলের মেজাজ ফুরফুরে থাকবে তা নয়, কয়েকজন জড়িয়ে পড়লেন বচসায়। ড্রেসিংরুমে সেই সময় দলের তিন সিনিয়র ক্রিকেটার নবনিযুক্ত অধিনায়ককে কিছু একটা বোঝাচ্ছিলেন। ভারতীয় দলে এঁদের তিনজনেরই তখন বেশ অনেকগুলি বছর খেলা হয়ে গেছে। অধিনায়ক যেহেতু তাদের থেকে অনেকটা জুনিয়র তাই তাকে পরামর্শ দেওয়াটা সিনিয়র ক্রিকেটার হিসাবে এই তিনজন নিজেদের কর্তব্য বলে মনে করেছিলেন। সেই তিনজন ছিলেন দিলিপ সরদেশাই, এম এল জয়সিমা এবং সেলিম দুরানি। তিনজনেরই বক্তব্য ছিল ওয়েস্টইন্ডিজকে যেন ফলো-অন দেওয়া না হয়। এমনিতেই সেটা ছিল পাঁচ ম্যাচের সিরিজের প্রথম টেস্ট, তার ওপর বৃষ্টিতে প্রথম দিনের খেলা ভেস্তে গিয়েছিল। প্রথম ইনিংসে দিলিপ সরদেশাইয়ের ২১২ রানের সৌজন্যে দল বড় স্কোর করলেও বাকি ব্যাটসম্যানরা সেরকম রান পাননি। ব্যাটিং অর্ডারের প্রথম ছয় জনের মধ্যে সরদেশাইকে বাদ দিলে বাকিদের মোট রান ছিল ৩৫। স্বভাবতই তাঁরা চেয়েছিলেন বাকি টেস্টগুলোর জন্য প্রস্তুতি হিসাবে এই টেস্টের শেষ দুদিন যেন দলের ব্যাটসম্যানদের ব্যাটিং প্র্যাকটিস হয়। তাদের বোঝানোতে লাভ বিশেষ হল না। দলের তিন সিনিয়রের পরামর্শ উপেক্ষা করে বিপক্ষের ড্রেসিংরুমের দিকে গটমট করে হেঁটে চলে গেলেন ভারতীয় দলের নবনিযুক্ত অধিনায়ক। ক্যারিবিয়ান ড্রেসিংরুম তখন হাসিঠাট্টায় মগ্ন। তারা এই একটা ইনিংসে ২১৭ রানে গুটিয়ে যাওয়াকে একটা অঘটন হিসাবেই দেখছিল। হোল্ডার, শিলিংফোর্ডরা তৈরি হচ্ছিলেন বল করার জন্য। হঠাৎ তাদের সামনে এসে তাদের দোর্দণ্ডপ্রতাপ অধিনায়ক স্যার গারফিল্ড সোবার্সকে ভারতীয় অধিনায়ক একটু জোর গলাতেই বললেন–

–গ্যারি, তোমাদের ফলো অন করতে হবে।

চমকে উঠলেন সোবার্স। এ ছোকরা বলে কী? এটাই তার অধিনায়ক হিসাবে প্রথম টেস্ট আর সেটাতে হিরোগিরি দেখাতে গিয়ে কিনা বলে ওয়েস্টইন্ডিজকে ফলো অন করতে হবে? এত সাহস?

খানিকটা মনঃক্ষুণ্ণ হলেও স্বভাবসুলভ ক্যারিবীয় কায়দায় হাসতে হাসতে সোবার্স উত্তর দিলেন–

–ফলো অনের জন্য দুশো রানের লিড থাকতে হয়। তোমাদের তো মাত্র ১৭০ রানের লিড। মানছি অধিনায়ক হিসাবে এটা তোমার প্রথম ম্যাচ, কিন্তু তা বলে এগুলো একটু জেনে বলা ভালো নয় কি?

জানি বলেই বলছি। প্রথম দিনের খেলা ভেস্তে গিয়ে এটা এখন চার দিনের ম্যাচ। চার দিনের ম্যাচে ফলো অনের জন্য ১৫০-এর লিড যথেষ্ট। সেখানে তো আমাদের আরও কুড়ি রান বেশি আছে। তোমরা প্যাড আপ করো।

এবার আর হাল্কা মেজাজে ব্যাপারটা নিলেন না সোবার্স। তার চোখেমুখে মনঃক্ষুণ্ণতার ছাপ স্পষ্ট, বললেন–

–একবার আম্পায়ারকে জিজ্ঞাসা করে নাও।

–আমি নিয়ম জানি। তোমার মনে প্রশ্ন থাকলে তুমি জিজ্ঞাসা করে নাও।

কথাটা বলে যেভাবে এসেছিলেন ঠিক সেভাবেই গটমট করে ওয়েস্টইন্ডিজ ড্রেসিংরুম থেকে বেরিয়ে এলেন ভারতীয় দলের অধিনায়ক অজিত লক্ষ্মণ ওয়াদেকর। পিছনে ক্যারিবিয়ান ড্রেসিংরুমের ভিতর পড়ে রইল শ্মশানের নিস্তব্ধতা।

গত ১৫ই অগাস্ট, মুম্বাইয়ের যশলোক হসপিটালে নিজের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন ওয়াদেকর। ছেড়ে গেলেন ভারতীয় ক্রিকেটে তাঁর লেগাসি। খবরটা পাওয়ার পর সবার প্রথমে উপরের ঘটনাটা মনে পড়ল আমার, যা শুনেছিলাম ওয়াদেকরেরই এক সাক্ষাৎকারে। ভারতীয় ক্রিকেট দলের বিদেশের মাঠে প্রথম জয়গুলির অন্যতম কাণ্ডারী ছিলেন তিনি। ১৯৬৭-৬৮ সালে ভারত প্রথমবার বিদেশে কোনও টেস্ট সিরিজ জিতেছিল নিউজিল্যান্ডকে হারিয়ে। ওয়াদেকর ছিলেন সেই সিরিজে ভারতীয় দলের টপ স্কোরার। ১৯৭১-এ ওয়েস্টইন্ডিজ এবং ইংল্যান্ডের মাটিতে প্রথম টেস্ট সিরিজ জয়ের সময় দলের অধিনায়ক ছিলেন তিনি। প্রথম ভারতীয় অধিনায়ক হিসাবে টেস্ট সিরিজ জয়ের হ্যাটট্রিকও তাঁর দখলে এবং তিনিই ছিলেন ওয়ান ডে ক্রিকেটে ভারতের প্রথম অধিনায়ক। ওয়েস্টইন্ডিজকে ফলো অন করানোর ওয়াদেকরের সেই সাহসী সিদ্ধান্ত ওয়েস্টইন্ডিজের মাটিতে ঐতিহাসিক টেস্ট সিরিজ জয়ের বীজ বপন করে দিয়েছিল। সেই একটা সিদ্ধান্তই ক্যারিবিয়ানদের যাবতীয় হিসাব এলোমেলো করে তাদের ক্রিকেটীয় ঐতিহ্যের অহংকারে এক বড় আঘাত দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট ছিল। অথচ সেই সিরিজের দল গঠনের সময় ওয়াদেকর ভেবেছিলেন তার সাম্প্রতিক অফ ফর্মের জন্য তিনি দলেই থাকবেন না। স্বভাবতই অধিনায়ক নির্বাচনের দিন তিনি স্ত্রীকে নিয়ে চলে যান তাঁর নতুন কোয়ার্টারের জানালাগুলির জন্য পর্দা কিনতে। স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ায় চাকরি করার দরুণ তিনি সেই অফিসার্স কোয়ার্টারটি পেয়েছিলেন। পর্দা কিনে ফেরার সময় তিনি দেখেন সেই লোকালয়ের সামনে বহু মানুষের জটলা। অনেকেই ফুলের মালা নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তিনি ভেবেছিলেন হয়তো কোনও অফিসারের প্রমোশন হয়েছে। কিছুক্ষণ পরে ওয়াদেকর বোঝেন যে তিনি শুধু দলে সুযোগই পাননি দলের অধিনায়কও নির্বাচিত হয়েছেন।

অধিনায়ক হিসাবে প্রথম সিরিজে ওয়েস্টইন্ডিজের সাথে তাদের মাঠেই খেলতে হবে সেটা জানতেন ওয়াদেকর। তাই দায়িত্ব পাওয়ামাত্রই তিনি দল গঠনের কাজে নেমে পড়েন। দিলিপ সরদেশাই, যিনি ১৯৬৮-র পরে দলে আর সুযোগ পাননি তাকে ফেরানোর আর্জি জানানো হয়। বম্বের হয়ে রঞ্জি খেলার দরুণ ওয়াদেকর সরদেশাইকে ভালো মতো চিনতেন, তাঁর খেলার ধরন জানতেন। তাই বম্বে লবির জন্য সুযোগ পেয়েছে বলে অনেকেই ভ্রু কুঁচকিয়েছিল সরদেশাইয়ের নির্বাচনে। সরদেশাইয়ের সাথে সেবার বম্বের এক তরুণ ডানহাতি ব্যাটসম্যানকে দলে নেওয়া হয়েছিল, যার নামেও অনেক কুৎসা রটেছিল। বলা হয়েছিল যে এই তরুণ বম্বে দলে নিয়মিত সুযোগ পায় কারণ তার মামা, ভারতীয় ক্রিকেট দলের প্রাক্তন উইকেটকিপার মাধব মন্ত্রী বম্বের সিলেকশন কমিটিতে আছেন। সেই তরুণের নাম ছিল সুনীল মনোহর গাভাস্কার। এই দুজনেই সেই সিরিজে যথাক্রমে ৬৪২ এবং ৭৭৪ রান করে যাবতীয় সমালোচনার এবং সমালোচকদের মুখে ঝামা ঘষে দেন। ওয়াদেকর তাঁর দলে আরও দুজনকে চেয়েছিলেন যাদের নাম ছিল মনসুর আলি খান পাতৌদি এবং ফারুখ ইঞ্জিনিয়ার। প্রথমজন খেলতে চাননি আর পরেরজন সেই সময় ভারতে ঘরোয়া ক্রিকেট খেলছিলেন না বলে সুযোগ পাননি। দলে ছিলেন ভারতের স্পিন চতুর্ভুজের তিন ভুজ বিষেণ বেদী, এরাপল্লি প্রসন্ন এবং শ্রীনিবাস ভেঙ্কটরাঘবন। ওয়েস্টইন্ডিজের সিংহভাগ উইকেট যেহেতু স্পিন সহায়ক নয় তাই বাদ পড়তে হয় চতুর্থ ভুজ ভাগবৎ চন্দ্রশেখরকে।

জামাইকার প্রথম টেস্টে ওয়েস্টইন্ডিজকে ফলো অন করালেও তা শেষমেশ ড্র হয়। দ্বিতীয় টেস্টে ওয়াদেকর পোর্ট অফ স্পেনের উইকেট দেখে আশাবাদী হয়ে উঠেছিলেন। স্পিন সহায়ক সেই উইকেটে তাঁর স্পিনত্রয়ী যে কামাল দেখাতে পারেন তা তিনি আগেই বুঝে গিয়েছিলেন। গত টেস্টে ফলো অনে যে ধাক্কা ক্যারিবীয় শিবিরে লেগেছিল তা দ্বিতীয় ইনিংসে কিছুটা হলেও মেরামত করেছিলেন রোহন কানহাই। ক্যারিবিয়ানরা তাই আত্মবিশ্বাসী হয়েই নেমেছিল দ্বিতীয় টেস্টে। কিন্তু ক্রিকেট দেবতা যে অন্য চিত্রনাট্য লিখে রেখেছিলেন। প্রথমে ব্যাট করতে নেমে আবিদ আলির প্রথম বলেই প্যাভিলিয়নে ফেরত যান ওপেনার রয় ফ্রেডরিক্স। রোহন কানহাই এবং চার্লি ডেভিস কিছুটা চেষ্টা করলেও সহায়ক উইকেটের ফায়দা তুলতে ভুল করেননি ভারতীয় স্পিনাররা। এবারে প্রসন্ন আর ভেঙ্কটের সাথে যোগ্য সঙ্গত দিলেন বেদী। আবারও ধস নামল দ্বীপপুঞ্জের ব্যাটিং-এ। তিন স্পিনার মিলে তুলে নিলেন ৮টি উইকেট। ইনিংস শেষ হল ২১৪ রানে। তারপর এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। প্রথম টেস্টে চোটের জন্য সুযোগ না পেলেও এবারে ভারতীয় দলের হয়ে প্রথমবার ব্যাট করতে নামলেন সুনীল গাভাস্কার। লেখা হল ভারতীয় ক্রিকেটের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যাটসম্যানের রূপকথার প্রথম অধ্যায়। ক্যারিবিয়ানরা প্রাণভরে দেখলেন ব্যাট হাতে ছোটখাটো চেহারার এক মারাঠি তরুণের শিল্প। সরদেশাই আগের টেস্ট যেখানে শেষ করেছিলেন ঠিক সেখান থেকেই শুরু করলেন। এই দুজনের কাঁধে ভর দিয়ে ভারত প্রথম ইনিংসে করল ৩৫২ রান। এই ইনিংসে এক মজার ঘটনা ঘটে, যা ওয়াদেকরের সেই সাক্ষাৎকারেই শুনেছিলাম। পোর্ট অফ স্পেনে স্পিন সহায়ক উইকেট বলে ওয়াদেকর আশঙ্কায় ছিলেন সেখানে ওয়েস্টইন্ডিজ নিজেদের সেরা স্পিনার ল্যান্স গিবসকে খেলাতে পারে। তাই বোর্ড প্রেসিডেন্টের সাথে ম্যাচে অনামী স্পিনার জ্যাক নোরেগাকে দেখে তাঁর মাথায় এক দুষ্টুবুদ্ধি খেলে যায়। দলের বাকিদের ওয়াদেকর বলেন সেই স্পিনারকে যেন সকলে একটু বেশি সমীহ করে খেলে, প্রয়োজনে উইকেট দিতেও যেন পিছপা না হয়। ক্রিকেট খেলায় অধিনায়কের স্ট্র্যাটেজির যে কত বড় ভূমিকা থাকে তা আরও একবার দেখিয়ে দেন ওয়াদেকর। জামাইকাতে ফলো অন দিয়ে সোবার্সের সাথে মনস্তাত্ত্বিক চাপের খেলা খেলার পর নোরেগাকে অতিরিক্ত সম্মান দেওয়াও ছিল তাঁর এক মোক্ষম চাল। ওয়াদেকরের সেই টোপ গেলেন ওয়েস্টইন্ডিজের নির্বাচকেরা। পোর্ট অফ স্পেনে খেলানো হয় নোরেগাকে। নোরেগা সেই টেস্টে নয়টি উইকেট নিলেও তাকে খেলতে বিশেষ অসুবিধা হয়নি গাভাস্কার, সোলকার, সরদেশাইদের। ওয়েস্টইন্ডিজের দ্বিতীয় ইনিংসে রোহন কানহাই এবং রয় ফ্রেডরিক্স দারুণ শুরু করেন। কানহাই আউট হতে চার্লি ডেভিস আর রয় ফ্রেডরিক্স দুজনে মিলে প্রথম ইনিংসের ঘাটতি পূরণ করে অনেকটা এগিয়ে নিয়ে যান দলকে। তখনও ব্যাট করা বাকি ক্লাইভ লয়েড এবং স্বয়ং গ্যারি সোবার্সের। এই চারজনের মধ্যে যে কোনও তিনজন দাঁড়িয়ে গেলে ম্যাচ ওয়েস্টইন্ডিজ হারবে না সেটা আঁচ করতে পেরে ওয়াদেকর ক্রমাগত বোলিং চেঞ্জ করছিলেন। তাতে লাভ বিশেষ কিছু হয়নি কারণ ভারতের স্পিনত্রয়ীকে বেশ সাবলীলভাবে খেলছিলেন ডেভিস এবং ফ্রেডরিক্স। কিন্তু ঐ যে একটু আগে বললাম, ক্রিকেট দেবতা অন্য চিত্রনাট্য লিখে রেখেছিলেন ভারতীয় ক্রিকেটের জন্য। হঠাৎ নিজেদের মধ্যে ভুলবোঝাবুঝিতে রান আউট হলেন ফ্রেডরিক্স। নামলেন লয়েড। তিনিও ক্রিজে আস্তে আস্তে জমে যেতে শুরু করেন। তিন স্পিনারদের মধ্যে লয়েড সব থেকে বেশি ভালো খেলছিলেন বিষেণ বেদীকে। ওয়াদেকর লক্ষ করেন বাঁহাতি লয়েডের অফ স্ট্যাম্পের বাইরে ক্যারিবিয়ান বোলারদের তৈরি করা প্যাচগুলোর সুবিধা ঠিকমতো নিতে পারছেন না বেদী। চটজলদি তাঁকে সরিয়ে সেই জায়গায় নিয়ে আসেন আরেক বাঁহাতি স্পিনার সেলিম দুরানিকে। দুরানি কয়েক ওভার সেই রাফ প্যাচে ফেলে বল লয়েডের উইকেটের ভিতরে আনতে পারছেন দেখে ওয়াদেকর বোঝেন লয়েড দুরানিকে উইথ দ্য স্পিন খেলার চেষ্টা করবেন। ভাবামাত্রই তিনি নিজেকে স্লিপ থেকে সরিয়ে শর্ট মিড উইকেটে নিয়ে আসেন। অধিনায়কের খেলার মধ্যে ইনভলভমেন্ট এবং অব্যর্থ গেম রিডিং থাকলে যা হয় ঠিক তাই হল। লয়েড দুরানিকে সজোরে পুল করতে গিয়ে জমা পড়লেন ওয়াদেকরের হাতে। একটু পরেই সেই বোলারস রাফে পড়ে দুরানির একটি বিষাক্ত ডেলিভারি সোবার্সের স্ট্যাম্প ছিটকে দেয়। ব্যস! আর কিছু নিয়ে চিন্তা করতে হয়নি। ভেঙ্কটরাঘবন একাই ভেঙে দেন ক্যারিবিয়ানদের লোয়ার মিডল অর্ডার। ওয়েস্টইন্ডিজ শেষ হয় ২৬১ রানে। ১২৪ রানের টার্গেট নিয়ে খেলতে নেমে সুনীল গাভাস্কারের অর্ধশতরানের সৌজন্যে ভারত ৭ উইকেটে জিতে নেয় সেই টেস্ট।

বাকি তিন টেস্টে ওয়েস্টইন্ডিজ মরণ কামড় দেওয়ার চেষ্টা করলেও কখনও গাভাস্কার, কখনও সরদেশাই, কখনও সোলকার আবার কখনওবা স্পিনত্রয়ীরা তা সামলে দিয়েছিলেন। বাকি তিন টেস্ট ড্র হতে ভারত ওয়েস্টইন্ডিজের মাটিতে প্রথমবার টেস্ট সিরিজ জিতেছিল। সেই ঐতিহাসিক টেস্ট সিরিজ জয়ের অধিনায়ক ইহলোক ছেড়ে চলে যেতে ভারতীয় ক্রিকেটপ্রেমীদের মনে বিষাদের সাথে সাথে সেই মধুর স্মৃতির রোমন্থনও হতে বাধ্য।

ওয়েস্টইন্ডিজ থেকে টেস্ট সিরিজ জিতেই ওয়াদেকরকে পরবর্তী বাধার সম্মুখীন হতে হয়। ১৯৭১-এর জুনে তাঁর নেতৃত্বে ভারতীয় দল পাড়ি দেয় ইংল্যান্ডে। সেই ইংল্যান্ড দল তখন সদ্য অস্ট্রেলিয়াতে অ্যাশেজ জিতে টগবগ করে ফুটছে। আগের টানা ২৫টি টেস্টে অপরাজিত ইংল্যান্ড দল সেই মুহূর্তে বিশ্বক্রিকেটের শ্রেষ্ঠ দল ছিল। জেফ্রি বয়কট, ডেনিস অ্যামিস, অ্যালান নট, জন এডরিচ, রে ইলিংওয়ার্থ, রিচার্ড হাটন, ডেরেক আন্ডারউডদের নিয়ে সেই দল একদম যাকে বলে তারকাখচিত। ওয়েস্টইন্ডিজে সিরিজ জয়ের কথা মানুষ একটা অঘটন হিসাবে মনে রাখবে যদি না দল ইংল্যান্ডে ভাল ফল করে, এই কথাটা ওয়াদেকরের মনে সর্বদাই ঘুরত। তিনি তাই বাড়তি সাবধানী হয়ে উঠলেন। ওয়েস্টইন্ডিজ ট্যুরের দল থেকে বাদ পড়েন এম এল জয়সিমা এবং সেলিম দুরানি। দলে ঢোকেন লেগ স্পিনার ভাগবৎ চন্দ্রশেখর। এক ম্যাচে চার স্পিনার খেলানো সম্ভব নয় তা জানতেন ওয়াদেকর। তবুও বিকল্প তৈরি রাখতেই দলে ঢোকেন চন্দ্র। ওয়েস্টইন্ডিজে পোচিয়া কৃষ্ণমূর্তি দলের উইকেটরক্ষক থাকলেও ওয়াদেকর এবার ফারুখ ইঞ্জিনিয়ারকে দলে ফেরাতে উদ্যত হন। ফারুখ সেই সময়ে ল্যাঙ্কাশায়ারের হয়ে কাউন্টি খেলছিলেন। ইংলিশ কন্ডিশন সম্পর্কে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল একজনকে দলে রাখলে বিরাট সুবিধা হবে তাই দলে নেওয়া হয় ইঞ্জিনিয়ারকে। ওয়াদেকর আন্দাজ করেন ইংলিশ কন্ডিশনে স্লিপে এবং ক্লোজ ইন ফিল্ডিং পজিশনে তাঁর স্পিনারদের বলে বহু ক্যাচ আসতে পারে। তিনি তাই দলের ক্লোজ ইন ফিল্ডিং এবং ক্যাচিং-এ জোর দেন। সেই সময়ের ভারতীয় দলের কাছে যা ছিল অবিশ্বাস্য। ফিল্ডিং ভারতের বরাবরের দুর্বল জায়গা। আজ আমরা কোহলি, ধাওয়ান, হার্দিকদের চমকপ্রদ ফিল্ডিং দেখছি বটে কিন্তু এই বিভাগে ভারতীয় দল লেট নাইন্টিজ এমনকি আর্লি টু থাউজেন্ডেও ভালো অবস্থায় ছিল না। কিন্তু ভাবতে অবাক লাগে ১৯৭১-এর সেই সিজনে ভারতীয় দলের ক্যাচ মিসের সংখ্যা ছিল নগণ্য এবং তা সম্ভব হয়েছিল ওয়াদেকরের তত্ত্বাবধানে। ওয়াদেকর সোলকার, সুনীল গাভাস্কার ও ভেঙ্কটকে বেছে নিয়েছিলেন ক্লোজ ইন ফিল্ডিং স্পেশালিস্ট হিসাবে। স্পিনারদের বোলিং-এর সময়ে নতুন ব্যাটসম্যান এলেই তাদের চারপাশে তিনি এই স্পেশালিস্ট ফিল্ডারদের নিয়ে আসতেন। ওয়াদেকর কখনওই কোনও বোলারকে বল করিয়েই পরের ওভারে তাকে ক্লোজ ফিল্ডিং-এ রাখেননি। শ্রান্তির কারণে কেউ ক্যাচ মিস করুক সেটা তিনি হতে দেননি। “ক্যাচেস উইন ম্যাচেস” এই বিখ্যাত প্রবাদের বড় ভক্ত ছিলেন ওয়াদেকর।

উনি নিজেও একজন ভালো স্লিপ ফিল্ডার ছিলেন এবং ভালো ফিল্ডারের কী কী গুণ থাকা দরকার সেটা তিনি ভালোই জানতেন। তাঁর চোখে পড়েই একনাথ সোলকার সেই সময়ের একজন সেরা ফিল্ডার হয়ে ওঠেন। ভারতীয় দলের দুর্ভাগ্য যে ওয়াদেকরের পরবর্তী অধিনায়কেরা ফিল্ডিংকে ততটা গুরুত্ব দেননি।

যাইহোক, ইংল্যান্ড সিরিজে প্রথম আঘাত হানে ভারত। লর্ডসের প্রথম টেস্টে বেদী-চন্দ্র-ভেঙ্কটের দাপটে ইংল্যান্ড ১৮৩ রানে ৭ উইকেট হারিয়ে ধুঁকছিল। দুশোর নিচে ইংল্যান্ডকে গুটিয়ে ফেলার মোক্ষম সুযোগ ছিল সামনে। কিন্তু পেসার জন স্নো নিজের জীবনের সেরা স্কোর করে ইংল্যান্ডকে পৌঁছে দেন ৩০৪ রানে। ব্যাট করতে নেমে শুরুতেই ওপেনারদের হারিয়ে চাপে পড়ে যায় ভারত। ওয়েস্টইন্ডিজে সেরকম রান না পেলেও এবার ওয়াদেকর দলের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন। তিন ঘণ্টার ওপর ক্রিজে থেকে ১১টি বাউন্ডারির সৌজন্যে ৮৫ রান করে দলের নিশ্চিত পতন রোধ করেন তিনি। ভারতের স্টাইলিশ বাঁহাতি অধিনায়কের খেলা দেখে মুগ্ধ হন ক্রিকেটের মক্কার দর্শকেরা। সাথে যোগ্য সঙ্গত দেন গুন্ডাপ্পা বিশ্বনাথ। ভারতের স্কোর হয় ৩১৩। দ্বিতীয় ইনিংসে আবার বেদী-চন্দ্র-ভেঙ্কট ৮টি উইকেট নিয়ে ইংল্যান্ডকে আটকে দেন মাত্র ১৯১ রানে। জেতার জন্য ১৮৩ রানের লক্ষ্য নিয়ে খেলতে নেমে চাপে পড়ে যায় ভারত। একমাত্র গাভাস্কার ছাড়া কেউ বড় স্কোর করতে পারেননি। আট উইকেট পড়ে যায় ভারতের কিন্তু টেল এন্ডারদের নিয়ে টেস্ট বাঁচিয়ে দেন একনাথ সোলকার। ৫৪ বল খেলে মাত্র ৬ রান করে দাঁতে দাঁত চেপে ক্রিজে পড়ে থাকেন তিনি। ভারত শেষ করে ১৪৫ রানে ৮ উইকেট হারিয়ে। ম্যানচেস্টারে দ্বিতীয় টেস্টে স্পিনাররা সেভাবে সফল না হওয়াতে ইংল্যান্ড বড় স্কোর খাড়া করে। জেতার জন্য চতুর্থ ইনিংসে ৪২০ রানের অসম্ভব টার্গেট নিয়ে ভারত খেলতে নেমে ৫০ রানে ৩ উইকেট হারিয়ে ফেলে, কিন্তু শেষদিন খেলা না হওয়ায় এই টেস্টও ড্র হয়ে যায়। সিরিজের তৃতীয় এবং অন্তিম টেস্টে দুই দলই জেতার জন্য মরিয়া হয়ে নেমেছিল। ওভালে তৃতীয় টেস্টে ইংল্যান্ড জন জেমসন, অ্যালান নট এবং রিচার্ড হাটনের সৌজন্যে ৩৫৫ রান খাড়া করে। পিচ তখনও স্পিনারদের অতটা সাহায্য করছিল না তাই একনাথ সোলকারকে বাড়তি দায়িত্ব নিতে হয়। সোলকারের মিডিয়াম পেস তিন উইকেট তুলে নেয় সেই ইনিংসে। জবাবে ভারত প্রথম ইনিংসে তোলে ২৮৪ রান। কেউ বড় স্কোর না পেলেও মোটামুটি রান সকলেই করেছিল। অর্ধশতরান করেন দিলিপ সরদেশাই এবং ফারুক ইঞ্জিনিয়ার। মাঝে একদিন খেলা সম্ভব হয়নি। চতুর্থ দিনে পিচ যেন স্পিনারদের জন্য আশীর্বাদ হয়ে উঠেছিল। চন্দ্রশেখর এমন একজন বোলার ছিলেন যিনি শুরুর কয়েক ওভারে উইকেট না পেলে বিভিন্ন পরীক্ষানিরীক্ষা করতে শুরু করতেন। তার ফলে মনোসংযোগে টান দেখা দিত তাঁর আর তিনি অনেক রান দিয়ে ফেলতেন। ঘরোয়া ক্রিকেটে চন্দ্রর বিরুদ্ধে অনেক খেলেছিলেন ওয়াদেকর। তিনি তাঁর এই দুর্বলতাটা জানতেন। চাপের মুখে চন্দ্রের দরকার ছিল অধিনায়কের ভরসা। সেদিন ক্রমাগত সেটাই জুগিয়ে যান ওয়াদেকর। ফলস্বরূপ মাত্র ৩৮ রান নিয়ে চন্দ্রশেখরই সেদিন ৬ উইকেট তুলে নেন। ইংল্যান্ড শেষ হয়ে যায় মাত্র ১০১ রানে। ১৭৩ রানের টার্গেট নিয়ে খেলতে নেমে দ্বিতীয় ইনিংসের শুরুতেই ফিরে যান সুনীল গাভাস্কার এবং অশোক মানকড়। ইতিহাস গড়ার এতটা কাছে এসে ফিরে যেতে চাননি ওয়াদেকর। তাই দিলিপ সরদেশাইকে নিয়ে নিজেই দলের হাল ধরেন। তৈরি করেন পার্টনারশিপ। সরদেশাই অসাধারণ স্কিলফুল ব্যাটসম্যান হলেও তাঁর রানিং বিটুইন দ্য উইকেটস ছিল ভয়ানক। পঞ্চম দিনে ওয়াদেকরের ফেস করা প্রথম বলের সময় তখন ভারতের স্কোর ৭৬-২, ওয়াদেকর খেলছেন ৪৮ রানে। তখনও জেতার জন্য ৯৭ রান দরকার। এরকম সময়ে সরদেশাইয়ের মারাত্মক ভুলে রান আউট হলেন ওয়াদেকর।

তিনি মনেপ্রাণে চেয়েছিলেন শেষ পর্যন্ত ক্রিজে থেকে দলকে ম্যাচ জেতাতে। রেগেমেগে প্যাভিলিয়ন ফেরার পথে আগত ব্যাটসম্যান গুন্ডাপ্পা বিশ্বনাথ তাঁকে বলেন–

–ক্যাপ্টেন, তুমি গিয়ে বিশ্রাম নাও, আমরা আছি।

কথাটা এক মুহূর্তে বদলে দেয় তাঁর মনের অবস্থা। ড্রেসিংরুমে সোলকার, ইঞ্জিনিয়াররাও একই কথা বলেন ওয়াদেকরকে। একটু পরে আউট হন সরদেশাই আর তারপর সোলকার। তখন ভারতের স্কোর ১৩৪-৫। ব্যাট করতে নামেন সৌম্যদর্শন ফারুখ ইঞ্জিনিয়ার। তিনি আর বিশ্বনাথ মিলে দলকে পৌঁছে দেন জয়ের দোরগোড়ায়। তিন রান বাকি থাকতে আউট হন বিশ্বনাথ। সৈয়দ আবিদ আলি নেমে একটা বাউন্ডারি মারতেই ওভালের মাঠে নেমে আসে ভারতীয় সমর্থকদের ঢেউ। ঠিক যেমন লর্ডসের মাঠে নেমে এসেছিল ২৫শে জুন ১৯৮৩-তে। প্রাক বিশ্বকাপ যুগে বিশ্বের এক নম্বর দলকে তাদেরই মাটিতে হারিয়ে টেস্ট সিরিজ জয় বিশ্বকাপ জেতার আবেগের থেকে কম কিছু ছিল না।

আজ ওয়াদেকরের মৃত্যুতে, তাই বারবার করে তাঁর এবং তাঁর দলের এই কীর্তির কথা ভারতীয় ক্রিকেটপ্রেমীদের বুকে বাজছে। বিশ্ব ক্রিকেটের দরবারে ভারত যে বিদেশের মাটিতেও বিশ্বের প্রথম সারির দলগুলির সাথে দাপটের সাথে সিরিজ জিততে পারে তা প্রথম শিখিয়েছিলেন তিনি। যখনই বিদেশের মাটিতে ভারতীয় দলের ল্যাজেগোবরে অবস্থা হয় তখন অনুপ্রেরণার জন্য ওয়াদেকরের নাম উঠে আসে। বিদেশের মাটিতে ভারতীয় দলের সাফল্যেও ঠিক একইভাবে তাঁর নাম উঠে আসে সেই সাফল্যের একজন পথিকৃৎ হিসাবে। ক্রিকেট থেকে অবসর নিলেও পরবর্তীকালে তিনি জাতীয় দলের কোচ ছিলেন এবং বিসিসিআই-এর নির্বাচন কমিটির চেয়ারম্যানও হয়েছিলেন। জাতীয় দলের খেলোয়ার, অধিনায়ক, কোচ/ম্যানেজার এবং নির্বাচন কমিটির চেয়ারম্যান হওয়ার কৃতিত্ব তিনি ছাড়া একমাত্র লালা অমরনাথ এবং চান্দু বোরদের রয়েছে। ভারতীয় ক্রিকেটে তাঁর অবদানের জন্য ভারতীয় ক্রিকেটকে নিঃসন্দেহে আজীবন ঋণী হয়ে থাকতে হবে অজিত লক্ষ্মণ ওয়াদেকরের কাছে।

যেখানেই থাকুন ভালো থাকবেন ক্যাপ্টেন।