প্রিয়ক মিত্র
পূর্ব প্রকাশিতের পর
–আপনি এত ভালো বাংলা বলা শিখলেন কোথায় ফাদার? এত পরিষ্কার বাংলা। আপনি তো ইংরেজ…
–নট ব্রিটিশ। আমি ফ্রান্সের মানুষ। কিন্তু আমার জন্ম, বেড়ে ওঠা সব শ্রীরামপুরে।
–শ্রীরামপুর বলতে? ওই গির্জায়?
মহেশ সেন আর ফাদারের মধ্যে যখন এই কথা চলছে, তখন জনার্দন সান্যাল শরীরি ভঙ্গিমায় অত্যন্ত বিরক্তি নিয়ে পায়চারি করছিল ঘরময়। হঠাৎ সে থমকে দাঁড়িয়েছে। তার চোখমুখ গনগনে হয়ে উঠেছে যেন। সে সোজা গিয়ে ফাদারের মুখোমুখি দাঁড়াল। মহেশ সেনের শেষতম প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগেই সে ফাদারকে পালটা প্রশ্ন করে বসল। এবং সে প্রশ্ন ঘরময় একটা অস্বস্তি ছড়িয়ে দিল লহমায়। মহেশ সেন পর্যন্ত আঁতকে উঠলেন।
–আপনিই তার মানে সেই ওয়ান্টেড ক্রিমিনাল?
–কী বলছেনটা কী! মহেশ সেন আর্তনাদ করে উঠলেন প্রায়।
জনার্দন সান্যাল মহেশ সেনকে তাচ্ছিল্য করে বলে চললেন, ‘গোয়েন্দা বিভাগের কাছে খবর আছে, ফেরার স্বদেশিদের সঙ্গে একজন ফাদার থাকতে পারেন। আপনি আমায় বলেছেন, কলকাতা যাওয়ার পথে আপনার ফিটন খারাপ হয়ে যাওয়ায় আপনি এখানে উঠেছেন। আপনার ফিটন কোথায়? সেটা কোথায় খারাপ হয়েছিল? স্বদেশিদের সঙ্গে আপনার কী কানেকশন? আপনি এখানে কেন এসেছেন? কী পরিকল্পনা আপনাদের? সূর্য মিত্র কোথায়? মৃন্ময় কোথায়?’
ঠান্ডা গলায় কথা শুরু করেছিল জনার্দন দারোগা। গলা আস্তে আস্তে উচ্চগ্রামে উঠতে উঠতে সপ্তমে ঠেকল তার।
গোটা ঘটনাটাই এত অপ্রত্যাশিত, যে ঘরের সকলেই থমকে গিয়েছে। আর জনার্দন সান্যালের গলা যে ভঙ্গিতে খাদ থেকে চড়াইয়ে উঠেছে, তাতে রক্ত হিম হয়ে যাওয়াই স্বাভাবিক। সকলেই কমবেশি তটস্থ। দুজন বাদে।
একজন সনাতন হাজরা।
সে একটা বিড়ি ধরানোর চেষ্টা করছে একটা লণ্ঠন থেকে।
আরেকজন ফাদার। তিনি শান্ত, সমাহিত দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন জনার্দনের দিকে।
এক মুহূর্তের স্তব্ধতা।
তারপরেই সেই স্তব্ধতা খানখান করে হেসে উঠলেন ফাদার।
–আপনার কল্পনাশক্তি অ্যাডমিরেবল! হ্যাঁ আমার ফিটন কাছেই খারাপ হয়েছিল। প্রিসাইসলি, ওয়ান অফ দ্য হর্সেস ড্রপড ডেড। একটা ঘোড়া মরে গিয়েছিল। তারপরে আমার গাড়োয়ান লোক ডাকতে যায় গ্রাম থেকে। আমি এখানে এসে উঠি। আই নো দিস প্লেস ফর আ লং টাইম! স্বদেশি! আপনি এই গাঁজাখুরি গল্প কোথা থেকে আমদানি…
ফাদারের কথা শেষ হয়নি। জনার্দন সান্যাল বলে উঠলেন, ‘ইশশ! এই ক্লুটা কী করে মিস করলাম। ধন্যবাদ মহেশবাবু। আপনি ওকে এতবার ফাদার বলে ডাকলেন বলে দুয়ে দুয়ে চার করতে সুবিধে হল।’
মহেশ সেন হতভম্ব হয়ে জনার্দন সান্যালের দিকে তাকিয়ে। তিনি আগাপাশতলা কিছুই না বুঝতে পেরে পূর্ণত নির্বাক হয়ে গেছেন।
ফাদার খুব ঠান্ডা গলায় বললেন, ‘আপনি কি ইমপ্লাই করছেন? আমি মিথ্যে বলছি?’
–আলবাত বলছেন! জোর গলায় বলল জনার্দন সান্যাল। ‘আপনি সেই লোক ছাড়া আর কেউ হতেই পারেন না! এবার বলুন, স্বদেশিদের সঙ্গে আপনার কীসের সাঁট?’
মুচকি হেসে ফাদার বললেন, ‘একঘর লোকের মধ্যে বসে একথা জানতে চাইছেন? তাও আবার যেখানে একজন স্বদেশি বসে রয়েছে!’
শেষ কথাটা বলতে বলতে আড়চোখে লতার দিকে তাকালেন ফাদার।
জনার্দনের কেন জানি না হুঁশ ফিরল।
সে দাঁতে দাঁত চিপে বলল, ‘বেশ। আপনাকে গ্রেফতার করছি। মহেশবাবু, আপনি উডপেক সাহেবের নির্দেশেই তো লালবাজার যাচ্ছিলেন। আর আপনার থেকে যা জানার, আমার জানা হয়ে গিয়েছে। আপনার আসামীকে এবার আপনি আমার হাতে সোপর্দ করুন। দুজনকে নিয়েই আমি লালবাজার রওনা দেব।’
মহেশ সেন এতক্ষণ আশ্চর্য হাঁ করে ছিলেন বিস্ময়ে। এই আকস্মিক ঘটনাটা তিনি তখনও আত্মস্থ করতে পারেননি। এবার তাঁর চোখমুখ থমথমে হয়ে গেল।
‘জনার্দনবাবু!’ স্বভাবসিদ্ধ বাঁজখাই গলায় উত্তর দিলেন মহেশ সেন। ‘আপনার পুলিশে কাজ করার কোনও প্রমাণপত্র আমার কাছে নেই। কীসের ভিত্তিতে আপনার হাতে এদের তুলে দেব?’
মুখচোখ বিকৃত করে বলে উঠলেন জনার্দন, ‘কী? আপনি প্রমাণপত্র চান?’
–হ্যাঁ চাই!
–আপনি ভুলে যাচ্ছেন আপনি লালবাজারের একজন দারোগার সঙ্গে কথা বলছেন।
–আপনি ভুলে যাচ্ছেন আপনি একজন ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে কথা বলছেন!
গলা চড়েছে মহেশ সেনেরও।
এই মুহূর্তে ঘরের অবস্থা কী? সেদিকে চোখ রাখা যাক। লতার এতক্ষণ কোনও ভয় ছিল না মনে! সে জানত আপাতত সে বন্দি। মুক্তির উপায় তার জানা নেই। সে এই ভবিতব্য মেনে নিয়েছিল। কিন্তু এবার তার আশ্চর্য ভয়মেশানো উত্তেজনা হচ্ছে। যদি ইনিই ফাদার হন, যার কথা তাকে মৃন্ময়দাদা বলেছিল, তাহলে নিশ্চিত কিছু পরিকল্পনা হয়েছে। সেই পরিকল্পনার মধ্যে কি মৃন্ময়দাদাও আছে? সে এখন কোথায়? কী পরিকল্পনা হয়েছে?
লতা কেমন বিভ্রান্ত হয়ে ঘরের বাকিদের একবার মেপে নিতে চাইল।
জয়চাঁদের চোখেমুখে একটা চাপা রাগ, আর আশ্চর্য আশঙ্কার ছায়া। কে এই লোকটা? লতা ভাবে। এই লোকটাকে প্রথম থেকেই কেমন জানি সন্দেহজনক লাগছে ওর। ওদের দলে কখনও একে দেখেনি। কিন্তু লোকটার এখনকার প্রতিক্রিয়া দেখে মনে হচ্ছে, লোকটা যা খুশি ঘটাতে পারে।
লোকটার হাতের দিকে চোখ গেল লতার।
একটা হাত কোমরের গেঁজে রাখা। আর সেই গেঁজ থেকে ওটা কি উঁকি মারছে?
একটা বড় ছুরির বাঁট।
লতা চমকে উঠল। লোকটা ওদের দলের লোক নয়তো? তাহলে এই ঘরে আগে থেকে যে কজন উপস্থিত ছিল, তাদের মধ্যে কেউ কেউ কি…
তার পাশের বৃদ্ধটির দিকে চোখ গেল লতার। এই লোকটি প্রথম থেকেই নির্বাক। শ্মশ্রুগুম্ফের আড়ালে লোকটার মুখটাও বোঝা যাচ্ছে না পরিষ্কার। কিন্তু…
আঁতকে উঠল লতা।
লোকটার দুটো হাত চাদরের আড়ালে। তার মধ্যে একটা হাত দিয়ে হাতের লাঠিটা ধরা। আর একটা হাতও খালি নেই।
সেই হাতে এমন কিছু ধরা, যার খোঁচাটা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে চাদরের ভেতর দিয়ে।
ওটা একটা পিস্তল!
লোকটাকে চেনে লতা!
এইভাবে চাদরের আড়ালে পিস্তল ধরে থাকতে সে একজনকেই দেখেছে।
সূর্যবাবু।
এই ঘরে ঘটে চলা নাটকটার আন্দাজ না পেলেও, একটা মঞ্চ যে প্রস্তুত হয়েছে, তা বুঝতে সমস্যা রইল না লতার।
আর এটা ভেবেই সে বিহ্বল হয়ে তাকাল বাকিদের দিকে।
সে, সূর্যবাবু, জয়চাঁদ আর ফাদার হল শিকার। এদের মধ্যে কেবল ফাদারেরই সৌম্য মুখে হাসির হালকা ঝিলিক। যদিও তার মধ্যে উদ্বেগের হালকা ছায়া।
মহেশ সেন আর জনার্দন সান্যাল আপাতত বিতণ্ডারত!
আরেকজন…
সনাতন হাজরার দিকে চোখ পড়তেই হাড় হিম হয়ে গেল লতার। আবার।
লোকটার সচকিত মিহি-সন্ধানী দৃষ্টি যেন তার দৃষ্টি অনুসরণ করে এবার তার মুখের ওপর স্থির হয়েছে।
বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে সেই দৃষ্টিতে তার দিকে ঠায় তাকিয়ে রয়েছে সনাতন।
কিন্তু এই তাকানোর অস্বস্তিতে বেশিক্ষণ থাকতে হল না লতাকে। তার চোখ আবার নেমে গেল সনাতন হাজরার পায়ের দিকে।
একটা বহু পুরনো খড়ম, তার ভেতর কীসের যেন একটা আভা!
এই আভাটা কিছু একটা মনে পড়িয়ে দিচ্ছে লতাকে। কারও কাছে শোনা কিছুর বর্ণনা…
খড়মসুদ্ধ পা আচমকা গুটিয়ে নিল সনাতন।
আরও একবার সনাতনের চোখে চোখ পড়তেই লতা দেখল এবারও লতার দৃষ্টি অনুসরণ করে সনাতনের চোখ গিয়েছিল নিজের খড়মের দিকে। এখন সে আতঙ্কমিশ্রিত সন্দেহ নিয়ে তাকিয়ে লতার দিকে।
কীসের আভা হতে পারে ওটা?
আলোটার মধ্যে একটা রঙের আভাস আছে। রংটা কেমন যেন চেনা চেনা…
কে তাকে বলেছিল এমন একটা আশ্চর্য আলোর কথা?
রমা?
হ্যাঁ! রমা! খগেনদার আংটি প্রসঙ্গে!
কী আছে সনাতন হাজরার ওই খড়মের ফাঁকে?
ফাদারের গলা ভেসে এল লতার এই চিন্তার স্রোতের মাঝে।
‘আপনারা বৃথা তর্ক করছেন ভদ্রমহোদয়গণ! এত রাতে আপনাদের কেউই এখান থেকে বেরোতে পারবেন না। আমি আমার অপরাধ স্বীকার করছি না। কিন্তু সন্দেহের বশে যদি আমাকে গ্রেফতার করেন, আমি ধরা দিতে রাজি। সকাল অবধি অপেক্ষা করলে হয় না?’
মহেশ সেন এবং জনার্দন সান্যাল দুজনেই চুপ করলেন।
আর হঠাৎ সনাতন বলে উঠল, ‘ঠিক! এই নিয়ে কাল সকালে ভাবা যাবেখ’ন! আপাতত খেতে দাও ভাই জয়চাঁদ।’
কথাটা বলতে বলতে উঠে দাঁড়াল সনাতন।
হঠাৎ যেন খানিক টলে গেল সে। লক্ষ করল লতা।
জয়চাঁদ আর বৃদ্ধ (সূর্যবাবু) দুজনেই তৎপর অবস্থা থেকে স্বাভাবিক অবস্থায় এসেছে আবার! কিন্তু লতার সামনে গোটা দুনিয়াটা ঘেঁটে যাচ্ছে। তাকে জানতেই হবে সনাতনের খড়মের মধ্যে কী রহস্য লুকিয়ে।
শাজাহান আর গোবিন্দরাম, দুজনের কেউ জানে না, যে গন্তব্যে তারা গিয়ে পৌঁছচ্ছে, সেখানে প্রমথরঞ্জন আছে কিনা, থাকলেও দুজন মিলে সেখানে পৌঁছে প্রমথকে পাকড়াও করতে পারবে কিনা। কিন্তু তারা আটঘাঁট বেঁধেই চলেছে।
শোভাবাজারে অনাদি চৌধুরীর যে আত্মীয়কে খুন করেছে প্রমথ, তার নিজের হাতে লেখা একটি পথনির্দেশ পাওয়া গিয়েছে। নিজে হাতে লেখা হলেও তা যে ত্রস্ত হয়ে লেখা, তার প্রমাণ হাতের লেখা। গোবিন্দরামের বিশ্বাস, ওই পথনির্দেশ চেয়েছে প্রমথ। তার এখন পালানোর জায়গা দরকার। আর এই একটি উপায়েই সে এই বাড়ির সাকিন জোগাড় করতে পারত।
কিন্তু সেই হাতে লেখা সাকিন নিয়ে গেল না প্রমথ? পুলিশের জন্য প্রমাণ রেখে গেল? কী করতে চায় সে? কোন অপরাধীর পেছনে ধাওয়া করেছে তারা?
প্রশ্নটা ভাবাচ্ছে শাজাহানকে।
কিন্তু এই অভিযানে সে সামিল হয়েছে কতটা প্রমথরঞ্জনের কথা ভেবে, আর কতটা স্বদেশিদের কথা ভেবে, তা অবশ্য সে নিজেও ভালো জানে না।
অনাদি চৌধুরীর বাড়ির খুব কাছে এসে গিয়েছে তারা। আজ রাতেই পৌঁছে যাবে গন্তব্যে।
(আবার আগামী সংখ্যায়)