Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

চক্রপাক

হারুণ রশিদ

 

কোনও সুগভীর আঘাত আহত করেনি এখনও, তাই ভালো আছি। আমি আশাও করি না বাকিটা জীবন বর্তমানের মতো নিরুপদ্রপ কেটে যাবে। এখানে ওখানে ওৎ পেতে থাকা সত্য মুখোশের মিথ্যেবাদীরা থাবা বসিয়ে দেবে যে কোনও দিন। প্রিয় মানুষেরাও একদিন অচেনা হয়ে যায়, তাও আমি খুব ভালো করে জানি। সময় যা গ্রাস করতে পারেনি, গ্রাস করে নেয় সমাজ। সসঙ্কোচে বেঁচে থাকাটাও কখনও কখনও জরুরি হয়ে যায়। পালিয়ে থাকা যে কাপুরুষেরা বাস করে আমাদের গভীরে, সেখানে সব অন্ধগলি একই সূত্রে গাঁথা। কেউ কেউ মাটির বদলে আকাশে বৃক্ষরোপণ করে অতৃপ্তি রোধের চেষ্টায়। আকাশ অঝোরে বর্ষণ করে তবু সে বৃক্ষে না হয় ফল, না হয় ফুল। নিষ্পত্র মিথ্যা চাষবাস অবশেষে মৃত জনপদে হারিয়ে যায়। সর্বশেষ যে জেগে ছিল তারও ঘুম পেয়ে যায়। তৃষ্ণারা আজ মরে গেছে। বিকল হয়েছে চেতনা। এই সময়টা আমার খুব চেনা। আগেও ছিল, আবার এসেছে ফিরে এই বৃষ্টি দুপুরবেলা।

পাশে একজন এসে ধুপ করে বসতেই চিন্তার সুত্র ছিঁড়ে যায় শাহেদের।

লোকটা বেশ স্বাস্থ্যবান, পেশীবহুল না হলেও টান টান শরীর। এক ধাক্কায় বসে শাহেদকে জানালার সাথে চেপে ধরল প্রায়।

লোকটার দোষ নেই। এই বাসটার সিটগুলোই এরকম। কোনওমতে দুজন শুটকো লোক বা বাচ্চা ছেলে বসতে পারলেও পরিপূর্ণ বয়স্ক দুজন বসা খুব মুশকিল। হাঁটু ভাজ করে বুকের কাছে না আনলে সোজা থাকা যায় না। লোকটার আগমনের পূর্ব পর্যন্ত দুই পা চেগিয়ে আরামেই বসেছিল শাহেদ।

বাসের কন্ডাকটর তোবড়ানো বডিতে থাবড়া মারতে মারতে চিৎকার করছে, “……ও-ই, হ-ইইইই, হাটগর, হাটগর….. ফোন্দোরো লম্বর, ফোন্দোরো লম্বর, ফোন্দোরো…….”

বারেক বিল্ডিং চলে এলে গাড়িটা ডানদিকে মোড় নেয়। এবার বৃষ্টির ছাট সরাসরি গায়ে এসে পড়ছে তার। বাতাসও আছে বেশ। সিগন্যাল দিয়েছে সাগরে? শার্টের কাঁধ ভিজে যাচ্ছে। কিন্তু সরে বসার উপায় নেই। পাশে সাক্ষাত দৈত্যটা পিষে ফেলছে তাকে। দৈত্যের শরীরের অর্ধেকটা সিটের বাইরে। সে উঠে দাঁড়িয়ে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েও আটকে গেল। লোকটার বিশাল শরীর ডিঙিয়ে ওঠাও যাবে না। লোকটাকে সরতে বলতে গিয়ে অবাক। এরই মধ্যে ঘুম? নাক ডাকছে তার। এই বেকায়দা আসনে বসে কেউ ঘুমোতে পারে শাহেদ ভাবতেই পারল না।

সে কখনও কোনও অচেনা লোককে ঘুম থেকে ডাকেনি। কীভাবে ডাকতে হয় বুঝতে পারছে না। ‘এই যে ভাই’ বলাটা কি ঠিক হবে? নাকি গায়ে হালকা একটু ধাক্কা। নাহ, সাহস হয় না ওর।

এমন সময় বাসটা একটা বেমক্কা ব্রেক কষল। শাহেদ একটুর জন্য প্রায় উড়ে যেত সামনের সিটে। কোনওমতে সামনের রেলিং ধরে সামলেছে। কিন্তু পাশের দৈত্যাকার লোকটা এক সেকেন্ডেই বাসে কেয়ামত করে ফেলেছে। ধাক্কার চোটে লোকটার ঘুমন্ত শরীর উল্টে পড়ল পাশে দাঁড়ানো দুজনের গায়ে, সেই ধাক্কার ধারাবাহিক আফটার শক একদম সামনে ইঞ্জিন পর্যন্ত পৌঁছে গেল। শেষপ্রান্তে ইঞ্জিনের সামনে দাঁড়ানো লোকটার উপর সমস্ত ধাক্কা পড়লে একটা ত্রাহি চিৎকার শোনা গেল। সামনের একটা দাঁড়ানো গাড়িকে ধাক্কা মেরেছে এই গাড়িটা। হৈ হৈ শুরু হল রাস্তায়। মারামারি ভাঙচুর। ড্রাইভার বাসের জানালা দিয়ে নেমে ভাগল। কন্ডাকটর ভাগল দরজা দিয়ে।

শাহেদ এই ফাঁকে টুপ করে নেমে পড়ল। মাথায় বৃষ্টি নিয়ে এক দৌড়ে ফকিরহাট ওভারব্রিজের কাছে একটা হোটেলে ঢুকে দোতলায় উঠে বসল। অনেক পুরনো এই ওরিয়েন্ট রেস্তোঁরা। তরুণ বয়সে অনেক দুপুর বিকেল কাটিয়েছে এখানে আড্ডা দিয়ে। কাছেই জাহাজের মাস্তুল দেখা যায় কর্ণফুলী নদীতে। চায়ের অর্ডার দিয়ে আবারও ভাবতে বসল।

কিছু কিছু জ্ঞানীর জাহির প্রবণতা অবাক করে। বিনয়ের সাথে জ্ঞানের একটা সম্পর্ক আছে। জ্ঞানের তিনটা ধাপ। প্রথম ধাপে জ্ঞানী নিজেকে জাহির করে। দ্বিতীয় ধাপে জ্ঞানী বিনয়ী হয়। তৃতীয় ধাপে এসে জ্ঞানী বোঝে, এখনও কত জানার বাকি, নিজেকে তখন নিতান্ত অজ্ঞ বলে উপলব্ধি করবে। কিন্তু আজকাল প্রথম ধাপের জ্ঞানীতে শহর বন্দর ভরপুর। তাদের মুখোমুখি হতে ভয় লাগে। জ্ঞানী লোকদের আসর সযত্নে এড়িয়ে চলি আমি। এই যে এখানে, এই রেস্তোরায় অধিকাংশ শ্রমজীবী মানুষ। এটা কুলি মজুরদের কফি হাউজের আড্ডা। এখানে এসে আমার অনেক স্বস্তি। ওদের সারল্য বা কূটনামি সবকিছুতেই একটা স্বাভাবিকত্ব দেখি। কিন্তু আমি ওদের কেউ নই। ওদের চেয়ে অনেক বেশি সুবিধাবাদী শ্রেণিতে আমার বসবাস। পাশে যে লোকটা সুরুত সুরুত করে চায়ে পরোটা চুবিয়ে খাচ্ছে, তার মতো আমিও খেতাম ছাত্রজীবনে। তখন আমারও পকেটে পয়সা থাকত না। ডাল কিংবা ভাজি কেনার সামর্থ্য থাকত না বলেই চা পরোটার সম্পর্কটা অত গভীর ছিল।

শাহেদ বহদ্দারহাট থেকে গাড়িতে উঠেছিল শহর দেখতে দেখতে পতেঙ্গা পর্যন্ত পৌঁছে যাবে বলে। কিন্তু ওই লোকটার পতনে প্ল্যানটা ভেস্তে গেল। এখানে বাসে উঠতে আবার লড়াই করতে হবে। উঠতে পারলেও দাঁড়িয়ে যেতে হবে। শাহেদের ইচ্ছে করছে না অতটা পথ দাঁড়িয়ে যেতে। তাছাড়া মানিব্যাগ মোবাইল দুটোই চুরি যেতে পারে। চাকরি নেই। গেলে আর কেনা হবে না। বাজার খরচটা চলছে সঞ্চয় ভাঙিয়ে। নতুন চাকরি পাওয়া যাবে না বলে খুঁজছে না। কলম পিষে চলা যায় তেমন একটা কাজ দরকার।

বেয়ারা এসে জিজ্ঞেস করল কিছু লাগবে কিনা। শাহেদ বলল একটা সিগারেট এনে দিতে। বৃষ্টি দেখলে তার সিগারেটের তেষ্টা পায়। এমনিতে তেমন খায় না আজকাল। প্রায় ছেড়েই দিয়েছে বলা যায়।

সিগারেট ধরিয়ে আয়েশ করে ধোঁয়া ছাড়ল শাহেদ। ধোঁয়ার কুণ্ডলী ছাতের দিকে ভেসে যাচ্ছে মেঘের মতো। অনেককাল আগের কথা মনে পড়ল তার। অনেক বছর আগে একজনের সাথে খুব বন্ধুতা ছিল। বন্ধু নাকি অন্য কিছু? দ্বিতীয় জন্মের মতো ছিল ব্যাপারটা। প্রথম জন্মের হাহাকার কেটে গিয়েছিল তার। শাহেদের অনেক বন্ধু ছিল যাদের প্রায় সবাই সহপাঠী। কিন্তু সার্বক্ষণিক সঙ্গসুখের বন্ধু একজনই ছিল। দিন রাতের যে কোনও সময় ওর কথা ভাবতে পারত, ভাবনায় চলে আসত। দুজনের বন্ধুতা গভীরতার চরমে পৌঁছানোর পর শাহেদ বুঝেছিল বহুকাল আগেই এরকম একটা সম্পর্ক হতে পারত। বিচ্ছিন্ন হবার পর এখন সে কোথায় শাহেদ জানে না। দীর্ঘকাল কোনও যোগাযোগ নেই। দুজনেরই ঠিকানা বদলে গেছে, মন বদলে গেছে, পরিস্থিতি বদলে গেছে। তবু আজ দীর্ঘকাল পর তার কথা ভাবল শাহেদ। এই সিগারেটের ধোঁয়াটা সেই স্মৃতিকে উসকে দিল। মনে পড়ল ধোঁয়া ওড়ানো নিয়ে ওর আপত্তির কথা। কিন্তু যেদিন বলল এই ধোঁয়ার মধ্যে ওর মায়ার সন্ধান করে প্রতি সন্ধ্যায়, সেদিন থেকে আর আপত্তি করেনি সে।

নাহ আর বসে থাকা যায় না। উঠে পড়ল সে। বৃষ্টি ধরে এসেছে। বাতাসে ঠান্ডা একটা ঘ্রাণ। এরকম আবহাওয়ায় হাঁটতে আরাম। এখান থেকে সোজা সল্টগোলা পর্যন্ত হেঁটে গেলে বাসে সিট পাবার সম্ভাবনা আছে। হাঁটতে হাঁটতে আবারও ভাবছে।

আমি সমুদ্রের চেয়ে পাহাড়কে বেশি ভালোবাসতাম। অথচ পাহাড়ের চেয়ে সমুদ্রেই বেশি গিয়েছি। যারা আমার বাহির দেখেছে তারা ভাববে আমি সমুদ্রকে ভালোবাসি। যারা আমার অন্তর জানে তারা বুঝবে আমি পাহাড়কে ভালোবাসলেও সমুদ্রে পড়ে থাকি বাধ্য হয়ে। পাহাড় আমাকে আশ্রয় দেয় না। অপছন্দের সমুদ্রতীরে আমি ঘুমিয়ে পড়ি। জীবনটাও এরকম না? যে জীবন আমি ভালোবাসি সে জীবনের কাছে যেতে পারি না। যে জীবন আমি পছন্দ করি না তার মধ্যে আমরণ বসবাস করি। আমার মধ্যে খুব বেশি বৈপরীত্য কি?

মহেশখালের ব্রিজে উঠে অবাক হয়ে গেল শাহেদ। খেয়াঘাটটা এখনও আছে? ছোট একটা নৌকা বাঁধা ঘাটে। বাসে ওঠার বদলে নৌকায় চড়ে বসল সে। এরকমই সে। তারুণ্যে একবার সন্দ্বীপ যাবার জন্য ঘর থেকে বেরিয়ে রাঙ্গামাটি চলে গিয়েছিল। বাসায় সবাই জানে সে সন্দ্বীপ গেছে। দুদিন পর সে যখন রাঙ্গামাটি থেকে ফিরে এল ওদের চোখ কপালে। এরকম দিকহারা পাখি সে। কোথায় যাবে, কীভাবে যাবে তার কোনও স্থিরতা নেই। মানুষের জীবনটা অনির্ধারিত গন্তব্যে থেমে যায় না? যে লোকটা ষাট বছর বাঁচার স্বপ্ন দেখেছিল সে কি চল্লিশে এসে থেমে যায় না?

প্রতিবার নৌকা চড়ার সময় মনে হয় এবার একটা নৌকাডুবি হবে। খুব ছেলেবেলায় একবার নৌকাডুবিতে পড়েছিল সে। জীবনের প্রথম স্মৃতি ওটাই। ভয়াবহ। সে কোনওমতে বেঁচেছিল। নদী তাকে নেয়নি। তাই বুঝি সে আজও নদীর প্রেমে পড়ে থাকে। শঙ্খ নদী তার এখনও সবচেয়ে প্রিয় নদী। সেখানেই ডুবেছিল জীবনের প্রথম নৌকাটি।

নদী পার হয়ে ওপারে উঠে গেল। জায়গাটা অচেনা। এটা কি আনোয়ারা না পটিয়া সে জানে না। কিন্তু এই গ্রামটাকে দূর থেকে তার ভালোই লাগত। কেমন জনমানবহীন। একসময় এই এলাকায় পর্তুগিজ রাজত্ব ছিল। জলদস্যুদের আখড়া। এখনও কোথাও সেই চিহ্ন আছে কি?

বৃষ্টি থেমে গেছে কিন্তু বাতাস এখনও শীতল। মাটির সোঁদা গন্ধটা বেশ ভালো লাগছে। বৃষ্টিতে রাস্তার জায়গায় জায়গায় জল জমে গেছে। কিছুদূর হাঁটার পর একটা বেড়ার চা খানা। সামনের টুলে বসে এক কাপ চায়ের অর্ডার দিল। সিগারেট চাইতে দোকানি বলল, ‘গোল্লিপ নাই বদ্দা’। শেষে একটা দুটাকা দামের সস্তা সিগ্রেট ধরিয়ে টানতে টানতে চারপাশ দেখতে লাগল।

জায়গাটা একটা বাজারের মতো হলেও কেমন একটা ভূতুড়ে রহস্যময়তা পুরো বাজারজুড়ে। একসময়ের খ্যাতিমান জায়গাগুলো পরিত্যক্ত হবার পর এরকম চেহারা নেয়। তার স্যান্ডেলের একটা ফিতা ছিড়ে আলগা হয়ে যাচ্ছে। এখানে কোথাও মুচির দোকান আছে? দোকানি বলল, বাজারের শেষ মাথায় একটা মুইচ্যা আছে।

মুচির দোকানটা খুঁজে পেলেও লোকজন কাউকে দেখল না ওখানে। কোথাও গেছে। পাশের পান দোকানের ছোকরাকে জিজ্ঞেস করতে বলল, ‘বা-রে গেইয়ে, ইত্তিরি আইবো।’

শাহেদ টুলে বসে অপেক্ষা করতে লাগল। ভাবনাটা আবারও ঘুরতে লাগল।

জীবনটা গুটিয়ে আসা একটা বৃত্তের মতো। শৈশবে বৃত্তটা অনেক বড় থাকে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে বৃত্তটা ছোট হয়ে আসতে থাকে। জ্ঞান আর অভিজ্ঞতা যতই বৃদ্ধি পাক না কেন, জীবনের বৃত্তটা শুধু ছোটই হতে থাকবে। যেদিন বৃত্তটা একটা বিন্দুতে মিলিত হবে সেদিন সবকিছুর অবসান। আজকাল ঘুমোলেই তার মনে হয় বৃত্তটা একটা বিন্দু হয়ে গেল বুঝি। চমকে জেগে উঠি আমি। মৃত্যুতে আমার খুব ভয় আছে তা নয়। কিন্তু সত্যি সত্যি একদিন চলে যেতে হবে এই ভাবনাটা কেমন কান্নাবোধের মতো জেগে থাকে। তখন আর কিছুই ভালো লাগে না। অথচ আমার আর কিছুই পাবার নেই। জীবনে অগাধ সুখ স্পর্শ করতে পেরেছি বহুবার। এর বেশি কিছু চাইবার নাই। পরকাল বলে কিছু আছে কিনা জানি না। যদি থাকে তাহলে আমার জন্য কঠিন শাস্তি বরাদ্দ আছে। আমি পুণ্যার্জনের কোনও চেষ্টা করিনি কখনও। জীবনটা আমোদ প্রমোদে কাটাতে চাইলে পুণ্যার্জন করে কেই বা সময় নষ্ট করে। তাই শাস্তি আমার অনিবার্য। আর যদি পরকাল বলে কিছু না থাকে, তাহলে আমি বেঁচে গেলাম। মাটির সঙ্গে মিশে যাবার পর যে রাসায়নিক উপাদান আমার শরীরকে গ্রাস করবে তার সঙ্গে একটা কাক বা টিকটিকির মৃতদেহের খুব বেশি পার্থক্য নেই।

আরেকটা সিগারেট ধরাল শাহেদ। ছোট্ট দোকানটা। এটা ঠিক দোকান না। একটা বন্ধ দোকানের সম্মুখভাগ। মাথার ওপর একটা তেরপল দেয়া। তিনকোনা একটা দোকান। কৈশোরে এরকম একটা দোকান ছিল তাদের পাড়ায়। রমেশকাকার দোকান। দোকানটা ওর খুব প্রিয় ছিল। ওদের বাড়ির সব পুরনো জুতো স্যান্ডেল মেরামত করার জন্য শাহেদ ওই দোকানে যেত। রমেশকাকার কাজ দেখতে তার ভীষণ ভালো লাগত। এত সুন্দর করে সেলাই করত, যেন একটা শিল্পকর্ম। রমেশকাকার দোকানটা আসলে বাসা কাম দোকান। শাহেদ সারাজীবন যত মানুষের জীবনযাত্রা দেখেছে তার মধ্যে রমেশকাকার জীবনটাই সবচেয়ে পছন্দের ছিল। সে চাইত ওরকম একটা জীবনের অংশ হতে। কিন্তু ভদ্রলোকের ছেলে কি মুচিগিরি করবে? কাউকে বলা হয়নি কথাটা। এতকাল পর রমেশকাকার কথা ভেবে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে গেল ভেতর থেকে। সে নিজেই এখন রমেশকাকার বয়সে এসে পৌঁছে গেছে।

দোকানি ফিরে এলে সে অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখল। এ কী? রমেশকাকা কোত্থেকে। এতদিনে তো তিনি তো মরে স্বর্গে চাষবাস শুরু করার কথা। কিন্তু সেই স্বাস্থ্য সেই চেহারা, অবিকল রমেশকাকা। কাকা বলে ডাক দিতে গিয়েও থেমে গেল সে। সে নিজেই তো এখন কাকার বয়সী। দাদা বলা যায় বড়জোর। তবে কণ্ঠ শুনে ভুল ভাঙল শাহেদের। কাকার গলাটা বেশ দরাজ ছিল। এই গলাটা অচেনা। তবু কৌতূহল জেগে থাকল। কাজ শেষ হবার পর মানুষটার নাম জিজ্ঞেস করতেই বলল, নাম পরেশ। বাবার নাম? রমেশ।

এই তো, এই তো! শাহেদ ঠিকই ধরেছিল। বুকের ভেতর কেমন একটা আনন্দস্রোত বয়ে গেল। সে জড়িয়ে ধরলো পরেশকে। পরেশবাবু অবাক। ব্যাপার কী? সে তো শাহেদকে চেনে না।

জানা গেল রমেশকাকা মারা যাবার পর পরেশ শহরে ব্যবসা জমাতে পারেনি। দায়দেনা শোধ করতে দোকান বিক্রি করতে হয়েছিল। তারপর এদিকে চলে এসেছে। আনোয়ারার এই গ্রামে ওর শ্বশুরবাড়ি। এখানে শ্বশুরপক্ষের একজনের দয়ায় এই দোকানটা করছে। দোকানটা সাজিয়েছে বাবার মতো করেই।

বউটা মরে গেছে আরও বছর দশেক আগে। একটা মেয়ে ছিল বিয়ে দিয়েছে। সংসারে সে এখন একা। শ্বশুরের দেওয়া ঘর একটা থাকলেও সে ওখানে খুব একটা যায় না। কেউ নেই, গিয়ে কী হবে। দোকানে কাজ করে এখানেই শুয়ে রাতটা পার করে দেয়।

আলাপ করতে করতেই শাহেদ ভালো করে দোকানটা দেখতে লাগল। এই দোকান রমেশকাকার চেয়েও ছোট। এক পাশে একটা লম্বা টুল। দৈর্ঘে সাড়ে চারফুট হবে, দোকানের দৈর্ঘের সমান, প্রস্থ দেড়ফুট। টুলের ওপর চাটাই বিছানো। ওটাই বিছানা মনে হয়। রমেশকাকার দোকানেও তেমন ছিল। সেই টুলের সামনে তক্তায় বসে কাজ করে পরেশ। পেছনে কিছু জুতো স্যান্ডেল ঝোলানো। সামনে জুতো সেলাই এবং পালিশের যন্ত্রপাতি মালমশলা।

তবে রমেশকাকার দোকানটি আরও সমৃদ্ধ ছিল। টুলের উপরটা বেডরুম, টুলের নীচে কিচেন। ওখানে থাকত একটা স্টোভ। দুটো ছোট ডেকচি। কিছু বৈয়াম বোতল ইত্যাদি। কাকা কাজ করতে করতেই চুলায় ভাত ফোটাতেন। তরকারির ঝোল নাড়াতেন। ফেরিওলার কাছ থেকে সবজি কিনতেন। আমি অবাক হয়ে দেখতাম একটা বেগুন, পাঁচটা শিম, একটা ফাইস্যা শুটকি কিনেই কাকার বাজার শেষ। দু তিন টাকার বেশি খরচ লাগত না এসব বাজারে। শাহেদের চোখে এখনও ভাসছে কাকা ছোট একটা ফাইস্যা শুটকি দিয়ে বেগুনের ঝোলটা রান্না করছে লাল বাটা মরিচ দিয়ে। কী দারুণ ঘ্রাণ আসছিল! শাহেদ নেশাড়ুর মতো তাকিয়ে থাকত মুগ্ধতা নিয়ে। কাকাকে কখনও বলা হয়নি আপনার ডেকচি থেকে এক থালা ধোঁয়া ওঠা গরম ভাত নিয়ে ওই বেগুনের ঝোল মেখে খেতে ইচ্ছে করছে। কাকার সেই সামান্য জীবনের প্রতি তার একবার লোভ হয়েছিল। কিন্তু সে চাইলেই অমন জীবন পেতে পারে না। তাকে পড়াশোনা শেষ করতে হবে, বড় চাকরি করতে হবে, দেশ বিদেশের সুনাম কুড়াতে হবে।

তখন বড় চাকরি মানে বিসিএস পাশ বোঝাত। কিন্তু বিসিএস পাশ করে কত টাকা বেতন পাওয়া যায় সেটা জানলেও ওই টাকায় সংসার কীভাবে চলে তার কোনও ধারণা ছিল না। কেননা দেখেছে যারাই বিসিএস নামের সোনার হরিণ ধরতে পেরেছে তারাই রাজা উজির মেরে বেড়াচ্ছে। ছোটচাচা বলত, তোকেও পারতে হবে। এটা আমাদের বংশের চ্যালেঞ্জ।

এখনও হাসি পায় ছোট চাচার সেই কথা মনে পড়লে। বংশের কী এমন ছিল যে ওই চ্যালেঞ্জ নিতে বলেছিলেন তিনি? পরীক্ষা দিয়েও ছিল। পাশও করেছিল ভাইভার আগ পর্যন্ত। ভাইভাতে ফেল করার পর আরেক মুশকিল দেখা দিল। যে কোনও অনুষ্ঠানে বড়সড় লোক দেখলে যে কোনও অজুহাতে তার বিসিএস পরীক্ষা দেবার কথাটা তুলবেই। বলত, ও তো বিসিএস পাশ করেছিল। কিন্তু অল্পের জন্য চাকরিটা হল না। ভাইভাতে ষড়যন্ত্র করে ফেল করিয়ে দেওয়া হয়েছে। বোঝেনই তো একদম সোজা ছেলে। একদম বুঝতে পারেনি।

এধরনের পরিস্থিতিতে অপমানে লজ্জায় সে মাথা নীচু করে থাকত। কিছু বলতে পারত না। কেননা ছোটচাচা প্রবল ভালোবাসা দিয়ে কথাগুলো বলত। কে জানে হয়তো বিশ্বাসও করত। মনে আছে ভাইভার আগে তার জন্য সুপারিশ করার জন্য মন্ত্রীকে ধরতে ছোটচাচা একদিন ঢাকা যাবার জেদ ধরেছিল। পরদিন ভাইভা। সেই রাতেই ঢাকা পৌঁছাতে হবে। কিন্তু প্লেনে কোনও সিট নেই। কিন্তু কীভাবে যেন ছোটচাচা রাজনৈতিক পরিচয় ব্যবহার করে সেই ফ্লাইটেই ঢাকা চলে গিয়েছিল পাইলটের পাশের সিটে বসে। আশ্চর্য এক মানুষ ছিল বটে। তার চাকরিটা হয়নি যথারীতি। তবু পাগলামিটায় এখনও ভালোবাসার স্মৃতি মাখানো রয়ে গেছে।

শাহেদ হঠাৎ করে পরেশকে বলে বসল, “আজ রাতটা আমি এখানেই থাকি?”

পরেশের চোখ কপালে উঠল। “কী বলছেন বাবু। এখানে জায়গা কোথায়?”

শাহেদ অনড়। “এখানে, এই দোকানের ঝাঁপির নীচে।”

পরেশ রাজী না। “তা হয় না বাবু। আপনি চাইলে আমি আমার বাড়িতে ঝেড়ে মুছে ব্যবস্থা করে দিতে পারি। কিন্তু এই খুপড়ি দোকানে? এটা অসম্ভব। মাফ করবেন বাবু।”

অসম্ভব বুঝতে পেরে শেষমেষ হাল ছেড়ে শাহেদ উঠে পড়ল। থাকার জায়গা না পেলেও ভালো লাগছে এতকাল পর রমেশকাকার ছেলের সাথে দেখা হল। আবার আসা যাবে একদিন।

লোকজনের কাছে পথের দিশা জেনে হাঁটতে হাঁটতে বড় রাস্তায় উঠে এল শাহেদ। এবার কোথায় যাবে? বাঁয়ে গেলে শহর, ডানে গেলে আরও গভীর গ্রাম। কোথায় যাবে সে?

টস করার মতো ভাবল যেদিকের বাস আগে আসবে সেদিকে উঠে পড়ব। প্রথম বাসটা এল শহরের পথে। এটায় উঠলে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে বহদ্দারহাট। যেখানে সে ফিরতে চায় না। অন্তত আজকের রাতটা। উঠতে চাইছিল না কিন্তু হঠাৎ ঝেঁপে বৃষ্টি এল। মাথা বাঁচাতে বাসে উঠে গেল আত্মরক্ষার স্বাভাবিক প্রবণতায়।

অতঃপর মানুষকে যুগ যুগ ধরে যা করতে হয়েছে তাকেও তাই করতে হবে। কোনও কারণ ছাড়াই ফিরতে হবে ঘরে। কোনও কারণ ছাড়াই সে বেরিয়েছিল সকালে। আবার এই সন্ধেবেলা ফিরে যাচ্ছে কোনও কারণ ছাড়াই। এমনকি সে বেঁচে আছে কোনও কারণ ছাড়াই। বেঁচে থাকার জন্য ফিরছে না সে, ফিরছে বেঁচে আছে বলেই।

বাসায় ঢোকার আগে মোড়ের ভ্রাম্যমান চা বিক্রেতা বুড়োর কাছে গিয়ে বলল, “এই অকর্মন্য জীবনে আরেক কাপ চা পাওয়া কি সহজ হবে?”

পরিচিত বুড়ো অবাক হয়ে তাকিয়ে চা বানিয়ে ওর হাতে তুলে দিল।

সে চুমুক দিতে দিতে মনে মনে হাসছে। ঘরে কখনও অসময়ে চা খেতে ইচ্ছে করলে যা বলে, বুড়োকে তাই বলে ভড়কে দিয়েছে।

এতক্ষণে তার মুখে একটু হাসি ফুটল। পকেটে থাকা শেষ দশ টাকার ছয় টাকা বুড়োকে দিলে বাকি থাকে চার টাকা। তামাকের ব্যবস্থা হয়ে যাবে তাতে।

সেই সকালে একশো টাকা নিয়ে বেরিয়েছিল। এখন সেই ১০০-র ১ বাদ দিয়ে দুটো ০০ নিয়েই বাড়ি ফিরবে। ক্লাস থ্রিতে তাদের ক্লাসে একটা ছেলে অঙ্কে ০০ পেয়েছিল বলে স্যার বলেছিলেন, খাতাটা বাড়ি নিয়ে মামলেট করে খেতে। দুটোই নাকি হাঁসের ডিম ছিল। অসময়ে এসব কথা কেন মনে পড়ে কে জানে।