Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

দিগেন লোকাল

সাধন দাস

 

ভুস ভুস তিন ডুব, ইছামতিতে। রাত সাড়ে তিনটে। বৌ বলে ভুতের চান। পোষ নেই, আষাঢ় নেই, ট্রেন রাত চারটে কুড়ি। ডেলিপ্যাসেঞ্জার। খোকা বলে, ভুতের ট্রেন। খুকি ভাবে, বাবা ভুত। সবাই ঘুমোই। দিগেন জানে, সে জেগে জেগে ঘুমোয়। ট্রেন না বেরিয়ে যায়, মাথায় ভুতের চাপ থাকে। তাড়াতাড়িতে খেতে পায় না। ছোটে। পরতে পায় না। ছুটতে ছুটতে জামার হাতা গলিয়ে নেয়। স্ট্রিটল্যাম্পের আলোয় ছায়া লম্বা সিড়িঙ্গে হয়, বেঁটে হতে হতে মিলিয়ে যায়। স্টেশনে পৌঁছে রাত চারটে সাড়ে ঊনিশে বলে, ভুতের জীবন।

স্টেশনে কুয়াশাআলো, বিবর্ণ প্ল্যাটফর্ম, শিকল ট্রেন, এক দঙ্গল ছায়া ছায়া ভুত, দিগেনের অপেক্ষায় ঠাণ্ডা মেরে পড়ে থাকে। বঁনগা শেয়ালদা দুইমুখে বাঁধা ট্রেন, শিকলে জড়িয়ে ধরে দিগেনকে। বুকে তুলে নেয়। দুই ভুত মিলে বনগাঁ শেয়ালদা, বনগাঁ শেয়ালদা, দিন নেই, রাত নেই, দিনের পর দিন ঝমঝমঝমঝম…. মাঠ ঘাট বন বাদাড় পেরিয়ে কু ঝিমঝিম… কু ঝিমঝিম…।

ট্রেনেদিগেনে গলায় গলায় ভাব। ট্রেন কাঁপে দিগেন কাঁপে। ট্রেন ছোটে দিগেনও ছোটে। ট্রেন দেখায়, দিগেন দ্যাখে। ট্রেনের বাইরে ছুটন্ত দুনিয়া। এই সময়টা সর্বাঙ্গে ঠেস দিয়ে বসে দিগেন জেগে জেগে ঘুমোয়। টের পায় না, ট্রেন কখন দিগেনে, দিগেন কখন ট্রেনে মিশে যায়। ট্রেন ভাবে, আমি দিগেনের ট্রেন, দিগেনলোকাল। দিগেন ভাবে, আমি ট্রেনের দিগেন, দিট্রেন। দুজনের শিকল ঝমঝম বাজে, ঝমঝম….

আপিসে দিগেন পিওন। টেবিলে টেবিলে জল দেয়। ফাইল বয়ে দেয়, টিফিন মায় দিদিমণিদের ন্যাপকিনও। জল দান পূণ্য দান। শুধু জলের আর এক নাম জীবন, টুকু মনে রাখে। রেল কোম্পানিতে দিগেনের বন্ধু ট্রেন, সেও কুলি। মাল টানে, মানুষও টানে। দুজনেই ছোটে। এ ঠিকানা, সে ঠিকানা। এ স্টেশন, সে স্টেশন। লম্বা লম্বা পা আর গোল পায়ে, শিকল বাজে।

দিগেন ফেরে শিয়ালদা সন্ধে আটটা আট। চাকার খুরে আর রেলের পাতে ঘর্ষণের ধাতব গন্ধ। ক্লান্ত দিগেন ট্রেনে ওঠে। বুক ভরে নিশ্বাস নেয়। একটা দিন শেষ হল! দিগেনের চ্যাটচেটে ঘাম, ময়লা, দুর্গন্ধ মেখে ট্রেন দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। দিগেনলোকাল ছাড়ে। দিট্রেন ছোটে। হাবড়া পেরুতেই ধু ধু মাঠ, ফাঁকা নিঝুম রাত, ঝুম ঝুম বাজে। বন, বাদাড়, ভুতের পাড়ায় পাড়ায় খবর পৌঁছে যায়, শিকল ভুতেরা ফিরছে ঝমঝমঝমঝম….

বনগাঁ পৌঁছে ভুতের অর্ধেক পড়ে থাকে স্টেশনে, বাকি অর্ধেক তখনও ছোটে পূর্বপাড়া মুখো। ব্রহ্মতালুতে মধ্য রাত্রি। বাড়ি আমার বাড়ি অবশেষে। রঞ্জনের মুদিখানা বন্ধ হয়ে গেছে! ইচ্ছে করে ভেলিগুড় চুষতে চুষতে ছোটে। বুলুময়রাণির তেলেভাজা সুনসান। পাপড় খুব সাবধানে খায়নি কতদিন! কালুমিঞার গাছ ভর্তি টোপাটোপা কুল। দেদার ঢেলা মেরে পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করে। বাড়িতে ঢোকার মুখে ড্রেন নরক হয়ে আছে। সাফাই আর হয়ে ওঠে না। সময় নেই, সময় নেই।

ঘরে ঢুকে খুব খুব সাধ হয়, ছেলে মেয়ে দুটো একবার জেগে উঠুক, মানুষের মতো চলে ফিরে বেড়াক, দেখি। চিত্‍কার করে হৈ চৈ বাঁধিয়ে দিতে ইচ্ছে করে, খোকা ওঠ, খুকি ওঠ। দ্যাখ দ্যাখ, বাবা এসেছে।

অর্ধেক ভুতুরে ট্রেন কানের কাছে বলে ওঠে– বাঁজা আমি। তোর ছেলে মেয়ে দুটো আমায় দিস, দিগেন।

অর্ধেক ভুতের তখন আস্ত মানুষ হয়ে উঠতে ইচ্ছে করে। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে– নাআআ– আমি হতে পারিনি। ওরা মানুষ হবে।

তখনই রাত সাড়ে তিনটের এ্যালার্ম বেজে ওঠে।

–না দিবিতো কেড়ে নেবো।