Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

ঝিঙ্কারগড়ি জঙ্গলের অধিকার আন্দোলন : গলিয়াথ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ডেভিডের জয়

চার নম্বর নিউজডেস্ক

 

উন্নয়নের নামে বৃক্ষনিধন কোনও আধুনিক সমস্যা নয়। গত শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকেই বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায় খেলাত চন্দ্র ঘোষ এস্টেটের হয়ে ছ’ বছর ধরে জঙ্গলের পর জঙ্গল সাফ করে বসত বানানোর তদারকি করেছিলেন। তাঁর এই অভিজ্ঞতা কতটা যন্ত্রণাবহ ছিল সেটা ‘আরণ্যক’ পড়লেই বোঝা যায়। শুধু একজন প্রকৃতিপ্রেমী হিসেবেই যে বিভূতিভূষণ যন্ত্রণা পেয়েছিলেন তা নয়, তিনি বুঝেছিলেন প্রকৃতির সাথে ওতপ্রোত জড়িয়ে থাকা মানুষজনও আসলে এই জঙ্গল ধ্বংসের সাথে সরে যেতে, মরে যেতে বাধ্য। আজকে আমরা এই ঘটনাটাকে ‘ডিসপ্লেসমেন্ট’ নামে চিনি। দোবরু পান্নারা এই ডিসপ্লেসমেন্টের বিরুদ্ধে সেদিন নিজেদের কণ্ঠস্বর খুঁজে পাননি। নাগরিক সভ্যতার দাবির কাছে তারা চুপচাপ আত্মসমর্পণ করেছিলেন। কর্মচারী বিভূতিভূষণও অবাধে নিজের কাজ শেষ করে আজমাবাদ-ফুলকিয়া-লবটুলিয়া-নাড়া বইহারের স্মৃতি আর অপরাধবোধ নিয়ে ফিরে এসেছিলেন যান্ত্রিক সভ্যতার কোলে।

জঙ্গল যে এমনকি রাষ্ট্রেরও পৈতৃক সম্পত্তি নয়, বরং ভূমিজ মানুষের বেঁচে থাকার উপায়, অস্তিত্বের অংশ, এ কথাটা প্রথম জোর গলায় উচ্চারিত হয় সাতের দশকে চিপকো আন্দোলনের সময়। বনবিভাগের তুঘলকি সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে চামোলি জেলার রেনি গ্রামের মহিলা মঙ্গল দলের সদস্যরা ১৯৭৪ সালের ২৫শে মার্চ থেকে শুরু করে চার দিন-রাত্রি পাহারা দিয়ে ফিরিয়ে দিতে সক্ষম হন সরকারি মদতপুষ্ট গাছকাটা দলকে। রাষ্ট্র প্রথমবার বাধ্য হয় প্রান্তিক মানুষজনের কথা শুনতে। শুধু ভারতে নয়, গোটা পৃথিবীর জন্যই এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন রেনি আর আশপাশের গ্রামের সাধারণ মানুষ।

ঐ সত্তরের দশকেই হিমালয়ের কোল থেকে বহুদূরে মধ্য ওড়িশার ঢেঙ্কানল জেলার এক অকিঞ্চিৎকর গ্রাম বলরামপুরের মানুষ সিদ্ধান্ত নেন ব্যাপক গাছ কাটার ফলে প্রায় মরুভূমি হয়ে যাওয়া ঝিঙ্কারগড়ি জঙ্গল রক্ষণাবেক্ষণের। ঠিক হয় রোজ পালা করে গ্রামের দুটি পরিবার থেকে দু’জন করে মানুষ ছ’শো একর জোড়া ঐ বনাঞ্চল ঘুরে দেখবে, যাতে চোরাগোপ্তা গাছ কাটা না পড়ে। গত চার দশক ধরে এই নিয়মের নড়চড় হয়নি, ফলত আজ ঝিঙ্কারগড়ি জঙ্গল আশপাশে সরকারি তদারকিতে থাকা জঙ্গলের থেকে অনেক বেশি ঘন ও সুস্থ। গ্রামবাসীদের (বিশেষত মহিলাদের) দৈনন্দিন নানা চাহিদা মেটাবার পরেও। ও হ্যাঁ, ঝিঙ্কারগড়ি জঙ্গল বনবিভাগের অধীন নয়, বলরামপুর গ্রামের ‘কমন ভিলেজ ল্যান্ড’।

রাষ্ট্রের বাঞ্ছিত উন্নয়নের জন্য দরকার জমি। কোনও বড় বিনিয়োগের প্রাথমিক শর্তই হল অনেকটা জমি। গত দশকের শেষের দিকে ওড়িশাতে বেদান্ত স্টারলাইট আর পস্কো স্টিলের জন্য জমি দখল করতে গিয়ে বড় ধাক্কা খায় ওড়িশা সরকার। দু জায়গাতেই স্থানীয় মানুষ তীব্র প্রতিরোধ করেন। পাঁচ বছর ধরে কোর্টকাছারি, আন্দোলন, কেন্দ্র-রাজ্য টানাপোড়েন, মিডিয়া কভারেজ চলার পর ২০১০-এ কেন্দ্রীয় পরিবেশ মন্ত্রক বেদান্ত-কে নিয়ামগিরি থেকে বক্সাইট মাইনিং-এর অনুমতি দিতে অস্বীকার করে। নিয়ামগিরির সন্তান ডোংরিয়া-কোন্ধরা ডেভিড বনাম গলিয়াথের অসম অথচ মহাকাব্যিক লড়াই জিতে যায়, অন্তত সাময়িকভাবে হলেও।

আর বহু পানের বরজ ভেঙে, লাখ লাখ গাছ কেটে উড়িয়ে দিয়ে দখল করা পস্কো স্টিলের ১৭০০ একর জমি দীর্ঘদিন পড়ে থাকার পর গত বছর পস্কো ঐ প্রজেক্ট থেকে হাত গুটিয়ে নেয়।

২০১১-র আঠাশে জানুয়ারি সুপ্রিম কোর্ট জগপাল সিং বনাম পাঞ্জাব মামলায় যে রায় দেয় তা পরিবেশ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে এক মাইলফলক বলা যায়। এই রায় অনুযায়ী ব্যক্তিগত মালিকানার বাইরে গ্রামের সবার ব্যবহারের জন্য যে সব জমি সরকার তার মালিক হলেও সেগুলি অন্য কোনও প্রয়োজনে ব্যবহার করা যাবে না।

অনেক রাজ্যেই রাজ্য সরকারের তরফ থেকে বিভিন্ন ব্যক্তি বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে অর্থের বিনিময়ে গ্রামসভার নিয়ন্ত্রণে থাকা জমি দেওয়া হয়েছে/হচ্ছে। আমাদের মতে এই সব সরকারি আদেশ বে-আইনি..

নিয়ামগিরি ও ঢিনকিয়া-গোবিন্দপুরে ছ্যাঁকা খাবার পর ওড়িশা সরকার ল্যান্ড ব্যাঙ্ক তৈরির কাজে হাত দেয়, এবং ২০১৪ সালে ঝিঙ্কারগড়ির জঙ্গল এই ল্যান্ড-ব্যাঙ্কের আওতায় আনার কথা ভাবা হয়। স্পষ্টতই আগের অনুচ্ছেদে লেখা রায়টি সম্পর্কে কর্তৃপক্ষ হয় অবগত ছিলেন না, অথবা সেটি উপেক্ষা করা হয়েছিল। যাই হোক, ঢেঙ্কানল জেলা কর্তৃপক্ষ এরপর ঐ জমির ক্লাসিফিকেশন বদলাবার কাজ শুরু করে, আর এ কথা জানতে পারার পর বলরামপুরে সাড়া পড়ে যায়। তাদের প্রতিবাদে অবশ্য জেলা কর্তৃপক্ষ কান দেয়নি— বলরামপুর গ্রামসভার নিয়ন্ত্রণে বাধ্যতামূলক পাঁচ শতাংশের থেকে অনেক বেশি জমি আছে, এই যুক্তিতে। কিন্তু চল্লিশ বছর ধরে পালন করার পর এত সহজে ঝিঙ্কারগড়ি জঙ্গলের অধিকার ছাড়তে রাজি ছিল না গ্রামের মানুষ। বলরামপুর গ্রাম পরিচালনা পর্ষদ (বিজিজিপি) গত বছর বিষয়টি নিয়ে ওড়িশা হাই কোর্টের দ্বারস্থ হয়।

সংকট ঘনিয়ে আসে যখন নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে রাজ্য জুড়ে এক গোছা নতুন প্রজেক্টের উদঘাটন করে ওড়িশা সরকার। এদের মাঝে ছিল ঝিঙ্কারগড়ি জঙ্গলের পাঁচ একর জায়গার ওপর ১০২ কোটি টাকার একটি ব্রুয়ারিও। কয়েকদিনের মধ্যেই জমি অধিগ্রহণ আর গাছ কাটার কাজ শুরু হবে, এমন পরিস্থিতিতে ন্যাশনাল গ্রিন ট্রাইব্যুনালের দ্বারস্থ হয় বিজিপিপি। শুনানি হবার কথা বিশে নভেম্বর, কিন্তু তার আগেই সতেরো তারিখ ভোরবেলা দু প্লাটুন সশস্ত্র পুলিশবাহিনী নিয়ে গাছ কাটার জন্য আসে এক বিরাট দল। খবর পেতেই গ্রাম খালি করে বেরিয়ে আসে সমস্ত মানুষ। মেয়েরা সবার আগে। সেই সত্তরের চিপকো আন্দোলনের স্মৃতি ফিরিয়ে এনে তারা জড়িয়ে ধরে শালগাছগুলিকে। কিছুতেই কাটা চলবে না। এত তীব্র প্রতিবাদ সত্ত্বেও ঐ দিন কাটা পড়ে প্রায় এক হাজার গাছ। কিন্তু বেলা বাড়ার সাথে ভিড় বাড়তে থাকে, লাইভ মিডিয়া কভারেজ চলে, আর ক্রমশ ব্যাকফুটে চলে যেতে থাকে প্রশাসন। বন্ধ হয়ে যায় গাছ কাটা। এর দু দিন পর মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়ক ঝিঙ্কারগড়ি ব্রুয়ারি প্রজেক্ট বাতিল বলে ঘোষণা করেন। বলরামপুর গ্রামে খুশির উৎসব শুরু হয়ে যায়। আরও একবার দুর্বল ডেভিডের হাতে পরাজিত হয় দানব গলিয়াথ।

ঝিঙ্কারগড়ির সাফল্য প্রমাণ করে ভূমিজ মানুষ আস্তে আস্তে গলার স্বর খুঁজে পাচ্ছে। অবশেষে আরামকেদারা  থেকে মাটিতে নেমে আসছে পরিবেশ সংরক্ষণের দাবি।