কমিউনিজম, কমিউনিস্ট পার্টি এবং আপস ও আমরা

প্রবুদ্ধ ঘোষ

 

আমাদের প্রজন্ম কমিউনিজম কী, ম্যানিফেস্টো কী এবং রাষ্ট্র-বিপ্লব, দ্বন্দ্বতত্ত্ব কী এগুলো জানবার বহু আগেই জেনে ফেলেছিলুম, ভারতে কমিউনিস্ট দল ক’টা (আনুমানিক)! বিভিন্ন দলের মধ্যে যে প্রবল বিরোধ, কখনও কখনও তা রক্তক্ষয়ী, তাও কানে এল, দেখলুম। সবকটা কমিউনিস্ট দলই ব্যবহার করে আয়তক্ষেত্র লাল পতাকা, যার মাঝে সাদা কাস্তে-হাতুড়ি; ভোটের সময় অবশ্য সেই চিহ্ন পাল্টে নিতে হয়। একটা-দুটো কমিউনিস্ট পার্টি কাস্তে-হাতুড়ি অক্ষুণ্ণ রাখে, কারণ তারা সংসদীয় ভোটব্যবস্থায় অংশ নিতে চায় না। আরেকটু বোধবেলায় বোঝা গেল যে, বাম দলগুলোর মেকি আর আসল হয়। যদিও, সব দলের মূল স্লোগান ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ এবং দেয়াল লিখন ‘কমরেড, নবযুগ আনবে না?’, তবুও তারা একে অপরের দিকে আঙুল তোলে— ‘আমরা আসল ওরা নকল’। সামান্য কিছু তত্ত্ব আর পুস্তিকা পড়ে এবং ভাষণ-বিতর্ক শুনে নিজস্ব জ্ঞানকাণ্ডে পরিষ্কার হতে থাকল, কোন কমিউনিস্ট পার্টি বিশ্বাসযোগ্য আর কোন দল নয়। আর, আগের প্রজন্মের বা তারও আগের প্রজন্মের পার্টিকর্মী ও বামপন্থী গণসংগঠনকর্মীদের মুখে শুনতে শুনতে যে বাক্য অসাড় হয়ে যায় তা হল— “আমাদের সময়ে কী ছিল, আহা!! আর, এখন?! ছিঃ! ছিঃ!” অথচ, যারা বলল এ কথা, দোষারোপ করল আমাদের সময়কে, তারা কখনও ভেবে দেখল না যে, তাদের সময় চুঁইয়েই আমাদের সময়টা এসেছে; আগের প্রজন্মের আগের দশকগুলোর আগের শতকের বহু দ্বন্দ্ব সাফল্য-ব্যর্থতা-সুবিধাবাদ-শোধনবাদ-রক্তপাত-আত্মত্যাগ-আপস-মতাদর্শের মধ্যে দিয়েই আমাদের সময় তৈরি হয়েছে। কোনও কমিউনিস্ট পার্টিই তার অতীতকে অস্বীকার করতে পারে না, আমরা কেউই পার্টি-গণতন্ত্রের কিংবা পার্টি-জনগণের অম্লমধুর সম্পর্ককে অস্বীকার করতে পারি না; না ভূতে না ভবিষ্যতে।

###

 

It is not the consciousness of men that determines their being, but, on the contrary, their social being that determines their consciousness.

–Karl Marx

কমিউনিস্টদের সম্পর্কে আগে কী ধারণা ছিল? তাঁরা বিশুদ্ধ, মিথ্‌তুল্য মানুষ, তাঁদের নীতিবোধ, আদর্শ অনমনীয়। কিন্তু, বিশ্বায়ন পরবর্তী সময়ে এই কমিউনিস্ট নেতাদের ‘ইমেজ’ পড়ল প্রশ্নের মুখে। কারণ, সংসদীয় কমিউনিস্ট দলের নেতাদের প্রবলভাবে পপুলিস্ট রাজনীতিতে মিশে যাওয়া এবং বিশ্বায়িত উদারনৈতিক সমাজ-অর্থনীতির মাপে ও ছাঁচে নিজেদের ঢেলে সাজিয়ে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চলে আসে আপসের প্রশ্ন। মতাদর্শের সঙ্গে কত অনুপাতে আপস মেশালে ‘মেজরিটির শাসকনির্মিত সংস্কৃতি’-র তালে তাল দেওয়া যায় চলতে লাগল তার অনুশীলন। ১৯৭০ দশকেও অন্তত সিপিআইএমের কোনও নেতা দোতলা বাড়ি হাঁকাচ্ছেন বা দামি পোশাক পরছেন— এটা অভাবনীয় ছিল। কিন্তু, গত দশকে সিপিআইএমের কোনও নেতা মঁ ব্লাঁ পেন পকেটে নিয়ে ঘুরছেন, আইফোনে তাঁর অনায়াস পারদর্শিতা— এটা ক্রমশ নর্ম্যালাইজ হতে থাকল। ‘অপারেশন? বসাই টুডু’-তে মহাশ্বেতা দেবী ক্রমশ বৃদ্ধিমান ফাঁকফোকর দেখেছিলেন ‘বাবু’ কমিউনিস্ট নেতা ও নিচুতলার কর্মীদের মধ্যে। গত দশকে আমরা দেখলুম যে, উন্নয়নহীন, পুলিশি সন্ত্রাসে ভয়ার্ত ও ন্যূনতম দাবিদাওয়া পূরণ না হওয়া প্রান্তিক-প্রত্যন্ত গ্রামে সিপিআইএম নেতার দোতলা বাড়ি যেখান থেকে গুলি চালানো হচ্ছে আন্দোলনকারী কৃষকদের ওপরে। এই যে ক্ষমতার দাম্ভিকতা, ক্ষমতাহীনের মতাদর্শের মুখোশে শোষকশ্রেণিকে তোল্লাই দেওয়া এবং ক্ষমতা-অর্থ-অপরাধের ত্রিভুজকে নর্ম্যালাইজ করে দেওয়া— এগুলোর মধ্যে একরকমের অশ্লীলতা আছে, নোংরামো আছে। যেটাকে ‘সংস্কৃতি’র দোহাই দিয়ে স্বাভাবিক করে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে বিগত কয়েক দশক ধরে— ফলে, ‘কংরেস’ নেতা আর ‘কমুনিস’ নেতার মধ্যে যে অনুশীলনগত ও স্ট্রাকচারাল পার্থক্য ছিল, জনমানসে যে ‘ইমেজ’ ছিল, তা ক্রমশ মিলিয়ে গেছে। নেতামাত্রেই যে করাপ্ট, দুর্নীতিপাঁকে নিমজ্জিত তা আমরা বুঝে গেছি— আর, সেখানে ভোটপন্থী বাম নেতা আর ডান নেতার মধ্যে তফাৎ নেই কোনও; নারী বা নিম্নবর্গের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিতে, প্রকাশ্য বক্তব্যে অথবা সুপ্ত মানসিকতায় যে অসংবেদনশীল হেজেমনিক মতামত প্রকাশ সেখানেও প্রায়শই বাম ও ডান নেতার আচরণ-স্বভাব মিলে যায়। তরুণমন বরাবরই ‘আইকন’ খোঁজে, শিল্প-রাজনীতি-কর্মক্ষেত্র সবখানেই কোনও একজন আদর্শমানুষের ছবি আঁকা হয়ে যায় এবং সেইমতো নিজেদের (অন্তত প্রৌঢ়ত্ব অবধি) গড়ে তোলার চেষ্টা থাকে। ভারতবর্ষের কমিউনিস্ট আন্দোলনে উত্তাল ৪০-৫০-৬০-৭০ দশকে কমিউনিস্টদের আত্মত্যাগ, শ্রেণিভাবনা, অতিসাধারণ জীবনযাপন এবং কথা-কাজের প্রায়-মেলবন্ধন তরুণমনকে প্রভাবিত করেছে; ছাত্র-যুবদের মানসিকতায়, আচরণে এবং গণআন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকায় সেটার প্রতিফলন ঘটেছে। কিন্তু, এর পরের দশকগুলোতে যখন সংসদীয় বামপন্থীদের দু-তিনটি রাজ্যে ক্ষমতাশীর্ষে আসন পাতা হল, সেই আসনগুলোকে নিষ্কণ্টক করতে ‘মেশিনারি’-র বহুলপ্রয়োগ ঘটল, ‘কমিউনিস্ট’ সংস্কৃতির নাম করে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির সঙ্গে ব্যত্যয় ঘটানো হল এবং উদারনৈতিক-বিশ্বায়িত পরিস্থিতিতে ‘শ্যাম রাখি না কূল’ বামপন্থীদের এই আদর্শবিমূঢ়তা প্রবল হল— তখন তরুণযুব মনে আদর্শ কমিউনিস্ট নেতার ‘আইকনিক ইমেজ’ ভাংচুর হতে থাকল।

১৯৪২ ও ১৯৬২ এই দুই সময়ে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি ‘দেশপ্রেম’ বনাম ‘আন্তর্জাতিকতাবাদ’ এই দ্বন্দ্বের সম্মুখীন হয়েছিল। সেই নিয়ে বিতর্কও কিছু কম হয়নি, এখনও দক্ষিণপন্থী দলগুলো সেই বিতর্ক উত্থাপন করে নিজেদের পালে হাওয়া টানতে চায়। ’৮০-র দশকের শেষভাগ থেকে আরএসএসের জাতীয়তাবাদী উত্থান ও তাদের ভোটমুখোশ বিজেপি-র নিরবচ্ছিন্ন কর্মকাণ্ডে কংগ্রেস নির্ধারিত জাতীয়তাবাদের সংজ্ঞায়ন থেকে আরও উগ্র জাতীয়তাবাদের দিকে যাত্রা চলেছে। কেন্দ্রীয় স্তরে মসনদ দখলের জোট-রাজনীতিতে সংসদীয় বাম দলগুলি নিজেদের অবস্থান নিয়ে দোলাচলে ভুগতে ভুগতে এবং তুলনামূলক ‘কম খারাপ’ দল/দলগুলোর সঙ্গে জোটবাঁধা নিয়ে বক্তব্য পরিষ্কার করতে করতে উগ্র জাতীয়তাবাদের রঙে ‘দেশপ্রেম’ ক্রমেই রাষ্ট্রপ্রেমে বদলে গেছে। জনপ্রিয়তার মাপকাঠিতে টিঁকে থাকতে গিয়ে, সংখ্যাগুরুর (ধর্ম বা জাতি) ভোটব্যাঙ্ক খোয়াতে না চেয়ে মতাদর্শের সঙ্গে আপস করে প্রয়োজনভিত্তিক দেশপ্রেম বা প্রাদেশিকতাকে প্রশ্রয় দেওয়া হয়েছে অনুশীলনে। বহু ন্যায্য কথা সময়মতো বলা হয়ে ওঠেনি বা কেন্দ্রের বহু অনৈতিক-শ্রমজীবীবিরোধী বক্তব্যের বিরুদ্ধে সক্রিয় গণবিক্ষোভ গড়া যায়নি সংসদীয় রাজনীতির দায়ে পড়ে। যে কংগ্রেস ছিল ’৮০-র দশক অবধি মূল শত্রু, তাদের সঙ্গেও হাত মেলাতে হয়েছে ভোট-রাজনীতিতে টিঁকে থাকতে গিয়ে। শাসকশ্রেণির আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের সুযোগ নিয়ে জন মতামত ঐক্যবদ্ধ করার প্রয়োজনীয় মুহূর্তে, সেই দ্বন্দ্বেরই অংশ হয়ে যেতে গিয়ে মুশকিল হয়েছে যে, মতাদর্শের বিশ্বাসযোগ্যতা পড়েছে প্রশ্নের মুখে।

কারণ, মতাদর্শের তাত্ত্বিক ভিত্তি যত মজবুতই হোক না কেন, সেটা জনগণের ও যুবমনের বোধগম্য হয় কিন্তু অনুশীলিত বাস্তবেই। আর, সেই অনুশীলনের ফাঁকফোকর ক্রমশ বড় হতে হতে এক সমুদ্র ব্যবধান তৈরি হয়ে গেছে নিপীড়িত বৃহৎ জনচেতনা ও সংসদীয় বামপন্থীদের মধ্যে। ‘কমিউনিস্টরা ধর্ম মানেন না, ধর্মীয় আচরণে বিশ্বাস রাখেন না’— এই আপ্তবাক্যের ছাপ বামপন্থী তত্ত্ব-অনুশীলনের সংস্পর্শে আসা মানুষদের মনে পড়েছে। কিন্তু, সেই বামপন্থীরাই যখন কেউ বোনালু উৎসবে মাথায় ফুলের পাত্র নিয়ে হাঁটেন, কেউ যখন হাতে মাদুলি-তাবিজ পরেন, তাদেরই মন্ত্রী যখন ‘ব্যক্তিগত বিশ্বাস’-এর দোহাই দিয়ে প্রকাশ্যে ধর্মপালন করেন— তখন সেই আপ্তবাক্যে দাগ পড়ে। কাশ্মীরের ‘আজাদি’-র প্রশ্নে সংসদীয় বামেদের দ্বিধাজড়িত উচ্চারণ, অসমে এনআরসি-র প্রশ্নে শর্তভিত্তিক সমর্থন অথবা, সেজ্‌-এফডিআই নীতিতে আস্থাজ্ঞাপন সাম্যবাদী তত্ত্ব ও বাস্তবের অনুশীলনের ব্যবধান কয়েকযোজন বাড়িয়ে দিয়েছে। একইসাথে বিভ্রান্ত ও দোদুল্যমান হয়ে পড়েছে এঁদের মতাদর্শের অধীনে থাকা গণসংগঠনের সদস্যরা।

###

 

১৯৮৯ এর পর থেকে বিশ্বে যা ঘটে গেছে তার সঙ্গে তাল রেখে, আমার স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, আমি তালকানা লেখক ও সেইসঙ্গে ভিতু বক্সারে পরিণত হয়েছি। এই অবস্থানটা সুখকর নয়।

—নবারুণ ভট্টাচার্য

আমরা যারা ’৯০-র দশক জুড়ে বেড়ে উঠেছি, তাদের সামনে কোনও ‘সমাজতান্ত্রিক দেশ’ ছিল না। ১৯৭০ দশক অবধি ‘চেয়ারম্যানের চিনকে রক্ষা করুন’ বা ‘দ্য সোশ্যালিস্ট ফাদারল্যান্ড ইন ডেঞ্জার’ সমস্বর বা দেয়ালবাক্য জেগে ছিল। ঠান্ডা যুদ্ধ চলাকালীন পক্ষ বেছে নেবার অবকাশ ও অনুশীলিত উদাহরণ (শুভেচ্ছা ও সমালোচনা সহ) ছিল। ১৯৯১ পরবর্তী সময়ে, সোভিয়েত ভেঙে যাওয়ার পরে, সেজ্‌-মার্কেট সোশ্যালিজম প্রতিষ্ঠার যুগে এবং অবাধ পণ্যায়ন-তথ্যসঙ্গমের সন্ধিক্ষণে পক্ষ বাছার অবকাশ আর রইল না। পুঁজি তার কালগ্রাসী ডানা মেলে দখল করতে থাকল বিকল্পের পরিসর। দ্রুতগতিতে পাল্টে যাওয়া আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে বাধ্যত বিশ্বায়নকে স্বীকার করে, তার ‘মানবিক মুখ’ খোঁজার সান্ত্বনা পড়ে রইল আর পড়ে থাকল উদারনৈতিক অর্থনীতিকে প্রাণপণে মার্ক্সবাদী তত্ত্বের সঙ্গে মিলিয়ে জনপ্রিয়তার গড্ডলিকা প্রবাহে মিশে যাওয়া। আর, তিয়েনানমেন-মরিচঝাঁপি-নন্দীগ্রাম-কিম জং কালপর্বে বাজার-সমাজতন্ত্রের গা-জোয়ারি প্রয়োগে কিংবা গণতন্ত্রহীন কেন্দ্রিকতার যান্ত্রিক-অমানবিক প্রয়োগে নতুন প্রজন্মের সঙ্গে অদ্ভুত দূরত্ব তৈরি হল বামপন্থী (অন্তত নামে) শাসকদের। ১৯৭০-র শেষে দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাসে হুড়মুড়িয়ে ভোগ্যপণ্য ঢুকে পড়ায় আতঙ্কিত বোধ করেন কমিউনিস্ট প্রোটাগনিস্ট, ‘যুদ্ধ পরিস্থিতি’তে রণজয়ের মতাদর্শ-জাগানিয়া স্মৃতি আপসহীন প্রতিরোধ গড়ে তোলে পণ্যকামী সমাজের বিরুদ্ধে। অথচ, নব্বই দশকে বেড়ে ওঠা আমাদের কাছে শ্রমিক ধর্মঘটের লাল রঙে মিশল কোকাকোলা-এভারেডির লাল; এক দশক পরে প্রতিবাদী কৃষকের রক্ত। চল্লিশ-সত্তর দশকের দ্রোহীপ্রজন্মকে নিয়ে মুখে মুখে ফেরা মিথ্‌ আর প্রতিশোধের গানের সুরে মিশল অ্যাড্‌-জিঙ্গল আর কলারটিউনের মুহূর্তবদল। আমরা জানলুম, কম্পিউটারে সিঁদুরের টিপ লাগানো, যুদ্ধবিমানকে পুজো করা, শ্রেণি থেকে স্টেটাসে ‘উত্তরণ’ এবং বৃহত্তর সমাজপরিসর থেকে ব্যক্তিপরিসরের আপসে মানিয়ে নেওয়া। ভারতীয় মধ্যবিত্তের বরাবরের প্রিয়শব্দ ‘আপস’, তবু এই ‘আপস’ শব্দের লজ্জাবোধ, অন্তর্দাহ যেটুকু ছিল, তা আর রইল না; বরং এই শব্দটির ব্যবহার হল প্রকাশ্য, দেখনদারিতে। ভারতের সংসদীয় বাম দলগুলো ২০০৪ সাল থেকে ভারতীয় রাজনীতিতে টিঁকে থাকার জন্যে তাদের এককালের ঘোর শত্রু কংগ্রেসের সঙ্গে আপসভিত্তিক জোট করল; পরমাণু চুক্তির বিরোধিতা করে (যদিও ২০০৬ সালে বামশাসিত পশ্চিমবঙ্গের হরিপুরে একটি রুশ কোম্পানির সঙ্গে সেজ্‌ চুক্তিতে দু’টি নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট তৈরির অনুমতি দেয় মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, গ্রামবাসীদের মতামতের তোয়াক্কা না করে) ইউপিএ সরকারের সঙ্গত্যাগ করলেও ফের ২০১৬ সালের বিধানসভা ভোটে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করে আরেক দক্ষিণপন্থী স্বৈরতান্ত্রিক দল তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে। এর ফলে, সংসদীয় বামপন্থী দলগুলোর ভোটসংখ্যায় (তাদের ভাষায় ‘শ্রেণিভিত্তি’) ধস নামে; হয়তো ‘রাজনৈতিক বন্ধুতা’ রক্ষা করতে গিয়ে মতাদর্শের সঙ্গে আপসের বিচ্যুতি মেনে নিতে পারেননি দলগুলোর সমর্থকেরা। ২০১৯-র লোকসভা ভোটে পশ্চিমবঙ্গ ও ভারতের বাম ভোটব্যাঙ্কে অবিশ্বাস্য রকমের ধাক্কা লাগে, বিতর্কের আবহ তৈরি হয় সিপিআইএমের ভোটভিত্তি উগ্র জাতীয়তাবাদী বিজেপির দিকে চলে যাওয়ার ইঙ্গিতে। নতুন যে প্রজন্ম এই রাজনৈতিক আবহে বিশ্বায়িত জ্ঞানকাণ্ডের প্রেক্ষিতে সংসদীয় বামেদের এই দোলাচল প্রত্যক্ষ করছে, খুব স্বাভাবিকভাবেই তাদের কাছে মতাদর্শ-আপস, জাতীয়তাবাদ-আন্তর্জাতিকতাবাদ, দেশপ্রেম-রাষ্ট্রপ্রেম, বিনিয়োগ পুঁজি-সমাজতান্ত্রিক বিকল্প ইত্যাদি বাইনারিগুলো ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে।

আমাদের প্রজন্মের বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে ভারতের সমাজ-অর্থনীতিতে কিছু বড়সড় রদবদল ঘটে গেছে। কৃষিঅর্থনীতির উৎপাদন সম্পর্ক, কৃষক শোষণ, অনুন্নত কৃষিব্যবস্থার মধ্যেই আচমকা ঢুকে পড়েছে পরিষেবা শিল্প; শিল্পক্ষেত্রকে (ইন্ডাস্ট্রিয়াল সেক্টর) বুড়িছোঁয়া ছুঁয়েই। পশ্চিমবঙ্গের শাসনক্ষমতায় থাকা বামদলটি কৃষি-অর্থনীতির মূলগত সমস্যার পুরো সমাধানের আগে এবং অন্তত নিজশাসনাঞ্চলে প্রয়োজনীয় ভারী-মাঝারি শিল্পক্ষেত্রের সঠিক বিকাশের আগেই ঢুকিয়ে ফেলেছে রিয়াল এস্টেটের মতো এক ফাটকা পুঁজির শিল্পকে। অর্থনীতির সুদীর্ঘ আলোচনাকে মুলতুবি রেখেও বলা যায় যে, এর ফলে ১— প্রয়োজনীয় পরিচর্যার অভাবে গুরুত্বপূর্ণ বহু শিল্প-কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে এবং ফাটকা পুঁজির শিল্পবিকাশের ফলে এক দালালশ্রেণির প্রতিপত্তি বেড়েছে। আর, ২— শিল্পস্থাপনের জন্যে শ্রমিকদরদী পরিকল্পনা ও বামপন্থী মতাদর্শের প্রয়োগকৌশল না থাকার কারণে কৃষকদের থেকে জোর করে জমি অধিগ্রহণ করতে হয়েছে এবং সেজ-সিইজেড ইত্যাদি মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী আইনের সঙ্গে হাত মেলাতে হয়েছে। বিশ্বায়ন পরবর্তী সময়ে দেশে হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়া পরিষেবা শিল্পকে গ্রহণ-বর্জনের ব্যাপারে দোদুল্যমানতা ও হঠাৎ চিনের বাজার-অর্থনীতির মডেলে আকৃষ্ট হয়ে রাতারাতি শ্রমিক-কৃষকদের অর্জিত অধিকার দমিয়ে শিল্পায়নের ‘ফেইলড্‌’ নীতিকৌশল আমদানি করা— এসবের মধ্যেই তালগোল পাকিয়ে গেছে দীর্ঘ তিন দশক ক্ষমতাসীন বামপন্থী দলের বিশ্বাস-ভরসা-ভোট-প্রগতি সবকিছুই। কতটা বামপন্থী হলে বহুজাতিক কোম্পানির পরিষেবা ক্ষেত্রে শ্রমিক সংগঠন গড়ে তোলা যায় আর, কতটা নীতিগত আপসের পরে শ্রমিক-কৃষক-বৃহত্তর ভারতের উন্নয়ন ভুলে যেতে হয়— এই ধোঁয়াশাতেই কাটছে প্রায় দুই দশক। গোটা ভারতের প্রেক্ষিতে মধ্যবিত্ত শ্রেণির সংজ্ঞাবদল হচ্ছে, শ্রেণিচেতনা থেকে স্টেটাসচেতনায় (সামাজিক অবস্থান) অক্ষবদল হচ্ছে পণ্যসঙ্গমের ভোগবাদী অর্থনীতিতে। অথচ, ভারতের বৃহত্তর জনগণ জীবনানন্দের কবিতালাইনের মতো নিস্তেল অন্ধকারে ডুবে আছে; মধ্যবিত্ত শ্রেণির পরিসর ছিঁড়ে নিম্নবিত্তের পরিসরে এসে পড়ছে আরও মানুষ। আর, নামমাত্র শতাংশ হ্যাঁচোড়-প্যাঁচোড় করে উচ্চবিত্ত তালিকায় জায়গা পাচ্ছে। ভারতের কমিউনিস্ট দলগুলোর সঙ্গে এই প্রজন্মের দূরত্ব-নৈকট্যের দ্বন্দ্বও অর্থনীতির এইসব জটিল ক্যালকুলাসের মধ্যে দিয়েই চলেছে।

অন্যদিকে, যে কমিউনিস্ট দলটি সংসদীয় রাজনীতির বাইরে থেকে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়াই করছে, তাদের ক্ষেত্রে সবথেকে বড় সমস্যা হচ্ছে জনগণের সঙ্গে যোগাযোগস্থাপনে। নকশালবাড়ি আন্দোলনের সাময়িক সেট-ব্যাকের পরবর্তীতে প্রায় ৫-৬টি পার্টিতে ভাগ হয়ে যায় তারা। পরবর্তীতে ছাত্র-যুব সংগঠনের নিরন্তর দ্রোহী মানসিকতা, আত্মত্যাগ এবং ‘ভিরাসাম’-র মতো সাংস্কৃতিক গণসংগঠনের বিপ্লবী কার্যক্রমের ধারাবাহিকতায় ফের শোষকবিরোধী সশস্ত্র আন্দোলনের বাস্তবপ্রয়োগ ঘটাতে থাকে। ২০০৪ সালে অতীতের ভিন্ন ভুলের পর্যালোচনা ও আত্মসমালোচনার মধ্যে দিয়ে সিপিআই (মাওবাদী) পার্টির প্রতিষ্ঠা হয়। কিন্তু, এর অল্প সময়ের মধ্যেই এই পার্টিটিকে ‘দ্য বিগেস্ট ইন্টারন্যাল থ্রেট টু ইন্ডিয়া’জ সিক্যোরিটি’ দেগে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে দেয় ভারতরাষ্ট্র। এই পার্টির বিভিন্ন গণসংগঠনের কর্মীদের ওপরে প্রয়োগ করা হয় ইউএপিএ, ‘ফেক এনকাউন্টার’-এ হত্যা করা হয় পলিটব্যুরো ও কেন্দ্রীয় কমিটির কয়েকজনকে এবং শুরু হয় ‘অপারেশন গ্রিন হান্ট (ইউপিএ সরকারের নীতি)’ এবং ‘অপারেশন সমাধান (মোদি সরকারের নীতি)’। গণসংগঠন ও বিভিন্ন মুখপত্র রাষ্ট্রকর্তৃক নিষিদ্ধ হওয়ার ফলে, বিভিন্ন ইস্যুতে এঁদের বক্তব্য পৌঁছয় না এঁদের আয়ত্তের বাইরে থাকা অঞ্চলের লোকজনের কাছে; এঁদের বিকল্প অর্থনীতির সূত্র বা ‘জনতানা সরকার’-এর কর্মকাণ্ড পৌঁছয় না নগরায়িত অর্থনীতিতে অভ্যস্ত জনগণের কাছে। একদা ’৬০-র দশকের শেষভাগে এঁদের মতাদর্শে আস্থা রেখে যে ছাত্র-যুবরা ভারতবর্ষের প্রকৃত স্বরূপ চিনতে গ্রামে গ্রামান্তরে গিয়ে জনতাকে সঙ্ঘবদ্ধ করার গুরুদায়িত্ব পালন করতেন, সেই ‘ছাত্র-যুব’ প্রজন্মের কাছে এখন আর এঁদের বক্তব্য সহজভাবে পৌঁছতে পারে না। এই কমিউনিস্ট পার্টির নীতি-কৌশল সংক্রান্ত বক্তব্য যেটুকু পৌঁছয়, তা হয় বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম ও রাষ্ট্রদ্বারা ‘ফিল্টার্ড’ হয়ে আসে, নয়তো স্টেট অ্যাপারেটাসের বজ্রআঁটুনির ফাঁকফোকর গলে আসা কিছু খবর, আহ্বান। কিন্তু, তা এতই অনিয়মিত এবং সময়সাপেক্ষ যে, দ্রুতগতিতে বদলে চলা আর্থ-সামাজিক খবর-ঘটনার স্রোতে চাপা পড়ে যায়। এ প্রজন্মের ছাত্রযুবরা অনেকক্ষেত্রেই সিপিআই (মাওবাদী)-র নিরন্তর দ্রোহচেতনার মতাদর্শের কথা যদিওবা মানে, কিন্তু তাঁদের শহরবিমুখতা ও শ্রেণিসংগ্রামের ‘বাস্তবপ্রয়োগ (শ্রেণিশত্রু খতম)’-এ আস্থা রাখতে পারে না। মাওবাদীরা পপ্যুলিস্ট রাজনীতির জোয়ারে ভেসে বা ভোটব্যাঙ্ক অক্ষত রাখতে চেয়ে মতাদর্শের উদারনৈতিক-শোধনবাদী আপসে হয়তো বিশ্বাস রাখে না, রাষ্ট্রের চাপিয়ে দেওয়া দেশপ্রেমের বাধ্য-সংজ্ঞার বিরোধিতা করে, জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার মেনে কাশ্মিরের আজাদিকে সমর্থন করে কিংবা সেজ-এফডিআই নীতির বিরোধিতা করে, উগ্র জাতীয়তাবাদী ফ্যাসিস্তদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র লড়াই জারি রাখে— তবুও, ভারতবর্ষের বর্তমান প্রজন্মের কাছে পৌঁছনোর সহজ স্বাভাবিক বিকল্প পথ এঁদের ভাবতেই হবে। নয়তো, নিকটাগত ফ্যাসিস্ত প্রবণতার সঙ্কটময় মুহূর্তে তাঁদের অনমনীয় মতাদর্শের গুরুত্ব থাকবে না।

কমিউনিজমের মতাদর্শ অনুযায়ী শ্রেণি একমাত্র বিপ্লবভিত্তি এবং শ্রেণিসংগ্রামে জারিত শ্রেণিচেতনাই কাঙ্খিত মুক্তি ও সমাজকাঠামো বদলের পথে নিয়ে যেতে পারে। কিন্তু, ভারতীয় সংস্কৃতি ও বাস্তবে শুধুমাত্র এই সরল সমীকরণে অঙ্ক কষা যায় না; এদেশে জাতি-ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ ও কিছুক্ষেত্রে ভাষা সমাজভিত্তিকে প্রভাবিত করে, ভারতবর্ষের সুপ্রাচীন ইতিহাসবোধ থেকেই। ধর্মকে শুধু ‘আফিম’ বলে দেগে দেওয়া যায় না বরং উপমহাদেশের রাজনীতির অন্যতম নিয়ন্ত্রাও এটা। বর্ণব্যবস্থার কুপ্রভাব হাজার বছরেরও বেশি সময় ভারতীয় জ্ঞানকাঠামো ও আর্থ-সামাজিক অবস্থার ভিত্তি। ভারতবর্ষের সংজ্ঞানির্ধারণ ‘এক জাতি বা এক ভাষা’ দিয়ে হয় না, বরং বহুজাতির বহুভাষার সহাবস্থানের-পরস্পরবিরোধের দ্বান্দ্বিকতায় নির্ধারিত হয়। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে লিঙ্গরাজনীতি বাদ দিয়ে ‘আগে বিপ্লব হোক, পরে সব ঠিক হয়ে যাবে’ স্তোকবাক্যে সমাজকাঠামোকে মূল্যায়ণ করা যায় না। আর, ভারতীয় কমিউনিস্ট দলগুলোর অনুশীলনে (দক্ষিণপন্থী দলগুলোর থেকে এ বোধ আশা করাও বাতুলতা) এই বাস্তববোধ এসেছে বহু পরে, বলা ভাল যে, এখনও আসছে প্রতিমুহূর্তে। শ্রেণিবৈষম্যমূলক সমাজে এই বিষয়গুলোর দ্বারা নিপীড়িত সত্তা প্রভাবিত হয় এবং নিম্নবর্গের অবস্থান ও শ্রেণিসংগ্রামে ভূমিকা নির্ধারিত হয়। এই বোধের ওপরে যত গুরুত্ব আরোপিত হচ্ছে, ততই কমিউনিস্ট পার্টিগুলোর পুরনো ধ্যানধারণা বদল হচ্ছে। বর্তমান প্রজন্মে যাঁরা সক্রিয়ভাবে কমিউনিস্ট পার্টি অথবা পার্টি নিয়ন্ত্রিত বিভিন্ন গণসংগঠনে যুক্ত আছেন, তাঁরা সচেতন এই বিষয়ে। বর্তমান প্রজন্মের অনুশীলনে উঠে আসা এই প্রশ্নগুলোর আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের মধ্যে দিয়ে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যরা শ্রেণিসংগ্রামের দিশা খুঁজছেন।

###

 

-Not the war itself but what it has revealed about the Vietnamese people, about their extraordinary power of resistance… ordinary people, peasants and no one knew they had it in them and this isn’t a matter of technology. It’s just plain human courage and it takes your breath away.

-Are you a communist?

“গত দশকের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা কোনটা?” ’৭০ দশকের এক ইন্টারভিউয়ের প্রশ্নে ১২ সেকেন্ড নীরবতার পরে সিদ্ধার্থর উত্তর ছিল— ভিয়েতনামের যুদ্ধ! কারণ, ভিয়েতনামের প্রত্যাঘাত, দুর্দান্ত শক্তিশালী রাষ্ট্রের সেনাবাহিনীকে মরণপণ যুদ্ধে রুখে দেওয়া এবং হারতে হারতেও ভিয়েতকংদের জিতে যাওয়ার রূপকথাসম বাস্তব। প্রযুক্তি-বিজ্ঞানের অগ্রগতির যুগে চন্দ্রাভিযান শুধু সময়ের অপেক্ষা, প্রত্যাশিত কিন্তু, ভিয়েতনামের যুদ্ধজয় অপ্রত্যাশিত এবং ঐক্যবদ্ধ মানুষের যুগান্তকারী সাফল্য!

চাঁদে মানুষের পা রাখার ৫০ বছর পেরোল। এই দশকের চন্দ্রাভিযান। প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের সাফল্য। আর, সিদ্ধার্থকে যদি এই শতকের বিশের দশকে কেউ জিজ্ঞেস করে ওই একই প্রশ্ন, ‘What do you regard as the most significant and outstanding event of the last decade?’ কী উত্তর দেবে সিদ্ধার্থ? ১২ সেকেন্ড, ১২০ সেকেন্ড… সিদ্ধার্থর দশকে অমন এক গর্বের রূপকথা ছিল। দানবিক রাষ্ট্র, এজেন্ট অরেঞ্জ, নাপাম বোমা এবং আধুনিকতম সমরাস্ত্রকে হারিয়ে মানুষের জিতে যাওয়ার বাস্তব। কিন্তু, এখন বা পরের দশকে কী উত্তর দেবে? আমাদের প্রজন্ম কী বলবে? ইরাক-ইরান পারেনি, আফগানিস্তান দুমড়ে-মুচড়ে গেছে, সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও কাশ্মীরকে আমরা আজাদির লড়াইয়ে পূর্ণ সমর্থন দিতে পারিনি ‘দেশপ্রেম’-র কড়া ওষুধ গিলে গিলে। দেশজোড়া ফ্যাসিবাদী জতুগৃহে, ‘কালেক্টিভ কনশেন্স’-র দাপাদাপির যুগে, আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক শিবির না-থাকার সময়ে এবং ক্রমশ মানুষের পাশ থেকে মানুষের সরে সরে যাওয়ার অন্ধসময়ে আমরা কী উত্তর দেব?

ভার্চুয়াল রিয়ালিটি, সোশ্যাল মিডিয়া অন্তত একটা কাজ খুব ভালভাবে গত দশকের শেষভাগ থেকে আমাদের মধ্যে ঢুকিয়ে দিতে পেরেছে— একটা ‘সেন্স অব্‌ রিলিফ’ বা আত্মতুষ্টির বোধ। ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলন তৎসহ ভারতের বর্তমান যুবমন এই ভার্চ্যুয়াল মাধ্যমের অধিবাস্তবতা ও সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রভাবিত। বহু মৌলিক সমস্যা ও অধিকারের সমাধান না হলেও, ফোন ও সোশ্যাল মিডিয়ার অ্যাকাউন্ট রয়েছে নগরায়নে প্রভাবিত জনগণের একটা বড় অংশের। আর, আর্থ-সামাজিক পরিসরে এঁদের প্রত্যেকের নিজস্ব ‘মতামত’ রয়েছে; যতই সে মতামত বহুলাংশে রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রের তাঁবেদার মাধ্যমদ্বারা নির্মিত হোক বা যতই সে মতামত প্রকাশের ‘স্বাধীনতা’ রাষ্ট্রনীতি কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হোক। যে কোনও ইস্যুতে সোশ্যাল মিডিয়ার পোস্টে যত সহজে ঘৃণা উগরে দিচ্ছি, নিজেদের মতের সপক্ষে সায় জোগাড় করছি বা ‘লাভ/স্যাড/অ্যাংরি’ রিয়াক্ট করছি একটা ক্লিকে, তত সহজে বাস্তবে সঙ্ঘবদ্ধ হতে পারছি না। রাষ্ট্রের অপদার্থতায়, রাষ্ট্রের জুলুমবাজি নীতিতে একটা ছবি শেয়ার করে, একটা পোস্ট শেয়ার করে বা একটা কবিতা লিখে ‘সেন্স অব্‌ রিলিফ’ পূরণ হচ্ছে আমাদের; চেনাবৃত্তে থাকা চেনামানুষেরা তাতে মতামত বা বিরোধিতা জানাচ্ছে— ফলে, তাদেরও একরকম আত্মতুষ্টির বোধ জন্মাচ্ছে। অর্থাৎ, এই পরিসরেই বোধহয় প্রতিবাদ-প্রতিরোধের দায় শেষ হল এবং নিজের মতামত চেনাজনেদের জানিয়ে দিয়ে সামাজিক দায়রক্ষা হল। আর, এত ইস্যু রোজ আমরা জানছি, দেখছি। আমাদের প্রতিবাদও ইস্যুতে ইস্যুতে ভাগ হয়ে যাচ্ছে। আমরাও ক্লান্ত হয়ে পড়ছি প্রতিবাদ লিখে। আমাদের মতামতও একটা পর্যায়ে এসে ভেঙে ভেঙে যাচ্ছে; ভার্চ্যুয়াল রিয়ালিটির সামাজিক মাধ্যমে নিরন্তর প্রতিবাদ জানানোর ক্লান্তি থেকে এবং সামাজিক ‘আত্ম’জনপ্রিয়তার দায় থেকেই প্রতিবাদ হয়ে পড়ছে ‘সিলেক্টিভ’। কমিউনিস্ট পার্টির গণআন্দোলনের ইতিহাসে মানুষের সক্রিয় সঙ্ঘবদ্ধ ভূমিকার যে উদাহরণ আছে, সেই উদাহরণের ধারাবাহিকতা থাকছে তো? নাকি, ফি-কমানোর দাবিতে ছাত্রদের প্রতিবাদী মিছিল একসময় শান্ত হবে জেনে, প্রতিবাদী কৃষকদের পদযাত্রা নিজেদের কুঁড়েঘরে ফিরবে জেনে, শ্রমিকদের হরতাল বাধ্যত মালিকের কথা মেনে নেবে জেনে আমরাও ভূমিকা নিতে ভুলে যাচ্ছি? বীভৎস নাজিবাদী শাসন কায়েম হচ্ছে জেনেও আমরা ব্যক্তিসুখগণ্ডিতে স্বস্তিক্ষেত্রে স্বাভাবিক থাকার ভান করছি? অথচ, এই সময়েই তো কমিউনিস্ট দলগুলোর সঙ্গে আমাদের মিশে থাকার কথা ছিল; আর, কমিউনিস্ট দলগুলোরও কথা ছিল আত্মসমালোচনার আপাতকঠিন রাস্তা পার হয়ে আমদের হাত ধরার!

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4661 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...