Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

অগ্নিগর্ভ

প্রবুদ্ধ ঘোষ

 

প্রতিস্পর্ধা এমনই এক শব্দ, যাকে কিছুতেই মাটিচাপা দেওয়া যায় না, শেষ করা যায় না, বিছন হয়ে যায়। প্রতিস্পর্ধা এমনই শব্দ যা রাষ্ট্র এবং শাসকমাত্রকেই উদ্বিগ্ন রাখে। যে কোনও চাপিয়ে দেওয়া অথবা মানিয়ে নেওয়া স্থিতিশীলতাকে প্রশ্নে প্রশ্নে জর্জরিত করে তোলে। অনুশাসনের রীতি ও বাধ্যতার নিয়মানুবর্তিতার দিকে ব্যঙ্গ ছুড়ে দিয়ে জেগে থাকার ধর্মকে অনুশীলনে রপ্ত করে। আর, ইতিহাস, এমনকি তা শাসকের/বিজয়ীর লেখা হলেও, প্রতিস্পর্ধার সততাকে মনে রাখতে বাধ্য হয়।

তোরা না করিলে এ মহাসাধনা/ এ ভারত আর জাগে না জাগে না

— দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়

এ এক এমন সময় যখন অশ্বমেধের ঘোড়া ছেড়ে দিয়েছে আরএসএস, এই মুহূর্তে ভারতের সবচেয়ে বড় সন্ত্রাসবাদী সংগঠন। ‘একটি ভাষা— হিন্দি’, ‘একটিই খাদ্যাভ্যাস— শাকাহারী’, ‘একটিই জাতি— আর্য’ এবং ‘একটিই ধর্ম— হিন্দু’— এই সমস্ত দাবিকে ন্যায্যতা দিতে ভারতে ঘুরে বেড়াচ্ছে সেই ঘোড়া। আরএসএস ও তাদের সংসদীয় মুখোশ বিজেপির উদ্দেশ্য ‘ন্যাশনাল রেজিস্টার্ড সিটিজেন্‌স’-এর তালিকা প্রকাশ করা— ‘হিন্দুত্ববাদী অখণ্ড ভারত’কামী উগ্র জাতীয়তাবাদের বিরোধীদের পিষে দেওয়া। অসমে ১৯,৬৬,০৬৭ জনকে তাঁদের নাগরিকত্ব ও অধিকার বলি দিয়ে ডিটেনশন ক্যাম্পে যেতে হচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গে তার হ্রেষারব শোনা যাচ্ছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর দাবি অনুযায়ী সারা ভারতজুড়েই এনআরসি লাগু হবে। একদিকে কর্মীসঙ্কোচন, শিল্পবিপর্যয়, অর্থনীতির ক্রমপতন অন্যদিকে শিক্ষাক্ষেত্রে বেসরকারিকরণ, গবেষণার অর্থহ্রাস— ক্রমশ দেশকে অন্ধকারে ঠেলে দেওয়ার অন্যতম কার্যকর্তা বাবুল সুপ্রিয় আরএসএসের ছাত্র সংগঠন অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদের নবীনবরণ অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে একটি সভাগৃহে আসে। বক্তব্যের বিষয়, ‘স্বাধীনতা পরবর্তী ভারতবর্ষের সরকারব্যবস্থা’, যার মূল সুর ভারতে এনআরসি লিস্ট তৈরি করাকে জাস্টিফাই করা। বাবুল সুপ্রিয়, ছাত্রদের সঙ্গে বচসার মুহূর্তে, “এনআরসি-র ফুলফর্ম কী?” বলে ক্যুইজমাস্টারের মতো প্রশ্ন করতে থাকে। কারণ, ক্রমফ্যাসিস্ট শাসনব্যবস্থার প্রতিনিধিকে এনআরসি-বিরোধী প্রশ্ন ছুঁড়ে দিতে থাকে ছাত্ররা, সঙ্গে ‘গো ব্যাক’ স্লোগান ও কালো পতাকা দেখানো।

‘ফ্যাসিস্ট নেতাকে সর্বান্তকরণে প্রতিরোধ করব’— এই দৃঢ় মানসিকতা থেকে বাবুল সুপ্রিয়কে প্রতিরোধের সময় মন্ত্রী বাবুলের দেহরক্ষীরা এবং বাবুল ছাত্রছাত্রীদের প্রতিরোধ ভাঙতে উদ্যত হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তারক্ষীরা বাবুল সুপ্রিয়র সঙ্গে কথা বলতে এলে, সুপ্রিয় বলে, “ইউ আর অ্যান এমপ্লয়ি, বিহেভ লাইক দ্যাট… আমাকে জ্ঞান দিতে এসো না;” মাননীয় উপাচার্য সুরঞ্জন দাশ বাবুল সুপ্রিয়র সঙ্গে কথা বলতে আসেন, কিন্তু তাঁর সঙ্গেও অভব্য আচরণ করে বাবুল। “আই অ্যাম অ্যা মিনিস্টার। হোয়াট আর ইউ ডুয়িং? ইউ শুড হ্যাভ রিসিভ মি!” সুরঞ্জনবাবু বারংবার বাবুল ও ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে মধ্যস্থতা করতে চাইলেও, মেজাজের পারদ চড়াতে থাকে বাবুল, “আপনাদের জন্যেই পশ্চিমবঙ্গে এই অরাজকতা হয়েছে। আপনি চাইছিলেন এটা হোক। আই অ্যাম সিওর, ইউ আর আ লেফটিস্ট।” ছাত্রছাত্রীদের ফ্যাসিজমবিরোধী স্লোগান ও এনআরসিবিরোধী প্রশ্নে জর্জরিত হয়ে আরওই মেজাজ হারাতে থাকে বাবুল সুপ্রিয় এবং ‘সোয়াগ’ বা ‘কুল্‌’ দেখনদারি দিয়ে যখন আর সামলানো যাচ্ছে না, তখন ‘মন্ত্রিত্ব’ ফলিয়ে আবার চেষ্টা করে এবিভিপি-র অনুষ্ঠানে সভাগৃহে ঢোকার। সেই মুহূর্তের বিশৃঙ্খলায় আহত হয় কয়েকজন ছাত্রী ও ছাত্র এবং জামা ছিঁড়ে যায় বাবুল সুপ্রিয়র। ছাত্রছাত্রীদের একটা অংশ প্রতিরোধে অনড় থাকলেও, রাষ্ট্রশক্তির পেশিপ্রদর্শন ও ইনস্যাস-এর ম্যাগাজিন প্রদর্শনের সামনে কিছুটা বিহ্বল হয় বাকিরা; সেই সুযোগ নিয়ে দেড় ঘণ্টা অবরুদ্ধ থাকার পর সভাগৃহে ঢুকে পড়ে মন্ত্রী বাবুল। এরপরে সঙ্ঘবদ্ধ ছাত্রছাত্রীরা নিজেদের মধ্যে আলোচনায় সিদ্ধান্ত নেয় মন্ত্রী ক্ষমা না চাইলে, সভাগৃহের দরজা আটকে রাখবে তারা; বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় উপাচার্যকে অসম্মান, বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তারক্ষীদের চাকরি কেড়ে নেওয়ার হুমকি, ছাত্রছাত্রীদের আহত করা, তাদের সঙ্গে অশালীন আচরণ ও গণতান্ত্রিক পরিবেশকে নষ্ট করা— মন্ত্রী বাবুলকে এগুলোর জন্যে নিঃশর্তে ক্ষমা চাইতে হবে।

 

***

ইয়াদ রাখ পর কোই আনহোনি নাহি তু লায়েগি/ লায়েগি তো ফির কহানি অউর কুছ হো যায়েগি

— পীযূষ মিশ্র

কে পি বসু মেমোরিয়াল হলের ভেতরে একগুচ্ছ অনবীন আরেসেস কর্মীর সামনে এনআরসি নিয়ে বক্তব্য রেখে এবং আধাখ্যাঁচড়া কাল্পনিক কিছু গল্প শুনিয়ে মন্ত্রী বাবুল যখন সভাগৃহ থেকে বেরোতে যায় এবিভিপি-আরএসএস কর্মীদের সহায়তায় ও কেন্দ্রীয় সুরক্ষাবাহিনীর বলপ্রয়োগে, তখনই ছাত্ররা নিঃশর্ত ক্ষমা চাওয়ার দাবিতে রুখে দাঁড়ায়। এরপরেই প্রকাশ পেতে থাকে মন্ত্রিত্বের দম্ভ। মন্ত্রীর বডিগার্ডদের ধাক্কায় পড়ে যান উপাচার্য সুরঞ্জনবাবু, তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় হাসপাতালে, ছাত্রছাত্রীদের মেরেধরে সরিয়ে কোনওমতে গাড়ির কাছে পৌঁছয় মন্ত্রী। আর, ছাত্রছাত্রীদের প্রতি অঙ্গভঙ্গি, “কারও মাথায় বুদ্ধি নেই” জাতীয় অপমানজক বক্তব্য চলতে থাকে মন্ত্রীর পক্ষ থেকে। সম্মাননীয় উপাচার্য ও প্রিয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অপমানে ছাত্রছাত্রীদের জেদ বাড়তে থাকে। আর, মন্ত্রীর পক্ষ থেকে চলে প্রশাসনিক হুমকি এবং কর্তাব্যক্তিদের কাছে সাহায্যভিক্ষা। ততক্ষণে, নিজেদের দলের মন্ত্রীকে উদ্ধার করতে আরএসএসের হিংস্র বাহিনী ও সশস্ত্র এবিভিপি জড়ো হয়েছে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪ নং গেটের বাইরে; বিপদের আঁচ পেয়ে দ্বাররক্ষীরা গেট বন্ধ করে দেওয়ায় সেই গেট ভাঙার জন্যে তাণ্ডব শুরু করে তারা। রাজ্যপাল ততক্ষণে অবরুদ্ধ মন্ত্রীকে উদ্ধার করতে সপারিষদ এসে গেছেন। কিন্তু, বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য হিসেবে অসুস্থ উপাচার্যকে দেখতে যাওয়া বা অভিভাবক হিসেবে ছাত্রছাত্রীদের বক্তব্য শোনা নয়, মন্ত্রীকে নিজের গাড়িতে বসিয়ে নিয়ে যাওয়াই বোধহয় তখন তাঁর একমাত্র লক্ষ্য। আর, একদিকে উদ্ধত মন্ত্রিত্ব দিয়ে ছাত্রছাত্রীদের আবেদনকে নস্যাৎ করে দেওয়া, অন্যদিকে এবিভিপি-র তাণ্ডবের উন্মত্ততার শুরু— একই সময়ে। প্রথমে টায়ার জ্বালিয়ে, তারপর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরের চা-দোকান ও গুমটিগুলো থেকে জিনিসপত্র বের করে আগুন লাগিয়ে পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ করা। ৪ নং গেট ভেঙে ঢুকে প্রথমেই এবিভিপি আঘাত করে গেটের পাশে ফটোকপি ও বইখাতার দোকানদার বয়স্ক তড়িৎদাকে। ‘জয় শ্রীরাম’ হিংস্রধ্বনি সহ ভাংচুর চলে দোকানে, তড়িৎদার মাথা ফেটে যায়। কলা বিভাগের ইউনিয়ন রুমে ঢুকে ভাঙা হয় টেবিল, চেয়ার, বেঞ্চ, পাখা ও কম্পিউটার; জ্বালিয়ে দেওয়া হয় বহু ছাত্রছাত্রীর ব্যাগ-বইখাতা-ক্যারমবোর্ড-সিপিইউ। দেয়ালে লিখে দেওয়া হয় ‘এবিভিপি’। ইউজি আর্টস বিল্ডিংয়ের বাইরের পার্কিং স্পেসে রাখা অধ্যাপক এবং ছাত্রদের বাইক ও সাইকেল ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়; নোটিস বোর্ড ভাংচুর করা হয় আর চার নম্বর গেটের বাইরে ভাঙা সামগ্রী, বইখাতা জড়ো করে লাগিয়ে দেওয়া হয় আগুন। প্রবলপ্রতাপ রাষ্ট্রশক্তির আইনি হুমকি ও তাদেরই প্রতিনিধিদের বেআইনি ধ্বংসলীলার মধ্যেই রাজ্যপাল বের করে নিয়ে যান মন্ত্রীকে। প্রিয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর এই আক্রমণের প্রতিরোধে ছাত্ররাও প্রস্তুতি নিচ্ছে তখন, এতদিন যে ফ্যাসিস্ট ধ্বংসলীলার কথা শুনেছে ও পড়েছে তা নিজেদের ‘অন্য বাড়ি’ তথা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটতে দেখে ছাত্রছাত্রীরা জোট বেঁধে আছে তখন, আরএসএসের হামলা আটকানোর বাস্তবে। ফ্যাসিস্ট আঘাতে মাথা ফাটে স্নাতকোত্তর প্রথম বর্ষের ছাত্র পবন শুক্লার, কারণ, দেশের বেহাল অর্থনীতি নিয়ে সে কিছু ‘বেয়াড়া’ প্রশ্ন করেছিল মন্ত্রীকে। ভাংচুর করে ও আগুন লাগিয়েই থেমে থাকেনি ফ্যাসিস্টরা; এইট বি মোড়ে বা তিন নম্বর গেটে কোনও ছাত্র-ছাত্রীকে একা পেলেই চলেছে তাদের আক্রমণ, ‘স্লাট-শেমিং’ ও টিটকিরি। আর, ‘গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ’ দেশের সঙ্কট-মুহূর্তে কখন যে রাষ্ট্রের তাঁবেদার হয়ে গেছে, কখন যে তারা প্রতিরোধী ছাত্রীছাত্র ও আক্রমণকারী রাষ্ট্রের ভূমিকাকে জনমানসে গুলিয়ে দিয়েছে, দেখা গেছে সেটাও। ‘দেশের মন্ত্রীকে হেনস্থা করল দেশদ্রোহী যাদবপুরের ছাত্ররা’— এই ন্যারেটিভ ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে দ্রুতবেগে, যাতে জনচেতনাকে রাষ্ট্রের পক্ষে ঘুরিয়ে নেওয়া যায়! কিন্তু, একে একে ঘটনামুহূর্তের ‘অন্য’ ছবি ও ভিডিওগুলো প্রকাশ্যে আসতে, ফ্যাসিস্ট-তাণ্ডবের পরের দিন রাজপথ কাঁপানো সুদীর্ঘ প্রত্যয়ী মিছিলের হুঙ্কারে কিছুটা হলেও বোঝা যাচ্ছে আক্রমণ ও প্রতিরোধের তফাৎ।

 

***

Somebody, after all, had to make a start. What we wrote and said is also believed by many others. They just don’t dare express themselves as we did.

— Sophie Scholl

এই অবধি ঘটনা কমবেশি সকলের জানা। গণমাধ্যম পরিবেশিত খবর ও তার রংবেরঙে ঘটনার ডালপালা ছড়াতে শুরু করেছে সেদিন বিকেল থেকেই। ছাত্রছাত্রীরা বেয়াদপ ভিলেন আর ‘মাননীয়’ মন্ত্রী আহত অবরুদ্ধ নায়ক— দশচক্রে ভূতকে ভগবান বানানোর আপ্রাণ চেষ্টা। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে সমাজের মাথা ও হরেক সংসদীয় দলের নেতাদের মতামত। তাদের সিংহভাগের বক্তব্য, এমনকি সংসদীয় বামেদের বক্তব্যও এক সুরে গাঁথা— ছাত্ররা যা করেছে তা নিন্দনীয়, তা অগণতান্ত্রিক। অথচ, এই নেতারাই নির্বাচনী দায়ে বিজেপি-র বিরোধিতা করে, এই মাথারাই ‘আমরা ফ্যাসিস্টদের চাই না’ আপাতবাক্যে কবিতা-গান-নাটকের অভিনয় করে। আর, এই সব অভিনয় ধরা পড়ে যায় তখনই, যখন শাসক তথা ফ্যাসিস্ট এজেন্টরা দরজা ভেঙে ঢুকে পড়ে। অগণতান্ত্রিক ও বলপ্রয়োগকারী একটি সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীকে এরা ততটুকুই প্রশ্ন করে, যতটুকু করলে এদের সামাজিক সুরক্ষা ও হাসিমুখের ফুটেজ অটুট থাকবে। যতটুকু বৃত্তের মধ্যে থেকে কবিতা-গান-আদর্শ বিক্রি করা যায়, ততটুকু গণ্ডির মধ্যে থেকেই এদের প্রাজ্ঞতার ভান এবং আক্রমণ ও প্রতিরোধকে এক করে দেখা বা দেখানোর ন্যাকা সংলাপ। আর, ছাত্ররা সেই গণ্ডির নিশ্চয়তা সেই বৃত্তের সুখী আমোদগেঁড়েপনা ভেঙে ফ্যাসিস্ট-প্রতিনিধিকে প্রশ্ন করেছে বলেই তারা ‘দেশদ্রোহী’; ছাত্ররা মন্ত্রীর চোখে চোখ রেখে দেশের ক্রমবেহাল দশার কারণ জানতে চেয়েছে বলে, তারা ‘অগণতান্ত্রিক’; আর, এই ছাত্রছাত্রীরাই দেশের সঙ্কটমুহূর্তে রাষ্ট্রশক্তির ক্ষমতাশালী প্রতিনিধিকে অসম শক্তি দিয়ে নিরস্ত্র উপায়ে প্রতিরোধ করেছে বলেই তাদের দাগিয়ে হচ্ছে ‘হঠকারী, আবেগপ্রবণ ও নেশাখোর’ বলে। ভেঙে পড়েছে ডান-বাম-রাম সমস্ত সংসদীয় দলের অভ্যন্তরীণ সূক্ষ্ণ পার্থক্যদেওয়াল, মিশে গেছে সব রঙের বুদ্ধিজীবীদের স্বর; তাই এরা কেউই প্রকাশ্যে, প্রেস বিবৃতিতে ছাত্রদের অসমসাহসী ওই দীর্ঘ সাড়ে ছয় ঘণ্টার প্রতিরোধকে বাহবা দিতে পারছেন না!

সঙ্কটমুহূর্তে দু’দলকেই অর্থাৎ ফ্যাসিস্ট এবং প্রতিবাদী-প্রতিরোধী দু’দলকেই নিন্দা করার অর্থ হচ্ছে, ফ্যাসিস্ট শাসককে অনেকটা জায়গা ছেড়ে দেওয়া; যে জায়গা থেকে তারা পরবর্তী দমননীতি দিয়ে জনগণের চেতনাকে গ্রাস করতে পারে। গণতন্ত্র ও ফ্যাসিজমের মধ্যে প্রধান পার্থক্যই হচ্ছে যে, একে অপরের মনোভূমি দখল করে নেয়। বুর্জোয়া গণতন্ত্রের চারণভূমি গ্রাস করে, তার প্রতিনিধিদের ‘জনগণের রায়ে’ পরাজিত করে ও গণতান্ত্রিক মুক্তচিন্তাকে হটিয়ে দিয়ে ফ্যাসিবাদ ক্ষমতায় আসে। আর, গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে গেলে সর্বাগ্রে প্রয়োজন ফ্যাসিবাদকে গলাধাক্কা দেওয়া; আগে গণতন্ত্র এনে পরে ফ্যাসিবাদকে সরানোর আখ্যান অন্তত ইতিহাসে নেই, কারণ গণতন্ত্রের পরিসরগুলো ক্রমসঙ্কুচিত অথবা গণতান্ত্রিকতার মনোভূমি প্রায়-দখল করে নিয়েছে ফ্যাসিস্টরা। তবু, যেটুকু দমবন্ধ গণতন্ত্রের আয়তক্ষেত্র পড়ে থাকে, সেখানে দাঁড়িয়েও ছাত্ররা ন্যূনতম অগণতান্ত্রিক হয়নি প্রথমে; প্রথমে তারা ছাত্রছাত্রীদের গণতান্ত্রিক মতামতের ভিত্তিতেই মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয়কে নিজেদের বিরোধিতার কথা ও তাকে প্রিয় বিদ্যাভূমিতে ‘স্বাগত না জানানো’-র কথা বলেছিল। কিন্তু… ভগৎ সিং বধিরকে শোনানোর জন্যে উচ্চকণ্ঠের প্রয়োজন সেকথা বলেছিলেন বটে; কিন্তু, আওয়াজটা ঠিক কত ডেসিবেলের হবে, সেটা বলে যাননি, কারণ সেই প্রতিবাদী শব্দোচ্চারণের ডেসিবেল সময়ে সময়ে পালটায়। ছাত্রছাত্রী-তরুণতরুণীরাই সেই আওয়াজ তুলতে জানে ও তার মাত্রা বাঁধতে জানে। যে সাহসের কথা বুদ্ধিজীবী ও নেতাদের মুখের বুলিতে ঠিকরে বেরোয়, সেই নেতাদের বচন উলটো মেরুতে চলে যায় নিজেদের পিঠ বাঁচাতে; যাতে গেস্টাপো বাহিনী ও এসএস বাহিনীর আঁচ না লাগে তাদের গায়ে! কিন্তু, এই প্রাজ্ঞ ও ভুয়োদর্শী ‘নিরপেক্ষ’-রা নিশ্চয় জানেন যে, ফ্যাসিবাদ কোনও নিরপক্ষতাকেও মেনে নেয় না; দ্রুতগতির রথ ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে চায় সামান্য ‘না’-টুকুও। কোথাও সেই প্রতিরোধের সূচনাবিন্দু থাকে; ছাত্রদের বহু ভুল, আবেগপ্রবণতা এমনকি দ্বন্দ্ব-সংশয়ও থাকে। কিন্তু আর যেটা থাকে, তার নাম প্রতিস্পর্ধা; সম্মিলিত ছাত্রছাত্রীজোট যখন উজ্জ্বল মুখে হার-না-মানা সঙ্কল্পে ফ্যাসিস্টবাহিনীর মুখোমুখি দাঁড়ায়, তখন আশা জাগে— তখন ইতিহাস আর বাস্তব গাঢ় অন্ধকারেও ভবিষ্যতের আলো ঠিকই জ্বালিয়ে রাখে।

 

***

আমার এক শ্রদ্ধেয় বন্ধু এগারো মাস বন্দিশিবিরে কাটিয়ে জার্মানির বাইরে পালিয়ে গিয়েছিলেন। মুক্তির পর আটদিন মাত্র জীবিত ছিলেন তিনি। তারপর আত্মহত্যা করলেন। তাঁর শেষ চিঠি আমি পেয়েছিলাম। তিনি ভাবতে পারেননি, বাইরের পৃথিবী এত উদাসীন! হিটলারের জার্মানি তার রক্তাক্ত হাত বাড়িয়ে দিয়েছে আর বাইরের পৃথিবী সে-হাতে হাত মেলাচ্ছে।

… তাই আমরা রক্ত-বিলিপ্ত পদদলিত মুখ তুলে, আমাদের বিচূর্ণ দেহ নিয়ে জিজ্ঞেস করছি: ‘এখনও চিৎকার করে উঠছ না কেন? সময় কি আসেনি? আসেনি?’

— হাইনৎস লাইপম্যান

‘অই শুন! অই শুন! ভেরীর আওয়াজ হে, ভেরীর আওয়াজ’— ছাত্র বনাম ফ্যাসিস্ট লড়াই শুরু হয়ে গেছে। ‘ফ্যাসিস্ট’ শব্দের অর্থ আঁটি বা জোট। আর, সঙ্ঘবদ্ধ সঙ্ঘীদের বিরুদ্ধে ছাত্রদের সঙ্ঘবদ্ধ লড়াই শুরু হয়ে গেছে। শাসকের দম্ভ, রাষ্ট্রের হুমকি, প্রতিবাদী ছাত্রছাত্রীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে আস্ফালন, সিংহভাগ গণমাধ্যমে অর্ধসত্য ও অসত্য প্রচার, দ্রোহী ছাত্রীছাত্রদের সমাজে ‘একঘরে’ করে দেওয়ার চেষ্টা— এই সবকিছুর পরেও যা পড়ে থাকে, তা হচ্ছে পবিত্র ঘৃণা ও উজ্জ্বল ক্রোধ। তার্কিক ও নীতিবাগীশরা ‘পাত্রাধারই তৈল নাকি তৈলাধারই পাত্র’— এই নিয়ে কালব্যয় করবে আরও। ছাত্রদের সংযম, ছাত্রদের রাজনীতি করা উচিত কি না, গণতন্ত্র কী ও ক’প্রকার— এসব বিষয়ে চ্যানেলে চ্যানেলে বিতর্কসভা বসছে, বসবে। কেউ কেউ উদাসীন ভানে সমদূরত্ব বজায় রাখবে, কেউ কেউ ফ্যাসি-নাজিদের ইউরোপের সঙ্গে বর্তমান ভারতের জাতীয়তাবাদী গা-জোয়ারির মিল-অমিলের প্রবন্ধ লিখবে। তবু, ফ্যাসিস্টদের হারাতে শেষ লড়াইটা রাস্তাতেই হয়। সেই লড়াইয়ে নাজিবিরোধীরা সমর্থন পায় দূরদর্শী কোনও কোনও ব্যক্তির থেকে, তাঁরা শিল্পী, তাঁরা সাহিত্যিক, তাঁরা মেঘ সরিয়ে আকাশ দেখতে পান কিছুটা— সংখ্যায় তাঁরা অল্প হন প্রথমে… তবু, সম্মিলিত মানবতাই টিঁকে থাকে। বাংলায় এই লড়াই, পাল্টা-আঘাত বোধহয় শুরু হল যাদবপুর থেকে। না, এটাই চূড়ান্ত নয়, এটাই ‘শেষ যুদ্ধ’ নয় বরং খুব সামান্য প্রত্যাঘাত রাষ্ট্রের মতাদর্শে। আর, তাই, যাদবপুরের ছাত্রছাত্রীদের দায়িত্ব সমগ্র ছাত্রসমাজকে এই লড়াইয়ে সামিল করা; ‘এলিটিজম’-র অসুখ সারিয়ে শ্রমিক ও কৃষকের কাছে এই দ্রোহবার্তা ও অঙ্গীকার পৌঁছে দেওয়া এবং সমস্ত বাংলা তথা দেশকে এই লড়াইয়ে জোট বাঁধতে বলা। এবং ছাত্রসমাজ বাদে বাকি সমাজেরও দায়িত্ব এই ছাত্রছাত্রীদের লড়াইয়ের পাশে থাকা, তাদের প্রতিরোধী মানসিকতাকে ভেঙে পড়তে না দেওয়া এবং শাসকের দেখানো ‘সত্যি’-র পেঁয়াজের খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে ‘রাষ্ট্র বনাম ছাত্র’, ১৯শে সেপ্টেম্বরের মূল বয়ানের কাছে পৌঁছানো। আরএসএসকে প্রতিরোধের ফর্ম কোনও প্রায়-ফ্যাসিস্ট নেতা বা বিক্রীত মিডিয়া ঠিক করে দেবে না, তা ঠিক করবে বারুদগন্ধী সময়ে মানুষের জোট। ‘প্রতিবাদে-প্রতিরোধে-প্রতিশোধে কমরেড/ গড়ে তোলো ব্যারিকেড’— এই দীর্ঘ দৃপ্ত স্লোগানের প্রতিটি শব্দের গুরুত্ব, প্রতিটি শব্দের বাস্তবতা ছাত্ররা, সহনাগরিকেরা বুঝবেনই। আর, তখন নিশ্চয়ই আরও স্পষ্ট শোনা যাবে— নো পাসারান।