তিনটি অণুগল্প

বৈদূর্য্য সরকার

 

গড্ডলিকা

পাড়ার নাম জিকো। ফুটবলের সঙ্গে সম্পর্ক জানা নেই। তবে মোহনবাগান ছিল, বনেদি বংশ। বলেছিল, সাবর্ণ রায়চৌধুরিদের লতায় পাতায়…। তবে এখন খেতে পাই না, বলত। চেহারায় বেশ জেল্লা। লম্বা ফরসা দোহারা চেহারা পরিস্কার ছাঁটা গোঁফ। থাকত বেশ বড় জায়গা নিয়ে। বাড়িটা বেশি বড় না হলেও বেশ কিছুটা জমি। আম নারকেল ছাড়া আগাছাই বেশি। দেবোত্তর সম্পত্তি বলে প্রোমোটারের থাবা এড়িয়ে টিঁকে আছে। মাথার ওপর অবিবাহিত দাদা দিদি রেলের চাকুরে।

জিকোদার স্ত্রীর সঙ্গে ডিফারেন্স থাকলেও অসুখ ছিল না। বেশি বয়সের ছেলে দিব্যি তড়তড় করে বাড়ছিল। জিকোদার অ্যাজমা থাকলেও পাড়ার দোকান থেকে ধারে সিগারেট খেতে দেখেছি অনেকদিন। খেয়াল আছে তখন ফিল্টার উইলসের প্যাকেট তেইশ। দোকানি পিন্টুদার সঙ্গে বেশ দোস্তি, কিছু কিনতে গিয়ে আধ ঘণ্টা আড্ডা। জিকোদা ল্যান্ডফোন থেকে পয়সা দিয়ে ফোন করে। তবে প্রশ্নটা হচ্ছে কাকে? ধারবাকি সংক্রান্ত কোনও ব্যাপারে পিন্টুদা বিরক্ত হয়ে গজগজ করছিল, ঘরে বউ বাচ্চা… এদিকে আবার! শুনে চমকানোর কী আছে? বয়স হয়েছে বলে কি শখ আহ্লাদ থাকতে নেই! তখনও বোধহয় জিকোদা বাটার দোকানে কাজ করে।

এ ঘটনা অবশ্য অনেক দিন থেকেই চলছে। সেই মহীয়সী নারীকে এর বাড়ির লোক মেনে নেয়নি বা কী ব্যাপার… তা অবশ্য জানা হয়ে ওঠেনি। তবে পিন্টুদা এটা বলেছিল, সবাই মিলে ধরেবেঁধে বিয়ে দিয়েছিল। যাইহোক অনেকে কল্পনা করত, যাতায়াত আছে এখনও। ছুটির দিনে ইনি ছেলেকে নিয়ে দ্রষ্টব্য স্থান দেখাতে গেলে তিনিও সঙ্গী হন।

তারপর যা হয়, সময় নিজের খেয়ালে। আমরাও পড়াশোনার পাট চুকিয়ে চাকরিবাকরি বিয়েথা। গলির মুখে ওদের দরজা হওয়াতে প্রায়ই দেখা হয়। কথা সবসময় না হলেও হালকা হাসি, ঘাড় নাড়া।

বন্ধুরা নিজেদের মধ্যে তখন বলাবলি করতাম— আগের জেনারেশানের মতো ব্যর্থ জীবন হওয়াটাই সবথেকে বড় অভিশাপ। জিকোদার গল্প সে দিক থেকে একটু হলেও টুইস্ট। এখন মনে হচ্ছে আমরাও বাবাদের গল্পেই ঢুকতে চলেছি। মধ্যত্রিশে পৌঁছে বুঝছি, আমাদের ক্ষেত্রে অশান্তির নতুন উপসর্গ যোগ হচ্ছে। বাবাদের যৌবনে ঘরে ভিন্নমত দেওয়ার নারীমুক্তি খানিক কম ছিল। করোনা আবহে ক মাস ঘরে আটকে পড়ে আরও বেশি করে এসব কথা মাথায় আসছে।

বন্ধুরা কর্পোরেট ফান্ড জোগাড় করে গরীবদের র‍্যাশন দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিল। আমাদের পাড়া থেকে মাংসভাতের ব্যবস্থা হলে, খুব গুরুত্বপূর্ণ মুখভঙ্গিসহ জিকোদা ফরসা পাঞ্জাবি পরে এসে তদারক করছিল। বেশ মানিয়েছিল।

তার পরে একদিন শানওলার কাছে বাড়ির ছুরি কাঁচি নিয়ে ধার দিতে গেছি। জিকোদাও এসেছে রাজ্যের বঁটি কাটারি নিয়ে। পাশ দিয়ে একটা লোক কী যেন বলে গেল। জিকোদার মুখে একটা ঘোর অবজ্ঞার ভাব। নীচু গলায় আমাকে অবাক করে বলল— টাকা হয়েছে বলে জেলেপাড়া থেকে এখানে ফ্ল্যাট কিনে এসেছে, সব নষ্ট হয়ে গেল!

এর কদিন পর নষ্ট হওয়ার নিদর্শন চাক্ষুষ করলাম। ফ্ল্যাটের একতলায় থাকা এক পরিবারের অশান্তি ঝগড়া কদিন ধরে শুনছিলাম। সুবীর বলে লোকটার চাকরি গেছে। শেষপর্যন্ত যেটা ঘটল, অনভিপ্রেত— ভরদুপুরে কোথা থেকে নেশা করে এস গলায় দড়ি দিল সুবীর। হসপিটালে নিয়ে যাওয়ার সময় আমরা ভিড় করেছিলাম,  হাহুতাশের মধ্যে নীচু গলায় গুহ্য কথা জানাল জিকোদা, জুয়াই ছেলেটাকে শেষ করে দিল। আমি চমকে তাকালাম গল্পের নতুন মোচড়ে। জিকোদা স্বচক্ষে দেখেছে, ট্যাক্সি থেকে নেমে টলতে টলতে পানওলার থেকে ধার করে ওকে ভাড়া মেটাতে।

এর মাসখানেক পরে জিকোদাও ট্যাক্সি ধরল হঠাৎ। আগের দিন বিকেলে নার্সিংহোমে দিয়েছিল। ফ্ল্যাটের তিনতলার কাকু গোপন খবর দিয়ে বলল, নিশ্চিত করোনা… কদিন ওদের বাইরের ঘরের জানলা বন্ধ, দেখোনি! বুকের জোর ছিল না… ধরেছে। শুনে অবাক হলাম না।

 

সম্মানিত অতিথি

–হিরো গোটাটা জুড়ে অপমানিত হতে থাকে। যুদ্ধের পরের কাহিনি লেখা হয় না। আগ্রহ থাকে না তাতে। ‘…এরপর সুখে স্বচ্ছন্দে’ থামানো হয় গপ্পো।
–মানুষের মন সংগ্রামের ব্যাপারে দুর্বলতা কাটাতে পারেনি?
–যদ্দিন মানুষের ভাবনা, সেদিন থেকেই লড়াই…

কথা থামাতে হল। ফোনটা পিংপিং করছে। নেট অন থাকলে এই সমস্যা। অবান্তর জিনিসপত্র আসতে থাকে। বউ বলে, কে যে এত ডাকে তোমায়! বলি, ডাকাডাকি নামে একটা বই ছিল।

প্রতিদিন সকালে উঠে মনে হয়, জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ফেজগুলো বৃথা কাটিয়েছে। কৈশোরে ক্রিকেট খেলার নেশা ঘুচল বিকেলের টিউশানির জন্য। কলেজের দিনগুলো শুকিয়ে গেল পলিটিক্সের চক্করে। দলটাও উঠে গেল, শ্রীমতী আগেই ভেগেছিল। রেজাল্ট লবডঙ্কা, লেখালিখিরা ফুরিয়ে গেল চাকরির চেষ্টা করে। চাকরি পাওয়ার পর বিয়ে, স্বাধীনতাটাও গেল। শেষপর্যন্ত যা অবস্থা হয়েছে, সে আর বলার মতো নয়। জীবনে আর কিচ্ছু হওয়ার নেই ওর।

শনি রবিবার বউয়ের সঙ্গে বসে দেখা গানের অনুষ্ঠানে চা বাগানের একটা ছেলের মুখে ‘ডর’ সিনেমার ‘তু হ্যায় মেরি কিরণ’ গানটা শুনে বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠেছিল। ওর কি শ্রীমতীর জন্য এরম কিছু করার কথা ছিল? সিনেমাটার মতোই ওর বিয়ে হয়েছে একটা দামড়া লোকের সঙ্গে।

বউ বলে উঠল, সব টাকার খেলা… যে যত টাকা দেবে তাকে ততদূর নিয়ে যাবে!

শুনলেও বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে না ওর। তাহলে তো কিশোরের টাইটেল হত আম্বানি কিংবা সচিনের বিড়লা। কোথাও ভালো কোনও কাজ হচ্ছে না ভাবলেই এক আকাশ মনখারাপে ঢেকে যায় দুনিয়া।

ফেসবুকে আলাপ হওয়া প্রত্যন্ত অঞ্চলের ছেলে মাহাতো প্রাইভেট টিউশানি করে চালায়। প্রচুর লেখে, আঞ্চলিক গানে সুর দেয়। লোকে সুখ্যাতি করে, পুরস্কার দেয়, মান্যিগন্যি করে। বরং রিট্যায়ারড অফিসারদের পদ্যবাসনা নিয়ে সবাই হাসাহাসি করে। ওর মনে হয়, এটাই তো জীবন! টাকা না থাকলেই কি সব ফুরিয়ে যায়?

যদিও চারদিকের কথাবার্তাগুলোকে উপেক্ষা করা যায় না। কেন ওঁর মতো দায়িত্ববান নও, কর্মঠ নও, ছাইভস্ম লিখে সময় নষ্ট না করে উপরি রোজগার করতে তো পারো! ভালো পদ্য লিখলে পকেটের টাকায় বই ছাপিয়ে বিলি করতে হয়, আর গপ্পো মানিকবাবুর মতো যখন পারছ না। ইএমআই-তে সবাই গাড়ি বাড়ি কিনছে… তাও পারলে না!

সব জায়গায় একইরকম কথাবার্তা। শুনে মাথা ধরে যায়। রোববার সকালে বেরোয়। সৌরভ পাখির ছবি তুলতে যায় লেন্স বাগিয়ে, ও দেখতে যায়।

সায়েন্স সিটি থেকে ভ্যান ধরে হাইওয়ের পাশে একটা জায়গায় নেমে কিছুটা হাঁটা। ভেড়ি, চষা জমি, চারপাশ ফাঁকা। এসব জলা জায়গায় নানারকম পাখির দেখা মেলে। সৌরভ লেন্স তাক করে ছুটোছুটি করে। ও পুকুরের ধারে বাঁশের মাচায় বসে আকাশের দিকে চেয়ে সিগারেট খায়। নীচেই একটা ছোট গর্ত। বেখেয়ালে সিগারেটের শেষটা ছুড়তেই ওটার মধ্যে ঢুকে গেল। ওরা দেখল, গর্তটার মধ্যে থেকে গলগল করে ধোঁয়া বেরোচ্ছে। সৌরভও সেখানে এসে গেছে।

চোখের সামনে যেটা ঘটল… একটা হিলহিলে সাপ গর্তটা থেকে বেরিয়ে ক্রমশ লম্বা হতে হতে ওদের মুখোমুখি। দিব্যি ওদের ভাষাতেই বলে উঠল, জীবনের রূপকথা কোনওদিন ফুরোবে না… মাথার মণিও আশা হারাবে না।

ঘোরলাগা অবস্থায় দেখল দিগন্তের আলো নিভে গেছে। মণিটা জ্বলজ্বল করছে অলীক বিশ্বাসে। ঘোর কাটার পর রাস্তা চিনে ফিরতে দেরি হয়ে গেল ওদের।

রাতের অনুষ্ঠান থেকে পাহাড়ি ছেলেটা বাদ গেল। অন্যরা রীতিমতো তালিম নিয়ে এসেছে, ও এসেছিল বুকের ভেতর ভরে রাখা সুর নিয়ে।

জোরালো কণ্ঠ বেজে উঠল, আবার ফিরে আসবে… সেদিন সবাই হেরে যাবে।

বিশ্বাসগুলো ধরে রাখতে না পারলে মানুষ বাঁচবে কী করে!

 

ভুল

গৃহকর্তা সাহস রায় পিসিমার ভয়ে ঘাবড়ে থাকেন আর সবকিছু গুলিয়ে ফেলেন। বিনের সঙ্গে বরবটির যে কী তফাৎ আজও বুঝতে পারলেন না। উচ্ছে করলাও তো একইরকম। বেগুনের মধ্যে যে পোকা আছে, সেটা যে কী করে মানুষ বাইরে থেকে বোঝে, কে জানে!

আজকে যেমন সস্তায় পেয়েছেন ভেবে পেঁয়াজের বদলে টোপাকুল কিনে এনেছেন। পিসিমা ফতোয়া দিয়েছে সরস্বতী পুজোর আগে কুল খাওয়া যাবে না। গায়ে জ্বালা ধরিয়ে বউ শুনিয়েছে— অসময়ে কুল খেয়েই তোমার যত ভুল।

পিসিমার সঙ্গে সর্বদা বউ সানাইয়ের পোঁ ধরে। কেউ কোনও সাশ্রয় করে না, কিন্তু সেকথা বলবার উপায় নেই সাহসবাবুর। অফিসে নারীদিবসের বক্তৃতায় শুনেছেন— গৃহশ্রমে মজুরি হয় না বলে…। তবে উনি খেয়াল করে দেখেছেন, সব বাড়ির নারীই শায়েস্তা হয় কাজের লোক কামাই করলে।

বাজার করা তার কাছে ছোটবেলা থেকেই বড় ঝক্কির কাজ। ফর্দ দেখে সস্তা খুঁজে বাজার দোকান করো, গলদঘর্ম হয়ে বয়ে নিয়ে এসো তারপর হাজার গঞ্জনাও সহ্য করো। যথেষ্ট সস্তায় জিনিস কিনতে পারে না বলে বাবা তাকে বাজার না যেতে দিয়ে নিজে খুঁজে যতরাজ্যের হাবিজাবি কিনে এনে লোককে কৃতিত্বের গল্প শোনাত। বাজারওলারা সম্পর্কে যেন সাহসবাবুর মামা।

বাহান্ন বছরের সাহসকে সুযোগ পেলেই এখনও বুড়ি পিসিমা অবহেলার হাসি হেসে বাচ্চা ছেলের মতো উপদেশ দিতে শুরু করেন। সম্পত্তিগুলো হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে বলে ঘ্যানঘ্যান। একটা কথা ওঁর মনে থাকে না, ঠাকুরদার আমলের যাবতীয় কাগজপত্র কোন এক সিন্দুকে লুকিয়ে তিনি মারা গেছিলেন।

বিয়ের পর থেকে গত বাইশ বছর ধরে সবেতেই ভয় পান সাহসবাবু। বসের ভয়, মাস শেষের ভয়, মুরগির ফ্লু হলে খাসি কেনার ভয়, নেমন্তন্ন এলে ভয়, ইএমআইয়ের ভয়, কোলেস্টেরলের ভয়, পাড়ার দাদাদের ভয়,  চাহিদার ভয়, সম্বৎসর পুজোর সময় দেবীও দশহাতে মহাভয় দেন। তাই আজকাল শরীরটা সবসময়েই যেন দুর্বল ঠেকে।

আজ ভুল হত না বড় একটা, চায়ের দোকানে বসে গল্পগাছা করতে গিয়েই হয়েছে মুশকিল। তারপরে মুদির দোকানে না গিয়ে তিনি সেলুনে গিয়ে আয়েস করে দাড়ি কেটে বাড়ি ফিরেছেন।

এই কারণেই অফিসে লোকে কাজ না করে তাকে নিয়ে ঠাট্টা করে। সবার আগে সব কাজ করে দেয়— সেটা নাকি তার গুণ নয়, বসের ভয়। আর কী করেন সাহসবাবু… ক্ষমা করে দেন। লোকগুলো যে গণ্ডমূর্খ সে ভালোই জানা আছে। কালীপুজোয় লোকের ঘরে রকেট ঢুকিয়ে, চন্দ্রযান কেন ঠিকমতো ল্যান্ড করল না সেই নিয়ে আলোচনা করে। তাকেও যে এরা পুঁছবে না, তাতে আশ্চর্য কী! অবশ্য সুযোগ পেলে তিনিও গালগল্পও যে ঝাড়েন না, তা  নয়। তবে অতি বড় নিন্দুকও তার গল্প বলার আর্টের তারিফ করে থাকেন।

তার ছোটবেলায় শান্তিনিবাসে পিসিমার সঙ্গে ইন্দিরা গান্ধি দেখা করতে এসেছিল কিংবা দাদুর নেতৃত্বে ভারতের সেনা গিয়ে বাংলাদেশটাকে উদ্ধার করেছিল অথবা বাবা কাউকে তেমন বুদ্ধি দিয়েছিলেন বলেই জিও এই অফার এনেছে… এসব শুনে সবাই আমোদ পায় খুব। সাহসবাবুও চা সিঙারা খাইয়ে থাকেন। সবাই বাহবা দিয়ে বলে, জমিদারের বংশ তো বটে।

ফেব্রুয়ারির শেষে অফিসে জোর খবর। অডিট করতে লোক আসছে হেড অফিস থেকে। কয়েকদিন বসের হম্বিতম্বি বন্ধ।

কয়েকদিন ধরে চলা গুজব সত্যি হতে দেখল অফিসের সবাই। বস ব্যাটা জব্বর ফাঁদে পড়েছে। কিন্তু যথেষ্ট প্রমাণ মিলছে না। ফাইল সব লোপাট। অনেকদিন আগেকার দলিল… কারও মনেও নেই।

সবাই যখন আশা ছেড়ে দিয়েছে তখন খেল দেখালেন সাহসবাবু। স্টক খুঁজে হাজির করলেন ভুলে যাওয়া সব ফাইলগুলো।

তারপর থেকে ভুলো লোকটাকে সবাই সাহস হিসেবেই মনে রাখল…

 

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4659 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...