একটি অদ্ভুত প্রণয়ের গল্প

সৌগত মুখোপাধ্যায়

 

“যে তোমার দেওয়া মাঠের ঘাস, তোমার দেওয়া তেষ্টার জল তাকে খেতে দেয়নি, তার কসুর তুমি যেন কখনো মাপ ক’রো না।” বাংলা সাহিত্যের পাঠকদের কাছে এই করুণ আর্তি অপরিচিত নয়। মহেশের প্রতি ভালোবাসায়, শোকে এবং গভীর দুঃখে গফুরের উক্তি আজও আমাদের চক্ষু সজল করে তোলে। আর একটি গল্পের সমাপ্তিও এরকমই তীব্র অভিঘাতে শেষ হয় যখন জয়রাম মুখোপাধ্যায় হস্তিনীর শবদেহের উপর লুটিয়ে পড়ে তার মুখের কাছে মুখ রেখে কাঁদতে কাঁদতে বারবার বলতে লাগলেন, “তুই অভিমান করে চলে গেলি মা ? তোকে বিক্রী করতে পাঠিয়েছিলাম বলে- তুই অভিমান করে চলে গেলি?” এই ঘটনার পর মুখোপাধ্যায় মহাশয়ের জীবৎকাল মাত্র দুইমাস স্থায়ী হয়েছিল। মহেশ গফুরের কাছে ছেলের মতো আর আদরিণী মুখুয্যে মশাইয়ের বাড়িতে মেয়ের মতো প্রতিপালিত হয়েছিল। শরৎচন্দ্রের ‘মহেশ’ বা প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের ‘আদরিণী’ দুটি গল্পেই পশুর সঙ্গে অপত্য স্নেহ জড়িত। কিন্তু পশুর সঙ্গে প্রণয়ের সম্পর্ক? উপরন্তু পশুটি আবার হিংস্র শ্বাপদ। ব্যোমকেশের স্রষ্টার কাছ থেকে প্রাপ্ত এরকম একটি গল্পই আমাদের আলোচ্য।

১৩৫২ বঙ্গাব্দের মাঘে বেঙ্গল পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত ‘গোপন কথা’ নামক গল্পগ্রন্থে বাঘিনী নামক গল্পটি প্রথম প্রকাশিত হয়। বাঘের গল্পের সঙ্গে আমাদের অনিবার্য সংযোগ হল শিকারের। মূলত বাঘ শিকারের গল্পই আমাদের কাছে জনপ্রিয়। এই গল্পটির পথ ধরে এগিয়ে গেলে সেই শিকারের কথা দিয়েই শুরু হয়। বঙ্গ বিহারের সমতলভূমি যেখানে হিমালয় এসে সমতলের সঙ্গে মিশেছে, যেখানে হরিণ শম্বর চমরী নীলগাই প্রভৃতি জন্তুর সঙ্গে সঙ্গে বাঘ নেকড়ে চিতা হায়েনাও স্বচ্ছন্দে ঘুরে বেড়ায় তরাইয়ের সেরকম একটি অঞ্চলে শিকারের সন্ধানে কথক গিয়ে উপস্থিত হন। সেখানে গিয়ে জানতে পারেন কাছের একটি গ্রামে বাঘিনীর উৎপাত আরম্ভ হয়েছে। বাঘিনী শুধুমাত্র মেয়েদের তুলে নিয়ে যাচ্ছে। পুরুষদের প্রতি তার কোনো আকর্ষণ নেই। বাঘিনীকে মারতে পারলে পঞ্চাশ টাকা পুরস্কারও ঘোষিত হয়েছে। গ্রামের লোকেদের বারবার আবেদনেও সরকার কোনো ব্যবস্থা এখনও পর্যন্ত নেয়নি। ফলে অতিষ্ঠ হয়ে গ্রামের লোক কথককে এসে ধরেন বাঘ শিকারের জন্য। প্রায় পঁচিশ মাইল দূরে গ্রাম, কিন্তু দুর্গম সে রাস্তা দিয়ে পৌঁছাতে লাগলো দু’দিন। গ্রামের লোকসংখ্যা ছেলে বুড়ো মিলিয়ে শ’দেড়েক। সবচেয়ে কাছের গ্রাম দশ মাইল দূরে। দুর্গম গিরিসঙ্কটের মধ্যে এই গ্রাম নিঃসঙ্গ, কলকোলাহল বর্জিত।

কথক বাঘিনী শিকারে সফলতা অর্জন করলেন। বাঘিনী মরল। কিন্তু বাঘিনীর মাথা কোলে নিয়ে সেই গ্রামের এক যুবক রূপদমনের প্রিয়জন বিয়োগের কান্না দেখে কথক অবাক হলেন। এবং জানলেন ওর সঙ্গে তার বড় ভালোবাসা ছিল। গল্পটি নিম্নরূপ। গ্রামের ছেলেদের সঙ্গে বনের মধ্যে লুকোচুরি খেলতে খেলতে রূপদমন বাঘিনীর গুহায় লুকিয়ে পড়ে। নিভৃত স্থানে কিছুক্ষণ অবস্থানের পর তার ঘুম পেয়ে যায়। যখন ঘুম ভাঙে তখন সে সামনে প্রকাণ্ড বাঘের মাথা দেখতে পায়। ‘বাঘিনী ঠিক তাহার পাশে আসিয়া বসিয়াছে এবং হিংস্র-প্রখর দৃষ্টিতে তাহাকে নিরীক্ষণ করিতেছে। তাহার গলা দিয়া একটা অবরুদ্ধ আওয়াজ বাহির হইতেছে- গর্ র্-’ । তার শরীর অসাড়। যখন সাড় ফিরল তখন নড়াচড়া করতেই বাঘ থাবা তুললো। সেই থাবার কব্জির কাছে পুঁজ রক্ত মাখা। ক্রমে ক্রমে রূপদমন সাহস সঞ্চয় করে বাঘিনীর কব্জি থেকে যে কাঁটা গুলো বার করে আনল সেগুলো সজারুর কাঁটা। বাঘিনী তাকে ছেড়ে দিল। প্রণয়ের সূত্রপাত। দশদিন পর রূপদমন আবার জঙ্গলে কাঠ কাটতে গিয়ে ঐ জায়গার আকর্ষণ এড়াতে না পেরে গিয়ে উপস্থিত হল। তার অবস্থা ছিল অনেকটা ‘নবীন অভিসারিকার মত’। বাঘিনীও উপস্থিত। কিন্তু রূপদমনের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব স্থাপিত হল। একদিন দেখা না হলে তাদের মন মানত না। বাঘিনী গ্রামের চারদিকে ঘুরে বেড়াত আর ডাকত। তাদের মধ্যে লুকোচুরি, হুড়োহুড়ি খেলার অন্ত ছিল না। রূপদমন গুহায় গিয়ে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লে বাঘিনী এসে তার পাশে শুতো, বুকের উপর থাবা তুলে ঘুমাতো। এইভাবে তিনবছর কেটে যায়। ক্রমে রূপদমনের বিবাহ হয় দশ মাইল দূরের একটি গ্রামে। বরবধূ গ্রামে প্রবেশের সময় ‘বাঘিনী কোথা হইতে ছুটিয়া আসিয়া বরযাত্রীদলের দশগজ সম্মুখে থাবা পাতিয়া বসিল। … বাঘিনীর হলুদবর্ণ দেহখানা আগুনের হল্কার মত জ্বলিতেছে, তাহার সর্বাঙ্গ দিয়া যেন বিদ্যুতের শিখা বাহির হইতেছে।’ বাঘিনীর এমন ভয়ঙ্কর চেহারা রূপদমন কখনও আগে দেখে নাই। সেদিন গাঁয়ের লোকের বাজনার আওয়াজে বাঘিনী পালিয়ে যায়। কিন্তু তার প্রতিহিংসা স্ত্রীলোকেদের উপর আছড়ে পড়ে। মেয়েদের বাড়ির বাইরে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। রূপদমনের স্ত্রীকে মারাই ছিল তার উদ্দেশ্য। রূপদমনের আক্ষেপ, “মানুষে মানুষে ভালবাসা হয়, কিন্তু বাঘের মত এমন ভালবাসতে কেউ পারে না।… অমন স্নেহশীল উচ্চমনা জন্তু আর নেই। পৃথিবীতে যদি ভদ্রলোক থাকে তো সে বাঘ।”

পৃথিবীতে মানুষের লোভের কাছে বাঘ কেন প্রায় সব জন্তুই পরাভূত। বাঘ মারতে মারতে আমরা শেষ করে এনেছি। শুধুমাত্র খেলার ছলে বা চামড়ার আশায় বা বীরত্ব প্রদর্শনে কত বাঘ মেরেছি তার হিসাব কি আছে? এখনও এই পশুটির উপর আমরা অত্যাচার করে চলেছি। কিন্তু বাঘের প্রণয়ের এই অদ্ভুত গল্প কি মানুষ পড়ছে? শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে আমরা ব্যোমকেশের মতো আশ্চর্য সত্যান্বেষী পেয়েছি। ইতিহাসের কাহিনিগুলির অসাধারণ রূপায়ণ পেয়েছি। কিন্তু বাঘের প্রণয়ের গল্পে হিংস্র পশুর প্রতি তাঁর প্রেমই প্রকাশ পেয়েছে। ঘটনার বিচারে বাংলা সাহিত্যে এই গল্পটি একটি আশ্চর্য গল্পের মতোই অবস্থান করছে।

Be the first to comment

আপনার মতামত...