সুপ্রতীক চক্রবর্তী
তপন সিনহার “গল্প হলেও সত্যি” ছবিটা মনে আছে??
ধনঞ্জয় চলে গেছিল। বলে গেছিল আর ওর ফিরে আসার দরকারই পড়বে না। মধ্যবিত্ত কুয়াশার ভিতর দিয়ে একেবারে ভ্যানিশ হয়ে গেছিল! ঘরে ফিরে এসে আমরা দেখলাম জন্মান্তরের পাঁক, সেই একইরকম আছে। একান্নবর্তীর জৌলুস ক্ষয় হচ্ছে, দেওয়ালে পিঁপড়ের মিছিল, পিছল উঠোন আর এন্ডলেস বিতণ্ডা!
টনসিল, বেকারত্ব, কুঁচকির ফোঁড়া, জলবসন্ত, হাঁপানি, অম্বল আরও কত মরবিড তুচ্ছতা! এভাবেই পালকগুলো উড়ে চলে গেল সপ্তসিন্ধুর দেশে! আমাদের সাদাকালো টেলিভিশন জুড়ে ধূসর মনস্তাপ! আকাশে হারিয়ে গেলেন কল্পনা চাওলা! গলার কাছে আটকে রইল খরখরে চিঠি! মৃণালের একদিন প্রতিদিন! ইনসিকিওর বাস্তু, ভ্রূকুটি, ভীতু ভালোবাসার গায়ে মর্গের সেলাই!
মন থেকে মুখের দূরত্ব কত! রাস্তায় নীতার চটিটা ছিঁড়ে গেছিল! বারবার ওরকম হোঁচট খাওয়া! এপাশ ওপাশ তাকানো! অতিপ্রাকৃত কিছু অস্বস্তি ঠেলে ঠেলে পাড়ার ভিতর এসে দাঁড়ানো তন্দ্রাহত শরীর! চেনা বাড়িতে অচেনা কোলাহল! ঘরের কোণে রাখা থাকত খিল দেওয়া ব্যাটটা! ধেয়ে আসা ইনসুইঙ্গার স্বপ্ন, তৃপ্তির কভার ড্রাইভ! বড় জ্যাঠার ঘরের দেওয়ালে কপিল দেব প্রুডেনশিয়াল কাপ হাতে হাসতেন! ডেভিড শেপার্ডকে মনে পড়ে, বোর্ডিংয়ের হেডমাস্টারের মতন! এক বিকেলে কাবেরীদি পালাল প্রেমিকের সঙ্গে! ফ্যামিলির মুখে ঝামা ঘষে দিয়ে! কোথায় গেল কেউ জানে না! লাভ ইজ নাথিং বাট অফারিং গ্রিফ! ভালোলাগার অন্ধকার সুড়ঙ্গে হারিয়ে গেল দুজন! তারপর তো কুৎসার মেঘ! উত্তাল উত্তাল! বহুবছর পর ফিরেছিল কাবেরীদি। এক মাথা সিঁদুর! কোলে বাচ্চা! বাপকে এসে বলেছিল “আমায় একটু থাকতে দেবে?”
শোয়েবের একটা স্পেলেই সব হুড়মুড়িয়ে বদলে গেলাম আমরা। সকালে উঠে রোজ একই দ্বিধা! কোন পিচে খেলা হবে? নিতাই যে পিচে খেলতে খেলতে তেন্ডুলকর হতে চেয়েও শেষে হঠাৎ খালাসি হয়ে গেছিল, সেই পিচে? যে পিচে মানুষ মানুষকে ছুৎমার্গ শেখায়? যে পিচে কচি গলায় গান হয় “পাশরিব ভাবনা পাশরিব যাতনা”? যে পিচে জীবন-মৃত্যু, কোনওটারই মন্থন আর হয় না, শুধু একটি বেড়ালছানা চুপচাপ বসে ঝিমোয়, সেটায়? প্রশ্ন! আর দে অ্যাওয়ার অফ আওয়ার ড্রিমস? আর দে? এই নাথিংনেস নিয়ে বেড়ে ওঠা ছায়াছবি, সাদা কালো ধূসর! পাঁজর জড়িয়ে রাখা দলীয় পতাকা, উত্থিত গুন্ডামি, লাম্পট্যের গা-ঢাকা স্বর! “আয় আয় আসমানি কবুতর…”
বড় হয়ে ওঠা গুচ্ছের ঝরা পাতা আর অন্তঃপুরের ফিসফিসানিতে! গেহচর্চা, চূড়ান্ত মুমূর্ষু কোনও গল্পের বাঁকে বাঁকে জলসত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন রবীন্দ্রনাথ। বোন প্রাইজ পেয়েছিল “প্রার্থনা” কবিতাটা বলে। চেনাজানা অনেক মুখেই তখন অবশ রামধনুর ঝলকানি! গার্লস স্কুলের কৃষ্ণচূড়া! আইসক্রিম বার! অপেক্ষা! রিকশার পিছন পিছন, মধ্যবিত্তর মেরি অ্যান! মিডলক্লাস ফিসফাস! রিডিক্যুলাস গসিপিং! পুরো টাল্লি হয়ে নালায় পড়ে থাকা বাপিদা কীভাবে নিজেই জ্যামিতির আঁক কষে কষে, গিজগিজে কংক্রিটের উপপাদ্যগুলো মেলাতে মেলাতে বাড়ির চৌকাঠে গিয়ে দাঁড়াত সেসব গল্প! লক্ষ্মীদি সব বাসন মেজে দেওয়ার পর একটা বাটি মিসিং কেন সেইসব গল্প! অঙ্ক মিলে গেলে ফিসফিস করেই হুররে বলে উঠতাম! ব্রেকিং দ্য হুইসপারস! মরমর শব্দ করতে করতে আমগাছটা ভেঙে পড়ল একদিন! সরিয়ে ফেলা হল! তৈরি হল শূন্যস্থান! আবার সমবেত ফিসফাস, লেট ইট পাস! লেট ইট গো! লেটস টক অন আ ফারটাইল ল্যান্ড! উর্বর জমির গল্প শোনাও! নতুন বিয়ে করা ভাড়াটে দম্পতির টুপটাপ শিশির-সুখ! এক এক করে ঘরের সব আলো নিভিয়ে মশারির ভেতর ঢুকে যাওয়া ইনট্রোভার্ট লোকটা, বাবার মতো দেখতে! সারা সন্ধ্যা তবলা বাজিয়ে বাজিয়ে, শক্ত হয়ে গেছে আঙুলগুলো। কমন ইউরিনাল, কমন পায়খানা! কমননেস! কালচে হাঁড়ির ভিতর গুষ্টির ক্ষুধা! ঝম্পক আর ঝাঁপতাল এক নয়! লালকালিতে রি-রাইটিং! তালের ওপর তাল, বোলের ওপর বোল! একটু বেসুরো হলেই ব্রহ্মতালুতে গাঁট্টা! ঘুপচি দোকানগুলোতে হেরে যাওয়া লোকগুলোর আদিরস বিস্তার, বিড়ির ধোঁয়া! ধোঁয়ার সর! হদ্দ পুরনো ম্যাগের পিছনে সাবান হাতে মীনাক্ষি শেষাদ্রি! আচমকা সাফল্যে সেই কোনকালে দু-আধখানা হয়ে যাওয়া লোকগুলো, দেরাজে ধুলো পড়া মলিন প্রাইজ-মেডেল! ফ্রিজড শট হয়ে থেকে যাওয়া জড় স্বীকৃতি!
আলিপুর-ফেরতা বাসে দেখা হল সংযুক্তার সঙ্গে। ওর মায়ের ক্যানসার জানতাম। “কেমন আছেন কাকিমা?”, জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে সংযুক্তা বলল “মা আর নেই।” মা আর নেই! হু হু ব্যথা! বাসের তুমুল স্পিড! জানলা দিয়ে সরে যাওয়া মাঠ, আকাশ, ঢেউয়ের মন্তাজ! শানুর চটুল হিন্দি গান! সংযুক্তার পার্সে ওর মায়ের হাসিমুখের ছবি। স্মাইলিং ফেস ইজ আ ডিভাইন ফেস! থমকে থাকা হাসি! আমাদের সবার ঘরেই এমন কত মানুষ চলে যাওয়ার পরেও হাসছেন! ছবির ভিতর! অনন্ত ঘুমের ভিতর! হাসি! সুখের স্টিল শট! এই তো! হাসিটুকুই রেখে যায় মানুষ! চলে যায় অলৌকিক এক উষার দিকে! আদিম চড়ুইপাখির মতো।
একদিন উঠোন বলে আর কিছু থাকল না। বৃত্তের ক্ষেত্রফলের সূত্র ভুলে গেলাম। একসঙ্গে, ধাপে ধাপে উপর নীচ ওঠা হল! নীচতলা আর ওপরতলার মার্জিন! পাশাপাশি যারা ছিল তারা হয় মাথার ওপরে উঠল নয় পায়ের নীচে নেমে গেল! মাথাগুলো ঝুঁকে গেল! ডানে বাঁয়ে, সবদিকেই স্পষ্ট হল, ভার্টিকাল কমউনিকেশন! টপ টু বটম! বটম টু টপ! মাথা উঁচিয়ে নয়তো মাথা ঝুঁকিয়ে! নো মোর হেডস ইন দ্য হরাইজন! মফস্বল থেকে প্লেন ওড়ানো হবে বড় শহরে! গোধূলি গায়ে মেখে উড়ে বেড়াত উদ্বাস্তু পাখিগুলো! গোল হয়ে উড়ত, উড়েই যেত! পুরনো চটি জুতো ছাতা চশমা আর টেলিভিশনের সামনে টান টান হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মধ্যবিত্ত খুচরো পাপ! বাবার কুঁচকে যাওয়া গাল, গলার চামড়ার সামনে, মায়ের তেত্রিশ বছরের স্যাক্রিফাইজের সামনে ছুড়ে দেওয়া ব্যক্তিগত জার্নাল! পারিনি! পারিনি! কিসসু পারিনি! শুধু ফিসফিস শুনেছি, আর দেখেছি ভালোবাসায় ক্ষতবিক্ষত একটা মানুষ সময় হাতড়ে হাতড়ে হুমড়ি খেয়ে মরে যাচ্ছে রাস্তার মোড়ে! ইনস্যানিটি! ভ্যানিটি অফ ইলিউশনস! সমস্ত দিনের শেষে দেখেছি কর্পোরেট লোকটা ঘরে ফিরে এক এক করে কোট প্যান্ট টাই ছাড়ে। ছেঁড়া লুঙ্গি পরে নিয়ে কলতলায় গিয়ে ঘাড়ে-মাথায় ছপ ছপ করে জল দেয়। তারপর একটা ধূপকাঠি জ্বালিয়ে ঘরের কোণে রাখে! তারপর সিগারেট… হুইস্কি… হাই… ঘুম… কিংবা ঘুম না এলে ফেসবুক মিম বা পর্ণহাব! এটাই ইনডিভিজুয়ালিটি! ফুরায় বেলা ফুরায় খেলা। টিঙ্কুর লটারিগুলো টেবিলের ওপর ফর ফর করে হাওয়ায় ওড়ে। কুকুরগুলো খোঁড়ায়। মা ভাত বেড়ে ডাকে। আর আমি টের পাই আমার ট্রেনটা অনেকক্ষণ দাঁড়িয়েই আছে। সিঙ্গল লাইনের জন্য, আরেকটা না ঢুকলে এটা ছাড়বে না! যে যার ব্যক্তিগত ক্রসিংয়ে ঠায় দাঁড়িয়েই আছে সিগন্যালের অপেক্ষায়! প্যারাডিসোর প্রতীক্ষায়!
আর বাকি সব গল্পকে সত্যি করে সামনে দিয়ে হেঁটে চলে যায় ধনঞ্জয়। যে কোনওদিন কখনও আর এ তল্লাটে আসবে না। দরকারই পড়বে না!

