উইমেন ইন ব্লুজ

শুভাশিস রায়চৌধুরী

 

আজ খুব মনে পড়ছে ওকে। ওর নাম ছিল ঝিনুক। ভাল নামটা কি ছিল জানি না। ঝিনুকটাই ডাকনাম আর আমরা ওকে সেই নামেই ডাকতাম। আমরা, মানে আমাদের বিকেলবেলার খেলাধুলার দলটার কথা বলছি। পুরনো পাড়ার পার্কের মাঠে আমরা একসাথে লুকোচুরি, কুমিরডাঙ্গা, বুড়ি-বাসন্তি ইত্যাদি খেলতাম। তখন ঐ ক্লাস থ্রিতে পড়ি। আমাদের সেই দলে অনেক মেয়েই ছিল কিন্তু তাদের মধ্যে ঝিনুককেই আলাদা করে মনে আছে আমার। তা আমাদের সেই খেলার দলটা বেশ ভালোই চলছিল, তার মাঝে হঠাৎ করে শুরু হয়ে গেল হিরো কাপ। সে এক পাঁচ দেশীয় ক্রিকেট টুর্নামেন্ট যেটায় দক্ষিণ আফ্রিকা, ওয়েস্ট ইন্ডিজদের সেমিফাইনাল আর ফাইনালে হারিয়ে জিতেছিল ভারত। ১৯৯২-এর বিশ্বকাপ খাপছাড়াভাবে দেখলেও তা আমাদের মাথায় ঢোকেনি। তাই হিরো কাপই আমাদের জেনারেশানের দেখা প্রথম টুর্নামেন্ট হয়ে থাকবে বলে মনে হয়। অন্তত আমার পরিচিতদের সকলেরই তাই। সে যাকগে, ওরকম একটা টুর্নামেন্ট দেখার পর রাতারাতি শচীন, লারা, কুম্বলে, অ্যামব্রোজ, জাদেজা, ক্রোনিয়েরা আমাদের চোখে স্টার হয়ে গেছিল। তার ফলস্বরূপ হঠাৎ করে আমাদের ভিতরের পুরুষেরা ঘুম ভেঙ্গে জেগে উঠল আর মেয়েদের সাথে বিকেলবেলা লুকোচুরি খেলে সময়টা নষ্ট করা নিয়ে আমাদের আফসোসের সীমা রইল না। তার ওপর বিলুর মামা ওর জন্মদিনে ওকে একটা ব্যাট গিফট করতেই তা হয়ে গেল কফিনের শেষ পেরেক। পার্কের মাঠে ইঁট পেতে উইকেট বানিয়ে শুরু হল আমাদের ক্রিকেট খেলা। দলের মেয়েদের হাবে ভাবে বুঝিয়ে দেওয়া হল, ‘দেখ, এটা ছেলেদের খেলা তাই আমরা খেলছি। তোরা সাইড হ আর যেরকম লুকোচুরি-ছোঁওয়াছুঁয়ি খেলতিস সেটাই কন্টিনিউ কর।’

মেয়েগুলো সেটা মেনে নিলেও ঝিনুক কেন জানি না আমাদের দিকেই রইল। সেও যে হিরো কাপ দেখেছে তার প্রমাণস্বরূপ ফাইনালে কুম্বলের ছটা উইকেটের নামও বলল। সেই থেকে সে বিকেলবেলা আমাদের সাথেই খেলত, এবং শুধু খেলার জন্যে খেলত না, বেশ ভালোই খেলত। মনে আছে আমাদের বলে টাঙিয়ে টাঙিয়ে চার-ছয় মারত, ঝাঁপিয়ে পড়ে ফিল্ডিং করত। আমাকে তো সঠিকভাবে ক্যাচ কি করে ধরতে হয় তা ঝিনুকই প্রথম শিখিয়েছিল। বেশ কয়েকবছর ভালোই চলল আমাদের খেলাধুলা। তারপর আমি যখন ক্লাস ফাইভে পড়ি, সেইসময় হঠাৎ করে ঝিনুক একদিন গায়েব হয়ে গেল। কয়েকদিন খেলতে এল না দেখে তাকে ডাকতে গেলাম আমরা সকলে। কাকিমা দরজা খুলে বলে দিলেন ওর শরীর খারাপ হয়েছে, দৌড়ঝাঁপ করা মানা। ও আর আমাদের সাথে খেলবে না। ঝিনুক আর আমাদের গ্রুপে নেই সেটা মানতে শুরুতে একটু খারাপ লাগলেও আস্তে আস্তে ব্যাপারটা আমাদের মন থেকে মুছে গেল। সময়ের সাথে সাথে একটু একটু করে ঝিনুক হারিয়ে গেল আমাদের পার্কের মাঠ থেকে। সে পাড়া ছেড়ে দেওয়ার আগে ঝিনুককে কয়েকবার দেখেছিলাম। কেমন যেন একটা জবুথবু মেরে গেছিল। চলাফেরায় সেই স্ফূর্তিটা ছিল না। তার চোখে তখন কাজল, কপালে টিপ, অনেক বেড়ে গেছিল চুলের দৈর্ঘ্যটাও। দেখা হলে মৃদু হেসে পাশ দিয়ে বেরিয়ে যেত। আমাদের পাশের বড় মাঠটায় এক প্রাক্তন বাংলা ক্রিকেটার নিজের কোচিং ক্যাম্প খুলবে শুনে যে ঝিনুক খুব আশা করেছিল সেখানে ভর্তি হবে বলে, সে ঝিনুক আর এই ঝিনুক যেন দুজন সম্পূর্ণ আলাদা কেউ।

আজ যখন হরমনপ্রীত কৌর টাঙিয়ে টাঙিয়ে ছয়গুলো মারছিল তখন খুব মনে পড়ছিল ঝিনুকের কথা। আচ্ছা, আমাদের বাড়ির মেয়েদের মনে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় কেন যে তারা মেয়ে? তাদের জগৎটা ছেলেদের থেকে আলাদা? সেই নর্ম ভেঙ্গে অন্য কিছু করতে চাইলেই তাদের সমাজের জুজুর দোহাই কেন দেওয়া হয়? আমাদের দেশে কজনের বাড়ি থেকে মেয়েদের স্বেচ্ছায় খেলাধুলা করতে দেওয়া হয়? বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বাড়ির মেয়ে যদি খেলতে চায়, প্রথমেই দোহাই দেওয়া হয় এটা বলে যে খেলাধুলা শুধু ছেলেদেরই কাজ। মেয়ে তাও অনড় থাকলে বলা হয়, রোদে রোদে খেলে গায়ের রঙ নষ্ট হলে কেউ বিয়ে করবে না, কুৎসিত হয়ে থাকতে হবে সারাজীবন। তাতেও কাজ না হলে বলা হয় মদ্দা মেয়েছেলেরা খেলাধুলা করে, যাদের সকলেই সমকামী, তোমার যখন নিজের রূপ যৌবনের মায়া নেই তার মানে তুমিও ওদের মতই হয়ে যাচ্ছ। এর সাথে চলতে থাকে ইমোশনাল অত্যাচার, কান্নাকাটি দিয়ে ভোলানো আর পাড়ার লোক, আত্মীয়স্বজনেরা কী বলবে ইত্যাদি প্রভৃতি। বোঝা মুশকিল হয়ে যায় বাড়ির মেয়ে খেলাধুলা করতে চাইছে না আইসিস জয়েন করতে। এতসব বাধা বিপত্তি পেরিয়ে কোনও মেয়ে যদি তাও খেলাটাকেই বেছে নেয় সেখানেও তাদের সহ্য করতে হয় নানান বঞ্চনা। দেশের খেলাধুলার সংস্থা মেয়েদের খেলাধুলায় খরচা বেশি করবে না, দেশের মিডিয়া মহিলাদের খেলার প্রচার সেভাবে করবে না, পাবলিক মেয়েদের খেলা দেখা তো দূরের কথা, খবরও রাখবে না। সত্যি বলুন তো, এদের কি এটাই প্রাপ্য? চলতি ক্রিকেট বিশ্বকাপে আমাদের মেয়েরা যেভাবে ৬ খানা ম্যাচ দাপটের সাথে জিতে ফাইনাল খেলতে চলল সেই খবর কজনই বা রেখেছে? সংবাদপত্রগুলোও খেলার পাতায় ছোট্ট করে রিপোর্ট লিখে নিজের দায় সেরেছে। ভাবতে অবাক লাগে যে এরা কিন্তু সেই একই মানুষ যারা সেহবাগ আর ধোনি এক সাদামাটা ম্যাচে সেঞ্চুরি করলে প্রথম পেজে বোল্ড হেডলাইন দেয় “মহেন্দ্র আর বীরেন্দ্রর দাপটে চূর্ণ শ্রীলঙ্কা”। যেখানে ভারতীয় পুরুষ ক্রিকেটাররা কোটি কোটি টাকা কামায়, নিজেদের দেশে স্টার স্ট্যাটাস পায় সেখানে মহিলা ক্রিকেটারদের পারিশ্রমিক বছরে মাত্র ১০-১৫ লাখ। জুনিয়রদের আরও কম। দুই দলের বোর্ড কিন্তু BCCI-ই, তাও এরকম সৎ মায়ের মতো একচোখো ব্যাবহার হয় মহিলাদের সাথে। পাবলিক চুপ, মিডিয়া চুপ সবাই চুপ। ক্রিকেট তো তাও তুলনামূলকভাবে ভাল স্থানে রয়েছে, বাকি খেলার স্পোর্টসউইমেনদের কথা বলে আর লজ্জা দেব না। শুধু একটাই প্রশ্ন করব। আর কত তেলা মাথায় তেল দেব আমরা তা বলতে পারেন?

যাকগে ক্ষোভ উগরে ব্যাপারটা না চটকে ঝিনুকের কথায় ফিরে যাই। চলুন কুর্ণিশ করি হরমনপ্রীতের ১৭১ নট আউটের ঝলমলে ইনিংসটায়। মাত্র ১১৫ বল খেলেছে মেয়েটি, মেরেছে ৭টা ঢাউস ছক্কা আর কুড়িটা চার। কুর্ণিশ করি ৩৫ বছর বয়সী ঝুলন গোস্বামীর ঐ ব্যাক অফ লেংথ বলটায় যেটা পারফেক্ট সিমে পিচ হয়ে আলতো মুভমেন্টে চুমু খেয়ে গেল মেগ ল্যানিং-এর অফ ষ্টাম্পটাকে। কুর্ণিশ করি স্মৃতি মান্ধানা, পুনম রাউতের স্ট্রোকপ্লে সমৃদ্ধ সেঞ্চুরিগুলোকে। কুর্ণিশ করি ক্যাপ্টেন মিতালি রাজের পর পর করে যাওয়া হাফ সেঞ্চুরিগুলোকে। কুর্ণিশ করি সেই মুহূর্তটাকে যখন প্রেস কনফারেন্সে এক অপগণ্ড সাংবাদিকের প্রশ্ন ‘আপনার প্রিয় পুরুষ ক্রিকেটার কে?’-এর উত্তরে তিনি বলেছিলেন ‘আপনি কি কোনওদিন কোনও পুরুষ ক্রিকেটারকে জিজ্ঞাসা করেছেন ওনার প্রিয় মহিলা ক্রিকেটার কে?’ দারুণ উত্তর তাই না?

এদের যত দেখি আমার ঝিনুককে তত বেশি করে মনে পড়ে যায়। ঝিনুক, আমি জানি না তুই কোথায় আছিস বা কী করছিস। আশা করব সামনের রবিবার এই মেয়েগুলো যখন ফাইনালে খেলবে তখন তুইও আমার মতো টিভির পর্দায় চোখ রাখবি আর ফিরে যাবি আমাদের ছেলেবেলার সেই পার্কের মাঠে। আপনাদেরও বলছি, এদের উৎসাহ দিন, এদের পাশে থাকুন। বিরাট কোহলিদের জন্য যেভাবে গলা ফাটান এদের জন্য সেই একইভাবে চিৎকার করুন। এরাও ঐ নীল রঙের জার্সিটা পরেই খেলছে কিন্তু। এদের পাশে এখন আমরা না দাঁড়ালে কলাবতীরা মতি নন্দীর গল্পের পাতা ছেড়ে আর বেরোতেই পারবে না যে।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4887 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...