Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

তিনটি অণুগল্প

বৈদূর্য্য সরকার

 

প্রতিশোধ

ডিসেম্বরের চোদ্দ তারিখ। এ বছর ঠান্ডা পড়েনি, শুধু সকালটায় কুয়াশা থাকে। দেখতে ভালো লাগে সুমনের, যদিও দেখার মতো কোনও ব্যাপার নয়। বউ বলে, অদ্ভুত মিনমিনে মানুষ। আমরা পেছনে লাগার জন্য বলি, দু বছরের দাম্পত্যে কেউ এত ঠান্ডা হয়ে যায় নাকি! কেউ বলে, আহারে বউটার কী কষ্ট… ইত্যাদি। ও অবশ্য বিশেষ কানে তোলে বলে মনে হয় না। বলে, তর্ক করার শক্তি কমে গেছে… সবেতেই আলস্য। অফিসের কাজেও উৎসাহ পায় না। তাতে অবশ্য কোনও অসুবিধে নেই। ও কাজ করে সরকারি স্টোরে, তাও গণ্ডগ্রামে। ফাঁকি দেওয়ার আলাদা করে উপায় খুঁজে বের করার দরকার নেই, কারণ কাজ এতই কম। বছর দশেক তৈরি হওয়া ফুড ডিপার্টমেন্টের এই স্টোরের পেছনে দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার বিস্তীর্ণ জলাজমি। আর পাঁচটা ঝোপঝাড় খালবিল যেমন হয় আর কী। কিছু চাষের জমিও আছে। তবে বাড়িঘর কিছুটা তফাতে। গ্রামটার নাম আনন্দপুর। সুমন যায় গড়িয়া থেকে দুবার অটো পালটে।

নতুন ক্যামেরা কেনার পর থেকেই ও বেশ অনেকরকমের পাখির ছবি তুলেছিল। চেনাজানার সাথে অচেনা কিছু পাখিরও। এসব আমরা কেউ যে বুঝি তাও নয়, লাইক কমেন্ট করি এই পর্যন্ত। নামগুলো গুগুল খুঁজে বের করত, লোকাল নামটাও। ও বলত— পানকৌড়ি, শামুকখোল, জলময়ূর, মাছরাঙা, কোঁচ বক প্রচুর পাওয়া যায় এই জলাজমিতে। পাখিদের ব্যাপার না বুঝলেও শুনতে খারাপ লাগত না। রোজ ও একা একা হাঁটতে যায় ঝিলের ধারে। হেঁটে মিনিট কুড়ি। জলের ধারে দুপুরে মাচায় বসে থাকে। শুনে হিংসেও করত অনেকে। ইঁদুর জলঢোঁড়ার ছবি তুলত আর ক্যাপশন দিত— ‘প্রতিবেশী’। এমনভাবেই একদিন হঠাৎ ও খোঁজ পেল একটা গোসাপের আস্তানার। এমন করে বলল যেন কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের মতো খবর। বলল, ও কচুরিপানার ঝোপের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় উঁকি দিলে গোসাপটা নাকি জিভ বের করে, লেজ নাড়ায় বা চোখ খুলে বন্ধ করে সাড়া দেয়। যেন পোষা। অনেকগুলো ছবি তুলে ফেসবুকে দিয়েছিল প্রায় মাসখানেক আগে। কে যেন কমেন্ট করেছিল, এতদিনে তুই বন্ধু খুঁজে পেলি! তবে কিছু যে একটা হচ্ছে সবাই বুঝতে পারছিল। বরাবর দাপুটে সুমন কেমন যেন ক্রমশ মিইয়ে যাচ্ছিল।

সুমন নিজেই বুঝতে পারে না কী যে হল। ওর বক্তব্য— একটু করে সবুজ চারপাশটা ওকে যেন বশ করে ফেলছে। মনে হয় এতদিন ধরে মানুষ প্রকৃতির ওপর যে অত্যাচার চালিয়েছে তারই রিটার্ন পাওয়ার সময়। ওর পোস্ট করা একটা ভিডিও দেখলাম— একটা গাছকে ওপড়ানোর সময় ডালপালা দিয়ে গাছটা যেন বুলডোজারের চালককে ক্রমাগত আঘাত করে চলেছে। বানানো ভিডিও হোক যাই হোক এটাই নাকি সত্যি, আমাকে সুমন বলেছিল। আমি শুনে বলেছিলাম, এটা কি অতি সরলীকরণ নয়? আমার মনে হচ্ছিল যেন আরও বেশি করে ও নিজেকে ছেড়ে দিচ্ছে পরিস্থিতির হাতে। শুনলাম আমিষ খাওয়াদাওয়া ছেড়ে দিয়েছে, সিগারেটও। ওর আজকাল আলাদা করে ঘাম হয় না, বেশ স্যাঁতস্যাঁতে ঠান্ডা হয়ে থাকে চামড়া। ওয়ার্নিং খেলেও অফিসে আসাটা শুধু বজায় রেখেছিল। কিন্তু আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব পাড়া প্রতিবেশী সবাইকে এড়িয়ে চলতে শুরু করল। ফেসবুকে অন পেয়ে কিছু কথাবার্তার পর চেনা এক সাইকোলজিস্টের নাম্বার ওকে দিতে চেয়েছিলাম কিন্তু তখনই অফ হয়ে গেল।

*

বেশ ক’দিন পর ওর পোস্ট দেখলাম, সেই গোসাপটার মৃতদেহের ছবি। যতই ফাঁকা জায়গা হোক, মানুষ তো আছে। সুমন একা কী করে পারবে ওটাকে বাঁচাতে।

তবে পরের খবরটার জন্য কেউই বোধহয় তৈরি ছিল না। রোববারের ভোরে ওখানেই সুমনকে পাওয়া যায়, জলে ভাসতে। তার আগের রাতে ও বাড়ি ফেরেনি। শুনেছিলাম কিছুদিন ধরেই বউয়ের সাথে ঝগড়াঝাঁটি চলত, জানতে পারিনি ওদের মধ্যে তৃতীয় কে ছিল।

কাটা ঘুড়ি

আজ বিশ্বকর্মা পুজো। আমার যথারীতি ছুটি। ছুটির দিন মানে বাজার দোকান, হ্যানো ত্যানো, বউয়ের গঞ্জনা, বাপ মায়ের দীর্ঘশ্বাস… মধ্য ত্রিশে যেমন হয়। বেশিদিন বিয়ে হয়নি, তবে এই ক’দিনে যেটা হয়েছে— বিশ বছরের নারীঘটিত কাঁটাওঠা মিলিয়ে গেছে। বদলে, একা বসে বসে পুরনো দিনের কথা ভাবা এবং বাবার কায়দায় দীর্ঘশ্বাস ফেলা। গত বিশ বছর দেখছি বিশ্বকর্মা পুজোর দিন আমার বাবার দীর্ঘশ্বাস ছাড়ার প্রবণতা বেশ খানিকটা বেড়ে যায়। মা মনে করিয়ে দেয়, বাবার কারখানার কথা— যেটা দুহাজার সালের বিশ্বায়নে অন্যান্য সব দিশি জিনিসের মতো উঠে গেছে।

মনে পড়ল, আজ আকাশের দিকে তাকানোর সময় পাইনি। তবু একবার হলেও তো ‘ভোকাট্টা’ শুনতে পাওয়ার কথা ছিল। জানলা দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে একটাও ঘুড়ি দেখতে পেলাম না, খানিকটা অবাক হয়ে বারান্দায় বেরিয়ে সেই একই অবস্থা। আকাশ বেবাক ফাঁকা। দেখে এই ধেড়ে বয়সেও কেমন যেন একটা মনখারাপ ভর করল। যদিও বিশ্বকর্মা পুজোর ঘুড়ি ওড়ানোতে আমার বিশেষ হাতযশ ছিল না। স্কুলের উঁচু ক্লাস থেকে আমি ক্ষান্ত দিয়েছিলাম ওই লাইনে। কিছু চিলেকোঠা তখনও টিকে ছিল, সেসব নিয়ে অবশ্য আমার ফ্যান্টাসি অব্যাহত ছিল। সেটা ঠিক শৈশব সম্পর্কিত নয়। কারণ ততদিনে বালকসুলভ অনেক ব্যাপার কাটাতে পেরেছি ভেবে খানিক শ্লাঘাও হয়তো তৈরি হয়েছিল।

পুরনো বাড়িঘর একধারসে ভেঙে আমাদের এখানে অসংখ্য ফ্ল্যাট উঠে গেছে। ফলে এলাকার চরিত্র বদলে গেছে, পুরনো লোকজন পথঘাট কিছুই অবশিষ্ট নেই…

আশ্চর্যের কথা হল এসব আমরা আলোচনা করছি— একটা নির্মীয়মান ফ্ল্যাটের বৈঠকখানায় বসে। মানে সোজা কথায় প্রোমোটারের আশ্রয়ে বসে।

এই জায়গাটা জোগাড় করেছে রাজাদা। আজকাল রকের কমতি, বৃষ্টিবাদলায় আড্ডার জন্য মাথাঢাকা আস্তানা পাওয়া বড় কথা! এটা একটা পুরনো বাড়ির বাইরের ঘর— পবন নামের ওই প্রোমোটার অফিস হিসেবে ব্যবহার করে। চেয়ার টেবিল কম্পিউটার সাউন্ডবক্স থাকলেও লোকজন বিশেষ থাকে না। একটা চাবি থাকে রাজাদার কাছে। সে নিরিবিলি এই ঘরটা ব্যবহার করে। আলো পাখা আছে, ফলে মোটামুটি আরামদায়ক। তবে খুব লো  ভল্যুয়মে কী একটা মন্ত্রোচ্চারণ হতে থাকে। লক্ষ করে দেখেছি একটা ছোট যন্ত্র প্লাগ পয়েন্টে সর্বক্ষণ লাগানো থাকে। আমি এটা জানি, প্রচুর টাকা সহজ পথে করা যায় না… আর অনেক টাকা হওয়ার পরে লোকজনকে  তন্ত্রমন্ত্রের ওপর বিশ্বাসী হতে হয়।

সেসব নিয়ে কথা হচ্ছিল, এসব জিনিস মানুষ যবে থেকে গোষ্ঠীবদ্ধ হয়েছে। আমি হেসে বললাম, তার মানে বলছ… ভূত প্রেত দেবতা মন্ত্রোচ্চারণ মারামারি ভোট সবই গোষ্ঠীর ব্যাপার। সবই তো মায়া… আর মায়া জিনিসটা একা থাকলে জন্মায় না। সুতরাং দুর্গাপুজোর ভোগ থেকে ভূতের ভয়, বিশ্বকর্মার ঘুড়ি থেকে চিলেকোঠার রোম্যান্স পুরোটাই গুষ্টিসুখের সাথে যুক্ত।

আজ এই ঘরটায় লাইটটা জ্বলছে না। রাজাদার মতে, মুখ দেখতে না পাওয়া গেলে কথা বলার অসুবিধে। দরজাটা খোলা ছিল, হঠাৎ সশব্দে দরজা ধাক্কা দিয়ে একজন ঘরে ঢুকে পড়ল। কোনও দিকে না তাকিয়ে হড়বড় করে পাশের সিঁড়ি দিয়ে উঠতে শুরু করল। রাজাদা  ঘাবড়ে বলে উঠল, আপনি কে? কোথায় যাচ্ছেন! লোকটা কড়া গলায় বলল, আমি কে জিজ্ঞেস করছ… নতুন কেয়ারটেকার নাকি! খেয়াল করলাম লোকটার পরনে হাফ প্যান্ট গেঞ্জি আর কপালে কমলা সিঁদুরের টিপ। হাঁটার ভঙ্গি দেখে আর যাই হোক অসুস্থ বলে মনে হচ্ছে না। তবু ট্রেসপাসার যখন, অগত্যা ওকে ফলো করে দোতলায় পৌঁছলাম। পুরনো কিছুর কোনও চিহ্ন নেই। কাল্পনিক কিছুর দিকে তাকিয়ে বিলাপের ভঙ্গিতে লোকটা বলতে লাগল, এই সব ঘর আমার ছিল। তারপর কী যেন মনে করে লোকটা সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগল ছাদের উদ্দেশ্যে।

আড্ডার দফারফা। ছাদ থেকে হাঁকডাক শোনা যাচ্ছে। কাকে যেন বকাবকি করছে। আমরা ওখানে গিয়ে দেখতে পেলাম— ন্যাড়া ছাদে একটা ছেলে টাঙ্কি মেরে মুখপোড়া ঘুড়ি ওড়াতে চেষ্টা করছে। লোকটা বলল, নিয়তিদি কোথায়! দেখা করেই চলে যাব।

এই ভরদুপুরে আমার শীত করছে। আশপাশের ছাদ থেকে অসংখ্য ঘুড়ি উড়তে লেগেছে। কোথা থেকে ভেসে আসা ‘ভোঁ মারা’ চিৎকারে চেতনা হারাতে শুরু করলাম। তার মধ্যেই দেখলাম কাটা ঘুড়ির মতো লাট খাচ্ছে ছেলেটার পাতলা শরীর।

*

বেমক্কা অচেতন হয়ে পড়া আমার অভিজ্ঞতার বাইরে। চোখ মেলে বুঝলাম তত্ত্বজ্ঞানী রাজাদার ওপর দিয়ে পুরো ঝড় বয়ে গেছে। এতবড় লাশ টেনে সরিয়ে ছাওয়ায় নিয়ে এসে চোখে মুখে জল দিয়ে উঠিয়ে বসানো তো কম ঝক্কি নয়। ইতিমধ্যে ফোন করে পবনকে ডেকে এনেছে। সে ট্যারাবাঁকা বাংলায় যা বলল, ছেলে ন্যাড়া ছাদ থেকে ঘুড়ি ওড়ানোর সময় পড়ে মারা গেছিল… বিশ্বকর্মা পুজোর দিন ও পাড়ার সব ছাদে ছেলেকে খোঁজে।

কিন্তু এই ঘটনার সাথে আমার জ্ঞান হারানোর সম্পর্কটা ওরা ঠিক ধরতে পারছে না। আমি বলতে পারলাম না, ঘটনাটার সাক্ষী আমি… হয়তো আলুথালু ফুলিদিকে ছেড়ে ওর ভাইকে নজর করলে বা সেইমুহূর্তে লোকজনকে জাগিয়ে হাসপাতালে যেতে পারলে ছেলেটা বেঁচে যেত।

আগুনের আঁচে জীবন

ক্লাস সেভেনে কোচিং-এর প্রিয়াঙ্কার হাতে সাধারণ পার্কার পেন দেখে হাঁ করে থাকত ছোটন। প্রিয়াঙ্কার কিশোরী আঙুল নাকি আলতো ছুঁয়ে থাকা পেনটা, কোনটা বেশি আকর্ষণীয় ছিল? বুঝতে পারত না ও। ক্লাস নাইনে সরস্বতী পুজোয় প্রিয়াঙ্কার আঙুল ছুঁয়েছিল। কলেজে ঢুকে কীভাবে যেন খুঁজে পেল প্রিয়াঙ্কাকে অন্য ডিপার্টমেন্টে। ততদিনে অবশ্য প্রিয়াঙ্কা ফুলে ফলে ভরে উঠে ক্রমশ যৌবনের পথে। ছোটন বুঝতে পারছিল সেই কিশোরীর শরীর থেকে বেরিয়ে আসছে এক মানবী। যার আঁটোসাঁটো টিশার্টে লেগে আছে পলাশের রঙ তার ব্লু জিন্সে বইছে খরস্রোতা। সব মিলিয়ে মার্চের এক বিকেলে মাথায় কালসর্পের দংশন অনুভব করেছিল ছোটন।

ছোটনের কপালে লেখা ছিল কালসর্প যোগ। লাল রং ওকে এড়িয়ে চলতে বলেছিল সেই গোল্ড মেডেলিস্ট জ্যোতিষী। কী সব গ্রহের ফের ছিল ওর কুষ্ঠীতে। পুরোটা না বুঝলেও এটুকু বোঝার মতো বয়স হয়েছিল যে ওর কপাল বিশেষ সুবিধার নয়।

সেই প্রথম দোলে প্রাপ্তবয়স্ক মেয়ের গালে রং লাগানো, গলায়-ঘাড়ে। খুব যে চিন্তাভাবনা করে তা নয়। তবু বিশেষ সময়ে মানুষ না ভেবে অজান্তেই সব কিছু করে ফেলে। প্রথমে রাগ পরে বিরক্তি শেষে কেঁদে ফেলার মতো, প্রিয়াঙ্কাময় বসন্ত উৎসব। সেই রঙের সূত্র ধরে ক্রমশ গাল ছোঁয়া তারপর ঠোঁট… খুব সহজ অঙ্ক। বসন্তে সেবার কলেজের গাছটায় অনেক ফুল, আগুনরঙা। উজ্জ্বল প্রিয়াঙ্কাকে ছুঁয়ে যেন হাত পুড়ে যেত, এত তেজ। আগুন রঙের কুর্তা, গলায় হাতে রুদ্রাক্ষের মালার মতো গয়না… কখনও টকটকে লাল সালোয়ার।

*

যেখানে লোকে একবেলা চেন্নাই অন্যবেলা চিকাগো করে, প্রযুক্তির উন্নতিতে সব মানুষ-কথাবার্তা-টাইমজোন জড়াজড়ি করে থাকে, সে জায়গায় নিজেকে ৫০-এর বাংলা সিনেমার হিরোর মতো মনে হয় ছোটনের। ইদানীং যেন দারিদ্র আর নেই কারুর, ওদের মতো কয়েকজন ছাড়া। আটটার লোকাল ধরে কারখানায় ঢোকার ঐতিহ্য কতদিন আগেই সবাই ভুলে গেছে। পৃথিবী অটোমেশনের দিকে এগিয়ে গেছে শুধু সেই কারণে নয়, গত ত্রিশ চল্লিশ বছরে সব কলকারখানা বন্ধ হয়েছে বলে।

একরকম জীবন কাটাতে কাটাতে ছোটন বুঝতে পারছিল আস্তে আস্তে ও হয়ে যাচ্ছে অনুভুতিশূন্য আবেগহীন একটা ঘটনা মাত্র। যেখানে নেই ক্লাইম্যাক্স কিংবা উত্থানপতন, সব কাজ কর্তব্যমাফিক করে যাওয়া… অতিরিক্ত কাজ করে পুরস্কারের আশায় ছোটন বুঝতে পারছিল একটা বস্তাপচা সিস্টেমের অপরিহার্য নাটবল্টু হয়ে উঠেছে ও। যারা সারাজীবন এক জায়গাতেই থেকে যায়।

মালিক সাহুজিকে ও একবার বলেছিল, এই রাজ্যে কোর ইন্ডাস্ট্রি কেন যে শুরু করলেন স্যর। উনি করুণ চোখে তাকিয়েছিলেন। সত্যিই নাকি আমার কল্পনা? মালিকের চোখ কি করুণ হয়! এটাই আশ্চর্য লাগে, রাজস্থানি হয়েও নিজেকে উনি বাংলার লোক ভাবেন। জন্ম-কম্ম অনেকেরই হয়, কিন্ত ক’জন ভাবে এমন! সাহুজির কাছাকাছি থাকতে থাকতে ও আরও ভাল বুঝতে পারে, ফ্যাক্টরির লাইফটাইম ফুরিয়ে আসছে। ওদের সবারও।

তবু প্রজেক্ট-লিড হিসেবে শেষবারের জন্য একটা পাইলট প্রজেক্ট রান করতে চেয়েছিল ছোটন একটা আলাদা টিম তৈরি করে। ওদের আশ্বাস দিয়ে দিয়েছিল প্রজেক্ট ওয়ার্ক করলে ইনক্রিমেন্ট হবেই। আর না হলে যেটা হবে, লজ্জায় ওকেই প্রথম রিজাইন করতে হবে। কেননা আমাদের অফিসে একটা যন্তরমন্তর ঘর আছে যেখানে সপ্তাহান্তে মগজধোলাই করে হেড এইচআর। সাথে থাকে ঢলঢলে সহকারী মিসেস রায়। আমি যার দিকে মাঝেমাঝেই আগুনে চোখে তাকাই। সবসময় যে অপরাধের জন্য তা নয়, মাঝেমাঝে শক্তি পরীক্ষার জন্যও বটে।

ছোটন বলত— এইচআরের লোকগুলো আসলে খরচ বাড়ায়, কোনও কাজ না করে। কারণ হাজার অসুবিধা সত্ত্বেও প্রডাকশনের জন্য ওরা মরণপণ করেছে। তবুও শেষ তিনমাস ধরে কোম্পানি ব্রেক ইভেন থেকে বেশ দূরে রয়ে গেছে। বেশিরভাগ সিনিয়ার ছেড়ে গেছে, অনিয়মিত মাইনের ফলে লেবারদেরও অবস্থা খারাপ।

*

অবশেষে সেই দিনটা এগিয়ে এল, তার আগের রাত সবাই জাগা। অবশ্য প্রজেক্ট রান করার পরে সবাই মনে করল তেমন দুশ্চিন্তার কারণ ছিল না বোধহয়। মোটামুটি সফল হল প্রজেক্ট, মানে কোম্পানি কয়েক বছরের জন্য টিকে গেল। সাহুজি খুশি একরকম। তবু মিসেস রায়কে অফিস ছাড়তে হল, উনি ছোটনের সাথে জীবনের বাজিতে হেরেছেন ও সেদিন রাতে বিনা প্রতিবাদে রাত কাটাতে বাধ্য হয়েছেন জয়ী ছোটনের সাথে।

বেহিসেবি মদের স্মৃতিবিভ্রমে লাল ডিমলাইটে ছোটন খুঁজে পেয়েছিল জ্বলন্ত এক নারীকে এবং অসফল একটা রাত। সেদিন অফিসের কোয়ার্টারে ও প্রিয়াঙ্কাকে আবিষ্কার করেছিল নতুন করে। তাই ওকে মিসেস রায়ের খোলসটা ফেলে চলে যেতে হল।