স্টেশনমাস্টারের কলম
…এই লুম্পেন সংস্কৃতিকে আমরা অস্বীকার করি। আমাদের রাজ্যে জাত, বসবাসকারী, ভ্রমণকারী প্রতিটি নারীর সুরক্ষা ও সম্মান রক্ষার দায়িত্ব রাজ্যের নির্বাচিত সরকারের। অন্য সমস্ত সাংবিধানিক দায়িত্বের পাশাপাশি নারীসুরক্ষার এই মৌলিক দায়িত্ব রাজ্যের শাসককে পালন করতেই হবে। এ কোনও আবেদন নয়, এ হল সাধারণ মানুষের গণতান্ত্রিক দাবি। এই সহজ কথাগুলোই সজোরে আমরা মনে করিয়ে দিতে চেয়েছি আরেকবার, চার নম্বর প্ল্যাটফর্মের জুলাই সংখ্যার প্রচ্ছদভাবনায়, যার শিরোনাম: অদ্ভুত আঁধার— আরজিকরের এক বছর। আমাদের এই কথাগুলি কে শুনবেন আমরা জানি না, কিন্তু আমাদের চিৎকার করে যেতেই হবে।…
চলমান ইতিহাসে কখনও কখনও এমন সময় আসে, যখন মনে হয় চারিদিকে এত বেনিয়ম, সমাজে এত বিশৃঙ্খলা, সংস্কৃতিক্ষেত্রে এমন দিশাহীনতা যে এর থেকে আদৌ কোনওদিন আমাদের পরিত্রাণ হতে পারে, সে-কথা ভাবতেই পারা যায় না। হতাশা এমনভাবে আসে, মনে হয়, এ নিয়ে আর একটি শব্দ খরচা করাও অর্থহীন। অবশ্য প্রতিবাদ-প্রতিরোধের কথা ধারাবাহিকভাবে বলে চলেন কয়েকজন, ভুল হল, কয়েকজন নয়, অনেকজনই— রাতদখল আন্দোলনের স্বতঃস্ফূর্তি ও জনযোগদান তো সাম্প্রতিকালে অভূতপূর্ব। অথচ কোথাও যেন তার কোনও প্রভাব নেই, অপরাধীর কাছে ভয় বা বিবেকদংশন বলে আসলে কিছু হয় না, সর্বব্যাপী কুনীতি আর নৈতিকতার অবক্ষয়ের কোনও প্রতিকার নেই, যা চলছে, তাই-ই চলবে— আজ ও সুদূর ভবিষ্যতে এই নরকদর্শনই পশ্চিমবঙ্গবাসীর ভবিতব্য।
রাধাগোবিন্দ কর নামাঙ্কিত হাসপাতালে মর্মান্তিক ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনার বর্ষপূর্তির দিকে এগোচ্ছি আমরা, যত এগোচ্ছি, ততই ‘উদযাপনের’ অতিরিক্ত রসদ হিসেবে সঙ্গে জুড়ে যাচ্ছে রাজ্যজুড়ে একের পর এক হেনস্থা, শ্লীলতাহানি ও নারীনির্যাতনের খবরাখবর, যার শেষতম সংযোজন কসবা আইন কলেজে গণধর্ষণের ঘটনাটি। প্রশ্ন উঠতেই পারে, ধর্ষণ বা নারীনির্যাতনের ঘটনা কি আমাদের রাজ্যে নতুন? পার্ক স্ট্রিট, কামদুনি বা তারও আগে তাপসী মালিকের কথা কি আমরা ভুলে গেছি? তা তো নয়। আর শুধু পশ্চিমবঙ্গের দোষ হবে কেন, গোটা ভারতবর্ষ তো বিশ্বমানচিত্রে ধর্ষণ রাজধানীর স্থান পেতে চলেছে। আমাদের দেশে ঘটে যাওয়া অপরাধের মধ্যে প্রতি চতুর্থ অপরাধ ধর্ষণ। এদেশে প্রতিদিন গড়ে ৮৫টি ধর্ষণের ঘটনা নথিবদ্ধ হয়, অর্থাৎ ভাবলে শিউরে উঠতে হবে, এই সামান্য সম্পাদকীয় ভূমিকাটি লেখা শেষ হওয়ার আগেই ভারতবর্ষে একটি-দুটি ধর্ষণ ঘটে যাওয়া সম্ভব।
তাহলে ধর্ষণের জীবন্ত সংস্কৃতি যখন আমাদের সুমহান দেশে এমনিতেই বিদ্যমান, পশ্চিমবঙ্গ তা থেকে আলাদাই বা হবে কেন? লজ্জাজনকভাবে সত্যি, সংস্কৃতি ও সামাজিক মানসিকতার দিক থেকে তুলনামূলকভাবে এগিয়ে থাকার দাবি করা বাঙালি আসলে আলাদা নয়, তার ওই আত্মশ্লাঘা শূন্যগর্ভ। তা সত্ত্বেও আমাদের রাজ্য আশঙ্কাজনকভাবে আলাদা, বিশেষত অন্য রাজ্যের ঘটে চলা শ্লীলতাহানির ঘটনাগুলির চেয়ে, কারণ নিশ্চিতভাবে দেখা যাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের ধর্ষণগুলির অধিকাংশ অভিযুক্তরাই, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে, ক্ষমতা-ঘনিষ্ঠ। ক্ষমতাপ্রদত্ত সেফটি নেটের ভিতরেই এ-রাজ্যের সকল আইনভঙ্গকারীদের স্বচ্ছন্দ বিচরণ। যেমন অভয়াকাণ্ডে ময়না তদন্তের আগেই ধর্ষিতার দেহ সৎকারের জন্য শাসক দলের নেতাকর্মীদের যুদ্ধকালীন তৎপরতা দেখা গিয়েছিল, অথবা যেভাবে ঘটনার অব্যবহিত পরে আইনের তোয়াক্কা না করে নজিরবিহীনভাবে ঘটনাস্থলের একটি-দুটি ঘর ভাঙা হল অর্থাৎ প্রমাণ বিলোপ করা হল, যেভাবে অনিয়মের দায়ে অভিযুক্ত আধিকারিককে সাসপেনশনের মাত্র ২৪ ঘন্টার মধ্যে তড়িঘড়ি নতুন পদ উপহার দেওয়া হল, তাতে ধর্ষণকাণ্ডে অভিযুক্ত ও সহযোগীদের ক্ষমতার অলিন্দে যোগসাজশের প্রশ্নটি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়। একইভাবে, কসবা আইন কলেজ গণধর্ষণের মূল পাণ্ডা হলেন কলেজের প্রাক্তন ছাত্র, ছাত্রনেতা ও কলেজেরই অস্থায়ী সাফাইকর্মী। কলেজে তোলাবাজি, ইউনিয়ন রুমে ডেকে নিয়ে ধারাবাহিক নারীনিগ্রহ, হেনস্থা ইত্যাদির মধ্যে ঠিক কোন কাজটি সাফাইকর্মের আওতায় পড়ে তা আমাদের জানা নেই, নিশ্চয়ই কলেজ কর্তৃপক্ষের জানা ছিল, না হলে অভিযুক্তের কাজের চুক্তি প্রতি পঁয়তাল্লিশ দিনে বিনাপ্রশ্নে বিনা তাগাদায় নবীকৃত হত কী করে? পশ্চিমবঙ্গের সরকারি কলেজগুলি ঘুরলে যে কলেজের ছাত্র সংসদে এমন অনেক তোলাবাজ ‘মোলেস্টর’ সাফাইকর্মী পাওয়া যাবে, তা বলাই বাহুল্য। আসলে এ-রাজ্যে ক্ষমতায় আসার পর পরই ‘ঘরে ছেলে ঢুকিয়ে দেওয়ার’ সংস্কৃতির যে চাষ-আবাদ শাসকদল শুরু করেছিল, এতদিন সেই বিষবৃক্ষ সর্বত্র শাখাপ্রশাখা ছড়িয়ে ফলদান শুরু করেছে।
এইখানে বলে রাখা দরকার, পশ্চিমবঙ্গ যে বর্তমানে নারীনির্যাতন ও ধর্ষণের অভয়ারণ্য হয়ে উঠেছে, তা রাজ্যজোড়া সর্বব্যাপী পচনের একটি প্রকট উপসর্গমাত্র। এই রাজ্যে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কর্মসংস্থান, নিযুক্তি, পরিষেবা— পাবলিক ওয়ার্কস-এর প্রতিটি ক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে পাহাড়প্রমাণ দুর্নীতি ও স্বজনপোষণের অভিযোগ। দলীয় পতাকাবাহকদের পাইয়ে দেওয়ার নীতি ও সিন্ডিকেটরাজ পশ্চিমবঙ্গে গত কয়েক দশক ধরেই এক ভয়াবহ লুম্পেন সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছে, আজ পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ, যেখানে একজন সাধারণ মানুষের পক্ষে সততার সঙ্গে সম্মানজনক জীবনযাপন করা কার্যত অসম্ভব। এই রাজ্যে যেনতেনপ্রকারেণ শুধুমাত্র শাসকের স্বার্থরক্ষা করে যেতে পারলে আমার সব হবে; সম্পদ চাইলে সম্পদ হবে, ক্ষমতা চাইলে ক্ষমতা, নারীমাংস চাইলে, তাও। একের পর এক প্রশাসনিক ব্যর্থতা সত্ত্বেও শুধুমাত্র ডোল রাজনীতির ওপর ভর করে অপদার্থ এই সরকার একের পর এক ভোট বৈতরণী পেরিয়ে যাচ্ছে। আর সমস্ত ধরনের ব্যর্থতার প্রশ্নে সরকারের কাছে রয়েছে একটিমাত্র দাওয়াই— বিনোদন। ছুটি, উৎসব ও কার্নিভালের জাঁকজমকে ডুবিয়ে দেওয়া হচ্ছে আশেপাশের সমস্ত অন্ধকার। নাহলে নির্লজ্জতার কোন সাবলীল শিখরে পৌঁছলে প্রশাসক ব্যথিত, ক্রুদ্ধ রাজ্যবাসীকে বলতে পারেন— প্রতিবাদ তো অনেক হল, এবার উৎসবে ফিরুন।
আবারও এক উৎসব আসন্ন। খুঁটিপুজো সারা। ম্যারাপ বাঁধার কাজ চলছে জোরকদমে। আর কয়েকদিনের মধ্যে ক্লাবে ক্লাবে পৌঁছে যাবে দুর্গাপূজার সরকারি ভাতা বা অনুগ্রহ, অনুগত থাকার ও মুখ বন্ধ রাখার জন্য রাজ্যের যুবসমাজকে বার্ষিক বকশিস, শিরদাঁড়া বিক্রির দাম। এ রাজ্যে নিত্যনতুন অভয়া জন্ম নেবে, স্কুলে-কলেজে-কর্মক্ষেত্রে-রাস্তাঘাটে তাঁদের নিয়মিত ধর্ষণ করা হবে, ক্ষেত্রবিশেষে হত্যা করাও হতে পারে। আমরা একের পর এক মোচ্ছবে ডুবে যেতে যেতে আর তাঁদের কথা ভুলে যেতে যেতে গেলাসে গেলাস ঠেকিয়ে আমরা আনন্দে চিৎকার করে বলে উঠব— পশ্চিমবঙ্গ একটি প্রমোদ তরণী… হাঃ হাঃ!
এই লুম্পেন সংস্কৃতিকে আমরা অস্বীকার করি। আমাদের রাজ্যে জাত, বসবাসকারী, ভ্রমণকারী প্রতিটি নারীর সুরক্ষা ও সম্মান রক্ষার দায়িত্ব রাজ্যের নির্বাচিত সরকারের। অন্য সমস্ত সাংবিধানিক দায়িত্বের পাশাপাশি নারীসুরক্ষার এই মৌলিক দায়িত্ব রাজ্যের শাসককে পালন করতেই হবে। এ কোনও আবেদন নয়, এ হল সাধারণ মানুষের গণতান্ত্রিক দাবি। এই সহজ কথাগুলোই সজোরে আমরা মনে করিয়ে দিতে চেয়েছি আরেকবার, চার নম্বর প্ল্যাটফর্মের জুলাই সংখ্যার প্রচ্ছদভাবনায়, যার শিরোনাম: অদ্ভুত আঁধার— আরজিকরের এক বছর। আমাদের এই কথাগুলি কে শুনবেন আমরা জানি না, কিন্তু আমাদের চিৎকার করে যেতেই হবে।
এই সংখ্যার জন্য কলম তুলে নিয়েছেন মেয়েরাই, লিখেছেন— প্রতিভা সরকার, আইরিন শবনম, তৃষ্ণা বসাক, খালিদা খানুম, সায়নী ব্যানার্জি, এবং উপমা নির্ঝরণী।
সঙ্গে রয়েছে যাবতীয় নিয়মিত বিভাগ…

