নীলাঞ্জন হাজরা
নক্শ ফরিয়াদি হ্যায় কিসিকি শওখি-এ-তহরির কা
কাগ়জ়ি হ্যায় প্যায়েরহন হর প্যায়কর-এ-তসবির কা৷৷
লেখালিখির এ কৌতুক আসলে কোন অভিযোগী হৃদয়ের ছাপ
হরেক ছবির দেহে কাগুজে পোশাক৷–মির্জ়া অসদুল্লা খান গ়ালিব
যে বুকে কোনও অভিযোগ নেই সে মহাসুখী মানুষটিকে ঈর্ষে করি৷ লেখালিখির প্রয়োজন তাঁর বিন্দুমাত্র নেই৷ কিন্তু তেমন মানুষ বোধ করি দুর্লভ৷ আমারও দু’কথা বলার ছিল, কিন্তু, আহা, কেউ শুনল না — এমন অভিযোগের বুড়বুড়ি কখনও কাটে না তেমন হৃদয়তল মেলা দুষ্কর৷ এও বড় কৌতুককর অবিশ্যি যে, হরেক হৃদয়েরই নিশ্চিত ধারণা তাঁর প্রতিটি কথাই এমন অমোঘ যে, দুনিয়ার সক্কলের সব কাজ ফেলে সবার আগে সেগুলি পড়ে ফেলা দরকার৷ আগে ভাগে মির্জ়ার সঙ্গে পরিচয় করে ফেলায়, মন থেকে সে ধারণাটা তাড়াতে পেরেছি৷ অতএব, যা লিখব তা আখুরে পোশাকে টুকরো টাকরা কিছু ছবি৷
মুসাফিরি: ১
স্যান্টা ফে
আলবুকার্কি এয়ারপোর্ট থেকে ট্যাক্সি নিয়ে যদ্দূর মনে পড়ছে ঘণ্টা খানেক৷ গাড়ি থেকে নামার সময় মাটিতে পা রাখতেও কিন্তু-কিন্তু লাগছিল৷ এমন পিকচার-পোস্টকার্ডের মতো শহর জীবনে আর একটি মাত্র দেখেছি আমি৷ অনেক আগে— মিস্টিক৷ স্যান্টা ফে-র মতো একরত্তি সে শহরও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই৷ তবে এ আমার প্রথম মার্কিন মুলুকে আসা নয়৷ প্রথমবার, সে অনেক অনেক বছর আগে — নেমেছিলাম ওয়াশিংটন ডিসি-র ছোট্ট ডালেস এয়ারপোর্টে৷ নেমেই পর পর দু’টি খাসা অভিজ্ঞতা৷
ইমিগ্রেশন কাউন্টারে আমার পাসপোর্টের সঙ্গে কলকাতার মার্কিন কনসুলেটের আইডি কার্ডের ছবি মিলল না৷ কাউন্টারের শ্বেতাঙ্গিনী আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন তো তাকিয়েই আছেন৷ সাধ যেন আর মিটছে না৷ সাধ মিটল না৷ আর এক শ্বেতাঙ্গ সহকর্মীকে ডেকে এনে পরখ করতে বললেন পাসপোর্ট ও আইডি-র মুখ দু’টি একই কিনা৷
শ্বেতাঙ্গ মাতব্বর৷ বাঁকা হাসি হেসে আমায় জিজ্ঞেস করলেন, কনসুলেটের আইডি-র ছবিটি যিনি তুলেছেন তিনি মাতাল কিনা৷ ফস করে মুখ থেকে বেরিয়ে গেল — আমার তো সব অ্যামেরিকানকেই সারাক্ষণ মাতাল মনে হয়, দম্ভে৷ বিড়বিড় করেই অবিশ্যি৷ মাতব্বর শুনতে পেয়েছিলেন কিনা কে জানে৷ পেলেও পাল্টা জবাব আসেনি৷ কেবল একটা জ্বলন্ত দৃষ্টি দিয়ে তারপর হুকুম — Please step out of the line and wait here Sir!
সরে দাঁড়ালুম৷ এবার পিছনের দিকের একটা ঘরে আমার ডাক পড়ল৷ ফাঁকা ঘর৷ একটা সোফা, একটা টেবিল আর একটা স্যুইভল চেয়ার৷ আমাকে সোফায় বসতে বলা হল৷ দড়াম করে দরজা বন্ধ করে শ্বেতাঙ্গ বিদায় নিলেন৷ একা বসে আছি ঘরটায়, যেটার সঙ্গে হলিউডের ছবিতে দেখা ইন্টারোগেশন চেম্বারের আশ্চর্য মিল৷ ততক্ষণে বিপ্লব ক্যাজুয়াল লিভ নিয়েছে, আমার বুকের তলা থেকে উপর দিকে একটা হিম ভাব উঠতে শুরু করেছে৷ ভয়৷ প্রায় আধঘণ্টা পরে এক প্রৌঢ় কৃষ্ণাঙ্গ অফিসার দুলে দুলে হেঁটে আমার সামনে হাজির হলেন৷ ঠিক যেমনটি দেখা যায় হলিউড মুভিতে৷ ফুট সাতেক লম্বা৷ ফুট চারেক চওড়া৷ সুন্দরবনের মানচিত্রের মতো বলিরেখায় ভরা মুখ৷ কুতকুতে চোখ৷ চোখে আশ্চর্য স্নিগ্ধ একটা হাসি৷
‘What’s your problem, Son?’ অফিসার স্যুইভল চেয়ারটার উপর ভেঙে পড়লেন৷ কিছুটা সময় ভেবে, উত্তর দিলাম— I’m sorry, but the problem appears to be on your part, Sir৷ ভদ্রলোক এরপর আমার সব কাগজপত্র অনেক্ষণ ধরে দেখতে থাকলেন৷ ওঃ! কী দীর্ঘ সেই দেখা, যেন আর শেষই হয় না৷ আমার বুকের মধ্যে ঘোড়দৌড়ের স্পিড নিমেষে নিমেষে বেড়ে চলেছে৷ পরে ঘড়ি দেখে বুঝেছিলাম প্রায় মিনিট তিনেক! দেখে-টেখে পিঠে একটা বিরাশি সিক্কার চাপ্পড় মেরে জানিয়ে দিলেন, ‘It’s all fine. Git goin’ Son!’
তারপরেই খেলা জমে উঠল৷ স্টেট ডিপার্টমেন্টের সংশ্লিষ্ট আপিস আমায় বলে দিয়েছিল, এয়ারপোর্টের বাইরে বেরিয়ে দেখবে নীল রঙের শাটল৷ তাতে চড়ে ড্রাইভারকে ঠিকানা বলবে, আর পাঁচজনকে নামাতে নামাতে তোমাকেও তোমার ঠিকানায় পৌঁছে দেবে৷ ভাড়া আমরা রিইমবার্স করে দেব৷ ট্যাক্সি নিলে তোমার পকেট থেকে যাবে৷ বেরিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা একটি শাটল-এ সুবোধ বালকের মতো উঠে পড়লাম৷ তরুণ ড্রাইভারটিকে ঠিকানাটা বলে জিজ্ঞেস করলাম, এ শাটল সেখানে যাবে তো? সে একগাল হেসে বলল, ‘ইয়েস, ইয়েস৷’
তারপর আর খেয়াল করিনি৷ খেয়াল করলেও অবশ্য কিছুই বুঝতাম না৷ জানালা দিয়ে আশ্চর্য নতুন পরিপাটি শহর দেখছি৷ প্রথম দুনিয়ায় সেই আমার প্রথম পা রাখা৷ অবিশ্বাস্য৷ এত পরিচ্ছন্ন, এমন আশ্চর্য পরিপাটি কোনও শহর হতে পারে? আমার দরিদ্র দেশের যা কিছু আমার মজ্জায়, প্যাচপ্যাচে ঘামের গরম, হুল্লোড়, জঞ্জালের ভ্যাট, ঘা-দগদগে ভিখিরি, তারস্বরে হাজার গাড়ির হর্ন, গরুর মতো বাসের কান টানতে টানতে আর পাছায় চাপড় মারতে মারতে কন্ডাক্টারের হুঙ্কার, আর যা-কিছু, এখানে সব কিছু ঠিক তার উল্টো মেরুতে৷ মশগুল হয়ে পড়ি৷
অবশেষে দেখি এক পেল্লায় হোটেলে গিয়ে গাড়িটা দাঁড়াল৷ আর তার পরেই উঠে এলেন একদল জার্মান ছেলে-বুড়ো-মহিলা-পুরুষ৷ আবার গাড়ি চলতে শুরু করল৷ এবার খানিকটা সজাগ৷ আধ ঘণ্টাটাক হতে চলল৷ গলা বাড়িয়ে আর একবার ড্রাইভারকে শুধালাম, ‘এক্সকিউজ মি৷ আমরা কি এবার আমার ঠিকানায় যাব?’ তরুণটি আরও চওড়া হেসে উত্তর দিল, ‘ইয়েস ইয়েস৷’ এ দিকে আমার কেমন সব চেনা-চেনা ঠেকতে শুরু করেছে৷ একটু পরেই স্পষ্ট বুঝলাম আমরা যে পথে এসেছি, সেই পথেই ফিরে চলেছি৷ বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল৷ ফের ড্রাইভারকে মুখ বাড়িয়ে শুধালাম, আমরা তো মনে হচ্ছে এয়ারপোর্টে ফিরে যাচ্ছি, তাই না? সে আগের বারের থেকে আরও একটা খোলতাই হাসি দিয়ে উত্তর দিল, ‘ইয়েস ইয়েস৷’ আর তখনই প্রথম আমার সন্দেহটা প্রখর হল৷
প্রায় কঁকিয়ে উঠি, ‘Excuse me, do you understand English?’ আমার দিকে এক পলক ফিরে সে শিশুর মতো নিষ্পাপ হাসিতে দু’চোখ ভাসিয়ে উত্তর দিল — ‘English? No, no. No English’৷ সাবাশ৷ শুনলে অবিশ্বাস্য মনে হবে, কিন্তু মার্কিন মুলুকে নেমে বিমানবন্দরের নিরাপত্তা কর্মী ছাড়া যে নাগরিকটির সঙ্গে আমার প্রথম মোলাকাত হল তিনি একটি শব্দও ইংরেজি জানেন না! এয়ারপোর্টে পৌঁছে বুঝলাম এটি সেই পেল্লায় পাঁচ-তারা হোটেলের নিজস্ব শাটল৷ বাইরে থেকে এয়ারপোর্টে আসা হোটেলের অতিথিদের এ গাড়ির নম্বর দেওয়া থাকে৷ তাঁরা উঠে পড়েন৷ গাড়ি তাঁদের হোটেলে নিয়ে চলে যায় সোজা৷ আবার প্রয়োজনমতো হোটেল থেকে তুলে এয়ারপোর্টে পৌঁছে দেয়৷
এরপর আর কোনও ঝুঁকি নিইনি৷ সোজা এক নিরাপত্তাকর্মীর শরণাপন্ন হই৷ তিনি আমায় সঠিক শাটল দেখিয়ে দেওয়ার পর অবিশ্যি আমি আমার হোটেলে পৌঁছেছিলাম নির্বিঘ্নেই৷ সেই সফরেই গিয়েছিলাম হার্টফোর্ড কানেটিকাট-এ মিস্টিক নদীর উপর ছবির মতো প্রায়-গ্রাম মিস্টিক-এ৷ কিন্তু সে ছবি হয়তো অন্য কোনও দিন৷
আজ স্যান্টা ফে৷ যেমনটা বলছিলাম, এই পিকচার পোস্টকার্ড শহরে ঢুকেছিলাম আলবুকার্কি বিমানবন্দরে নেমে ট্যাক্সি নিয়ে৷ এসেছি মার্কিন সরকারের একটা ট্রেনিংয়ে৷ আমারই মতো বিভিন্ন দেশের মার্কিন দূতাবাসের আরও কয়েক জন কর্মী এসেছেন৷ সকলেই এসেছেন ওই আলবুকার্কি দিয়েই৷ সেটাই কাছাকাছি সব থেকে বড় এয়ারপোর্ট৷ স্যান্টা ফে-তেও একটা এয়ারপোর্ট আছে৷ কিন্তু ছোট্ট৷ ফেরার সময় সকলে ফিরলও আলবুকার্কি দিয়ে৷ একমাত্র আমিই ঠিক করলাম ওই ছোট্ট বিমানবন্দর দিয়েই ফিরব৷ সেখান থেকে শিকাগো৷ শিকাগো থেকে ইস্তানবুল৷ কেন এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আজ আর মনে নেই৷ কিন্তু ভাগ্যিস নিয়েছিলাম৷
এত ছোট এয়ারপোর্ট আমি বার দুয়েক দেখেছি — শিলিগুড়ির কাছে নেপালের কাকরভিটা, টিকিট হারিয়ে ফেলে যেখান থেকে একবার টিকিট ছাড়াই কাঠমান্ডু উড়েছিলাম (সে সব ছিল অন্য দিন কাল!), আর তার অনেক পরে, ইরানের পশ্চিমে আজ়রবইজানের রাজধানী খোই৷ আজ কী অবস্থা জানি না, কিন্তু সে দিন কাকরভিটা বিমানবন্দর যাব বলায় শিলিগুড়ি থেকে ভাড়া করা গাড়ি মিনিট পঁয়তাল্লিশ পরে বিস্তীর্ণ হলুদ সরষে ক্ষেতের মধ্যে একটা হলদেটে হল ঘরের সামনে আমায় নামিয়ে দিয়ে বিদায় নিল৷ আর তারপরেই খেয়াল হল পকেটে টিকিটটা নেই৷ দৌড়ে হল ঘরে ঢুকে দেখি দেওয়ালের গায়ে সারি সারি চেয়ার৷ একটার ওপর কাঁধের রুকস্যাকটা রেখে তার প্রত্যেকটা পকেট, ব্যাগের মূল থলেটা তন্ন তন্ন করে খুঁজছি — কোত্থাও নেই৷ এরই মধ্যে পাশ থেকে মিষ্টি গলায় প্রশ্ন উড়ে এল — Is there a problem? এক নেপালি মহিলা৷ আমারই বয়সি৷ মানে তিরিশের নীচে৷ পরনে জিন্স আর কালো শার্ট৷ রং করা খয়রিটে চুল৷ লম্বাটে মুখ৷ মুখে একগাল হাসি৷ আমার মাথায় তখন বাজ, আর এ কিনা ফ্যালফেলিয়ে হাসছে! মুখ দিয়ে একটা গালি প্রায় বেরিয়েই গিয়েছিল৷ সামলে নিয়ে এক বাক্যে বললুম সমস্যাটা৷
‘সর্বনাশ৷ কোথায় ফেলেছ?’
‘শিলিগুড়ির হোটেলে নির্ঘাৎ৷’
‘ফোন করে আনানো যায় না, ফ্লাইট তো এখনও ঘণ্টা খানেক দেরি?’
‘ফোন নম্বর নেই৷’
তারপরেই চিন্তাটা খেলে গেল মাথায়৷ টিকিটটা করে দিয়েছিল আমার বন্ধু স্থানীয় ট্র্যাভেল এজেন্ট দীপক৷ তাঁকে একটা ফোন করলে হয়৷ এ মোবাইল-যুগের আগের কথা৷ এয়ারপোর্টে কোনও পাবলিক ফোন নেই৷ অনেক অনুনয় করে ‘এনকোয়্যারি’ গোছের একটা অফিস থেকে দীপককে ফোন করি৷ ‘কোনও চিন্তা করবেন না দাদা৷ আমি দেখছি৷’ এও অবিশ্বাস্য, কিন্তু সে দিন কাকরভিটা থেকে কাঠমান্ডু উড়েছিলাম বিনা টিকিটেই৷ রোদ্দুরে সরষে ক্ষেতের মধ্যে ২২ সিটারের প্লেনে লাইন দিয়ে ওঠার সময় সেই মহিলা দেখি ঠিক আমার সামনে৷ সে দার্জিলিংয়ে কোনও একটা স্কুলে পড়ায়৷ নেপালে বাড়ি ফিরছে পুজোর ছুটিতে৷ হঠাৎ পিছনে ফিরে ফের একগাল হেসে জানতে চাইল এ পথে আমার প্রথম যাত্রা কিনা৷ ‘ইয়েস৷’ ‘তাহলে ডান দিকের সারির সিট নিয়ে বসো৷’ উপদেশ নিয়েছিলাম৷
আর নিয়েছিলাম বলেই যে অভিজ্ঞতা হয়েছিল তার শিহরণও কখনও মন থেকে মুছবে না৷ ঠিক মনে নেই ওড়ার কতক্ষণ পরে, কিন্তু খুব বেশিক্ষণ নয়, জানালার ওপাশে যতদূর দৃষ্টি যায় শুধু পাহাড়ের চূড়া, একটার পর একটা, স্তরে স্তরে, মধ্য দুপুরের রোদে আলো ঠিকরোচ্ছে৷ তারপর ধীরে ধীরে সব সাদা হয়ে গেল৷ দৈত্যের মতো এক একটা বরফের দেওয়াল এগিয়ে আসতে থাকল আমাদের প্লেনের দিকে৷ তারই ফাঁক দিয়ে ফাঁক দিয়ে চলেছি৷ আরও ওপরে উঠে গেলাম৷ পিছন থেকে কাঁধের ওপর ঝুঁকে পড়ে সেই মহিলা জানিয়ে দিল, ‘ওই যে কালচে পাহাড়টা দেখছ, সাদার মধ্যে মাথা তুলে, ওটা এভারেস্ট৷ এত ঝড় চলে ওর ওপরে, তুষার ধরে না৷’ বুক হিম করা ভয়ঙ্কর সে সুন্দর৷ উলঙ্গ প্রকৃতি৷ মনে আছে, হঠাৎ আমার মনে হয়েছিল আমি যেন কালীর মুখোমুখি৷ আদিম৷ সেই হা-হা মহাকাল-বিস্তীর্ণতার মধ্যে উড়ে চলেছে একটা পুটকির মতো আমাদের প্লেন৷ সে অভিজ্ঞতা কখনও ভুলব না৷
যেমন ভুলব না এক চিলতে স্যান্টা ফে এয়ারপোর্টের সে দিনের কথাও৷ কারণ, জীবনে ছোটখাটো যে সব অভিজ্ঞতা আমার মনে এই প্রত্যয় গভীর করেছে যে, ব্যক্তি-মানুষটিই আসল, শ্রেণি, দেশ, জাতি, ধর্ম, বর্ণ দিয়ে তার বিচারের মতো বকোয়াস আর কিচ্ছু হয় না, তার একটি হয়েছিল এই স্যান্টা ফে এয়ারপোর্টেই৷
স্যান্টা ফে থেকে প্লেন ভোর সাতটা নাগাদ৷ ডোমেস্টিক ফ্লাইট৷ যাব শিকাগো৷ তবু পাছে দেরিটেরি হয়ে যায়, কাকভোরে ট্যাক্সি ডেকে পাঁচটা নাগাদ টার্মিনাল বিল্ডিংয়ে হাজির হই৷ কাঁটাতার ঘেরা একটা বিশাল চত্বরের ফটক দিয়ে ঢুকে একটা বড়সড়ো হল ঘরের সামনে আমায় নামিয়ে দিয়ে ট্যাক্সি বিদায় নিল৷ বেশ ঠান্ডা ছিল৷ কিন্তু আমি জানি টার্মিনাল বিল্ডিং সেন্ট্রালি হিটেড থাকবে, তাই কোনও গরম জামা পরিনি৷ আসলে একটা সামার জ্যাকেট ছাড়া কোনও গরম জামা ছিলই না৷ কারণ আমি কল্পনাই করতে পারিনি এপ্রিল মাসে স্যান্টা ফেতে এমন ঠান্ডা পড়তে পারে৷
ধাক্কাটা খেলাম যখন ঢুকতে গিয়ে দেখি টার্মিনালের দরজা বন্ধ৷ ত্রিসীমানায় জনমনিষ্যি নেই৷ এক চিলতে বারান্দা৷ তাতে খান দুয়েক বেঞ্চ৷ এইবার আকাশ কালো করে শুরু হল বরফ পড়া৷ আমি বাঁকড়োর ৪৫ ডিগ্রির বান্দা৷ হাত-পা কালিয়ে যেতে লাগল৷ কোটটা পেল্লায় স্যুটকেসটার এক্কেবারে তলায়৷ তা ছাড়া জানি ওই ফিনফিনে কোট পরা না পরা সমান৷ দাঁতে দাঁত চেপে দাঁড়িয়ে আছি৷ হন হন করে বারান্দাটায় পায়চারি করছি — যদি শরীর গরম হয়৷ একটা পেল্লায় গাড়ি এসে দাঁড়াল৷ আপাদমস্তক উলে মোড়া এক থুত্থুড়ে শেতাঙ্গ বুড়ি একটা হাত-ব্যাগ নিয়ে নামলেন, যাঁকে দেখা মাত্র আমার শীত-বোধটা আরও শতগুণ বেড়ে গেল৷ গাড়ি বিদায় নিল৷ আমি দাঁড়িয়ে ঠকঠক করে কাঁপছি আর বুড়ির দিকে মাঝে মাঝে আড় চোখে দেখছি৷ বুড়িও দরজা বন্ধ দেখে এক কোণায় দাঁড়িয়ে আমায় আড় চোখে দেখছেন৷
এই ভাবে মিনিট পাঁচেক কাটার পর শুনি সরু খ্যানখেনে গলা, ‘Son, you will freeze to death! তোমার কোনও ওয়ার্ম ক্লোদিং নেই?’
সংক্ষেপে পরিস্থিতি বলি৷
‘সর্বনাশ! দাঁড়াও আমার বরকে ডাকি৷ সে তো এতক্ষণে অনেকটা চলেও গেল৷’
মোবাইলে জরুরি তলব৷ সেই পেল্লায় গাড়ি নিয়ে বরের পুনরাবির্ভাব৷ এসো, এসো, এসো৷ ঠিক কতক্ষণ মনে নেই, কিন্তু বেশ খানিকক্ষণ আমরা সেই গাড়িতে বসে, হিটার চালিয়ে, গল্প করেছিলাম৷ আমার খুব ঠান্ডা লেগে গিয়েছে বলে বর গাড়িতে রাখা ফ্লাস্ক থেকে আমায় গরম কফি খাইয়ে ছিলেন৷ ভদ্রমহিলার নামটা আজ আর মনে নেই৷
চকমকি
ফুল কেউ দেখে না৷ সত্যি৷ ফুল এত ছোট্ট যে দেখতে সময় লাগে৷ আমাদের যে সময় নেই৷ দেখতে সময় লাগে, যেমন বন্ধু পেতে সময় লাগে৷
–জর্জিয়া ও’কিফে
দেখার ওপরেই তো সব নির্ভর করে৷ না সব নয়৷ প্রাণী সমাজ, যার কেন্দ্রে নিজেকে ভাবতে ভালোবাসে মানুষ৷ চিতা বাঘ৷ ছিপছিপে শরীরটাকে গুটিয়ে নিয়েছে৷ আগুন রঙা শরীরে মৃদু কম্পন৷ উত্তেজনায়৷ কানদুটো খাড়া৷ চোখ দুটো স্থির৷ দেখছে৷ খরগোশটাকে৷ ফ্রিজ৷ ক্লোজ শট৷ খরগোশটা ঘাসটা দাঁতে নিয়েই স্থির৷ মেটে রঙের শরীরটা মৃদু কাঁপছে৷ কান দুটো খাড়া৷ চোখ দুটো ঘুরছে৷ দেখছে৷ আকাশ৷ মাটি৷ চিতাবাঘ৷ খরগোশের ৩৬০ ডিগ্রি দৃষ্টিকোণ৷ প্যানিং৷ চিতাবাঘ আর তার দুনিয়া সম্পূর্ণ আলাদা৷ যার দেখা জিতবে, তার নিজের দুনিয়ায় সে আর একটা দিন বেঁচে গেল৷ দু’পক্ষেই চূড়ান্ত ক্ষিপ্রতার আগে দীর্ঘ সময় ধরে দেখা৷
কিন্তু সব দেখার জন্য চোখ খোলা রাখার প্রয়োজন নেই৷ ‘আমার চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ’৷ চোখ বন্ধ করে দেখা এ সবুজ৷ ‘অন্তরে আজ দেখব, যখন আলোক নাহি রে’৷ নিউ মেক্সিকোয় আলবুকার্কি থেকে স্যান্টা ফে, বা স্যান্টা ফে থেকে ব্যান্ডেলিয়ারের পথে আমার মনে হয়েছে এই-প্রান্তরকে-নিজের-দেশ-করে-নেওয়া শিল্পী জর্জিয়া ও’কিফে-র দেখা রবীন্দ্রনাথের দেখার ঠিক উল্টো৷ বরং বাঘের বা যে কোনও শিকারীর তিলে তিলে প্রতিটা ‘ঘাসের পাতা’ একটা একটা করে যে-দেখা (যার অনবদ্য বর্ণনার জন্য জিম কর্বেট পড়তেই হবে), আর বিপুল আকাশ-মাটি মিলিয়ে খরগোশের যে-দেখা, এই দুইয়ের মধ্যে ক্রমাগত যাতায়াত জর্জিয়া ও’কিফে-র দেখা! সেই দেখা অনেক জান্তব৷ জৈবিক৷ তার মধ্যে একটা কলজে ধকধক করছে৷
আর এই দেখার অলিতে গলিতে একটা গোটা দুপুর কাটিয়েছিলাম জর্জিয়া ও’কিফে মিউজিয়ামে৷ স্যান্টা ফে-তে৷ ১৪০টি তেল-রঙের পেন্টিং৷ ১০০টি জলরঙের৷ ৬৬৯টি স্কেচ৷ ১৪৯টি ফটোগ্রাফ (কিছু শিল্পীর, কিছু শিল্পীর তোলা)৷
জন্ম ১৮৮৭৷ ১৫ নভেম্বর৷ উইসকনসিন প্রদেশের সান প্রাইরি-র কাছে৷ আর্ট ইনস্টিটিউট অফ শিকাগো-র স্নাতক৷ ১৯১৬-তে প্রথম প্রদর্শনী৷ ১৯২৯-এ প্রথম নিউ মেক্সিকো আসা৷ ১৯৪৯-এ পাকাপাকিভাবে৷ মৃত্যু ১৯৮৬৷ ৬ মার্চ৷ স্যান্টা ফে৷
সঙ্গের ছবিটি আমার তোলা — স্যান্টা ফে থেকে ব্যান্ডেলিয়ার-এর পথে৷ তার নীচে জর্জিয়ার একটি পেন্টিং৷ পেন্টিংটির স্প্যানিশ নাম — পেদেরনাল৷ মানে চকমকি৷ আশ্চর্য নাম যার সঙ্গে আগুন, বন্দুক, ফুলকি, বিদ্রোহ সব কিছুরই সম্পর্ক রয়েছে৷ সত্যিই এ বিস্তীর্ণ ‘ওয়াইল্ড ওয়েস্ট’-টাই তো একটা চকমকি৷
বাতাসের দাস
অনেক, অনেক বছর আগের একটা ছবি মনে পড়ে গেল৷ প্রত্যন্ত বাঁকুড়ার সাঁওতাল বস্তি আর হাতে গোনা ক’টা বাঙালি পরিবারের গ্রাম পাঁচমুড়ার কুমোরদের চাকে গড়া লম্বা-গলা, ছাগল মার্কা, সম্পূর্ণ গতিহীন পোড়া মাটির ঘোড়া তখনও তীব্র পারফিউম মাখা বগলের উচ্ছ্বসিত শহুরে কল্পনায় টগবগিয়ে ভারতীয় হস্তশিল্পের জাতীয় লোগো হয়ে ওঠেনি বোধহয়৷ ভীষণ ধুলো উড়িয়ে সাত সকালে বাঁকুড়ার একটি মাত্র বাস চলে যাওয়ার পর অরণ্য পরিবৃত এক নিরবধি বিস্তীর্ণতার মধ্যে বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ্যের আগুন দ্বিপ্রহরে প্রায় কোনও আজগুবি গুজবের মতোই কেঁপে কেঁপে ভেসে থাকত পাঁচমুড়া৷ তারও থেকে বেশ কিছুটা দূরে আদিম ল্যাটেরাইটের এক হা-হা মাঠের মধ্যে ছিল আমার বাবার কলেজ আর তার পাশে আমাদের একরত্তি কোয়ার্টার৷ গ্রীষ্মের ছুটিতে সেই কোয়ার্টারের বারান্দার একটা বেঞ্চে বসে কাটত আমার দুপুরগুলো৷ আর তখনই চারপাশ ছাপিয়ে উঠত একটা সোঁ-সোঁ ডাক৷ শনশন বাতাসের ডাক৷ যে ডাক উঠলে বিশ্বচরাচরের আর সমস্ত শব্দ স্তব্ধ হয়ে যেত৷ লু৷ সেই লু তাড়িত হয়ে এক দিকের কাঁপা-কাঁপা দিগন্ত থেকে গড়াতে গড়াতে কিছুক্ষণ একটা পাথরে আটকে, ফের ছাড়া পেয়ে তির-গতিতে আর এক দিকের কাঁপা কাঁপা দিগন্তে মিলিয়ে যেত বড়সড়ো এক একটা দলা৷ শুকনো কাঁটা ঝোপ তালগোল পাকিয়ে তৈরি দলা৷ বহু বহু কাল আর কখনও কোত্থাও দেখিনি এই ছবি৷ আর বহু খুঁজেও এ অবধি পাইনি তার কোনও এক-শব্দের বাংলা নাম৷
কিন্তু চল্লিশ বছর পর সহসা আর একবার দেখেছিলাম সেই ছবি৷ আর পেয়ে গিয়েছিলাম তার একটা এক-শব্দের ইংরেজি নাম৷ জোয়ান বায়েজ-এর জ্যোৎস্নার মতো গলায় বাসের স্পিকারে বাজছিল গানটা —
Feel like a lonesome tumbleweed
Turning end over end.
Once I pulled all my roots free
I became a slave to the wind,
A slave to the wind.
২০১০৷ মার্কিন মুলুকের নিউ মেক্সিকোর স্যান্টা ফে থেকে ঝলমলে ভোরে ব্যান্ডেলিয়ার ন্যাশনাল মনুমেন্ট-এর উদ্দেশে বেরিয়ে পড়েছি আমরা এক ডজন৷ বারো দেশ থেকে জড়ো হওয়া বারো জন মার্কিন দূতাবাসের কর্মী৷ মসৃণ ড্রাইভওয়ে দিয়ে আমাদের সিক্সটিন সিটার ছুটে চলেছে বিলিয়ার্ড বলের মতো৷ দু’পাশে পরতে পরতে খুলে যাচ্ছে জর্জিয়া ও’কিফে’র ছবির দেশ৷ রং যেন এখনও কাঁচা৷ ‘Mother of American Modernism’ জর্জিয়া জনহীন এই বিস্তীর্ণ আদিম ভূমিকেই করে নিয়েছিলন নিজের দেশ৷ ১৯৮৬ সালে ৯৮ বছর বয়সে মারা গিয়েছিলেন স্যান্টা ফে-তেই৷ হুবহু পিকচার পোস্টাকার্ডের মতো আদ্যোপান্ত ‘তুরিস্তিক’ সে শহরের হরেক ‘অ্যাট্রাকশন’-এর মধ্যে দলছুট হয়ে ১২ ডলার (আজকের হিসেবে আটশো টাকা) খসিয়ে একা একাই সব থেকে বেশি সময় কাটিয়েছিলাম জর্জিয়া ও’কিফে মিউজিয়ামের ছবির পরে ছবি বেয়ে শৈশবের সেই পশ্চিম রাঢ়ী রঙের দুনিয়ায় ঢুকে প’ড়ে৷ কাল দুপুরে৷ আজ চলেছি এক্কেবারে তার মাঝখান দিয়ে৷ পশ্চিম রাঢ় থেকে ‘ওয়াইল্ড ওয়েস্ট’! আর, কী আশ্চর্য, অবাক হয়ে দেখি আদিগন্ত হাহা ল্যাটেরাইট মাঠে ঠিক সেই পাঁচমুড়ার মতোই বাতাস তাড়িত হয়ে প্রস্তরখণ্ড থেকে প্রস্তরখণ্ডে ছুটে চলেছে দলা পাকানো ঝোপ — ‘টাম্বলউইড’!
তবে যে-প্রস্তরখণ্ডে প্রথম চোখ আটকে হাঁইমাই করে ড্রাইভার সাহেবকে গাড়ি থামাতে বাধ্য করতে হল তেমনটা আর দেখিনি জিন্দেগিতে৷ ধূসর ঊষর প্রান্তর আর খামচা খামচা কালচে সবজেটে ঝোপের মধ্যে জমিয়ে বসে আছে আস্ত একখানা অতিকায় উট৷ ইয়েস, জটায়ুর সেই ‘ভয়ঙ্কর জানোয়ার’! এক্কেবারে হুবহু৷ এই সেই বিখ্যাত ক্যামেল রক!
ততক্ষণে কথা নেই বার্তা নেই হৈহৈ করে শুরু হয়েছে বরফ পড়া৷ মিহি তুলোর মতো নিঃশব্দে আকাশ থেকে নেমে এসে ঢেকে ফেলছে মাটি, ঝোপ-ঝাড়, কুচকুচে সেন্ট মেরিজ ড্রাইভওয়ে৷ আর সেই তুষারপাতে গ্যাঁট হয়ে বসে থাকা দানবীয় উটের উল্টো দিকেই এ অঞ্চলের জমাটি জুয়ার আড্ডা ‘ক্যামেল রক ক্যাসিনো’৷ আমাদের ছবি তোলার হিড়িক৷ উদ্বাহু আদেখলাপনা৷ বরফ পড়েই চলেছে৷ আর স্তূপাকৃত হয়ে জমে উঠছে জর্জিয়া ও’কিফে-দের এ বিস্তীর্ণতায় হাজির হওয়ার হাজার হাজার বছরের পরম্পরার গভীর থেকে ভেসে আসা একটা স্বর৷ ‘নেটিভ আমেরিকান’ স্বর — Your casinos are booming / even Las Vegas is mad! / You have done it. / Now you have the right to gloat / But remember your Elders / and the warning they gave: / beware the white man’s gold!/$ $ $ ৷ কবি লরেন্স টি৷ নেটিভ আমেরিকান তেসুকে পুয়েবলো-র (মানে জনগোষ্ঠীর) মানুষরা চালান এই ক্যামেল রক ক্যাসিনো৷ এই বিস্তীর্ণ প্রান্তর, এই ক্যামেল রক, এই জুয়ার আড্ডা — এখানেই একদিন ওই ‘টাম্বলউইড’-এর মতোই ছিল তাঁদের অবাধ ঘোড়দৌড়৷ শিকার৷ সন্ধ্যার আগুন ঘিরে নাচ৷ প্রয়াত পূর্বজদের সঙ্গে প্রতিনিয়ত কথোপকথন৷ পশ্চিম রাঢ়েরই মতো এও ছিল আদিবাসীদের অজস্র গোষ্ঠীর দেশ, যাঁদের সক্কলকে এক করে এখন ইতিহাসের দেওয়ালে লেপে দেওয়া হয়েছে ‘নেটিভ আমেরিকান’ বা ‘আমেরিকান ইন্ডিয়ান’ বলে৷
‘ইন্ডিয়ান’ কারণ সেই মারাত্মক ভুল৷ ক্রিস্টোফার কলাম্বাস৷ ডি ব্রাউন-এর সেই যুগান্তকারী বই — Bury My Heart at Wounded Knee: A History of the American West৷ যার প্রথম বাক্য — It began with Christopher Columbus৷ তারপর পশ্চিম ইউরোপ থেকে পিলপিল করে শ্বেতাঙ্গের দল৷ গোল্ড রাশ! Beware the white man’s gold! তারপর…? তারপর কাল বিকেলে দেখেছি স্যান্টা ফে শহরের মাঝখানে মাটিতে সারি সারি বসে৷ সামনে সাজানো পারিবারিক সামগ্রী৷ হুমড়ি খেয়ে পড়ে দরাদরি করে ‘জলের দরে’ কিনে নিচ্ছেন শ্বেতাঙ্গ টুরিস্টের দল৷ ‘নেটিভ আমেরিকান কালেকটিবল্স্’ — মোষের চামড়ার পার্স, নীল পাথর বসানো হাতের বালা, রঙিন পাথরের বড় বড় দুল, হার, বাসনকোসন, অদ্ভুত পাথরের টুকরো৷ বেচে দিচ্ছেন যে যেমন পারেন৷ নারী, পুরুষ৷ মাঝ বয়সী, বুড়ো, আধবুড়ো৷ স্থূলকায়৷ বলিরেখায় কাটিকুটি মুখ৷ মুখে মদের গন্ধ৷ ডলার চাই৷ $ $ $৷ কালা-চামড়া টুরিস্ট ছবি তুলতে গেলে ক্রুদ্ধ আপত্তি৷
বরফ পড়েই চলেছে৷ ক্যামেল রকের ছবি তোলা হয়ে গিয়েছে৷ ক্যামেল রক ক্যাসিনোয় ঢোকার রেস্ত আমার নেই৷ নাকের ডগা, কান কনকন৷ ক্যাসিনোর জ্বলতে নিভতে থাকা লাল আলো তুষার বাতাসে আবছা হয়ে মিলিয়ে যায় পিছনে৷
তারপর? তারপর লোস আলামোস৷ বুকটা ধড়াস করে ওঠে৷ ১৯৪২-এর সেপ্টেম্বর৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ৷ মার্কিন যুদ্ধ-যন্ত্রের চাই এক অভূতপূর্ব গণমারণাস্ত্র৷ যা একবার ঝলসাতে পারলেই বদলে যাবে দুনিয়ার ক্ষমতার বিন্যাসের ইতিহাস৷ চিরকালের মতো৷ পরমাণু বোমা৷ পরিকল্পনার সাঙ্কেতিক নাম ‘ম্যানহ্যাটান প্রজেক্ট’৷ কিন্তু যদি তার ফর্মুলা ফাঁস হয়ে যায়? চাই ভয়ঙ্কর গোপন কোনও ডেরা৷ জনমানবহীন৷ আক্ষরিক অর্থেই পাণ্ডববর্জিত৷ টের পাবে না কাক পক্ষীও৷ বিখ্যাত বিজ্ঞানী রবার্ট ওপেনহাইমার হদিশ দেন — লোস আলামোস৷ প্রজেক্টের কর্ণধার জেনারেল লেসলি গ্রোভস৷ সিলমোহর মেরে দেন৷ ছোট্ট এক লাইন — This is the place৷ তৈরি হয়ে যায় ‘লোস আলামোস ন্যাশনাল ল্যাবরেটরি’৷ কয়েক হাজার কর্মী৷ বিশ্বের শ্রেষ্ঠ, নোবেল জয়ী, বহু বিজ্ঞানীর কর্মস্থল৷ কিন্তু বাড়ির নাম নেই৷ রাস্তার নাম নেই৷ পাড়া বা ব্লকের নাম নেই৷ ঠিকানা? স্রেফ, পোস্ট বক্স ১৬৬৩৷ স্যান্টা ফে৷ নিউ মেক্সিকো৷ তারপর? তারপর ৬ অগস্ট, ১৯৪৫৷ হিরোশিমা৷ লিটল বয়৷ তারপর? ৯ অগস্ট৷ নাগাসাকি৷ ফ্যাট ম্যান৷ পারমাণবিক বোমা দুটোর রসিক মার্কিনি নাম — লিটল বয় আর ফ্যাট ম্যান৷ মৃতের সংখ্যা অন্তত এক লক্ষ ৩৫ হাজার৷ শিশু, নারী, বৃদ্ধ, অসুস্থ৷ বাছবিচার নেই৷ রাস্তার ডান হাতে মোড়৷ তিরচিহ্ন — লোস আলামোস৷ দূরে দেখা যায় কাঁটাতারের বেড়া৷ সামনেই হলুদ সাইন * Security check ahead৷ গাড়ি দাঁড়ায় না৷
আর বরফ পড়ছে না৷ রাস্তা উপরে উঠতে থাকে৷ মাথার উপরে শিসে রঙের পাকানো মেঘের ঢেউ৷ বেশ কিছু দূর৷ তারপর এক ফালি ঝকঝকে নীল৷ তার পর ধবধবে সাদা মেঘের আর একটা আদিগন্ত ঢেউ৷ ধূসর মাঠ৷ সবুজ ঝোপ-ঝাড় বেঁটে বেঁটে গাছ৷ কালচে টিলার ঢেউ৷ মাঝে মাঝে লালচে খয়েরি ‘মেসা’ — ছোট ছোট পাহাড় যার মাথাগুলো টেবিলের মতো চাঁছা৷ ফের জর্জিয়া ও’কিফে-র ছবি৷ লালচে-কমলা-খয়েরি পাহাড়ি পাথুরে দুনিয়া৷ মাথার উপর ঝলমলে রোদ৷
ব্যান্ডেলিয়ার ন্যাশনাল মনুমেন্ট৷ বৃদ্ধ নেটিভ আমেরিকান ওয়ার্ডেন, লি ওয়ারেন, স্বাগত জানান৷ ঘুরিয়ে দেখান৷ ইতিহাস ঘাঁটেন৷ ৩৩ হাজার একর জুড়ে ছড়ানো প্রাচীন জনবসতির কঙ্কাল৷ এক পাশে ঝোপ-জঙ্গুলে ধূসর পাহাড়ের সারি৷ অন্য পাশে খয়েরি টিলার পর টিলা৷ টিলার পেটের কাছে গুহার পর গুহা৷ শত শত৷ প্রাকৃতিক নয়৷ মানুষের হাতে খোদা৷ গুহার ভিতরে ঘর৷ এক তলা, দো তলা, তিন তলা৷ আর মাঝখানের সমতলে গোল করে সাজানো সারিসারি বাড়িঘরের ভিতের পাঁজর৷ ত্যুয়োনিয়ি গ্রাম৷ ১১৫০ থেকে ১৫০০ সাধারণাব্দ৷ গমগমে নেটিভ আমেরিকান জনপদ৷ তারপর? তারপর It began with Christopher Columbus৷ সেই যে সেই ১৪৯২৷ পাকাপাকিভাবে এখানে পৌঁছতে আরও শ’খানেক বছর — ১৬০০ সাধারণাব্দ৷ তারপর ‘সভ্যতা’৷ গণহত্যার পর গণহত্যার পর গণহত্যা৷ আর তারও পর — আহা, বড় অনুতাপ৷ তাইতো আজ এই ‘ন্যাশনাল মনুমেন্ট’! ততক্ষণে টিলা থেকে টিলার ফাঁকে ফাঁকে উঠেছে সোঁ-সোঁ ডাক৷ বাতাসের ডাক৷ আগুন নয় অবশ্য৷ ধারালো চাকুর মতো হিম৷ ঘুরে বেড়াই ভূতুড়ে জনপদের অলিতে গলিতে — A slave to the wind৷
মুসাফির এ মন-এর সব কটি পর্বের জন্য ক্লিক করুন: মুসাফির এ মন — নীলাঞ্জন হাজরা