Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

মেলা, মেলা দিয়ে শুরু

মেলা

সম্বিত বসু

 

করুণাময়ী-সল্টলেক, করুণাময়ী মা কালী— এরকমটাই শুনতাম। এখন বইমেলাকে সত্যি সত্যিই ‘করুণাময়ী’ বলে মনে হয়।

বাস থেকে করুণাময়ী নামতেই মনে পড়ল দু’বছর আগেও সেক্টর-থ্রিতে একটি পত্রিকায় কাজ করতাম। তখন অনেক দিন হেঁটে কিংবা রিকশা করে আসতাম করুণাময়ী। আজ সেই করুণাময়ীর রোদে মেলার গন্ধ। ভিড় জড়ানো পা। লাল, নীল, হলুদ, সবুজ— হাজারো পাজামা-জিন্সের যাত্রাপথ বাঁদিকে চলে যাচ্ছে।

আমার এক বন্ধু, অতিপ্রিয় বন্ধু করুণাময়ী বাসস্ট্যান্ডের একটি চায়ের দোকানে ছাতা হারিয়ে ফেলেছিল। নেমে মনে হল, জিগ্যেস করব কি না, আমাদের মনে আছে? বছর দেড় আগে দু’কাপ চা খাওয়ার পর, আমদের বসে থাকা বেঞ্চে ছাতা ছেড়ে গিয়েছিলাম। সেই ছাতা আজ কাকেই বা ছায়া দিচ্ছে? সেই ছায়া প্রকাশিত হওয়ার কোনও সুযোগ আর নেই।

বইমেলার গান ‘বই আসছে বই’। শুনলে মনটাই অন্যরকম হয়ে ওঠে। আজ বলে না। অনেক দিনই। এই গান অন্য কোনও দিন শুনি না। শুধু মেলার মাঠে। কিন্তু আমি নিশ্চিত এই গান যদি কেউ ইউটিউবে শোনেন, তিনি চোখ বন্ধ করে বেশ কয়েকটা বই কিনে চোখ খুলে ফেলতে পারবেন।

প্রথমেই দুম করে ঢুকে পড়িনি। বাইরে থেকে তাকিয়ে দেখেছি কমলা গেট। কলকাতা পুস্তকমেলা। তারপর এককাপ লেবু চা। নিকোটিন শরীরে ছড়িয়ে দিতে দিতে, বিকেলের মেঘে সামান্য অবদান রাখলাম।

মেলা ঢুকলেই নিজেকে আর চিনতে পারি না। তখন শরীর ঝমঝম করে। এত বই। এত স্টল। গান। ঘোষণা। লোকজন। মাথায় বিজ্ঞাপনী-টুপি। গায়ে কারও শাল, সোয়েটার। কেউ বা বসন্তে ঢুকে পড়েছে। কেউ শীত এখনও পেরতে পারেনি। লেটে রান করছে। এখন যা সময়, তা অবশ্য সকালে শীত, দিনে বসন্ত, রাত্রে শীত।

মেলায় ঢুকে পড়লে অবশ্য সমস্ত মেলার কথা মনে পড়ে। মানে জীবনে যা যা মেলা কাটিয়ে এসেছি। বন্ধুদের মুখ, মুখে ব্রণ, সিগারেট, বয়সে বড়-ছোট বন্ধু। কেউ কেউ সদ্য-বেরনো কাগজ নিয়ে বিলি করছে। তারা ছোট, নতুন। কাগজের মাথায় এলোমেলো করে লেখা কাগজের নাম। কিন্তু তা মায়াবী। বইমেলার ভিতর ঢুকে পড়েও যেদিন এগুলো পাওয়া যাবে না, সেদিন কি আর বইমেলা থাকবে?

ধুলো ওড়ে। ধুলোর ভিতর ওড়ে বন্ধুকণা। যেতে যেতে বিশ্রাম পালের সঙ্গে দেখা হল। বিশ্রাম বলল, সাবধান। আমি বললাম, বলো কী বিশ্রাম!

সকালে গদ্যকার অনিন্দ্য সুন্দর রায় বাড়ি এসেছিল। সে বলল, স্বপ্নে দেখেছে আমি আর ও রামের বোতল থেকে ঢকঢক করে রাম খাচ্ছি। এবং ঘুম থেকে ওঠে ওর এখনও নেশা ডগবগে। বইমেলায় যাওয়া অনেকটা এরকম, রোজ হয়তো যেতে পারছি না, অন্যরা যাচ্ছে কিন্তু তাদের যাওয়াটাই আমার যাওয়া। লোকে গঙ্গার জল, পুণ্যের জল নিয়ে রাখে। বইমেলার একটু ধুলোও নিয়ে রাখা উচিত মনে হয়। সারা বছর সেই ধুলোর উপর হাত বুলনো। সেই ধুলোয় একটু কাল পেতে হইহল্লা শোনা। বন্ধুদের ডাক। হাসি-ইয়ার্কি-ঠাট্টা।

পৃথ্বী (বসু) অনেক দিন ধরেই স্টলে বসে। বিল লেখে। সম্পাদনা করে দশমিক নামের কাগজটি। ও বলেছিল যে, বিল লেখা নিয়ে একটা গদ্য লিখবে। লিখেওছিল। বোধহয় হারিয়ে ফেলেছে। লেখার বিষয়, তাড়াহুড়ো করে লেখা বিল। যাতে কোনও যত্ন নেই। বই হওয়ার যেমন যত্ন আছে, বই দেওয়ার, কেন বিল লেখার সময় সেই যত্ন থাকবে না! কবির অভিমান দিয়ে চিন্তা করা, বইয়ের পাতার শিরায় যাতায়াত করে বলেই হয়তো এমনটা ভাবতে পেরেছিল ও। ওকে দেখলাম আজ। পাঞ্জাবির উপর কালো সোয়েটার পরে। কথা হল। লুকিয়ে সিগারেটও হল। খেটেখুটে চমৎকার একটা বই করেছে: প্রিয় লেখক প্রিয় বই। প্রচ্ছদ করে দিয়েছেন প্রণবেশ মাইতি। সম্পাদনা: প্রশান্তদা (মাজী)।

তারাপদ রায় একবার বইমেলার রোজদিনের ঘোরাফেরা নিয়ে লিখেছিলেন— দিব্যি মনে আছে। মনে পড়ছে ‘প্রতিক্ষণ’-এর ছোট কয়েক পাতার কাগজ। বইমেলা এলে এই ইতিহাস আমরা যেন ভুলে না যাই। ক’দিন আগেই ভেসে উঠেছিল ’৯৭ সালের আগুন ধরে যাওয়া বইমেলার দৃশ্য। ভয় পাইনি। স্তব্ধ হয়েছিলাম। ইতিহাসে কী ঘটে গিয়েছে, তার জন্য ভয় পাই না।

সেলিম (মণ্ডল) কি ‘তবুও প্রয়াস’ থেকে গোপাল ভাঁড় সংখ্যাটা বের করতে পারল? সুস্নাতদা (চৌধুরী) ‘বোধশব্দ’-র গল্প সংখ্যাটা? ওদিকে অরিজিৎদা ‘কণিকা সাহিত্য পত্রিকা’-র গল্পসংখ্যা নিয়ে একটু পরেই ঢুকে যাওয়ার কথা। কীরকম যে দেখতে হল সেটা!

এই যে চারপাশে এত লোক, এত প্রকাশনীর প্লাস্টিক ও তার ভিতরে বইয়ের স্পষ্ট আভাস, এই আভাসের চর্চা আমরা চিরকাল যৌনত্তেজনা নিয়েই করে এসেছি। সেই আভাসচর্চার এই মাঠে এসে পাল্টে যায় বইয়ে। সুপ্রিয় (মিত্র) লিখেছে ‘বেরিয়ে পড়ার ট্রেলার’। ‘ধানসিড়ি’র বই। বলার বিষয় গান। লোকে কী গান শুনছে তার ইয়ারফোনে, রাস্তায় যেতে-আসতে, তার আভাস, আন্দাজ করা। আমিও কি বইমেলার ভিড়ে এর-ওর প্লাস্টিকের ভিতর সেই আন্দাজের তীরন্দাজ হয়ে যাচ্ছি না?

রঞ্জনদার কথা মনে পড়ে খুব। রঞ্জনদা মানে ‘নাটমন্দির’-এর রঞ্জন আচার্য। শেষ বই ‘সম্পর্ক’। নিজেকে নিয়ে কখনও ভাবিত নয়। সেই পুরুলিয়া থেকে এক নাগাড়ে ধরে ধরে চমৎকার সব বই করে চলেছেন। কিন্তু তাঁর কবিতা কি পাঠকের নিবিড়তা দাবী করে না? পুরুলিয়ার এই সান্তাক্লজকে দেখলে আমার মন ভাল হয়ে যায়। একদল শুরু শুরুতেই এসে পড়ে না বলে আজ রঞ্জনদার সঙ্গে দেখা হয়ে উঠল না। দেখলাম কৃষ্ণকে, জিশানকে। স্টলে বসছিল। হাসল। হাসলাম। এইটুকু দেখাতেই আনন্দ!

লিটল ম্যাগাজিন মেলার আশপাশে যেমন ছোট্ট একটা জায়গা বরাদ্দ থাকে, এবারেও সেরকম। যেরকম জায়গায় দাঁড়ালে ছোটকাগজের ফ্লেক্স দেখে দেখে, বন্ধুদের তাকানো, হাত নাড়া ও কথা বলা দেখে জীবন সালটে নেওয়া যায়। একটু গুছিয়ে তোলা যায়। আকাশ (গঙ্গোপাধ্যায়) এতই বদ, যে ওর ‘মাস্তুল’-এর ফ্লেক্সের তলায় লিখে রেখেছে ‘কপি পাঠাব।’ ‘কপি পাঠিও’ কথাটি ছিল এক ক্ষুধার্ত কবির জনপ্রিয়তম লাইন। হয়তো তাঁর কবিতার থেকেও তরুণরা তাঁকে এই বাক্যে চেনে। তাছাড়াও এই লাইনের অমোঘ বর্তমান তাৎপর্যও বাদ দেওয়া যায় না। মাস্তুল-আঙ্গিক-এর হইচই আমার ভাল লাগে। এই বন্ধুত্ব, কাগজের মধ্যে দিয়ে ঢুকে বসন্তের বিছানায় এসে পড়ুক।

বইমেলায় এলে দুটো জিনিস আমার হয়। হঠাৎ করেই গরম লেগে যায়। জুলপির পাশ দিয়ে নুন জমে যায়। মুখ খানিক লালচে হয়ে ওঠে অনবরত হাঁটাহাঁটিতে। তখন জল খাই। সেই জল, অন্য কোনও জলের মতো না। দ্বিতীয় জিনিস হল, খিদে। কারণ ঢুকি এক্কেবারে মেলা শুরু হওয়ার সময়। ফাঁকা থেকে ভরাট হয়ে ওঠা মেলা দেখতে যে কী ভাল লাগে। কিন্তু খিদে পায়। সব সময় যে খাই তা নয়, এর-ওর সঙ্গে একটু একটু করে কাটিয়ে কোথায় যে চলে যায় খিদে! কে জানে!

আজ সন্ধে পড়তে পড়তেই ঠান্ডা একটা হাওয়া এল মেলায়। এমনই ঠান্ডা হাওয়া, যে মনে করিয়ে দিল, আসলে শুরু হয়ে গিয়েছে মেলা, আর মোটেই আমি যাইনি। যেতে পারিনি। আসলে এই পুরো, পুরোটাই আমার দ্রুত চিন্তাভাবনা। অফিসের ফাঁকে বসে উল্টোপাল্টা ভাবা। কি-বোর্ডে হাত রেখে মেলার ভিতর ঘুরে বেড়ানো। বাচ্চাদের মাথার চুল ঘেঁটে দেওয়া। কারও টিফিনের রুটি ছিঁড়ে খাওয়া। কখনও হনহন করে হেঁটে যাওয়া সুবর্ণরেখার স্টলে, পুরনো বইয়ের আশায়। জড়িয়ে ধরা বন্ধুদের। নতুন বই হাতে তোলা। ছুঁয়ে যাওয়া লিটল ম্যাগাজিনের টেবিল।

অথচ এসব কিছুই হয়নি। এসব মনখারাপ। গুলতাপ্পি।