Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

আজীব দস্তান হ্যায় ইয়ে — এক কথকতার পুনর্জন্ম

চার নম্বর নিউজডেস্ক

 

‘এই যে জানু পেতে বসেছি পশ্চিম’। জানু, পশ্চিম, প্রার্থনা। তবে বসন্তের শূন্য হাত না। বরং পায়ের তলায় শ্বেতশুভ্র আসন। কুর্তা পাজামা। টুপি। আর… হ্যাঁ, দস্তানগি। ষোড়শ শতকের সেই দস্তানগি। গল্প। সেই দস্তান যারা বলে, তারা দস্তানগো। মূলত পারস্যে শুরু হওয়া এই দস্তানগিরা একটা সময়ে দিল্লিতে চলে এল। তারপর সিপাহী বিদ্রোহের সময়ে রমরমা বাজার। গালিবের খামখেয়াল। নিজস্ব খানসামার সঙ্গে দৈনন্দিন দাস্তানগোদের রাস্তা থেকে ধরে এনে গল্প শোনার অভ্যেস। মিথ। কালের যাত্রার ধ্বনি। একটা সময়ে খসে যাওয়া পোড়ামাটির মতো যার শেষটুকু। গল্প, কথা, কথন কোনও কিছুরই তো শেষ নেই? তাহলে দস্তানগোরা ধুঁকতে ধুঁকতে নিভে গেল জাস্ট? কোথায় গেল তারা? আছেন কেউ এখনও? বংশধর? থাকলে জীবিকা কী এখন? উত্তর নেই। শেষ পারফর্মেন্স? মনে পড়ছে মীর বকর আলির কথা। ১৯২৮। পরেরটুকু অন্ধকার। একশ বছর পেরোত বছর দশেক হলেই। কাউন্টডাউন। ঠিক এসময়েই ফারিস্তা এসে যান। শিল্প সংরক্ষণ, সংস্কৃতির পুনরুদ্ধার, ইতিহাসের রিজুভিনেশন। লেখক দানিশ ইকবাল। পরিচালনায় ফৌজিয়া দস্তানগো। প্রথম নারী দস্তানগো। সঙ্গে গরিমা আর্য। নয়ডার সেক্টর ১২৬-এ তৈরি করা মধ্যযুগ। ফিরিয়ে আনা পুরনো নতুন আফসানা। মন্টো, ইসমাত। কিংবা সময়ের আগেপিছে বেশ কিছুটা স্প্যান জুড়ে আশরাফ দেহলাভি, ইন্তিজার হোসেন এবং বাকি নক্ষত্ররা। এদের বলা, বলতে না দেওয়া প্রকাশিত অপ্রকাশিত সবরকম গল্প। ভাষা? উর্দু বা হিন্দি। পুরনো, আদি, অকৃত্রিম আমেজকে ফিরিয়ে আনতে। অবশ্য এই কথনের নির্যাসটুকু এখানেই শেষ না। গল্প তো হল? গল্পবলিয়ে? সেই কুশীলব বলতে ছোট ছোট মুখ। রাঘব মেহতা, আরমান সেন দাভে, মহুয়া আগরওয়াল, শোভিতা নেহরা, শুভঙ্কর নেহরা, আম্রপালি মাখিজা, ইশান সেন দাভে, ইরা জাসুজা। আটজন। বয়স আট থেকে বারোর মধ্যে। ইতিহাসের সর্বকনিষ্ঠ দস্তানগো দল। নয়ডার নামকরা ইংরিজি স্কুলের ভেতর যাদের স্বাভাবিক নিয়মিত জীবনযাপন। আর তার দরজার বাইরে এদের অন্য জগৎ। চোস্ত, ফ্লুয়েন্ট বিদেশি ভাষার অভ্যেস, স্মার্টনেসের ভেতরেও এক অন্য সনাতন ভারতবর্ষ। অবশ্য দানিশ, ফৌজিয়া, গরিমাদের লড়াই সহজ ছিল না। কোনওরকম ইম্প্রোভাইজেশন চলত না। আক্ষরিকভাবে স্ক্রিপ্ট-বাউন্ড হতেই হবে। না হলেই উচ্চারণগত, সময়োচিত বিদেশি অভ্যেস, টান বেরিয়ে পড়বে। তাতে কৃত্রিমতা আসার সম্ভাবনা। তাই, শুরু থেকেই সচেতন ছিলেন ফৌজিয়ারা। লেগে থাকা ওদের সঙ্গে। ‘হামসে নেহি হোগা। বহত ডিফিকাল্ট হ্যায়’। ছেলেমেয়েগুলোর চোখে জল। কষ্ট। ভয়। একটা সময়ে ভালোবাসা। জয়। ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাসের ত্রিমুখী ম্যাজিক। রাঘব, আম্রপালীদের কণ্ঠে, স্বপ্নে, চরিত্রে সীমানা পেরোনোর হাতছানি। মাসখানেকের টানা রিহার্সাল। যার পরিণতি নয়ডার এক রোববারের সন্ধে। গরিমা আর্যর ড্রামাবাজ কোম্পানির উদ্যোগ। একঘণ্টার পারফর্মেন্সে এক একজনের বড়জোর ছয় থেকে পনেরো মিনিট। নিখুঁত উর্দু উচ্চারণে কীভাবে মানাল ওরা? দানিশ মূল গল্প থেকে নিজের মতো করে দাঁড় করালেন। ফৌজিয়া সেই গল্পগুলোই লিখে দিলেন রোমান স্ক্রিপ্টে। তারপর অনুশীলন। একমাস। অন্তিম উপস্থাপনায় কোনওরকম জড়তা ছিল না ছেলেমেয়েগুলোর। মহাভারত, বুদ্ধ, তুর্কি ফোকটেল, কিংবা কোমিল্লা রাওতের হীরামন তোতা এবং রাজকুমারী। বয়সোচিত চরিত্র এবং গল্পনির্বাচন। এপিক আর উপকথার পাশাপাশি মন্টো, ইসমাতদের সাম্প্রতিক প্রাসঙ্গিকতার নিখুঁত মেলবন্ধন। নয়ডার সেই রোববারের ভিডিওগুলো রেখে দিয়েছেন ফৌজিয়া, গরিমারা। পরিকল্পনা আছে বিভিন্ন সাহিত্য উৎসবে পাঠানো। ছোটদের ভেতর হারিয়ে যাওয়া উর্দু, হিন্দি দস্তানগোদের ফিরিয়ে আনতে হবে না? বিদেশি চোখধাঁধানো পৃথিবীনির্মাণ তাঁরা থামাতে পারবেন না। সঙ্গে ভাষাগত দেশজ রূপকথাজন্মও চলুক। দস্তানগোদের বয়স বাড়বে? বাড়ুক। দস্তান যেন কমে না আসে…