সংশোধনবাদ ও মার্কসবাদের মধ্যে ঐক্য হতে পারে না

সংশোধনবাদ ও মার্কসবাদের মধ্যে ঐক্য হতে পারে না -- হরেকৃষ্ণ কোঙার

হরেকৃষ্ণ কোঙার

 

চার নম্বর প্ল্যাটফর্মের ডিসেম্বর সংখ্যার মূল ভাবনা ভারতে বাম আন্দোলনের একশো বছর। সেই ভাবনার সঙ্গে সাযুজ্য রেখেই আমরা হরেকৃষ্ণ কোঙারের এই নিবন্ধটি স্টিম ইঞ্জিন বিভাগে পুনর্মুদ্রণ করছি। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম ভাঙনের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বোঝার জন্য এই নিবন্ধটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে। এটি প্রথম ‘দেশহিতৈষী’-তে ১৯৬৫র ৩রা এপ্রিল প্রকাশিত হয় এবং পরে ১৯৭৬ সালে প্রয়াত মজহারুল ইসলাম কর্তৃক নবজাতক প্রকাশন থেকে ‘পথের সন্ধান’ নামে হরেকৃষ্ণ কোঙারের একটি নিবন্ধ সঙ্কলনে অন্তর্ভুক্ত হয়। নিবন্ধটির জন্য আমরা নবজাতক প্রকাশনের বর্তমান কর্ণধার বুলবুল ইসলামের কাছে আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞ।

সাম্রাজ্যবাদের নয়া ঔপনিবেশিক নীতি এবং দেশের ধনতান্ত্রিক বিকাশের পটভূমিকায় ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে বুর্জোয়া প্রভাব দীর্ঘদিন ধরে ধাপে ধাপে পুষ্টিলাভ করেছে এবং পার্টির মধ্যে মার্কসবাদ-বর্জনকারী এক সংশোধনবাদী গোষ্ঠী সৃষ্টি করেছে। একদিকে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের মধ্যে এক শক্তিশালী সংশোধনবাদের আবির্ভাব ও অন্যদিকে পার্টির মধ্যে মার্কসবাদী আদর্শগত সংগ্রামের দুর্বলতা – এই উভয় ঘটনা উপরোক্ত বুর্জোয়া প্রভাব ও সংশোধনবাদী গোষ্ঠীকে বিপজ্জনক ভাবে শক্তিশালী করে তুলেছে এবং পার্টি নেতৃত্ব দখল করতে তাদের সাহায্য করেছে। দেশের মধ্যে জরুরী অবস্থা ঘোষণা এবং শাসকশ্রেণী কর্তৃক উগ্র জাতীয়তাবাদী প্রচারের মুখে এই সংশোধনবাদী গোষ্ঠী আরো নীচে নেমে নিজেদের বুর্জোয়া লেজুড়ে পরিণত করেছে; তারা মার্কসবাদের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করেছে, ১৯৫৭ সালের মস্কো ঘোষণা ও ১৯৬০ সালের মস্কো বিবৃতিকে জলাঞ্জলি দিয়েছে এবং শাসকশ্রেণীর নিকট সম্পূর্ণভাবে আত্মসমর্পণ করেছে।

 

গত দেড় বৎসরের ইতিহাস

লেনিনের মতে সংশোধনবাদী চক্র হোল শ্রমিকশ্রেণীর মধ্যে বুর্জোয়া বাহিনী। ধনিকশ্রেণীর নিজেদের লোক অপেক্ষা এরা অনেক সময় ভালভাবে বুর্জোয়া স্বার্থরক্ষা করে। এরা মুখে মার্কসবাদের কথা বলে ও জনগণের দাবি-দাওয়া নিয়ে কিছু সংস্কারবাদী আন্দোলন করে নিজেদের প্রভাব বজায় রাখে এবং তাকে ধনিকশ্রেণীর স্বার্থে ব্যবহার করে। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির গত দেড় বৎসরের ইতিহাস সংশোধনবাদ সম্বন্ধে এই বক্তব্যের যথার্থ প্রমাণিত করেছে। বিভিন্ন বিষয়ে শাসক চক্রের বক্তব্যের প্রতিধ্বনি করা, যে সব মার্কসবাদী-লেনিনবাদীরা সংশোধনবাদী নীতির বিরোধিতা করেছে ও করছে, তাদের বিরুদ্ধে কুৎসা প্রচার করা, কার্যত কোনও বন্দিমুক্তি আন্দোলন না করা এবং অন্যেরা এইরূপ আন্দোলন করলে পার্টি শৃঙ্খলার নামে তার বিরোধিতা করা, তাদের শাস্তি দেওয়া, পার্টির মধ্যে গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার নীতিকে বর্জন করে পার্টি যন্ত্রকে কুক্ষিগত করা এবং জোর করে পার্টির মধ্যে দিয়ে আমাদের দেশে এই সংশোধনবাদ আত্মপ্রকাশ করেছে। কমিউনিস্ট পার্টি যথার্থ কমিউনিস্ট পার্টি থাকতে পারে একমাত্র মার্কসবাদের ভিত্তিতে। পার্টি ঐক্য একমাত্র এই ভিত্তিতেই হতে পারে। তাই মার্কসবাদ ছেড়ে দিলে এবং মার্কসবাদকে রক্ষার জন্য যারা সংগ্রাম করে তাদের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালালে গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতাকে সেই সঙ্গে পার্টিকে ভাঙ্গা হয়। সংশোধনবাদী গোষ্ঠী তাই করেছে। কিন্তু সরকারী দমননীতি স্বত্তেও প্রকৃত কমিউনিস্টরা এসবের নিকট আত্মসমর্পণ করেনি, বরং তাঁরা মার্কসবাদ ও পার্টিকে রক্ষার জন্য সংগ্রাম করে চলেছে এবং তারই মধ্য দিয়ে মার্কসবাদী শক্তিকে সংহত করেছে।

কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যকরী সমিতির গত জানুয়ারী মাসের সভায় সংশোধনবাদ ও মার্কসবাদের মধ্যে সংগ্রাম আরো স্পষ্ট ও তীব্র হয়েছে। প্রতিটি প্রস্তাব ও সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে দুই পরস্পর-বিরোধী ভাবধারার সংঘাত ঘটেছে। এই সভায় সংশোধনবাদীদের চরিত্র আরো নগ্নভাবে ফুটে উঠেছে। তাদের দুটি উদ্দেশ্য পরিষ্কার দেখা গেছে। একটি হোল বুর্জোয়া অনুচরবৃত্তি ও শাসকশ্রেণীর সঙ্গে রাজনৈতিক সহযোগিতা। অন্যটি হোল পার্টিযন্ত্রের ওপর নিজেদের আধিপত্যকে উপদলীয়ভাবে কাজে লাগিয়ে হাজার হাজার পার্টি সভাকে বাদ দিয়ে বে-আইনী ও কৃত্রিমভাবে নিজেদের মিথ্যা সংখ্যাধিক্য সৃষ্টি করে পার্টি কংগ্রেস করা এবং এইভাবে পার্টিকে ভাঙ্গার পথে আর এক ধাপ অগ্রসর হওয়া। নীচের ঘটনাগুলি হতে তা বোঝা যাবে৷

 

তামিলনাডের ঘটনা

তামিলনাড়ু পার্টির সংশোধনবাদী নেতৃত্ব সিদ্ধান্ত করে যে শ্রীকামরাজের ব্যক্তিত্বের ফলে শাসক পার্টি কংগ্রেসের মধ্যে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি ঘাঁটি গাড়তে পারে নাই, মূলতঃ তামিলনাড কংগ্রস গণতান্ত্রিক শক্তির আধার। তারা আরও ঠিক করে যে যদিও ডি. এম. কে. পার্টি গণতান্ত্রিক দাবি দাওয়া নিয়ে আন্দোলন করে ও পৃথক দ্রাবিড়িস্তানের দাবি ছেড়ে দিয়েছে, তবুও আসলে এটা প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি এবং স্বতন্ত্র পার্টি ও মুসলিম লীগের সঙ্গে সমঝোতা করে ওই পার্টি এক চরম বিপজ্জনক জোট সৃষ্টি করেছে। তাই পার্টির রাজ্য কমিটি স্থির করেছিল যে কর্পোরেশন ও মিউনিসিপ্যাল নির্বাচনে কংগ্রেসের সঙ্গে কার্যতঃ মিতালী করে এই জোটের হাত হতে ‘গণতন্ত্র রক্ষা’ করতে হবে। প্রতিক্রিয়ার বিরুদ্ধে সংগ্রামের নামে এটা যে আসলে কংগ্রেসের নির্লজ্জ অনুচরবৃত্তি তা কার্যক্ষেত্রে দেখা গেছে। মাদ্রাজ শহরের আগের কর্পোরেশনে ১০০ জন কাউন্সিলারের মধ্যে ৪ জন পার্টি সদস্য ও ১ জন দরদী নিয়ে কমিউনিস্ট গ্রুপ ছিল। এই দরদী কমরেড কৃষ্ণমূর্তি হলেন মাদ্রাজ প্রাদেশিক ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেসের দীর্ঘদিনের সহ-সভাপতি এবং তিনিই ছিলেন কমিউনিস্ট গ্রুপের নেতা। বাৎসরিক মেয়র নির্বাচনে প্রথা হিসেবে এবারে জনৈক ব্রাহ্মণের মেয়র হবার কথা ছিল। ডি. এম. কে. পার্টি কৃষ্ণমূর্তিকে সমর্থন করে মেয়র করতে চায় এবং তা সম্ভবও ছিল৷ কিন্তু ‘গণতন্ত্র রক্ষার’ নামে সংশোধনবাদী পার্টির নেতৃত্বের আদেশে পার্টি কাউন্সিলাররা কৃষ্ণমূর্তির বিরুদ্ধে কংগ্রেস প্রার্থীকে ভোট দিয়ে মেয়র নির্বাচন করে এবং পার্টি দৈনিক “জনশক্তি” তাকে গণতন্ত্রের জয় বলে জাহির করে। পরবর্তী কর্পোরেশন ও বিভিন্ন মিউনিসিপ্যাল নির্বাচনে এই অনুচরবৃত্তি নীতিকেই এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। মাদ্রাজ শহরে কংগ্রেসের সম্মতিতে পার্টি মাত্র ৪টি আসনে প্রার্থী দিয়ে বাকি আসনে কংগ্রেসের ভলান্টিয়ারী করে। কিন্তু যে সব মিউনিসিপ্যালিটিতে (যেমন মাদুরা, কোয়েম্বাটুর) আমরা ভাল শক্তি ছিলাম সেখানে কংগ্রেস আমাদের বিরুদ্ধে লড়ে। ফলে মাদ্রাজে মাত্র ১টি আসন (১০০ এর মধ্যে) পেয়েছি এবং অন্যান্য সর্বত্র আমরা দুর্বল হয়েছি। তামিলনাড সংশোধনবাদী নেতৃত্বের এই আত্মবিলোপকারী বুর্জোয়া লেজুড়বৃত্তি নীতির বিরোধিতা করে এবং আরো আলোচনা সাপেক্ষে স্বাধীনভাবে নির্বাচন সংগ্রাম পরিচালনার দাবি করে পার্টির “বামপন্থী” নেতারা কেন্দ্রীয় কার্যকরী সমিতিতে প্রস্তাব আনেন, কিন্তু কমিটির সংখ্যাধিক সংশোধনবাদীগণ ভোটের জোরে তা হারিয়ে দিয়ে তামিলনাড শাখার লেজুড়বৃত্তি নীতিগতভাবে সমর্থন করে প্রস্তাব পাশ করেন৷ সংশোধনবাদীরা পার্টিকে কোন পথে নিয়ে যেতে চান তা এই প্রস্তাবের মধ্য দিয়ে নগ্নভাবে আত্মপ্রকাশ করেছে। এই নীতি শুধু মার্কসবাদ-বিরোধীই নয়, ইহা পার্টি কংগ্রেসের গৃহীত সিদ্ধান্তেরও বিরোধী৷ তাই তামিলনাড মার্কসবাদীরা এই পার্টি-বিরোধী নীতির বিরুদ্ধে দাঁড়াতে বাধ্য হয়েছেন। অন্যদিকে মার্কসবাদের সমর্থনে দাঁড়ানোর “অপরাধে” তামিলনাডের সংশোধনবাদী চক্র এঁদের বিরুদ্ধে শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগ আনছে।

 

দক্ষিণপন্থীদের কৌশল

মার্কসবাদ ও তার ভিত্তিতে পার্টি ঐক্য রক্ষা জরুরী হয়ে উঠেছে৷ কেন্দ্রীয় কার্যকরী সমিতিতে “বামপন্থীরা” এক দলিল পেশ করে দেখান যে দক্ষিণপন্থীরা শুধু পার্টি নীতিকেই বিসর্জন দেন নাই, বিভিন্ন প্রদেশে তাঁরা নানা অ-গণতান্ত্রিক, স্বেচ্ছাচারমূলক ও উপদলীয় সাংগঠনিক পদ্ধতি অবলম্বন করে পার্টিকে ভেঙে দেবার ব্যবস্থা করেছেন। কার্যতঃ পার্টি আজ দ্বিধা-বিভক্ত। এই অবস্থায় “বামপন্থীরা” দাবি করেন যে অবিলম্বে এই উপদলীয় বন্ধ করে করা হোক, পার্টিতে যখন গুরুতর ও মৌলিক পার্থক্য রয়েছে তখন গায়ের জোরে কোন আদর্শগত ও রাজনৈতিক মত না চাপিয়ে সমগ্র পার্টির মধ্যে অবাধ আলোচনা হোক, কালবিলম্ব না করে জুন-জুলাইয়ের মধ্যে পার্টি-কংগ্রেস ডাকা হোক এবং ইতিমধ্যে আশু কাজকর্ম সমঝোতার ভিত্তিতে চালানো হোক৷ দক্ষিণ-পন্থীরা এই ন্যায়সঙ্গত দাবিকে বাতিল করে দিয়েছেন এবং আগামী অক্টোবরে পার্টি কংগ্রেসে ডাকার কথা বলে কালহরণের নীতি গ্রহণ করেছেন। যে ভিত্তিতে এই পার্টি কংগ্রেস ডাকা হবে বলে তাঁরা স্থির করেছেন তাতে স্পষ্ট বোঝা যায় যে মার্কসবাদীদের বিরুদ্ধে আক্রমণকে তীব্রতর করা ও পার্টিকে ভাঙ্গাই তাঁদের উদ্দেশ্য।

জরুরী অবস্থা ও দমননীতির মধ্যে পার্টির কাজ স্বাভাবিকভাবে চলতে পারে না ও কার্যতঃ পারে নাই। হাজার হাজার পার্টি সভ্যের চাঁদা ঠিকমত আদায় করা হয় নাই, আবার অনেক ক্ষেত্রে চাঁদা দিলেও নানা অজুহাতে দক্ষিণপন্থীরা (সবর্ত্র পার্টিযন্ত্র যাদের দখলে ছিল) হাজার হাজার সভ্যকে তালিকা হতে বাদ দিয়েছেন। বাংলাদেশে এটা ব্যাপকভাবে করা হয়েছে, কিন্তু শুধু এখানে নয়, সর্বত্রই হয়েছে। আবার কয়েকটি ক্ষেত্রে এমনও দেখা যাচ্ছে যে জরুরী অবস্থার মধ্যেও পার্টি সভ্য তালিকাকে শতকরা ৫০ ভাগ বা আরও বেশী বাড়ানো হয়েছে। এমনি নূতন সভ্য নিয়েও বর্তমানে খাতায়-কলমে মাত্র ১ লাখ ৩০ হাজারের মত সভ্যকে স্বীকার করা হচ্ছে, যেখানে আগে ছিল প্রায় ১ লাখ ৮৭ হাজার। এমনি ভিত্তিতে কোন পার্টি কংগ্রেস হলে তা মোটেই গণতান্ত্রিক হবে না, তা হবে বে-আইনি ও উদ্দেশ্যমূলক। তাই “বামপন্থীরা” ন্যায়সঙ্গতভাবেই দাবি করেছিলেন যে পুরাতন পার্টি সভ্যদের কোন নামমাত্র আনুষ্ঠানিক অজুহাতে বাদ দেওয়া যাবে না, চাঁদা বাকী থাকায় যাদের বাদ দেওয়া হয়েছে তাদের চাঁদা দেবার জন্য এক মাস সময় দিতে হবে। যে সব এলাকায় নূতন সভ্য সংগ্রহ সম্বন্ধে প্রশ্ন উঠবে সেখানে উভয় পক্ষের মিলিত কমিশনের দ্বারা তার তদন্ত করতে হবে। এইভাবে প্রকৃত পার্টি সভ্য তালিকার ভিত্তিতে পার্টি কংগ্রেস করতে হবে। কিন্তু দক্ষিণপন্থীরা এই প্রস্তাব বাতিল করে দিয়েছেন। শুধু বিশেষ বিশেষ সভ্যের ক্ষেত্রে তাঁরা নিজেরা পুনর্বিবেচনা করবেন বলেছেন।

এই সিদ্ধান্তকে শুধুমাত্র একটি সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত হিসাবে দেখলে ভুল হবে। এর অর্থ হোল কৃত্রিম সংখ্যাধিক্য সৃষ্টি করে পার্টিযন্ত্রকে স্থায়ীভাবে কুক্ষিগত রাখা, সংশোধনবাদকে বিধিসম্মত করা এবং মার্কসবাদী শক্তিকে ছত্রভঙ্গ করা। রাজনৈতিক ও আদর্শগত ক্ষেত্রে বুর্জোয়া অনুচরবৃত্তির আনুষঙ্গিক হিসাবে সংগঠনের ক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবে বুর্জোয়া দুর্নীতির পথই সংশোধনবাদীরা গ্রহণ করেছে। এই অপচেষ্টাকে ব্যর্থ করে মার্কসবাদকে রক্ষা করার গুরু দায়িত্ব আজ সমস্ত মার্কসবাদী-লেনিনবাদীদের বহন করতে হবে।

 

পশ্চিমবঙ্গ

পার্টির গঠনতন্ত্র অমান্য করে বে-আইনীভাবে পশ্চিমবঙ্গে পার্টির রাজ্য পরিষদকে বাতিল করে এক ক্ষুদ্র সংশোধনবাদী গোষ্ঠীকে পি.ও.সি. নামে এখানে চাপানো হয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ কমরেডগণ শাসক শ্রেণীর কুৎসা ও দমননীতি উপেক্ষা করে এই বে-আইনী পি.ও.সি.কে বর্জন করেছেন এবং মার্কসবাদ ও পার্টি গণতন্ত্র রক্ষার জন্য প্রশংসনীয় সংগ্রাম করেছেন। তারই জন্য সংশোধনবাদীদের পক্ষে পি.ও.সি.কে স্থায়ী করা সম্ভব হয় নাই, যদিও পি.ও.সি. নেতারা তাই চেয়েছিলেন৷ সাধারণ কমরেডদের তীব্র বিরোধিতার জন্যই এখানে পাঞ্জাবের মত তথাকথিত বিশেষ সম্মেলন করে নিজেদের মনোমত মাইনরিটিকে মেজরিটিতে পরিণত করে স্থায়ী কমিটি তাঁরা গঠন করতে পারেন নাই। তাই কেন্দ্রীয় কার্যকরী সমিতির সভায় সংশোধনবাদীরা পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য পরিষদকে স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন। কিন্তু এই স্বীকৃতির মূল্য স্বরূপ তাঁরা চেয়েছিলেন যে রাজ্য পরিষদ সাধারণ কমরেডদের গত এক বছরের মার্কসবাদী কাজকে নিন্দা করুক, লক্ষ মানুষের জমায়েতের সংগঠক গণতান্ত্রিক কনভেনশনকে নিন্দা করুক, অর্থাৎ সংশোধনবাদীদের কাছে বশ্যতা স্বীকার করুক। স্বভাবতঃই রাজ্য পরিষদ তা মেনে নিতে পারেন নাই, ভারতের মার্কসবাদীরা, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ কমরেডরা এই আশাই করেছিলেন যে রাজ্য পরিষদ সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে মার্কসবাদীদের হাতিয়ার হিসাবে কাজ করবেন। কিন্তু রাজ্য পরিষদের কিছু কিছু নেতা মুখে নিজেদের বামপন্থী বললেও বিশেষ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে “বামপন্থীদের” বিরোধিতা  করে ও সংশোধনবাদীদের সঙ্গে সহযোগিতা করে এই আশাকে বানচাল করে দিচ্ছেন৷ সংশোধনবাদ যখন প্রধান ও মারাত্মক বিপদ হিসাবে পার্টির ও জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের সর্বনাশ করেছে তখন কোন অজুহাতে তাকে পুষ্ট করা বা তার সঙ্গে সহযোগিতা করা নিছক সুবিধাবাদী দুর্বলতা ছাড়া আর কিছু হতে পারে না। এই পরিস্থিতি পশ্চিমবঙ্গে সংশোধনবাদীদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে নূতন জটিলতা ও বাধা সৃষ্টি করেছে। কিন্তু এতে কোন সন্দেহ নাই যে এখানের মার্কসবাদীরা এই জটিলতা ও বাধাকেও অতিক্রম করে এগিয়ে যাবেন।

 

পাঞ্জাবে

পাঞ্জাবে নির্বাচিত রাজ্য কমিটির জনপ্রিয় নেতাদের গ্রেপ্তারের পর সংশোধনবাদীরা এখানে পার্টি অফিস দখল করেছিলেন৷ নেতৃবৃন্দের অনুপস্থিতিতে এবং অসম প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে (সভ্য সংখ্যা নির্বিশেষে শুধু জেলা কমিটির সদস্যদের প্রতিনিধি হিসাবে গণ্য করা হয়েছিল)। সংশোধনবাদীরা এখানে হঠাৎ এক বিশেষ সম্মেলন করে স্থায়ীভাবে কমিটি বদলে দিয়েছেন এবং নিজেরা সংখ্যালঘু হওয়া সত্ত্বেও পার্টি কমিটিকে দখলে রাখার ব্যবস্থা করেছেন। কেন্দ্রীয় কার্যকরী সমিতির সভায় “বামপন্থীরা” ন্যায়সঙ্গতভাবে আগের রাজ্য পরিষদকে চালু করার দাবি জানিয়েছিলেন কিন্তু দক্ষিণপন্থীরা তা বাতিল করে দিয়েছেন।

 

লেনিনের শিক্ষা

সংশোধনবাদ ও মার্কসবাদের মধ্যে সংগ্রাম আজ আরো তীব্র আকার ধারণ করেছে৷ এই দুইয়ের মধ্যে কোন ঐক্য বা সমঝোতা হতে পারে না। বুর্জোয়া অনুচরবৃত্তি ও শ্রমিকশ্রেণীর বৈপ্লবিক পথের মধ্যে কোন আপস হতে পারে না। ফরম বা শৃঙ্খলার নামে সংশোধনবাদকে নেবার অর্থ হবে গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার মূল নীতিকে বিসর্জন দেওয়া৷ যারা নিজেরা মার্কসবাদ বর্জন করেছে তারা মার্কসবাদীদের ওপর নিজেদের মতকে পার্টির মত বলে চাপাতে পারে না। সংশোধনবাদ ও সংশোধনবাদী চক্র হতে মুক্ত হয়েই মার্কসবাদ তার গৌরবোজ্জ্বল বৈপ্লবিক নীতিতে ভাস্বর হয়ে উঠতে পারে এবং কমিউনিস্ট পার্টি তার কর্তব্য পালনের উপযোগী হতে পারে। এই হোল লেনিনের শিক্ষা। সংশোধনবাদীদের পায়ের তলা হতে মাটি সরে যাচ্ছে। তাঁরা আরো ক্রুদ্ধ হবেন, ধনিক শ্রেণীর অনুকরণে তাঁরা মার্কসবাদীদের বিরুদ্ধে কুৎসাকে তীব্রতর করবেন। মার্কসবাদ বর্জন করে তাঁরা নিজেরা বিভেদ সৃষ্টি করেছেন, অথচ তাঁরাই মার্কসবাদীদের বিরুদ্ধে বিভেদ সৃষ্টির অভিযোগ এনে তাঁদের বশ্যতা দাবি করছেন। বৃহৎ বুর্জোয়া পরিচালিত সরকারও প্রকৃত কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে দমননীতি ও কুৎসার অভিযান কেন্দ্রীভূত করে সংশোধনবাদীদের সাহায্য করছে। আজও অনেক নেতাকে জেলে আটকে রাখা হয়েছে কিন্তু ইতিহাসের অমোঘ নিয়মে এই সব কিছুই ব্যর্থ হতে বাধ্য৷ মার্কসবাদের জয় অনিবার্য।

 

“দেশহিতৈষী”
৩রা এপ্রিল, ১৯৬৫

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4658 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...