![cnnd-bkaug](https://i0.wp.com/www.4numberplatform.com/wp-content/uploads/2021/08/cnnd-bkaug.jpg?resize=678%2C381&ssl=1)
চার নম্বর নিউজডেস্ক
এক প্রত্নমানুষের গল্প। যথার্থই প্রত্নমানুষ। বছর আটত্রিশের অধ্যাপক ডক্টর বিশ্বজিৎ রায়। উত্তরবঙ্গের আলিপুরদুয়ারের পীযূষকান্তি মুখার্জি মহাবিদ্যালয়ের অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর। ইতিহাসের খোঁজে মাটির নিচে চোখ রেখে চলা বিশ্বজিৎবাবুর চলার পথে এক অলৌকিকতার খোঁজ। আর সেই খোঁজের নাম দেবগ্রাম।
![](https://i1.wp.com/www.4numberplatform.com/wp-content/uploads/2021/08/cnnd-bkaugin@1.jpg?resize=640%2C335&ssl=1)
নদীয়া জেলার দেবগ্রাম কলকাতা থেকে ১৪৫ কিলোমিটার দূরের এক গ্রাম। কুম্ভকর গোত্রের দেবলরাজা এবং পরবর্তীকালে রাঘব রায়ের শাসনাধীন দেবলগড় অঞ্চলের এই দেবগ্রামে আছে প্রাচীন কিছু দুর্গের ধ্বংসাবশেষ। তবে চাষবাস নিয়ে থাকা সাধারণ মানুষের কাছেও তাঁদের গ্রাম নেহাতই এক গ্রাম মাত্র। অবশ্য এই সাধারণ গল্পটাই বদলে দিলেন বিশ্বজিৎবাবু। ২০১২ সালে নদীয়া জেলায় তাঁর গবেষণার প্যালিওচ্যানেল বিশ্লেষণ সংক্রান্ত কাজে দেবগ্রামে প্রথম এসে তিনি একটি অদ্ভুত জিনিস লক্ষ করেছিলেন। গ্রামের অনেকগুলি নদী এবং খাল শুকিয়ে গেছে। বেশ কিছু প্রাচীন নৌকো ভাঙা অবস্থায় পড়ে আছে যত্রতত্র। নদীখাতের এলাকা দেখে পরিষ্কার বোঝা যায় নদী বা খালগুলি শুকিয়ে গেলেও একসময় নদীর অস্তিত্ব ছিল। বিশ্বজিৎবাবুর মাথায় তখনই জিও-আর্কিওলজি চলে আসে। তিনি এলাকায় প্রাচীন নদীর অস্তিত্ব এবং হারানো গতিপথ খুঁজতে শুরু করেন। গ্রামের মানুষের সঙ্গে মেশেন। আর তখনই ক্রমশ বেরোতে থাকে হারানো রত্ন।
![](https://i0.wp.com/www.4numberplatform.com/wp-content/uploads/2021/08/cnnd-bkaugin@2.jpg?resize=640%2C321&ssl=1)
পুকুর বোজানো বা আবাসন নির্মাণকাজে খননের সময় প্রায়শই গ্রামবাসীরা পেয়ে আসছেন বেশ কিছু অদ্ভুত জিনিসপত্র, যা তাঁদের বুদ্ধির বাইরে। পোড়ামাটির জিনিসপত্র, আইভরি পেন্ডেন্ট, রংবেরঙের পাথর, পুরনো জলপাত্র, খাবার রাখার পাত্র, মূর্তি, পুতুল আরও কত কী। বিশ্বজিৎবাবু গ্রামের ইতিহাস চিনতে শুরু করলেন। প্রথমে জোগাড় করলেন কিছু ছাত্রছাত্রীকে। একটি দল তৈরি করে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বন্ধুত্ব করলেন। গ্রামবাসীদের বোঝালেন, এবার থেকে এমন কোনও জিনিসপত্র দেখলেই তৎক্ষণাৎ তাঁরা যেন বিশ্বজিৎবাবু অথবা তাঁর বন্ধুদের খবর দেন। কোনওভাবেই যেন সেসব রত্ন গ্রামের বাইরে না বেরোয়। হেলায় যেন ফেলেও না দেন।
গ্রামের মানুষেরাই একটা সময় জনসচেতনা শিবির গড়ে তুললেন। পার্শ্ববর্তী গ্রামেও খবর পৌঁছে গেল। গ্রামের নিজস্ব ঐশ্বর্য সম্পর্কে চিনতে শিখলেন তাঁরা। ঐতিহাসিক জিনিসপত্র সংরক্ষণ করার প্রয়োজনীয়তাও এসে গেল। আর তখনই বিশ্বজিৎবাবুর পাশে সহায় হলেন চিত্তরঞ্জন বিশ্বাস। ২০১৪ সালে ডাকবিভাগের চাকরি থেকে অবসর নেওয়া স্থানীয় চিত্তরঞ্জনবাবুর সঙ্গে বিশ্বজিৎবাবুর দেখা ২০১৫ সালে। গ্রামের ঐশ্বর্যগুলি সংরক্ষণের জন্য একটি ঘরের দরকার শুনে প্রত্নবিষয়ে আগ্রহী চিত্তরঞ্জনবাবু তাঁর বাড়ির বাইরের দশ ফুট বাই দশ ফুট ঘরটি দিয়ে দিলেন বন্ধু, সহযোদ্ধাকে। ঐতিহ্যপ্রেমী আরেক মানুষ অধীশ হালদার ২৬০০০ টাকা মূল্যের মোট দুটি কাঠের শোকেস উপহার দিলেন ঘরটিতে। এসবেরই পরিণতি দেবগ্রাম জাদুঘর। প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনায় দেবগ্রাম দেবলরাজা পুরাতত্ত্ব ও লোকসংস্কৃতি সংঘ। ২০১৭-র রথযাত্রার দিন জাদুঘরের দ্বারোদঘাটন।
![](https://i1.wp.com/www.4numberplatform.com/wp-content/uploads/2021/08/cnnd-bkaugin@3.jpg?resize=640%2C480&ssl=1)
২০১৭-র শুরুর সময়ের ২০টি জিনিসপত্র বেড়ে বেড়ে আজ সংখ্যাটা দাঁড়িয়েছে ১০০০-এ। কী কী আছে জাদুঘরে? ৩২১ থেকে ১৮৫ খ্রিস্টপূর্বের মৌর্য যুগের জলপাত্র, ৩০ থেকে ৩৭৫ খ্রিস্টাব্দের কুষাণ যুগের মাটির পাত্র, তৃতীয় শতক থেকে ৫৪৩ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি সময়ের গুপ্তযুগের রঙিন কিছু পাথর, অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতকের পাল যুগের কিছু শিলমোহর অথবা ১২০৬ থেকে ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দের সুলতান আমলের রুপোর মুদ্রা। দেবগ্রাম ও আনুলিয়া গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার অরণ্য অঞ্চল সংলগ্ন ৪ বর্গকিলোমিটার ব্যাপী এলাকায় দীর্ঘ পাঁচ বছরে পাওয়া এইসব ইতিহাসের টুকরো। অ্যালুভিয়াম মাটিতে তৈরি জলপাত্রগুলির বাইরে তৈলাক্ত আবরণী। প্রধানত ওয়াইন ও তেল রাখার জন্য ব্যবহৃত এই পাত্রগুলি গঙ্গা ও চূর্ণী নদী ধরে ভূমধ্যসাগরের মাধ্যমে জাহাজপথে প্রাচীন রোম বা গ্রিসে রপ্তানি করা হত বলে মনে করা হচ্ছে। ঐতিহাসিক দেবলগড় অঞ্চলের এই দুই গ্রামে পাওয়া এইসব ঐশ্বর্যগুলি কাছাকাছি সময়ে নদীয়ার সামান্য কিছু এলাকা এবং চন্দ্রকেতুগড় ছাড়া আর কোথাও পাওয়া গেছে বলে মনে করতে পারছেন না বিশ্বজিৎবাবুরা।
![](https://i0.wp.com/www.4numberplatform.com/wp-content/uploads/2021/08/cnnd-bkaugin@4.jpg?resize=472%2C480&ssl=1)
![](https://i1.wp.com/www.4numberplatform.com/wp-content/uploads/2021/08/cnnd-bkaugin@5.jpg?resize=640%2C360&ssl=1)
![](https://i2.wp.com/www.4numberplatform.com/wp-content/uploads/2021/08/cnnd-bkaugin@7.jpg?resize=640%2C349&ssl=1)
যদিও অন্ধকারের দিকটাও কম নয়। ব্যক্তিগত খননকাজ বলে সেভাবে কিছুই করার অনুমতি পাননি বিশ্বজিৎবাবু। গ্রামের মানুষেরাও খননে হাত লাগাচ্ছেন না। নির্মাণকাজে খুঁড়তে গিয়ে বা বৃষ্টির জলে ভেসে এসে জাদুঘরের সম্পদগুলি সংগ্রহ করা গেছে গত পাঁচ বছরে। গ্রামের অনেকেই সচেতন হলেও পাশাপাশি একটা বড়সড় অংশ এখনও শিক্ষিত হতে পারেননি। ফলে বেশ কিছু সম্পদকে বিক্রি হয়ে যেতে দেখছেন বিশ্বজিৎবাবুরা। জাদুঘরে না দিয়ে বিক্রি করলে অর্থ আসবে এমন একটা আশায় সত্যি সত্যই বেশ কিছু মূর্তি, পুতুল বিক্রি করে দিয়েছেন অনেকেই। স্থানীয় গাংনাপুর থানায় শোভা পাচ্ছে ঐতিহাসিকভাবে মূল্যবান একটি বিষ্ণু মূর্তি, যা বিশ্বজিৎবাবুদের ক্রমাগত অনুরোধেও জাদুঘরে আনতে দেওয়া হচ্ছে না। রাজ্য পুরাতত্ত্ব বিভাগ, এশিয়াটিক সোসাইটি, নদীয়া জেলা প্রশাসন এবং আর্কিওলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার কলকাতা শাখাকে দেবগ্রাম দেবলরাজা পুরাতত্ত্ব ও লোকসংস্কৃতি সংঘের পক্ষ থেকে ক্রমাগত অনুরোধ, চিঠিচাপাটি সত্ত্বেও এখনও অঞ্চলটিকে পুরাতাত্তিক দিক দিয়ে সংরক্ষিত এলাকা বলে চিহ্নিত করা সম্ভবপর হয়নি। ফলত, সেভাবে কোনও বৈজ্ঞানিক সুসংগঠিত খননকার্যও হয়নি। এলাকার বাড়তে থাকা বসতি এমনিতেই সম্পূর্ণ খননের পক্ষে পরিপন্থী হয়ে দেখা দিচ্ছে।
![](https://i2.wp.com/www.4numberplatform.com/wp-content/uploads/2021/08/cnnd-bkaugin@8.jpg?resize=640%2C355&ssl=1)
আশা একটাই। শিক্ষার আলো। বিশ্বজিৎ এবং তাঁর নেতৃত্বে দেবগ্রাম দেবলরাজা পুরাতত্ত্ব ও লোকসংস্কৃতি সংঘে অক্লান্ত লড়াই। হাল না ছেড়ে দেওয়ার মনোভাব। আশা করা যায় সরকারি উদাসীনতা পেরিয়ে এক দীর্ঘ ও পরিকল্পিত খননকাজ খুব শীঘ্রই শুরু হবে। ক্রমাগত বেড়ে চলা নির্মাণকাজ, স্থানীয় মানুষের অনেকাংশের সচেতনতার অভাব ইত্যাদি অন্ধকারের সেইসব দিন পেরিয়ে একসময় শিক্ষা পৌঁছবে ঐতিহাসিক দেবলগড়ে। ইতিহাস ফিরে পাবে তার রাস্তা। আলো ক্রমে আসবে…
তথ্যসূত্র:
- https://www.thebetterindia.com/258543/west-bengal-debagram-museum-ancient-artefacts-excavation-history-india/
- https://www.telegraphindia.com/west-bengal/in-interior-bengal-a-treasure-awaiting-discovery/cid/1689124
সত্যি ভালো খবর।