Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

সবুজ ঘাসের দেশ দারুচিনি দ্বীপের ভিতর — তৃতীয় বর্ষ, চতুর্থ যাত্রা

স্টেশন মাস্টার

 

...ইতোমধ্যে তাঁহাদিগের পত্রিকা বিষয়নির্বাচনে গুরুগম্ভীর ও ভারিক্কি বলিয়া বাজারে দুর্নাম কিনিয়াছে... অধিকাংশ পাঠক বলেন, কঠিন সব প্রতিষ্ঠানবিরোধী ও আগমার্কা রাজনৈতিক প্রতিপাদ্যে ঠাসা পত্রিকার এক-একটি সংখ্যার সূচিপত্র দেখিলেই নাকি হৃৎকম্প উপস্থিত হয়। অতএব সম্পাদকমণ্ডলী এইবার আদাজল খাইয়া সহজ হইবার সাধনায় নামিয়াছেন। কিন্তু বদস্বভাব সহজে যায় না— যথেষ্ট সহজ বিষয়ও ভাবনার দোষে কঠিন হইয়া দাঁড়ায়। তালবৃক্ষের ন্যায় সরলরৈখিক প্রস্তাবটিও তাঁহাদিগের কূটচিন্তার গুণে বাবলাগাছের প্রায় কণ্টকিত ত্রিভঙ্গমুরারীরূপ পরিগ্রহ করে। ভ্রমণই হউক এই সংখ্যার বিষয়মুখ— এ-পর্যন্ত ভাবিয়াও তাঁহারা অতএব স্বভাবদোষে ভাবনার লাঙ্গুলে একটি মোক্ষম মোচড় কষিলেন। স্থির হইল, ভ্রমণই হউক কেন্দ্রীয় বিষয়, কিন্তু তাহা যেন হয় ‘অন্য ভ্রমণ’।

এইবার এই অন্য ভ্রমণের সংজ্ঞা নিরুপণে নরক দ্বিতীয়দফা গুলজার হইয়া উঠিল। কাহাকে বলিব অন্য ভ্রমণ?...

 

কবি লিখিয়াছিলেন হাজার বছর ধরিয়া পৃথিবীর পথে পথ হাঁটিবার কথা। লিখিয়াছিলেন সিংহল সমুদ্র হইতে মালয় সাগরে– আরও দূরে বিম্বিসার অশোকের ধুসর জগতে– জীবনের সফেন সমুদ্রের মাঝে মানসপরিক্রমার ধারাবিবরণী। পাঠক জানেন, সহস্রাব্দব্যাপী সে অভিযাত্রার অন্তিমে একটি যৎপরোনাস্তি আবিষ্কার ছিল। সে আবিষ্কার কি দারুচিনি দ্বীপের ভিতর সবুজ ঘাসের এক দেশ? নাকি আবিষ্কারের কেন্দ্রে থাকেন অন্য কেহ – মুখ যাঁহার শ্রাবস্তীর কারুকার্য, কেশরাশি যাঁহার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা, পাখির নীড়ের ন্যায় আশ্রয়প্রতিম যাঁহার দুই চোখ…

এই কাব্যের পাঠপ্রসঙ্গে অনুসন্ধিৎসু পাঠকের মনে পড়িতে পারে অদিসেউসের সমুদ্রযাত্রার কোনও-কোনও অনুষঙ্গের কথাও। জীবনানন্দের কবিতায় সময়পরিক্রমার অভিমুখটিযদিচ নিশ্চিতভাবেই পরিক্রমার অন্তিমে, অদিসেউসের ভ্রমণবৃত্তান্তে ভ্রমণটিই হইয়া উঠে কেন্দ্রীয় প্রতিপাদ্য… ক্লান্ত প্রাণ তিনিও– মস্ত যুদ্ধ জয় করিয়া স্বগৃহে ফিরিতেছেন, সেখানে তাঁহার স্ত্রী বিনিদ্র অপেক্ষায়– তথাপি অভিজ্ঞতার বোঝা অদিসেউসের কাছে জানিবার গাঢ় বেদনার অবিরাম অবিরাম ভার বহন করিয়া আনে না। ‘বনলতা সেন’-এর প্রতিতুলনায় ‘অদিসি’-র উল্লেখ অতএব কেবল এই বক্তব্যবিন্দুটিতেই সীমায়িত থাকে যে, একজনের অভিজ্ঞতায় দেখিবার সমস্ত আয়োজন যেখানে সমস্ত দিনের শেষে ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছিয়া ফেলিয়া ঘরে ফিরিবার অন্তিমতায় এক অনির্বচনীয় উত্তরণের নিমিত্তস্বরূপ, অপর ভ্রামণিকটি সেখানে জীবনের পেয়ালা উপুড় করিয়া শেষ বিন্দুটি পর্যন্ত পানের নেশায় অভিভূত থাকিতেই চাহেন… পানেই তাঁহার আনন্দ, পথেই তাঁহার মুক্তি।

… এত গৌরচন্দ্রিকা আবশ্যক হইল, কারণ কথা হইতেছিল ভ্রমণ বিষয়ে। নিতান্ত ব্যবসায়িক কথা। দুর্গাপূজাবকাশ আসিতেছে, মানুষজন সম্বৎসরের বেড়াইতে যাইবার স্থান ও কালবিষয়ে সুলুকসন্ধান করিতেছেন, অথচ আমাদের কাগজে এমত আনন্দ-উদ্যোগের বিন্দুমাত্র প্রতিফলন নাই কেন, ইহাই ছিল সম্পাদকমণ্ডলীর সম্মিলিত আক্ষেপ ও খেদোক্তির বিষয়। ইতোমধ্যে তাঁহাদিগের পত্রিকা বিষয়নির্বাচনে গুরুগম্ভীর ও ভারিক্কি বলিয়া বাজারে দুর্নাম কিনিয়াছে… অধিকাংশ পাঠক বলেন, কঠিন সব প্রতিষ্ঠানবিরোধী ও আগমার্কা রাজনৈতিক প্রতিপাদ্যে ঠাসা পত্রিকার এক-একটি সংখ্যার সূচিপত্র দেখিলেই নাকি হৃৎকম্প উপস্থিত হয়। অতএব সম্পাদকমণ্ডলী এইবার আদাজল খাইয়া সহজ হইবার সাধনায় নামিয়াছেন। কিন্তু বদস্বভাব সহজে যায় না— যথেষ্ট সহজ বিষয়ও ভাবনার দোষে কঠিন হইয়া দাঁড়ায়। তালবৃক্ষের ন্যায় সরলরৈখিক প্রস্তাবটিও তাঁহাদিগের কূটচিন্তার গুণে বাবলাগাছের প্রায় কণ্টকিত ত্রিভঙ্গমুরারীরূপ পরিগ্রহ করে। ভ্রমণই হউক এই সংখ্যার বিষয়মুখ – এ-পর্যন্ত ভাবিয়াও তাঁহারা অতএব স্বভাবদোষে ভাবনার লাঙ্গুলে একটি মোক্ষম মোচড় কষিলেন। স্থির হইল, ভ্রমণই হউক কেন্দ্রীয় বিষয়, কিন্তু তাহা যেন হয় ‘অন্য ভ্রমণ’।

এইবার এই অন্য ভ্রমণের সংজ্ঞা নিরুপণে নরক দ্বিতীয়দফা গুলজার হইয়া উঠিল। কাহাকে বলিব অন্য ভ্রমণ? সম্পাদকগণ একপ্রকার ঐকমত্যে আসিলেন যে, আর যাহাই হউক, অমুকদিবস প্রভাতে হোটেলবালক চা লইয়া আসিল, প্রাতঃকৃত্য সারিয়া ক-স্থান হইতে খ-স্থানে গেলাম, অমুক হোটেলে উঠিয়া প্রথমরাত্রে তমুক খাদ্যবস্তু অর্ডার করিলাম, ইত্যাকার তথ্যপঞ্জী যেন কদাচ না-থাকে। ‘না-থাকে’-র তালিকা এইপ্রকারে সুনিশ্চিত করা গেলেও, ‘কী থাকিবে’-র পাল্লা খালিই পড়িয়া রহিল। অনেক ভাবিয়া অবশেষে স্থির হইল, ভ্রমণের বহিরঙ্গটি নয়, ভ্রমণের কেন্দ্রস্থিত আবিষ্কারের এষণাটিই হইবে আমাদের বিষয়কোরক। সম্পাদকমণ্ডলীর জনৈক বর্ষীয়ান, ফলতঃ সমধিক তালেবর, এক সদস্য এই স্থলে সহসা একটি গল্প ফাঁদিলেন – কবে তাঁহার কোন এক বান্ধবী নাকি ‘মাই নেম ইজ রেড’ পড়িয়া শ্রী অরহান পামুককে আবিষ্কারের উদ্দেশ্যে ইস্তানবুল পাড়ি দিয়াছিলেন, অদ্যবধি ফিরেন নাই – সেই আজগবি গল্প শুনাইয়া তিনি প্রস্তাব করিলেন, এমনই বিচিত্র সব ঘটনাসন্নিবেশ যেন লেখাগুলিতে উপস্থিত থাকে! সেখানেই না-থামিয়া, অনির্দ্দেশ্যের উদ্দেশে দৃক্‌পাত করিয়া যখন তিনি বলিলেন, “কেমন হয়, আমরা যদি রচনাগুলির মধ্যে এক-একটি গোটা দেশকে তাহার রামশ্যাম-রাজাগজা-লোকলস্কর-বাজারহাট-অফিসআদালত-পাইকবরকন্দাজ-মণ্ডামেঠাই-ফলপাকুড়-পোশাকপরিচ্ছদ-হাতিশাল-ঘোড়াশাল-সমেত একবহুবর্ণ মোজাইক চিত্রের ন্যায় তাহার আনন্দদুঃখবিষাদবেদনার পটভূমি হইতে গোটাগুটি তুলিয়া আনিতে পারি…” তখন সম্পাদকমণ্ডলীর বাকি সদস্যদিগের যুগপৎ বিস্ময় ও বিভ্রান্তির আর অবধি রহিল না।

এইপ্রকারে সংখ্যাটির ভরাডুবি যখন প্রায় নিশ্চিত হইয়া আসিয়াছে (পাঠক এই স্থলে “হাল ভেঙে যে নাবিক হারায়েছে দিশা” বাক্যাংশটি পুনর্বার স্মরণ করুন), সেই সময়, দৈবাৎ, আশ্চর্য স্ফটিকখণ্ডের ন্যায় দ্যুতিময় কয়েকটি ভ্রমণবিষয়ক নিবন্ধ সম্পাদকমণ্ডলীর হাতে আসিয়া পৌঁছিল। অতিদূর সমুদ্রের পর দারুচিনি দ্বীপের ভিতর সবুজ ঘাসের দেশ খুঁজিয়া পাওয়ার মতনই অনির্বচনীয় সেই মহদাবিষ্কার। নীলাঞ্জন হাজরা, স্বাতী ভট্টাচার্য, সুমন গুণ, যশোধরা রায়চৌধুরী, ব্রতীন্দ্র ভট্টাচার্যশ্রীজাতা গুপ্ত-রচিত মায়াময় সেই ছয়টি শ্যামল উৎপন্ন সম্পাদকমণ্ডলী পরম কৃতজ্ঞতায় ও যত্নে এই সংখ্যার ‘রিজার্ভড বগি’-তে সওয়ার করাইয়া দিলেন।

রিজার্ভড বগি ব্যতিরেকে আর যে বিষয়গুলি জানাইবার, চার নম্বর প্ল্যাটফর্মের অগস্ট সংখ্যার স্মরণ বিভাগে সদ্যোপ্রয়াত প্রখ্যাত আর্জেন্তিনীয় সাংবাদিক অ্যান্ড্রু গ্রাহাম ইউলকে লইয়া লিখিয়াছেন সত্যব্রত ঘোষ। ঝাড়খণ্ডের প্রবাদপ্রতিম কমিউনিস্ট নেতা প্রয়াত অরুণকুমার রায়ের স্মৃতিচারণ করিয়াছেন প্রশান্ত ভট্টাচার্য। একইসঙ্গে, কমরেড এ কে রায়কে কেন্দ্রীয় চরিত্র করিয়া লিখিত অজিত রায়ের উপন্যাস ‘হিরণ্যরেতা’-র অংশবিশেষ আমরা প্রাসঙ্গিকবিধায় পুনঃপ্রকাশ করিলাম ‘স্টিম ইঞ্জিন’ বিভাগে।

উল্লেখ্য, এই সংখ্যা হইতেই শুরু হইতেছে মৃণাল চক্রবর্তীর একেবারে ভিন্ন স্বাদের নূতন ধারাবাহিক উপন্যাস, ‘সন্তোষ পাল’।

এতদ্‌ব্যতীত অন্যান্য সকল নিয়মিত বিভাগ— গল্প, অণুগল্প, অন্যগদ্য, কবিতা, প্রবন্ধ, পুস্তক-আলোচনা, ফটোফিচার, অনুবাদ সাহিত্য সকলই যথাযথ প্রকাশিত হইল। রহিল মেল ট্রেনের দুটি বিশেষ বিভাগ সবুজ স্লিপার এবং ভালো খবর-ও।

এত কথার পর নটেগাছটি মুড়ানো ছাড়া আর কোনও কৃত্য অবশিষ্ট থাকে না। কিন্তু বৃক্ষচ্ছেদন কদাপি কাজের কথা নহে, বর্তমান উষ্ণায়নের প্রেক্ষিতে তো আরওই নহে। ফলে, আমাদিগের কথা ফুরাক, কিন্তু নটেগাছগুলির ভাল হউক, উহারা সর্বত্র বিনা প্রতিবন্ধকতায় বাড়িয়া চলুক।

ওই ট্রেন নড়িয়া উঠিল। আপনাদিগের যাত্রা শুভ হউক। সকলে ভাল থাকুন…