লকডাউন কিম্বা আনলক ওয়ান— ব্যাপারটা একই

বিষাণ বসু

 


লেখক পেশায় চিকিৎসক। গদ্যকার, প্রাবন্ধিক

 

 

 

আনলক পর্ব নিয়ে বিশেষ কিছু বলার নেই, শুধু ওই দু-একখানা মন কি বাত ছাড়া।

মুখ্যমন্ত্রীদের সঙ্গে ভিডিও বৈঠকে, শুনলাম, মোদিজি নাকি বলেছেন— ভাবীকাল যখন বিচার করতে বসবে, করোনার বিরুদ্ধে দেশের এই যুদ্ধ চিহ্নিত হয়ে থাকবে দেশের মূল শক্তি, অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর কেন্দ্র-রাজ্য সহযোগিতার অনন্য নজির হিসেবে। এও শুনলাম, মোদিজি নাকি করোনার বিরুদ্ধে এই “সফল লড়াই”-কে কেন্দ্র ও রাজ্যের কাঁধে কাঁধে মিলিয়ে লড়াই করার অসামান্য দৃষ্টান্ত হিসেবে উল্লেখ করেছেন— এবং “সাফল্য”-এর কৃতিত্ব কেন্দ্র ও রাজ্য উভয়েরই, এমন কথাও নাকি বলেছেন।

কথাটা শুনে একটু ঘাবড়ে গেলাম। এমনিতেই এদেশে কেন্দ্রের সরকার রাজ্যকে যথাসম্ভব কম পাত্তা দিয়েই চলতে চায়। কর আদায়ের মতো ছোটখাটো কাজ বাদ দিয়ে খুব বেশি জটিলতা তাঁরা রাজ্যের ভরসায় ছাড়েন না। প্রকল্প-টকল্প-ও এমন ধাঁচে চালু করা হয়, যাতে প্রয়োগের সামান্য দায়িত্বটুকু থাকে রাজ্যের হাতে— অর্থাৎ বণ্টন এমনভাবে, যাতে সমস্যার দায় রাজ্যের, কিন্তু সাফল্যের কৃতিত্ব বড়দার। কোনও রাজ্যের সরকার ট্যান্ডাইম্যান্ডাই করলে বিবিধ উপায়ে ঠান্ডা করে দেওয়ার দাওয়াইও আছে— আর কিছু না হোক, বেশ খাপের একটা রাজ্যপাল বসিয়ে রাজ্যকে অস্বস্তিতে রাখাটা তো পরীক্ষিত সিস্টেম। স্বাধীনতার পর থেকে লাগাতার জারি থাকা এই প্রক্রিয়াকে উৎকর্ষের শিখরে পৌঁছে দেওয়ার কৃতিত্বের যোগ্য দাবিদার অবশ্যই মোদিজি।

তাছাড়া আমরা তো একথা জানি, দেশের গৌরব বলতে যেটুকু, তার পুরোটাই মোদিজির কারণে— সে দিকে দিকে পাকা পায়খানা খোলাই হোক, বা চিনের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের বিকাশ, (যেকোনও প্রেমের মতোই যার চূড়ান্ত পরীক্ষা ক্রাইসিস সিচ্যুয়েশনের মুহূর্তে, অর্থাৎ এখন সীমান্তে) কিম্বা চিনকে নরমেগরমে রাখা (অর্থাৎ দেশবাসীকে চিনা পণ্যের বিপদের ব্যাপারে সচেতন করা, এমনকি চিনা অ্যাপ আনইনস্টল করতে উদ্বুদ্ধ করে চিনকে ভাতে মারার ব্যবস্থা করা, আরেকদিকে চিনা বহুজাতিক সংস্থাদের একের পর এক মোটা টাকার বরাত দেওয়া নিয়ে লোকে যাতে খারাপ না বলে সেটুকু নিশ্চিত করা), কিম্বা কাশ্মির সমস্যার সম্পূর্ণ সমাধান বা পাকিস্তানকে টাইট দিয়ে রাখা— সব কৃতিত্বই মোদিজির। দেশ কেন বিশ্বের ইতিহাসে কোনও প্রধানমন্ত্রী মার্কিন মুলুকে দাঁড়িয়ে আগলে-বার-অমুক-সরকার স্লোগান দিতে পেরেছেন— হ্যায় দম?? মোদিজির সঙ্গে সঙ্গে অমিতজিও আগে একটু-আধটু কৃতিত্বের ভাগ পেতেন, কিন্তু, করোনার অসামান্য স্ট্র‍্যাটেজিক মোকাবিলায় তিনি প্রকাশ্যে তেমনভাবে আসেননি, একেবারে শেষ মুহূর্তে এদিক-সেদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা শ্রমিকদের পরিস্থিতি নিয়ে অস্বস্তিকর প্রশ্নগুলো বাড়াবাড়ি পর্যায়ে পৌঁছানোর মুহূর্তটি ছাড়া। তাঁর নীরবতা এমনই হিরণ্ময় লেভেলে পৌঁছে গেছিল, যে, কুলোকে তো তাঁকে রীতিমতো অসুস্থ ও মৃত্যুপথযাত্রী বলে গুজব ছড়িয়ে ফেলেছিল।

কিন্তু, সেসব কথা আপাতত থাক। বেসিক প্রশ্নটা দাঁড়ায়, এখন স্বয়ং মোদিজি আচমকা সাফল্যের ভাগ রাজ্যকে দিতে চাইলে সাফল্য ব্যাপারটাকেই একটু খুঁটিয়ে দেখতে হয়, তাই না?

অত্যন্ত সফল এই আড়াইমাসের লকডাউন শুরু হওয়ার মুহূর্তে দেশ জুড়ে মোট আক্রান্তের সংখ্যা যত ছিল, লকডাউনের শেষে একেকটি রাজ্যে রোজ সংক্রামিত হচ্ছেন তার চাইতে বেশি। ঈর্ষণীয় সাফল্য বই কি!!

আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞরা আগাগোড়াই বলেছেন, লকডাউনের মুখ্য উদ্দেশ্য পরিকাঠামো গুছিয়ে নেওয়া, টেস্টের সংখ্যা বাড়ানো— এককথায়, ক্রাইসিস মোকাবিলার জন্যে কিছুটা সময় কিনে নেওয়া। এবং মাথায় রাখতে হবে, এই সময় কেনা হচ্ছে অত্যন্ত চড়া দামে— দেশের অর্থনীতির বিপুল ক্ষতির বিনিময়ে।

আমরাও অবশ্য যথেষ্ট গুছিয়ে নিয়েছি। প্রথমদিকে ঠিক কোন ধর্মের লোকেদের জন্যে করোনা ছড়াচ্ছে, সেই নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। র‍্যাপিড টেস্ট হবে কি হবে না, সেই নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। চিন থেকে এজেন্টের মাধ্যমে দ্বিগুণ দাম দিয়ে কিট কিনে বিশেষ কিছু মানুষের অর্থনীতির সুবন্দোবস্ত করেছি। তারপর সেই কিট যে ব্যবহারের অযোগ্য তা মেনে নিয়ে বৃহত্তর জনসমাজকে আরও বৃহত্তর বিপদের হাত থেকে বাঁচিয়েছি। যাঁদের এধরনের যন্ত্রপাতি তৈরির কোনও পূর্ব-অভিজ্ঞতা নেই, বেছে বেছে তেমন কিছু কোম্পানিকে ভেন্টিলেটর বানানোর বরাত দিয়েছি— এবং, সেইসব ভেন্টিলেটর যে আদপেই ভেন্টিলেটর নয়, তা জানাজানি হয়ে গেলে সেগুলো যে কেনা নয়, স্রেফ অনুদান, এমন তত্ত্ব পরিবেশন করেছি।

টেস্টের সংখ্যা এবং রিপোর্ট নিয়ে যে অবাধ খেলাধূলার ব্যবস্থা হয়েছে, তাতে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বে যে কটি দেশের তথ্যকে চিটিংবাজির সমান বলে আখ্যা দিয়েছেন, তার মধ্যে একেবারে প্রথম দিকেই আমরা। কিন্তু, আমাদের তো অনেক আগেই মোদিজি সচেতন করেছিলেন, মুঝে হার্ভার্ড নহি, হার্ড ওয়ার্ক চাহিয়ে— তাই না?

অতএব, সময়ের সদ্ব্যবহার হয়নি, পরম শত্তুরেও এমন বদনাম দেবে না। (আর, লকডাউনের আগের দেড় মাসে যে কী কী করেছি, সেই বিপুল কর্মকাণ্ডের কথা লিখতে হলে স্বয়ং ব্যাসদেবকে ডাকাডাকি করতে হবে। ক্ষুদ্র মনুষ্যের কম্মোই নয় সে বিবরণ লিপিবদ্ধ করা।)

হ্যাঁ, এর মধ্যে বেশ কিছু লোক মরে গেছে— কিছু না খেতে পেয়ে, কিছু খাবারের খোঁজে, কিছু বাড়ি ফিরতে গিয়ে, কিছু বাস-ট্রেন-লরি চাপা পড়ে, আরও কিছু আরও অন্য কোনওভাবে— টিভিতে তো সবকিছু দেখায়নি, অতএব বলা মুশকিল। কিন্তু, আমরা মানি, লকডাউন খুব সফল একটা ব্যাপার।

কয়েক লাখ (নাকি কোটি?) মানুষকে বাড়ি ফেরার সুযোগ বা সময় দেওয়া হল না। তাঁরা এদিক-ওদিক নরকের পরিস্থিতিতে থেকে সংক্রামিত হলেন (মানে, যাঁরা মরে যেতে পারেননি, সেরকম অবিবেচক পাবলিকের কথা বলছি)। দেড় কি দুমাসের মাথায় তাঁদের বাড়ি ফিরিয়ে দেওয়া শুরু হল। এবং, যে অঞ্চল অসংক্রামিত ছিল, সেখানে সংক্রমণের রাস্তা খুলে দেওয়া হল। কিন্তু, সেসব যাকে বলে কোল্যাটারাল ড্যামেজ— চাঁদের গায়ে খুচরো কলঙ্ক— লকডাউন যে একটা ঐতিহাসিক সাফল্য, সে নিয়ে তো প্রশ্নের অবকাশ নেই।

লকডাউনের সবচেয়ে বড় সাফল্য— আমরা কমিউনিটি ট্রান্সমিশন হতে দিইনি। সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের গল্পে বড়মামাকে ঠাকুমা শিখিয়েছিলেন ভয় পেলেই চোখ বন্ধ করে ফেলতে। সেই শিক্ষা শিরোধার্য করে বড়মামা জীবনের প্রতি পদক্ষেপে সেই শিক্ষার প্রয়োগ করতেন— এমনকি, গাড়ি চালানোর সময় উল্টোদিক থেকে কোনও গাড়ি বেকায়দায় কাছাকাছি চলে এলেও বড়মামা চোখ বুঁজে ফেলতেন। আমরাও জানি, কমিউনিটি ট্রান্সমিশন হয়নি। এই যে দিনে হাজার দশেক মানুষ নতুন করে সংক্রামিত হচ্ছেন— সংখ্যাটা বাড়ছে নিয়মিত— তাঁরা কোথা থেকে সংক্রামিত হলেন বা কারা তাঁদের সংস্পর্শে আসছেন, তা খুঁজে দেখার চেষ্টাটুকুও হচ্ছে না। কিন্তু, সে যা-ই হোক, আমরা কিন্তু নিশ্চিত জানি, আমাদের কমিউনিটি ট্রান্সমিশন হয়নি।

অতএব, দুশ্চিতার কিছু নেই।

কেন্দ্র-রাজ্য সহযোগিতা প্রকল্পের সম্প্রসারিত ভার্সানে আমাদের রাজ্যেও অফিস-কাছাড়ি খুলে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে, হাজিরা বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে, কিন্তু, রাস্তায় যানবাহন বাড়ানোর ব্যাপারটা নিশ্চিত করা হয়নি। অতএব, প্রতিটি বাসে গাদাগাদি ভিড় নিশ্চিত করা সম্ভবপর হয়েছে। সে হোক গে, আমরা তো একশো শতাংশ নিশ্চিত, আর যা-ই হোক, কমিউনিটি ট্রান্সমিশন হতে পারবে না কিছুতেই।

অতএব, লকডাউনের আগেও যা, এখনও তা-ই।

ভরসা সেই এদেশের মানুষের আশ্চর্য বেঁচে থাকার, বেঁচে যাওয়ার ক্ষমতা। ফুটপাথে খোলা আকাশের নীচে গাদাগাদি করে শুয়ে, একবেলা না খেতে পেয়ে, ভোজবাড়ির উল্টোদিকের ডাস্টবিন থেকে খাবার আর টাইমকলের তলায় জমে থাকা জল খেয়ে এদেশে মানুষ বেঁচে থাকে— এমনকি প্যাকাটি হাত-পা আর ফোলা পেটের বেড়ে-না-ওঠা বাচ্চাগুলোও বেঁচে থাকে (ইন ফ্যাক্ট, মরলে শুধু তারা-ই মরবে, এটা আগে বোঝা গেলে খামোখা লকডাউনের হ্যাপা পোয়াতে হত না, এ নিয়ে তো সংশয় নেই সেভাবে)। বেনিয়মে চলা তীব্রগতিতে রেষারেষি করা গাড়ির ভিড়ের মধ্যে দিয়েও কানে মোবাইল নিয়ে কথা বলতে বলতে রাস্তা পার হতে গিয়েও মানুষ, অধিকাংশ ক্ষেত্রে, বেঁচেই যায়। করোনাতেও তা-ই— এর বেশি কিছুও না, কম কিছুও নয়।

এদেশে এসে এমনকি বড় দোকানের জল খেয়ে ফেললেও বিলেত-আমেরিকার সাহেবসুবোদের (এমনকি দেশপ্রেমিক “কালা সাহেবদের”-ও) বাঁহাতের জল শুকোয় না— এখন-তখন অবস্থা হয়— কে বলতে পারে, হয়ত করোনার ক্ষেত্রেও দুই দুনিয়ার মৃত্যুহারের ফারাকের এ-ও বড় কারণ!!

অর্থাৎ, ভরসাটা লকডাউনের আগেও যে “এক্স-ফ্যাক্টর”-এর উপর ছিল, এখনও তা-ই। এক্স-ফ্যাক্টর, যাকে ইমিউনিটি বলতে পারেন, এদেশের প্রাকৃতিক পরিবেশ বলতে পারেন, ভাইরাসের বিশেষ স্ট্রেইন ও তার মারণক্ষমতা বলতে পারেন, এমনকি কপাল-ও বলতে পারেন। সে যা-ই হোক, তার মাঝে লকডাউন যে বড় সাফল্য, মেনে নিতে অসুবিধে কোথায়!!

বাই দ্য ওয়ে, মোদিজি বলেছেন, এদেশে মৃত্যুহার কম হওয়ার কারণ লকডাউন।

আমার অশিক্ষিত লজিক অনুসারে ধারণা ছিল, লকডাউন কার্যকরী হলে যেটা কমার সম্ভাবনা, সেটা ওই সংক্রমণের হার— সংক্রামিত মানুষদের মধ্যে মৃত্যুর হার যেসব ফ্যাক্টরের উপর নির্ভর করে, তার একটিও লকডাউনের কার্যকারিতার সঙ্গে সম্পর্কিত নয়।

কিন্তু, আমি নিশ্চিত জানি, আমি ভুল জানতাম। মোদিজি যখন বলছেন, তার ওপর কি আর কথা হয়!!!

অতএব, লকডাউন সফল— এককথায় এটি একটি ঐতিহাসিক পদক্ষেপ, নজিরবিহীন সিদ্ধান্ত ও বিশ্বের সামনে একটি জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত।

আনলক ওয়ান-ও তাই।

আনলক দুই তিন চার তেমনই হবে।

আর আমি এ-ও নিশ্চিত, আবারও যদি লকডাউন হয়, সে-ও একইরকম ঐতিহাসিক ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি…ই হবে।

আর যা-ই হোক, খামোখা বিচলিত বা চিন্তিত হবেন না, প্লিজ। ডিপ্রেশনের তো প্রশ্নই ওঠে না। নেতারা তো রয়েছেন। আমি নিশ্চিত, সুশান্ত সিং রাজপুত যদি প্রতি সন্ধেয় নিয়মিত টিভিতে দিলীপ ঘোষকে দেখতে পেতেন, এই করুণ পরিণতি তাঁর কিছুতেই হতে পারত না।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4887 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...