Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

গোঁফ — ২য় পর্ব

এস হরিশ

 

অনুবাদ: ব্রতীন্দ্র ভট্টাচার্য

পূর্ব-প্রসঙ্গ: তামাশাবাজের দল

গল্পগাছার পাগলামি

গল্পকাহিনির সঙ্গে তার বাপের যে কোনও একটা যোগাযোগ আছে, এ কথা পোন্নু মনে হয় জানে। পোন্নু আমার ছেলে। রোজ রাতে শুতে যাওয়ার সময়ে গল্পের আবদার করে সে। শুরুর দিকে আমার বেশ ভালই লাগত অবশ্য। আজকালকার দিনে একটা বাচ্চা গল্প শোনার আবদার করছে— এমন দেখে কারই বা ভাল না লাগবে? একটা ভাল গল্প হল অর্জুনের তূণের একটা তিরের মতো। ধনুক থেকে বেরোলে ওই একটাই হয় দশটার সমান, আর লক্ষ্যে আঘাত করার সময় দশটা হয়ে যায় হাজার হাজার।

কিন্তু আমার সে উৎসাহ খুব বেশিদিন টিকল না। একটা জোরদার বিপদের সম্মুখীন হলাম। বাচ্চাদের মনের মতো গপ্পো আর কটাই বা জানা থাকে মানুষের? পনেরোটা? কুড়িটা? তিরিশটা, খুব বেশি হলে? রামায়নম আর মহাভারতমের কাহিনি বলে বলে কয়েকটা মাত্র দিনই কাটানো যায়। আর ওইসব ক্ষমতা দখলের লড়াই, উৎসব, পালাপার্বণ ইত্যাদির বিবরণ আর ধম্মোকম্মের কথা তো ঠিক শিশুদের জন্য নয়। বয়সে একটু বড়দের জন্যই বরং। তা ছাড়া আজকের দিনে দাঁড়িয়ে ওইসব গল্পের প্রাসঙ্গিকতাও তো তেমন নেই। মহাকাব্যের মহান মহান ব্যক্তিত্বেরা আজকের বাচ্চাকাচ্চাদের তুলনায় বেশ একটু সেকেলেই ছিলেন বলা চলে, তাই না? গুগল আর এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার, স্টিম ইঞ্জিন আর পোলিও প্রতিষেধকের আগেকার জমানার জ্ঞানীশ্রেষ্ঠ ভিদুরর-এর সর্বশ্রেষ্ঠ মহাজ্ঞানের কথা ছিল এই, যে পৃথিবী সমতল, এবং তা দাঁড়িয়ে আছে সাতটি হাতির পিঠে ভর করে। আজকের একটা পাঁচ বছরের শিশুও এর থেকে অনেক বেশি জানেশোনে!

এরপর পঞ্চতন্ত্রম, আরব্যরজনীর গল্প আর কথাসরিৎসাগরম, যেসব গল্প আমরা বহুবার পড়েছি। আশ্চর্যের কথা হল, সব গল্পের মধ্যে কেবল আট-দশটাই আমার মনে আছে। এর মানে বাকিগুলো মনে তেমন দাগই কাটেনি। এই গল্পগুলো আবার পড়ে-টড়ে ঝালিয়ে নিয়ে বাচ্চাকে বলাই যায়, কিন্তু এসব যে তার ভাল লাগবে এমন কোনও নিশ্চয়তা তো নেই। এদিকে, আজকাল আমার চটজলদি বানানো গল্প শুনে রাগ-টাগ করে সে ঘুমিয়ে পড়ে। ভাল আমারও লাগে না, যখন দেখি গল্পে উৎসাহ হারিয়ে সে ক্রমে কম্পিউটার গেমস আর কার্টুনের দিকে ঝুঁকে পড়ছে।

এসবের মধ্যে একদিন খবরের কাগজের শেষ পাতার একটা কোণে একটা ছোট্ট খবর খুঁজে পেলাম। খবরটা টিভি চ্যানেলগুলোয় একেবারেই আসেনি। আমেরিকার মহাকাশবিজ্ঞান সংস্থা নাসা-র একটা মহাকাশযান প্রথমবারের জন্য কেরালার আকাশপথ পার করতে চলেছে। রাতের আকাশ পরিষ্কার থাকলে ভোর চারটে নাগাদ আকাশের উত্তর-পশ্চিম কোণে তাকে দেখতে পাওয়ার কথা। ওই যানে ছিলেন চারজন— তিনজন আমেরিকান ও একজন রাশিয়ান, যাঁরা গবেষণার জন্য বিগত ছ-মাস ওই মহাকাশযানেই বাস করছিলেন। কাগজের খবরে ওই মিশনের খরচখরচা নিয়ে আলোচনা ছিল। খবরটা আমি ছেলেকে পড়ে শোনালাম। ইন্টারনেট থেকে মহাকাশযানের একটা ছবি দেখালাম, আর বললাম, ভোরবেলা ওই যানের আকাশ পার করার ঘটনাটা নিজেরা চাক্ষুষ করলে কেমন হয়?

—ওটা কি আকাশের সমুদ্র দিয়ে যাবে? পোন্নু জানতে চায়।
—আকাশে কোনও সমুদ্র নেই বাবা। আকাশ হচ্ছে একটা খালি জায়গা। কিচ্ছু নেই সেখানে। মহাশূন্য। আর স্পেসশিপ জলে চলা জাহাজের মতো না। আসলে খানিকটা এরোপ্লেনের মতো। নামটাই শুধু ওরকম।
—তার মানে আকাশ ওইরকম এমনি-এমনিই পড়ে আছে? ঘাস, আগাছা এইসব গজাচ্ছে?
—না না না। আকাশে ঘাসপাথরমাটি এসব কিচ্ছু নেই রে। এমনকি হাওয়া পর্যন্ত নেই। ফাঁকা মানে এক্কেবারেই ফাঁকা।

অপার শূন্যতা কী, তা কেমন করেই বা বোঝানো যায়?

অ্যালার্ম দিয়ে ভোর চারটেয় উঠে পোন্নুকে ডাকতে গেলাম। কিন্তু ডিসেম্বরের শীতভোরে গরম আচ্ছাদনের নিচে সে তখন গভীর ঘুমে অচেতন। চেষ্টা করলেও আর ঘুম আসবে না আমার। তাই চোখেমুখে জল দিয়ে সোজা চলে গেলাম ছাদে। শেষ কবে যে এই সময়ে ঘুম থেকে উঠেছি মনে পড়ে না। কিছুদিন যাবত অনিদ্রায় ভুগছি বলে রাত একটা কি দুটোর আগে শুতে যাই না। টিভি দেখি বা বই পড়ি। রাতে দুটো করে, মোট ১২০ এমএল, ব্র্যান্ডি খাওয়া শুরু করার পর থেকে অবশ্য অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছে। কিন্তু তাতে সমস্যা হয়েছে এই, যে সকাল ছটার আগে কিছুতেই ঘুম থেকে উঠতে পারি না।

খালি পায়ে ঠান্ডা মেঝে আর সিঁড়ি পার করে ছাদে উঠে এদিক-সেদিক দেখলাম। চারিদিকে কেউ কোথাও জেগে নেই। মিশকালো অন্ধকার আর ফাঁকেফোঁকরে অল্পস্বল্প আলোর ছোপ ছাড়া কোথাও কিছুই দেখা যাচ্ছে না। মহাকাশযানের অভিযাত্রীর মতন আমি একেবারে একা। আমি যে এখানে বসে আছি, সে-কথা মহাবিশ্বের কোথাও কেউ জানে না। আমার যদি এক্ষুনি হারিয়ে যাবার হত, ভগবান যদি একফালি ভিজে ন্যাকড়া দিয়ে ব্ল্যাকবোর্ডে চকের দাগের মতো এই দুনিয়া থেকে আমাকে একেবারে মুছে ফেলতেন, হয়তো হাতে-গোনা সামান্য কজন আমার অনুপস্থিতি লক্ষ করতেন। আমাকে মনে করতেন। আমি যে এখন আছি, বা কখনও ছিলাম, ওই সামান্য কজন চলে গেলে হয়তো সে-কথাও জানবে না কেউ। আজ থেকে হাজার বা দশ হাজার বছর আগে এই পৃথিবীতে বুকে চরে বেড়ানো মানুষদের নামগোত্র আজ কে-ই বা জানে। ভগবান এই পৃথিবীর বুক থেকে, মানুষের অকিঞ্চিৎকর স্মৃতির থেকে তাদের বিলকুল মুছে ফেলেছেন। গায়ে এসে লাগছে ছাদের দড়িতে শুকোতে দেওয়া কাপড়। প্লাস্টিকের গ্রো-ব্যাগে লাগানো টমেটোচারার পাতাগুলো শিশিরঝরা এই অন্ধকারে নিস্তেজ হয়ে নেতিয়ে আছে।

ওই স্পেসশিপের যাওয়ার সময় হয়ে আসতে আকাশের দিকে তাকালাম। কিন্তু তেমন কিছুই নজরে এল না। আকাশটাকে দেখে মনে হল যেন একটা বিরাট মন্দির। নানারকম প্রদীপ জ্বলছে সেখানে। কোনওটা উজ্জ্বল, কোনওটা টিমটিম করছে, কোনওটা আবার কোনওমতে আলো ধরে রেখেছে। কয়েকটা তারাপুঞ্জকে চিনতে পারলাম, কারণ ছেলেবেলায় শাস্ত্রসাহিত্য পরিষদের এক শিক্ষকের সঙ্গে তারা চিনতে যাবার সুযোগ ঘটেছিল। উনি বলেছিলেন, আকাশ দেখা অনেকটা সমুদ্র দেখার মতো। আমরা আসলে আকাশ আর সমুদ্রকে আমাদের ভেতরেই দেখতে পাই।

আকাশের উত্তর-পশ্চিম কোণে তাকালাম। যানটা কত বড় হতে পারে? মনে মনে ভাবি। আকাশে অনেক উঁচুতে উড়তে থাকা একটা পাখির মতো বড়? দেখতে দেখতে চোখে পড়ল গ্রহের মতো একটা জিনিস, শুক্রগ্রহের সঙ্গে যার মিল আছে। কিন্তু আকাশের ওদিকে তো শুক্রের থাকার কথা নয়। তাছাড়া ওর গতিও বেশ ভাল। এই তাহলে সেই মহাকাশযান! চলতে চলতে আমার মাথার ওপর এলে আমি আনন্দে একটু হাত নেড়ে দিই। আমার ছেলে এখানে থাকলে আনন্দে উত্তেজনায় লাফালাফি করত। ওকে বলার জন্য একটা গল্পও বানিয়ে ফেললাম মনে মনে। আমার হাত নাড়া দেখে ওরাও পালটা হাত নেড়েছে! এক তুচ্ছ বিজ্ঞানপ্রেমীর অভিবাদন গ্রহণ করো, বহুদূরদেশের সৌভাগ্যবান মহাকাশ অভিযাত্রীরা! যদি আমার ছেলেবেলার ভাললাগাটাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারতাম, তার আগুনটাকে যদি নিবে যেতে না-দিতাম, তবে আমিও হয়তো তোমাদের সঙ্গে সঙ্গে, তোমাদেরই একজন হয়ে আকাশের পর আকাশ পেরিয়ে যেতাম। কিন্তু তা তো হওয়ার নয়। আমি এখানে, এমন একটা জায়গায় আছি যার নামও তোমরা শোনোনি। এমন ভাষায় কথা বলছি যা তোমাদের অজানা। একদৃষ্টে আমি ওই দৃশ্য দেখতে লাগলাম, এমনভাবে যেন চোখের পাতা পড়লে ওই অদ্ভুত ছবির কিছুটা আমার অদেখা থেকে যাবে। ততক্ষণ দেখলাম, যতক্ষণ না ওই উজ্জ্বল আলোর রেখা আমার আকাশ পার করে দক্ষিণের দিগন্তে মিলিয়ে না যায়।

দেখা হয়ে গেলে ভাবতে বসলাম, যা দেখলাম তা কি সত্যিই দেখলাম, না কি নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে আমার কল্পনার আকাশে একটা ছবি তৈরি করলাম মাত্র? কাউকে একটা বলতেই হবে! যেন অন্য কারও সঙ্গে এই অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিলে তবেই এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত হতে পারব। কী হাস্যকর রকমের অন্তঃসারশূন্য প্রাণী আমরা! আমাদের অভিজ্ঞতা, চিন্তাভাবনার প্রাসঙ্গিকতা যেন শুধুই অন্যের অনুমোদন-নির্ভর। আমাদের জীবন যেন কিছু মুষ্টিমেয় মানুষের চিন্তা আর স্মৃতিতেই সীমাবদ্ধ। তারা চলে গেলেই আমাদের জীবনও শূন্যে বিলীন হয়ে যাবে।

বিছানায় ফেরত না গিয়ে মর্নিং ওয়াকটা একটু তাড়াতাড়িই শুরু করে দেব বলে মনস্থ করলাম। অন্ধকারে ডুবে থাকা জনহীন রাস্তায় হাঁটতে শুরু করলাম খুব দ্রুত, দুই হাত দুপাশে ঘোরাতে ঘোরাতে। আমার শরীর, যা তৈরি হয়েছে কায়িক শ্রমের জন্য, আর মন— এই দুইকে যেন বোকা বানাবার চেষ্টা, যে আমি সত্যিই কায়িক শ্রম করছি। ছেলেকে বলব ভেবে মনে মনে একটা গল্প ফাঁদার চেষ্টা করলাম। একটা অপ্রত্যাশিত মোলাকাতের গল্প। মর্নিং ওয়াকে বেরিয়ে এমন একজনের সঙ্গে দেখা হওয়ার গল্প, যার মৃত্যু হয়েছে একশো বছর আগে। কিছুদূর গিয়ে একটা মোড়, সেখানে রাস্তার আলোর নিচে একটু জিরিয়ে নেব ভেবে দাঁড়ালাম। আলোটা কেউ নিভিয়ে যেতে ভুলে গেছে নিশ্চয়ই। এই মোড়টা আর এর আশপাশের সেকেলে দোকানপাটগুলো বহুদিন ধরে একইরকম আছে। আমাদের ছেলেবেলার তুলনায় এখানে বদল বলতে শুধু মোবাইল ফোনের রিচার্জ কুপনের বিজ্ঞাপনগুলোর পোস্টার। রাস্তার কিছুটা দখল করে একটা পানের দোকান, একটা প্রায়-পরিত্যক্ত গাড়িবারান্দাওয়ালা বাড়ি, আর একটা চায়ের দোকান। বন্ধ, কিন্তু ভেতরে আলো জ্বলছে। মনে হয় খোলার সময় হল। আমার ছেলেবেলায় এই দোকানটা যিনি চালাতেন, তাঁর অবর্তমানে তাঁরই জামাই এখন দোকান চালান। ভাজাভুজি আগে যা পাওয়া যেত, এখনও তাই-ই যায় বলে আমার বিশ্বাস। মেনুতে বড়জোর পরোটা যোগ হয়েছে।

এই মোড়ে এসে রাস্তাটা তিন ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। বাঁদিকের রাস্তার পাশে চার্চের পরিত্যক্ত রাবার বাগান। ডানদিকের রাস্তায় গেলে মাছের বাজার, যেখানে এতক্ষণে মেলা ভিড় জমে গেছে। চলছে জেলে আর পাইকারি ব্যবসায়ীদের চিৎকৃত দরাদরি আর একে অপরের প্রতি একসঙ্গে খিস্তি আর অভিবাদন ছুঁড়ে দেওয়াদেইয়ি। সোজা পথে গেলে মন্দির। সেখানে গেলে দেখতে পাব সবে-সবে ভোরের স্নান সেরে ওঠা ফরসা ফরসা সুন্দরীদের।

ছ-মাস আগে পর্যন্ত আমার এক বন্ধুর সঙ্গে হাঁটতে বেরোতাম। সে একদিন আমায় জিজ্ঞেস করল— আচ্ছা, এই অল্পবয়সী মেয়েরা স্নান করে সেজেগুজে মন্দিরে কেন যায় বলতে পারো?

—পুজো দিতে, আর কী, আমি বলি।
—না না। ভাল করে ভেবে দেখো। পুজো দেওয়াই যদি উদ্দেশ্য হবে তাহলে সবচেয়ে ভাল পোশাক পরে সেজেগুজে যাওয়ার মানে কী? ওরা আসলে অবচেতনে সঙ্কেত দিতে চায়, যে যৌনমিলনের জন্য ওরা সহজলভ্য।
—ভ্যাট! হাবিজাবি বকছ! আমি হেসে উঠে বলি।
—দেখো, তাই-ই যদি না হবে, তবে প্রতি মাসে চার কি পাঁচদিন ওরা মন্দিরে যেতে চায় না কেন? আসলে ওরা জানাতে চায়, ওই সময়টা ওরা লভ্য নয়। বিশেষ করে পুরোহিতদের, কারণ ওরাই এইসব ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি পারদর্শী।

ব্যায়াম করে নিজের শরীরকে বোকা বানাতে ব্যর্থ হয়ে হার্ট অ্যাটাকে সেই বন্ধুটি মারা গেছে। তারপর থেকে আমি একাই হাঁটি।

সোজা রাস্তায় বেশ খানিকটা হেঁটে গেলে একটা খাল। সেই খালের ওপরের ব্রিজ পার করলেই একটা গ্রাম। স্ফূর্তি, প্রাণশক্তি যখন বেশি ছিল, ওই ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে ঠান্ডা হাওয়া উপভোগ করতাম, তার পর আবার হাঁটতাম। আজ সকালে হাঁটতে হাঁটতে একটা জায়গায় গেলাম যেখানে পরপর কয়েকটা দোকান আছে। সাইকেল সারাইয়ের দোকানের ওপরের বারান্দায় চোখ যেতেই দেখি একজন সরে গেল। আরে! ওই তো সেই লোক— মোটা গোঁফওয়ালা! মাথায় বরাবরের মতো একটা গামছা বাঁধা, আর মুখে জ্বলন্ত বিড়ি। এই পথে যেতে-আসতে অনেকবারই আমাদের দেখা হয়েছে। কখনও-সখনও দু-একটা সৌজন্যমূলক ‘হ্যাঁহ্‌’ বিনিময়ও হয়েছে। তবে আজ দেখলাম, চোখ পড়তেই বারান্দা থেকে নেমে উনি আমার দিকেই হেঁটে এলেন। আমার জন্যই অপেক্ষা করছিলেন যেন। কে জানে, হয়তো আমাকে অন্য কারও সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেছেন। আমার সামনে এসে এমনভাবে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন, যেন আমি ঠকাচ্ছি কি না প্রথমে সেটাই পরখ করে নিতে চাইছেন। বুড়ো মানুষেরা অচেনা বাচ্চাকাচ্চাদের মুখে যেমন চেনা মানুষজনের সঙ্গে সাদৃশ্য খোঁজে, তেমনি উনি আমার দিকে চেয়ে রইলেন। আমার পূর্বজদের হদিশ লাগাতে চাইছেন যেন। আর আমিও, প্রথমবার, কাছ থেকে ওঁর অনন্যসাধারণ মুখাবয়ব দেখার সুযোগ পেলাম। চামড়া কুঁচকে একটু ঝুলে গেছে, কিন্তু কাঁধের পেশি এখনও যথেষ্ট টানটান। মোটা গোঁফে মুখের অনেকটা ঢাকা। সেই গোঁফের একটি কেশেও পাক ধরেনি। গর্বিত, উদ্ধত মোরগকে যেমন দেখায়, ওই গোঁফটার জন্য তাঁকেও ওইরকমই দেখাচ্ছিল। একমাত্র তাঁর ঈষৎ ভেতরে ঢুকে থাকা পেট আর দুটো পা ফেলায় সামান্য অসামঞ্জস্য থেকেই বোঝা যাচ্ছিল যে বয়স তার শরীরে থাবা বসাচ্ছে।

ওঁর গোঁফজোড়া যদি বশীর বা গোগোলের গল্পের নাকের মতন জাদুকরী হত! আমি মনে মনে ভাবি। হঠাৎ একদিন যদি তার মালিককে বোকা বানিয়ে ওই গোঁফজোড়া কেবলই বাড়তে বাড়তে বিশ্বের একটা বিস্ময়ে পরিণত হয়ে যেত? জঙ্গল সাফ করা জমির আধুনিক অধিবাসীদের কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে জমির পুনর্দখল নিতে থাকা জঙ্গলের মতো? বা, নিদেনপক্ষে, ছোট্ট শিশুদের খেলার উপযোগী দোলনা টাঙানোর দাঁড়ের মতো বড় হয়ে যেত ওই গোঁফজোড়া?

দুপুরে গেছিলাম একটা বই প্রকাশের অনুষ্ঠানে। বইটা লিখেছেন এক সাংবাদিক, যিনি অধুনাকালে খুব একনিষ্ঠভাবে লেখালেখি করছেন। তাঁকেই সংবর্ধিত করে একটা ভাষণ দেওয়ার কথা ছিল আমার। এককালে আমরা যারা উঠতি লিখিয়ে ছিলাম, কোনও নামী পত্রিকায় নিজেদের নাম দেখার সুযোগ তখনও যাদের হয়নি, তারা একযোগে আমাদের ছোট শহরে একটা ঘর ভাড়া করে যার যার নিজের নিজের গল্প, কবিতা এসব পড়তাম। প্রত্যেকেই তাদের রচনার তীব্রতম সমালোচনা বিনা-বাক্যব্যয়ে সহ্য করত, যেহেতু এসব লেখা যে সত্যিই কখনও প্রকাশিত হবে, এ নিয়ে কারও মনের কোনও কোণেই কোনও আশা ছিল না। আমাদের গ্রুপে ছিলেন একজন কলেজবালিকা ও সত্তরোর্ধ্ব এক অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকও। এঁদের দুজনেরই আশা ছিল, যে আমাদের ওই আলাপচারিতার মাধ্যমে এঁদের লেখার মান ক্রমশ উন্নত হবে, এবং একদিন না একদিন নামী কাগজে পত্রিকায় সেইসব লেখা প্রকাশিতও হবে। আজ যে লেখকের বই প্রকাশের অনুষ্ঠান ছিল, সে ছিল আমাদের গ্রুপের সবথেকে প্রতিশ্রুতিবান ও তৈরি লেখক। এর আগে তার কোনও লেখা কোথাও প্রকাশিত হয়নি। কিন্তু বিভিন্ন সম্পাদকের সঙ্গে তার সখ্য ছিল, আর সেই সখ্যবিষয়ক নানান গল্প তার থেকে আমরা হাঁ করে গিলতাম। যাই হোক, এই বই প্রকাশের অনুষ্ঠানে মঞ্চে ডাক পেয়ে আমার বেশ ভালই লেগেছিল, কেননা আমি জানতাম যে আমাদের এই লেখক আমাকে ওই গ্রুপের সবথেকে সম্ভাবনাময় লেখক বলে মানত।

কী বলব না বলব সেসব নিয়ে আমার মনে বেশ একটু উৎকণ্ঠা ছিল। তবুও আমার ধারণা ওই বিশ মিনিটের মতো বক্তৃতায় আমি বেশ কিছু মনোজ্ঞ বিষয় তুলে আনতে পেরেছিলাম। একটা বই প্রকাশের অনুষ্ঠানে বলার সুযোগ পাওয়া মানে কিছুটা যা খুশি বলার ছাড়পত্র পাওয়ার মতোই ব্যাপার। আমিও এই সুযোগে আমার বিগত কয়েকদিনের ভাবনা থেকে কয়েকটা কথা বলে দিয়েছিলাম।

আমার বক্তৃতা শুরু করার সময় দর্শক-শ্রোতাদের সামনে একটা প্রশ্ন রাখলাম। গল্প বা উপন্যাস আমরা পড়ি কেন? একটা ভাল কাহিনিকে উপভোগ করার জন্য, আর কেন— নিজেই নিজের রাখা প্রশ্নের উত্তর দিয়ে আমি বলি। এর বাইরে আর কিছুই হতে পারে না। ছেলেবেলায় পুম্বাট্টা বা অম্বিলিয়াম্মাভন-এর গল্পগুলো পড়া, বা ঠাকুরমার গল্প শোনা, এসব কেন করেছিলাম? শুধুমাত্র ভাল-ভাল কয়েকটা গল্পকাহিনি উপভোগ করার জন্যই নয় কি? ছোটদের গল্পগুলো সাধারণভাবে শেষ হত একটা নীতিকথা দিয়ে। তবে তারও একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল মা-বাপেদের বোঝানো যে গল্পগুলো আদতে ছেলেপুলেদের নৈতিকতার উন্নতিসাধনের জন্যই লিখিত হয়েছে। তা যা হোক, মোদ্দা কথা হল, একটা ভাল কাহিনির সঙ্গে পরিচিত হওয়ার ঐকান্তিক ইচ্ছাই আমাদের পঞ্চতন্ত্রম-এর গল্প বা পোট্টেক্কাড-এর একটা উপন্যাস পড়তে উদ্বুদ্ধ করে। বই পড়লে আমরা রাজনীতি, দর্শন, অধ্যাত্মবাদ, জীবনের নানান খুঁটিনাটি জানতে পারি, তাই বই পড়া ভাল— এসব নেহাতই বাজে কথা। কিন্তু এসব আমরা স্বীকার করি না। আমরা মানেবইয়ের সাহায্য নিয়ে জয়েস-এর ইউলিসিস পড়ব, আর তারপর ভান করব আমরা সেই হাতেগোনা কয়েকজনের মধ্যে পড়ি যারা ইউলিসিস বুঝেছে। এক ঝটকায় বেনিয়ামিন-এর অদুজীভিতম পড়ে ফেলেই তার সমালোচনা করতে বসে যাব। আমার কাছে সবথেকে ভাল গল্প বলতে ওই এক হাজার এক রাতের গল্পগুলো, বা খরগোশ আর কচ্ছপের গল্প, অথবা ওই কুমিরের গল্প যে কী না বাঁদরের মিষ্টি হৃদপিণ্ড খাবার জন্য নানান ফন্দি আঁটছে। এগুলোর মতো আর কোনও গল্পই আমার কৌতূহলকে উন্মুখ করে না। এ-সবই আমি আমার শ্রোতাদের বলছিলাম ওই বই প্রকাশের আসরে।

আমার কথায় কেউ বিশেষ কর্ণপাত করবে না, সে আমি একপ্রকার ধরেই নিয়েছিলাম। যদিও বাস্তবে ঘটল এর উলটো। আমার পরবর্তী বক্তা ছিলেন খুবই আত্মপ্রত্যয়ী ধরনের একজন কলেজছাত্র, আঁটো জিনস আর দামি জামা-টামা পরা। তাঁর শরীরী ভাষা থেকে চুঁইয়ে পড়ছে অদম্য প্রাণশক্তি। ওঁর কিছু কিছু কবিতা আমি সোশ্যাল মিডিয়ায় পড়েছি। আমার যথেষ্ট ভাল লেগেছে।

তিনি শুরুই করলেন ভাইলোপ্পিল্লি-র কুডিয়োড়িক্কাল থেকে একটা অংশের উল্লেখ করে আমার এক-একটা বক্তব্যকে নস্যাৎ করতে করতে। চারপাশের দুনিয়া-বিষয়ে সম্পূর্ণ উদাসীন আহাম্মকেরা কল্পনার কালো ঘোড়ায় চেপে ঘুরে বেড়ায়, ওই অংশে এমনই কিছু ছিল। বক্তার উৎসাহী ভাবভঙ্গি ও গাঢ় কণ্ঠস্বর শ্রোতাদের বেশ সহজেই পেড়ে ফেলেছিল। উনি এত চমৎকার গুছিয়ে বলছিলেন, যে মাঝেমধ্যে মনে হচ্ছিল আমিও ওঁর সঙ্গে একমত হয়ে যেতে চাইছি। নিজেই নিজের দিকে করুণার দৃষ্টিতে তাকালাম। বক্তা শ্লেষ নিয়ে বলছেন— একদিকে লেখকেরা একের পর এক আক্রান্ত হচ্ছেন, খুন হয়ে যাচ্ছেন, আর এদিকে খরগোশ আর কচ্ছপের কাহিনির সাহিত্যগুণ নিয়ে কথার ফুলঝুরি ছোটাচ্ছেন কেউ কেউ। একবার আড়চোখে তাকিয়ে দেখলাম শ্রোতারা সব আমার দিকেই যেন তাকিয়ে হেসে উঠলেন। সামনের সারিতে বসা দুই সুন্দরীকে দেখলাম মুখে কাপড় চাপা দিয়ে শরীর কাঁপিয়ে প্রচণ্ড হাসছেন। মনটা সবিশেষ খারাপ হয়ে গেল। কী প্রচণ্ড নিষ্ঠুরতা! আনন্দের এমনই আতিশয্য, যে তাঁরা ওই মুহূর্তে ওই যুবকের কাছে নিজেদের সমর্পণ করে দিলেও আমি আশ্চর্য হতাম না! এরপর ওই বক্তা যখন বলতে শুরু করলেন, সারা দেশে ফ্যাসিস্ট মানসিকতা ছড়িয়ে পড়ার পিছনে আমার মতো মানুষেরাই দায়ী, দেখলাম সকলে বেশ সন্দেহের চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। ইশকুলে মাস্টারমশাইয়ের থেকে শাস্তি পেয়ে বেঞ্চির উপরে দাঁড়ানো বাচ্চা ছেলেটার মতো মুখে একটা বোকা হাসি এঁটে আমি ওইখানে বসে রইলাম, অনুষ্ঠান যতক্ষণ না শেষ হয়।

অনুষ্ঠানের পর আমায় নিয়ে বিশেষ কেউই মাথা ঘামাচ্ছিলেন না। পরে যখন আমাদের বন্ধু ওই লেখকের সঙ্গে হাত মেলাতে গেলাম, তার মুখের হাসি দেখেই সমস্ত ব্যাপারটা আমার কাছে জলের মতন পরিষ্কার হয়ে গেল।

প্রবল অস্বস্তি আর অপমান ভুলতে বন্ধু জোসেফকে নিয়ে একটা বারে গেলাম। আকণ্ঠ মদ খেয়ে খুব নেশা হল।

—মরুক ওই সবজান্তা ছোকরা! আমিই ঠিক বলেছি। ও তো আবোলতাবোল বলে গেল, আমি বলি। তার আগে মালের চাটের জন্য লেবুর আচার দিতে দেরি করায় এক বেচারা ওয়েটারের ওপর এক হাত নেওয়া হয়ে গেছে। বক্তিমে মারা আমার কাজ নয়। আমার কাজ লেখা। আরে বর্হেস পর্যন্ত বলে গেছেন লেখালেখি কখনওই জীবনের পুরোপুরি কপি হতে পারে না। তার জন্য গল্পে যদি তিনপেয়ে রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারকে দিয়ে সংস্কৃত বলাতে হয়, তাতেও আমার আপত্তি নেই।
—দেখো, তোমাকে আগেও বলেছি, জোসেফ বলে, যদি এসব অনুষ্ঠান-ফনুস্টান থেকে দূরে বাড়িতে বসে থাকো, দেখবে লোকে তোমায় ইন্টেলেকচুয়াল বলছে। আর নয়তো এসব যদি করতেই হয়, তবে এই সমস্ত আজগুবি আলফাল কথা বলা বন্ধ করো। নিজের সম্মান তুমি নিজেই নষ্ট করছ।
—শালা ওর মায়ের ইয়েতে মারি ফ্যাসিজম! সামনে রেখে যাওয়া খাবারের ওপর আমি ঝাঁপিয়ে পড়ি। ওলাসা নারায়ণপিল্লা-র আত্মজীবনীতে একটা কথা আছে, জানলে জোসেফ? প্রকৃত বিপ্লবের বন্দুকের আওয়াজ শুনলে মেকি বিপ্লবীরা দৌড়ে গিয়ে শবরীমালায় আশ্রয় নেবে। বুঝলে? শবরীমালা! কী মোক্ষম কথাই না বলে গেছেন তিনি! তেমনি, আসলি ফ্যাসিজম যখন সামনে এসে নেত্য করবে, তখন এই মাথামোটারাই তার সামনে নাকে খত দেবে। দেখো, তার জন্যে আর বেশিদিন অপেক্ষা করতে হবে না।
—ওলাসা নারায়ণপিল্লা মানে? অভিনেতা ও নাট্যব্যক্তিত্ব এনএন পিল্লা?
—হ্যাঁ, আর কে!
—ওহো! কী একখানা জীবনই না কাটিয়ে গেলেন ভদ্রলোক!
—ওহ! সত্যি ভাই! কী একখানা জীবন, বলো?

আজকাল অবশ্য নারায়ণপিল্লার জীবন আমাকে তেমন টানে না। কিছুদিন যাবত আমি এমন একজনের অতুলনীয় জীবনের কথা ভেবে চলেছি যিনি নিতান্তই একজন সাধারণ মানুষ। তাঁর নাম বাবচন। প্যাপিলন বা রাসকলনিকভ বা চন্থ্রাক্করনের জীবনের থেকে এই বাবচনের জীবন আমাকে অনেক বেশি টানে আজকাল। নীলবর্ণ শৃগালের গল্প বা গালিভারের ভ্রমণবৃত্তান্তের মতো টানটান মনোযোগ ধরে রাখে।

বেশ কিছুক্ষণ পর একটা বাসে উঠলাম। সাইডের সিটে বসে জানলার শাটারটা উঠিয়ে দিলাম। বাইরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে। অন্যান্য প্যাসেঞ্জারেরা গুটিসুটি মেরে জানলা নামিয়ে বসে আছে। ওদের চোখেমুখে যেন ওদের অন্তঃসারশূন্য মনেরই ছবি। নইলে কেনই বা ওরা জানলার ধারে বসে শিশুদের মতন আনন্দে বাইরের দৃশ্য দেখছে না? বাইরের পৃথিবী কেমন করে পরতে পরতে নিজেকে মেলে ধরে, ঘরবাড়ি, গাছ, মানুষ সব কেমন করে পিছনদিকে দৌড়ে চলে যায়, বাসে যেতে যেতে তা-ই যদি না দেখলে তবে বাপু বুঝতে হবে তোমার ওই জীবনটি নিয়ে তুমি একেবারেই হা-ক্লান্ত। হাঁ করে বসে আছ, কবে ষাঁড়ের পিঠে চেপে মৃত্যুর দেবতা কালন তোমায় নিতে আসেন।

বাসটা মান্ননম ব্রিজ পার করলে আমার উত্তেজনা আরও বেড়ে গেল। জানলার বাইরের দৃশ্যে এমন কিছুই নেই যা আমি রোজই দেখতে পাই না। কিন্তু আমার স্থানীয় দৃশ্যপটের বৃষ্টিভেজা চেহারা দেখতে দেখতে মন আমার ভরে গেল। কুট্টোমবুরম-এ বাস থামল। দেখি, স্টপেজের ছাউনির নিচে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি! বাবচন! বিরাট ও পুরুষ্টু গোঁফওয়ালা বাবচন। বৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্য মাথার উপর পাট করে রাখা মোটা গামছা। এই প্রৌঢ়কে বাসে যাওয়া-আসা করতে আমি কখনওই দেখিনি। সব জায়গাতেই যেতে দেখেছি স্রেফ পায়ে হেঁটে। তাও আবার খালি পায়ে, সে যত দূরের রাস্তাই হোক না কেন। বাস চলতে শুরু করতেই আমি এক চিৎকার দিয়ে বাসটাকে থামাতে বলে প্রায় লাফ মেরে বাস থেকে নেমে পড়লাম। দেখি, আমার সহযাত্রীরা জানলার শাটার তুলে আমায় দেখছে। যাক, লোকগুলো বেঁচে আছে অন্তত! এক্কেবারে মরে যায়নি!

ওই গোঁফবাবাজিকে ধরে, অনেক বলেকয়ে আমি কাছেরই একটা তাড়ির দোকানে আমার সঙ্গে যেতে রাজি করালাম। কোণের একটা টেবিলে মুখোমুখি বসলাম আমরা। ওই সন্ধেতেই ধরা স্টকের থেকে দু-বোতল টাটকা তাড়ির অর্ডার দিলাম। আর এক প্লেট মাছের ঝাল।

—পুরনো দিনের কথা কিছু বলুন, আমি বলি।
—কী আর বলব বাবু, গোঁফ বলে। মুখে একচিলতে হাসি। বাবাকাকারা এখন বেঁচে ফিরলে কাণ্ডকারখানা দেখে তাজ্জব বলে যেতেন! মেয়েছেলেরা ইস্কুটার চালাচ্ছে। লোকে সকালে এরনাকুলাম যেয়ে সন্ধের মধ্যে ফেরত চলে আসছে। ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাটে এত্ত আলোর রোশনাই যে রাতকে মনে করি দিন! সকালে সক্কলে দেখি ভালমন্দ খায়। কাঞ্জি আর কেউ খায় না!
—সে তো বটেই! সব কত বদলে গেছে।
—আপনার বাড়ির পাশ দিয়ে যে নালাটা গেছে, তার পাশের বাসরাস্তাটা চেনেন তো? ওটা ছিল ওই নালাটারই একটা ভাগ। হাতদুটো সামনে জড়ো করে এনে গোঁফ বলে, আর ওই পুকুরটা— ওটা ছিল এখনকার তিনগুণ সাইজ। আমি ওখানে শোলমাছ ধরতাম।
—তাই নাকি!

পেচ্ছাপ করতে বাইরে এসে সামনের মাঠে জমে থাকা বিশাল অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থাকি। তাড়ির দোকানটা প্রায় খালি। একটা ঘরে আস্তে করে ভক্তিগীতি বাজছে। রাত অনেক হয়েছে বটে, কিন্তু মোবাইলটা বের করে সময় দেখার ইচ্ছা হল না। গোঁফের সঙ্গে আজ কথা বলতেই হবে, সে রাত বারোটাই বাজুক না কেন। খুব মন দিয়ে কারও কথা শুনলে, তাদের অভিজ্ঞতার কথা হৃদয়ঙ্গম করলে আমাদের আরও একটা জীবন বাঁচার সুযোগ আসে। যে আমাদের একটামাত্র রোলে অভিনয় করতে মঞ্চে পাঠিয়ে দেয়, নাটকের নির্দেশক সেই জীবনকে বোকা বানিয়ে আরও অনেক রোলে অভিনয় করার সুযোগ চলে আসে আমাদের সামনে। অন্ধকারের দিকে আলতো করে একটা শিস্‌ ভাসিয়ে দিয়ে ঈষৎ টলতে টলতে আমি আবার ভিতরে চলে আসি। এসে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে দেখি, গোঁফ ভ্যানিশ! পড়ে আছে শুধু খালি খালি কাচের গেলাস আর তাড়ির বোতল।

—গোঁফ গেল কোথায়? তাড়িওয়ালা চন্দ্রনকে আমি জিজ্ঞাসা করি।
—গোঁফ? সে তো এখানে আসেইনি।
—আরে এই তো এক্ষুনি ছিল। আমরা একসঙ্গে মাল খাচ্ছিলাম।
—ধুর! কী যে বলেন হাবড়িজাবড়ি! আজ আপনার চড়ে গেছে বাবু, আমার কাঁধে আলতো চাপড় মেরে চন্দ্রন বলে। আমি দেখছিলাম যে আপনি হাত-পা নেড়ে নিজেনিজেই কীসব বলছিলেন, আর ভাবছিলাম এত মদগাঁজা খেয়ে খেয়ে আপনার এই অবস্থা হল।
—আরে ইয়ার্কি মেরো না চন্দ্রনচেট্টা। আমরা এইখানেই বসেছিলাম। দেখো, এই তো এই গেলাসটা থেকেই ও মাল খাচ্ছিল।
—কী করে হয় বাবু? গত এক হপ্তা ধরে গোঁফ তো হাসপাতালে! মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।

আমার থেকে টাকা বুঝে নিয়ে চন্দ্রন আমায় বাড়ি পাঠাবার চেষ্টা করে।

দু-রকমের মদ খেয়ে মাথা ধরে গেছে আমার। তবু সেই অবস্থাতেই তিন কিলোমিটার হেঁটে বাড়ি ফিরে এলাম। মনটা বেশ ভাল লাগছে। আজ রাতে ছেলেকে শোনাব একটা জবরদস্ত গল্প। গোঁফের গল্প, যে কী না একইসঙ্গে একাধিক জায়গায় ইচ্ছামাফিক উদয় হতে পারে, আবার মিলিয়েও যেতে পারে যেমন তার খুশি। তার গোঁফ এমন বিশাল, অতিকায় যে তার বাঁকানো প্রান্ত আকাশ ছুঁয়ে যায়। আর তাতে বাসা বেঁধে থাকে একটা বুটিদার ঈগল।

 

[আবার আগামী সংখ্যায়]