কবিতাগুচ্ছ

দীপ শেখর চক্রবর্তী

 

একটি বিন্দুর নিস্তব্ধতা

নিস্তব্ধতার ভেতর দিয়ে জীবনের বহুদূর দেখা যায়।

কার্নিশে,বৃষ্টির জলের ভেতরে অতীতে ফেলে আসা সুখের দিনগুলো কিছুক্ষণ জমে থাকে।তবুও এ জীবনের সবকিছু শুকিয়ে যায় ধীরে ধীরে।এই মুহূর্ত আমার নয়,ভবিষ্যৎ কখনও ছিল না।শুধুই খণ্ড খণ্ড অতীতের স্মৃতি উন্মাদ করে।অথচ দক্ষ যাদুকরের মতো সেও লুকিয়ে নিতে পারে হাতের তালুর ভেতরে রঙিন রুমাল।যেদিকে যা দেখি,মনে হয় শুধু ক্ষণিকের মায়া।তবু এই আমিই তো কতকাল বুকের খাঁচাটি খুলে দুটো চমৎকার শাদা পাখি উড়িয়ে দিতে পেরেছি,অনায়াসে।পৃথিবীতে আনন্দ ছিল,অহেতুক সুখ ছিল।যদিও সুখ মানে চিরকালই অহেতুক,এমনকি অসুখও।যেখানেই যাই মনে হয় সমস্তকিছুর এক গূঢ় মানে আছে।নিজেকে বিন্দুর ভেতরে তাই সমাহিত করি।একটি বিন্দুর মতো নির্জনতা কি কারো আছে?

একটি বিন্দুর ভেতর দিয়ে যতটা জীবন দেখা যায়, মাঝে মাঝে ততটা দেখা যায়না সমস্ত জীবন খুলে দিয়ে।

 

বেহালার নির্মাণ পদ্ধতি

যে নাবিক জাহাজডুবির পর একমাত্র বেঁচে যায় তার হৃৎপিণ্ড থেকে তৈরি হতে পারে উৎকৃষ্ট বেহালা।যে বাজায়,যে শোনে তারা এসমস্ত তথ্যের কিছুই জানে না,তাই জীবন এমন অপরূপ।তাই জীবন-এমন নিষ্ঠুর মুগ্ধতা।

সেই সুর আমি শুনেছি,তারপর মিটে গেছে দরজা খোলা ও বন্ধের সমস্ত তফাৎ।

মনে হয়,কেন যে বোকার মতো অপেক্ষা করে গেছি?কখন জীবন এসে ছুঁয়ে নিলে আমার ঘুম ভেঙে যাবে-এই কি জীবনের সব?আমিও কি মনে মনে সামান্যও কথাটি জানিনি,এতদিনে-

যে যতবেশি জাগে ততবেশি উঁচু হয়ে ওঠে তার চিতার আগুন?

 

বুদবুদ

সমস্তকিছুই দূর থেকে মুগ্ধতা আনে।

যত ধরি,মুঠোর ভেতরে জীবনের রঙিন জলের বক ভেঙে যায়।জীবনকে ঘৃণা করার মতো যথেষ্ট সময় আমাদের ফুরিয়ে গিয়েছে,কুমারি মেয়েদের চোখের কাজলে।তাই বলে এমনও নয় বৃদ্ধ সাধুর মতো সমস্ত খড়ির দাগ অতিক্রম করে এসেছি নির্লিপ্ত বৃক্ষের ছায়াতলে,বিশ্রাম নিতে।

আসলে সকলেরই জীবনের অবিরাম মিষ্টতা থেকে গরলের কটূ স্বাদ ভালো লাগে।দেখার তফাৎ শেখা গেলে কোনও শেষই যে শেষ নয়-এই সুখ-এই এক সীমাহীন ভীতি।তাই হীরে মকরতের থেকেও বেশি ভালো লেগে যায় ক্ষণস্থায়ী সামান্য বুদবুদ।

ভালোবাসা

তাই শুধু ফেরা নয়- এখনও সমান মধুর লাগে ফিরে ফিরে দূরে চলে যাওয়া।

 

কালনাগিনীর খেলা

গ্রীষ্মের দেশে বসবাস করি তাই সমস্ত আর্তনাদ উড়ে চলে যায় টেবিল ফ্যানের হাওয়াতে।

বুকের ওপর যারা ধানগাছ পুঁতে রেখে যায় যারা ফলনের আগেই তারা হারিয়ে যায়।আসলে ফলন কিছুই নেই,তেমন উর্বর নয় মাটি।আমাদের এসমস্ত শরীর-প্রদেশে ঘূর্ণিঝড় বেশি হয়,বাঁধ ভাঙে,লোনা জলে একবার জমি ছেয়ে গেলে কয়েকবছর চাষ বন্ধ।তবু নদীতে মাছ আর মউবনে পেছনে নিজেরই মুখোশ পড়ে বেঁচে থাকা।এই চোখে,মশারির গায়ে জোঁকের মতো লেগে থাকা মশাদেরও মুগ্ধতার চোখে দেখি।তবু সাধ হয়,শরীরে রোমাঞ্চ জাগে এই ভেবে- কবে এসে বিছানায় এসে শোবে এক কালনাগিনীর বিষাক্ত ছোবল।

তড়পাতে তড়পাতে এই লোনা মাটি তবে আশ্চর্য ফসল ফলাবে।

 

জাহাজের একমাত্র জীবিত নাবিক

কোথাও কোনও ব্যক্তিগত জয় নেই এই পৃথিবীতে।কোথাও কেউ পুরোপুরি হেরে যেতে পারেনি।যুক্তিহীন এই জীবনের একেকটা পথ একেকদিকে যায়।যে পথ আমার সে পথ অবশেষে আমাতেই পৌঁছবে।সমুদ্রে ভেঙে পড়া জাহাজের একমাত্র জীবিত নাবিক আমি, ফিরে এসে অবশেষে বুঝেছি-

যার হারিয়ে যাওয়ার কথা একবার প্রচারিত হয়ে যায় তার হারিয়ে যাওয়াই ভালো,নইলে আজীবন প্রেত হয়ে বাঁচা।

যত ফুরিয়েছি আমি তত কেন মধুর মনে হয় এই সমস্ত জীবন?বয়স?আজীবন যুবক থাকার অলীক কল্পনা আমি করিনি কখনও।শুধু এ দুটি চোখ কখনও বিস্ময় হারাবে না-এই কথা ছিল।

অথচ বিস্ময়ের থেকেও আজ বড় ভালো লাগে দুচোখের সমস্ত জেনে যাওয়া।

এসকল কথা কাউকে দেওয়া যায়না,তাই একা একা হেঁটে আমি না দেওয়ার মুগ্ধতা ছড়িয়ে এই শহরের পথে।কি এসে যায়?কেউ যদি বলে- কখনও দেখেনি।

স্নেহ পেলে কোথাও দুদিন থেকে যেতে বড় সাধ হয়,তাই জীবনেও আছি।

 

বেদুইন মেয়েটি, স্নান

পরপর মানুষ হেঁটে আসে মন্ত্রমুগ্ধ, দুচোখে আশ্চর্য বিষণ্ণতা নিয়ে।বুকের পাথর টুপ করে ফেলে দেয় আমার বুকের ভেতর-কান পেতে থাকে।শোনে,কতক্ষণ পর শব্দ উঠে আসে,এই নির্জনতায়।অথচ,আমি জানি জল কিছুমাত্র উঠে আসবেনা এতে।আমার এই সমস্ত শরীর মরীচিকা।শুধু মাঝে মাঝে একেকটি উটের ছায়া পার করে গেলে গলা ভিজে যায়।

দিন ও রাতের শরীর।তাপের তফাতে কি প্রবল বিষাদ।

তবুও শরীর জেগে থাকে।কবে বেদুইন মেয়েটি এসে খালি পায়ে দুদণ্ড হেঁটে গেলে,হে জীবন-

তার নোখ ভিজে যাবে।

Be the first to comment

আপনার মতামত...