দ্বিতীয় বর্ষ, ষষ্ঠ যাত্রা : এসেছে শরৎ, লেখার পরত

স্টেশন মাস্টার

 

পাবলিক মেমরি ইয়ানি কি জনস্মৃতি যদিচ শর্ট অর্থাৎ ভাষান্তরে ক্ষণস্থায়ী, ধীমান পাঠকবন্ধুবর্গের বিলক্ষণ ইয়াদ থাকিবে কি আমরা যখন ঘোর বর্ষার মধ্যে চারনম্বর প্ল্যাটফর্মের জুলাই-অগস্ট সংখ্যার বিষয়সূচি নির্ধারণ লইয়া খাবি খাইতেছিলাম, ঠিক তখনই, মহাসমারোহে, বর্ষণক্লান্ত ও কর্দমকণ্টকিত কলিকাতার বুকস্টলগুলির দখল নিতে আবির্ভাব হইতেছিল স্ফীতোদর শারদসাহিত্যপত্রিকাগুলির। আয়তনবাহুল্যে তাহাদিগকে আদৌ পত্রিকা বলা চলে নাকি সাহিত্য-পোর্টমান্টো বলিলেই অধিকতর সমীচীন হয় তাহা ভিন্ন অপিচ প্রাসঙ্গিক বিতর্ক, কিন্তু সে-বিতর্কে প্রবেশের আগে বটমলাইন এই যে, তখনও কলিকাতায় বিলক্ষণ গগন ভরি বরিখন্তিয়া — শরতের টিকির নাগালের বদলে মেঘমাশ্লিষ্ট সানুদেশে বর্ষণমেঘের পিক-মনসুন বপ্রক্রীড়া। বেণীমাধববাবুর পঞ্জিকার পাতা ব্যতীত আর কোত্থাও তখনও শরৎকালের চিহ্নমাত্র আছিল না — রাস্তায় বারোয়ারির ম্যারাপের বাঁশ পড়া দূরস্থান, অর্ধেক পূজাকমিটি তখনও বিলবহিটিও ছাপাইয়া উঠিতে পারে নাই। সরকার বাহাদুর ক্লাবগুলিকে পূজার ব্যয়ভারবহনবিধায় খয়রাতির বিষয়ে সবে মনস্থির করিয়া ফেলিয়াছেন, কিন্তু চাঁদার অর্থমূল্য তখনও ধার্য হইতে বাকি – ফলতঃ স্থানে-স্থানে পূজাকমিটির প্রেসিডেন্ট ও সেক্রেট্রি শ্রীযুক্ত জগাই-মাধাই তাঁহাদিগের অঙ্গসংবাহকমণ্ডলী সমভিব্যাহারে সবুজ শালু টাঙাইয়া বসিলেও মালকড়ির সুরাহা না-হওয়ায় আলোচনা বিশেষ অগ্রসর হয় নাই। এমত বিচিত্র অপ্রস্তুত অবস্থার মধ্যে অকস্মাৎ সাহিত্যে শরৎ উদ্‌যাপনের ধুম লাগিল – প্রথম শ্রেণির দৈনিকে সিকিপৃষ্ঠা, আধাপৃষ্ঠা-জোড়া বিজ্ঞাপনে অমুকবাবুকে লেখা তমুকবাবুর অপ্রকাশিত পত্রাবলীর ঘোষণাসমেত শারদসাহিত্যের আগমনবার্তা শোভা পাইতে লাগিলেন।

মাতিয়া উঠিবার মতো যেমন-তেমন একটি হুজুক পাইলে বাঙালি আর কিছু চাহে না, অতএব প্রথম শ্রেণির দেখাদেখি দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির পত্রিকারাও পত্রপাঠ মাঠে নামিয়া পড়িলেন। রাস্তার জল তখনও পুরা নামে নাই, কিন্তু সাহিত্যরসিক জানেন যে গণ্ডুষজলমাত্রে যেমন সফরী ফরফরায়তে, তেমনই এই স্বল্প জলে ডেঙ্গিমশকের চাষ উত্তম হয়। অতএব দেখিতে-দেখিতে বাঙলা বহিবাজারের পয়ঃপ্রণালী শারদসাহিত্যের মহাপ্লাবনে উপচিয়া গেল, দোকানে আর ধরে না। কিন্তু বিক্রেতাদের আক্ষেপ, বিক্কিরি নাকি তেমন নাই — যত সংখ্যায় ছাপা হইয়া আসিতেছে তত সংখ্যায় নাকি কাটিতেছে না। তখন উপায়ান্তর না-দেখিয়া সার্কুলেশন দফতরের বিলাতফেরত ম্যানেজমেন্ট-গুরু নিদান দিলেন, কাগোচ বাজারে যদি ধীরে কাটে তবে তাহার শেল্‌ফ-লাইফ বাড়াইয়া দাও, পূজাসংখ্যা বর্ষায়, চাই কি ভর-গ্রীষ্মেও বাজারে ছাড়িয়া দাও, তাহাতেও বিক্কিরি না-হইলে অনলাইনে দাও — পাবলিকের সাধ্য কী না-গিলিয়া থাকে। গুরুবাক্য মিথ্যা হইবার নহে — অতএব সায়াব্লাউজের দোকান, চটিজুতার দোকান ও মণ্ডামিঠাইয়ের দোকানের সঙ্গে পত্রিকাহৌসের মার্কেটিং টাই-আপ (মতান্তরে সাঁট) হইল, অ্যাড আসিল — এতটাকার কেনাকাটা করিলে এতগুলি শারদপত্রিকা বিলকুল ফিরি। বাঙালি অতএব খুশিমনে সায়াসেমিজ ও জুতার সহিত বাঙলাসাহিত্যের শারদ উৎপন্নের খরিদারি বগলদাবায় বহিয়া কান এঁটো করা হাসিবদনে বাটী ফিরিতে লাগিলেন। বাবুর কন্যাটি সন্ধ্যার ঝোঁকে ফেসবুকে লাইভ হইয়া লিখিলেন, পুজোসংখ্যা মানেই কাশফুল আর সৈসবের গন্ধ — দন্ত্য স-এর আধিক্যহেতু বাল্যকালের সে গন্ধটি ঈষৎ টসকাইয়া গেলেও সাহিত্যপ্রিয় বাঙালির তাতে বিন্দুমাত্র রসবিকৃতি ঘটিল না, পরন্তু ফটাফট লাইক পড়িয়া চণ্ডীমণ্ডপে পায়রা উড়াইয়া দিলে। এদিকে পত্রিকার মালিক বড় খলিফা লোক — তিনি পূর্বাহ্নেই আঁক কষিয়া দেখিয়াছেন যে, বিজ্ঞাপন যাহা আসিয়াছে তাহাতেই ছাপার খরচ উঠিয়া লাভের কড়ি ঘরে ঢুকিয়া গিয়াছে, অতএব তাঁহারও হাসিগুলি জোয়ারের গঙ্গার ন্যায় উত্তরোত্তর কুলপ্লাবী হইয়া উঠিল। কুল মিলাকে, সবপক্ষই খুশিয়াল রহিল, শারদসাহিত্যলক্ষ্মী কাশফুলের মতো মাঠাঘাটে ছড়াইয়া পড়িয়া হাসিতে লাগিলেন। বেদম সেই হাসির পশ্চাতে সাহিত্যের সিদ্ধি, নাকি নিছকই সাহিত্যনেশাড়ুর সেবাবিধায় সংগৃহীত ভাঙের গুলির মাত্রাতিরিক্ত মৌতাত — সেই তর্ক, বাহুল্যবোধে, অমীমাংসিতই রহিয়া গেল।

কিন্তু বঙ্গভূমে তেএঁটে নিন্দকের অভাব কোনওকালেই নাই, তাহাদের কেহ-কেহ প্রশ্ন করিল, বিজ্ঞাপন না হয় যেমন-তেমন, কিন্তু তাহা বাদ দিয়া যে এডিট-পাতাগুলি, তাহা ভরানো হইবে কী উপায়ে? সে বিষয়ও সম্পাদক পূর্বেই সবিশদ ভাবিয়া রাখিয়াছেন। তিনি জানেন, আগেকার কালে পাঠক শারদসংখ্যার জন্য অপেক্ষমান থাকিতেন, এ-কালে লিখিবার ডাক পাইবার জন্য অপেক্ষমান থাকেন লেখকেরা। অতএব তিনি হৃষ্টচিত্তে বরাত দিতে বসিলেন – অমুকটি বড় মায়াবী, পরন্তু জেলার পুস্তকমেলায় ভাল যোগসাজশ, ওকে একটু আনিশ দাও… তমুকটির গদ্যের হাত ভাল, পরন্তু সে ফি-রোব্বার সকালে আমার বাসায় ইয়ে শোনাতে আসে, ওকে একটু আনিশ দাও… এইভাবে চক্ষের নিমেষে লেখকসূচি চূড়ান্ত হইল, চাহিতে না-চাহিতে লেখকেরা লেখাহস্তে সম্পাদকীয় দফতরে আবির্ভাব হইলেন… সবেডিটর যুবা বামপার্শ্বের মার্জিনে খসখস করিয়া বডি-বারো-পয়েন্ট-লেখকনাম-বডিপয়েন্ট-বোল্ড-বেলেআর লিখিয়া সে কাগজ কম্পোজিটরের টেবিলে তুরন্ত চালান করিয়া দিলেন, এইপ্রকারে শরদাগমের বহু পূর্বেই নীলাকাশে সাদা মেঘের ভেলার পরিবর্তে পরতের পর পরত লেখা রাশিকৃত, পুঞ্জীভূত, স্তূপীকৃত হইতে লাগিল এবং লেখকগণ হরষিতচিতে গৃহে ফিরিয়া ফেসবুকে উপুড় হইয়া পড়িলেন। পরদিবস তাঁহাদিগের পোস্ট ভাইরাল হইলে জানা গেল, তাঁহারা কেহই বেশি লিখেন না, কিন্তু এমন নাছোড় চাহিলে লেখা না-দিয়া উপায় থাকে না… অতএব…

এমন বিচিত্র শারদসাহিত্যবাজারের মধ্যখানটিতে বসিয়া, ভো পাঠক, চারনম্বর প্ল্যাটফর্মের সম্পাদকমণ্ডলী শুরুতে মনস্থ করিয়াছিলেন কি সমকালীন শারদসাহিত্যের ধুদ্ধুড়ি নাড়িয়া একেবারে বারোটা বাজাইয়া ছাড়িয়া দিবেন। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল, সমর সেনেদের দিন গিয়াছে। সম্পাদকমণ্ডলীর ডম্ফাই আর বাহ্বাস্ফোটই সার — খুঁজিয়া-পাতিয়া এমন লেখক এ ধরাধামে পাওয়া গেল না যিনি বুকে হাত দিয়া বলিতে পারেন বাংলাসাহিত্য নামে যাহা হইতেছে তাহা বিলকুল অপাঠ্য — খাজা ও ভুষিমাল। অতঃপর সম্পাদকমণ্ডলী, ঘাট হইয়াছে মানিয়া, আপনাপন সাঞ্চো পাঞ্জা অবতাররূপ পরিত্যাগ-পূর্বক ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষে উমেশ বোনার্জির নেতৃত্বাধীন ন্যাশনল কাংগ্রেসের ন্যায় সুগৃহীসুলভ একটি নরমপন্থী ও মেনিমুখো অবস্থান নিলেন। কণ্ঠস্বর যথোচিত মিনমিনে করিয়া কহিলেন, কালিকার শারদসাহিত্য কেমন ছিল বনাম আজিকার শারদসাহিত্য কেমন হইতেছে, আমরা কেবল তাহারই চিত্রটি ধরিতে চাই। অহো! এইপ্রকারে সম্পাদকদিগের কালাপাহাড়ি অস্তমিত হইয়া আসিল, পরিবর্তে একটি কাছা ও পৈতাধারী নাদান রূপ ক্রমে শোভা পাইতে লাগিল। নিজেদের যথাবিধি স্যানিটাইজ্‌ করিয়া তাঁহারা সুভদ্র হইলেন। বাংলার শারদসাহিত্য, এ-যাত্রা বাঁচিয়া গেল।

অধুনা বাংলা শারদসাহিত্যের হালহকিকৎ লইয়া আমাদিগের এই সংখ্যার রিজার্ভড বগি-তে লিখিলেন সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়, যশোধরা রায়চৌধুরী, প্রতিভা সরকার, দেবতোষ দাশ, সর্বজিৎ সরকার, সুবীর সরকারসৌমিত দেব

লেখার প্রায় শেষে আসিয়া মনে পড়িল সুপ্রাচীন সেই গ্রিক প্রবাদটি। মেগা বিবলিওন মেগা কাকোন। বাংলায় তাহার অর্থ দাঁড়ায়, বইয়ের কলেবর যত স্ফীত, তাহা সাহিত্যের তত বড় জঞ্জাল। সে প্রবাদ বাংলা শারদসাহিত্যের ক্ষেত্রে কতদূর প্রযোজ্য, আদৌ প্রযোজ্য কি না, মহামতি পাঠক তাহা নিজগুণে বিচার করিবেন।

এতদ্‌ব্যতীত পত্রিকার অন্যান্য নিয়মিত বিভাগনিচয় — যথা, স্মরণ, প্রবন্ধ, গল্প, অন্যগদ্য, অণুগল্প, কবিতা, অনুবাদ সাহিত্য, হুইলার্স স্টল, ভালো খবর ও ধারাবাহিক উপন্যাস – সকলই যথাযথ রহিল।

পরন্তু, আপনাদিগের অনুরোধ শিরোধার্য করিয়া, এই সংখ্যা হইতে শুরু হইল পরিবেশ-বিষয়ক নিবন্ধের নতুন বিভাগ – সবুজ স্লিপার। লিখিলেন পরিমল ভট্টাচার্য। অপরাপর বিভাগের ন্যায়, এই বিভাগটিও আমরা নিয়মিত প্রকাশ করিব।

শারদীয়ার যদিচ এখনও পক্ষাধিককাল বাকি, তথাপি বলি, শারদীয়ার প্রণাম নিবেন। ভাল থাকিবেন…

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4659 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...