একটু স্বাধীন বলে কোনও কথা হয় না

স্বাতী ভট্টাচার্য

 



প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক

 

 

 

নিরবধি কালতরঙ্গে আড়াইশো বছর কী, আর পঁচাত্তর বছরই বা কী। তবু ভারতের স্বাধীনতার হীরক জয়ন্তী আর রাজা রামমোহন রায়ের সার্ধদ্বিশত জন্মবার্ষিকী যে একই বছর উদযাপিত হচ্ছে, এ কথাটা মনে গুনগুন করে চলেছে। ভারতের স্বাধীনতার সঙ্গে মেয়েদের স্বাধীনতার যোগটা যে আধুনিক ভারতের জন্মলগ্নেই বাঁধা পড়েছিল, সে কি ভোলা যায়? স্বাধীন ভারতের ধারণা যখন কারও মনে জন্মায়নি, তখনই রামমোহন স্বাধীনতার সঙ্গে সম্পত্তির সম্পর্কটি স্থাপন করেছিলেন। যাজ্ঞবল্ক্য, কাত্যায়ন, নারদ, বৃহস্পতি, প্রাচীন ভারতের বিধিপ্রণেতাদের উদ্ধৃত করে তিনি দেখাচ্ছেন, স্বামীর সম্পত্তির উত্তরাধিকারী তাঁর স্ত্রী, পুত্রের সঙ্গে সমান অধিকার। এ কেবল মেয়েদের জন্য টাকার ব্যবস্থা করার কথা নয়। রামমোহন বলছেন, প্রাচীনরা এমন ব্যবস্থা করেছেন যাতে মেয়েরা জীবনকে উপভোগ করতে পারে (the opportunity of enjoyment of life)। সতীদাহ নিবারণের ব্র্যাকেটের মধ্যে রামমোহনকে আটকে দিয়েছি আমরা, তাই খেয়াল করি না যে রামমোহন সংসারে মেয়েদের গঞ্জনা-লাঞ্ছনার কথা কত বিশদে বলেছেন। গতকালও যিনি ছিলেন গৃহকর্ত্রী, বিধবা হয়েই তিনি যে সকল সম্মান, সম্পদ হারিয়ে অসহায়, নিত্য অপমানিত, করুণার পাত্রী— এই অন্যায় রামমোহন কত তীব্রভাবে অনুভব করেছিলেন, তা আজও তাঁর লেখা (‘দ্য রাইটস অব উইমেন’) পড়লে বোঝা যায়। হয় সংসারে লাথি-ঝাঁটা খাও, নইলে স্বাধীনভাবে বাঁচতে গিয়ে সমাজে পতিত হও, না হলে আত্মহত্যা করো— এই তিনটে রাস্তা মেয়েদের সামনে খোলা, লিখছেন তিনি। রামমোহনের কল্পনায়, আদর্শ ভারতে মেয়েরা শিক্ষিত, সম্পদশালী, স্বাধীন এবং সুখী। নানা যুক্তি আর দৃষ্টান্তের মধ্যে দিয়ে যে কথাটা তিনি বলছেন তা হল, মেয়েদের স্বাধীনতাই স্বাভাবিক।

আজকের ভারতে এ কথা বলার মতো বুকের পাটা কজনের আছে? এখন বলা হয় ‘সক্ষমতা’ বা ‘ক্ষমতায়ন’ (এমপাওয়ারমেন্ট)। শব্দটা যেভাবে ব্যবহার হচ্ছে, তা যেন ‘ডমিনিয়ন স্টেটাস’-এর মতো। মেয়েদের কিস্যু না দিলে খারাপ দেখায়, আফটার অল একটা গণতন্ত্র। তা বলে পূর্ণ স্বরাজ তো দেওয়া চলে না, কী না কী করে বসে। বরং কিছু প্রকল্প চলুক, যাতে মেয়েদের হাতে কিছু কাজ, অ্যাকাউন্টে কিছু টাকা ঢোকে। তাতেই রামমোহন-বিদ্যাসাগরের ফটোয় কুচো ফুল ছোঁড়ার কাজ হবে। অন্য দিকে সনাতন ধর্মও থাকবে— যে মতে পুরুষজন্মই শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি, আধিপত্যের লাইসেন্স। বেয়াড়া মেয়েদের বশে আনতে হিংসার ব্যবহার নীরব কিন্তু সক্রিয় সমর্থন পাবে। সম্প্রতি এক কলেজ-পড়ুয়া মেয়ের অ্যাকাউন্টে কন্যাশ্রীর টাকা ঢুকতে তার বাপ তার মাকে এমন মারধর শুরু করল, যে মেয়ে নিজেই টাকা তুলে দিয়ে দিয়েছে মাতাল, নিষ্কর্মা বাপের হাতে। হ্যাঁ, এটা একটু বাড়াবাড়ি। ওই টাকা সাধারণত মেয়ের বিয়ের আয়োজনে খরচ করে বাপেরা। সাধারণত আঠারোতেই। মেয়ের মত না নিয়ে। না, পাত্র বাছাইয়ের ক্ষমতাও মেয়েদের দেওয়া হয় না। তবে কথা পাকা হওয়ার পর একটু দেখাসাক্ষাৎ চলতে পারে। বিয়ের পরেও পড়ুক না, যদি পাত্রপক্ষের সম্মতি থাকে। না থাকলে কী দরকার, একটু অ্যাডজাস্ট করতে হয়। ‘সক্ষমতা’ নিয়ে এমন দরদস্তুর চলে। স্বাধীনতায় সে সুযোগ নেই। ‘একটু স্বাধীন’ বলে কোনও কথা হয় না।

আজ যদি কোনও মেয়েকে প্রশ্ন করা হয়— তোমার দিদিমার চাইতে, মায়ের চাইতে, তুমি কি বেশি স্বাধীন? সে বড় গোলমেলে প্রশ্ন হবে। যদি পরিসংখ্যানের নিরিখে বিচার করা হয়, তবে মেয়েরা স্বাধীনতার উপযোগী নানা ক্ষমতা পেয়েছে, পরাধীন ভারতের মেয়েরা যা সহজে কল্পনা করতে পারত না। মাধ্যমিক পরীক্ষায় বেশি মেয়ে বসবে ছেলেদের চাইতে, আকছার মেয়েরা ফার্স্ট হবে, এই মেয়েদের মায়েরা কি স্কুলে থাকতে ভেবেছিল? যারা দরিদ্রতম, সর্বাধিক প্রান্তিক মানুষ, সেই আদিবাসীদের মধ্যেও অর্ধেক মেয়ে আজ সাক্ষর। স্বাধীনতার সময়ে সারা ভারতে মোট আট শতাংশ মেয়ে সাক্ষর ছিল।

দ্বিতীয় যে দরজাটা দরিদ্র থেকে ধনী, সব মেয়ের কাছে অনেকটা খুলে গিয়েছে, তা হল রাজনীতি ও প্রশাসন। স্বাধীনতার আগে নানা আন্দোলন, বিশেষত মহাত্মা গান্ধির আন্দোলন এবং কমিউনিস্ট আন্দোলনের টানে বহু মেয়ে সক্রিয় রাজনীতিতে এসেছিল, সেই স্রোতেই স্বাধীনতা-উত্তর বড় বড় গণআন্দোলনগুলিতে নেমেছিল বহু মেয়ে। কিন্তু তাদের শাসনব্যবস্থার অংশিদারিত্ব থেকে সযত্নে দূরে রেখেছিল দলীয় রাজনীতি। পঞ্চায়েত ব্যবস্থায় মেয়েদের জন্য আসন সংরক্ষণ সেই দেওয়ালটা অনেকটা ভেঙে দিয়েছে। স্থানীয় প্রশাসনে অর্ধেক আসন মেয়েদের, তাদের স্বাক্ষরে খরচ হচ্ছে কোটি কোটি টাকা, বিডিও-র পাশে বসে ‘মাননীয়া প্রধান’ সভা পরিচালনা করছেন, দু দিন আগেও যাঁর একমাত্র পরিচয় ছিল দলিত পরিবারের স্বল্পশিক্ষিত বধূ, এ-ও দু প্রজন্ম আগে ভাবা যায়নি। পারিবারিক সম্পদে মেয়েদের কর্তৃত্ব ব্যক্তিগত জীবনে তাকে স্বাধীন করতে পারে। জনসম্পদে মেয়েদের কর্তৃত্ব সমাজে ও রাষ্ট্রে তাকে স্বাধীনতা দিতে পারে। ‘স্বাধীন’ বললেই তো স্বাধীন হয় না, স্বাধীনতা কাজে লাগানোর সুযোগটাও তো চাই। নব্বইয়ের দশকে ভারত তার মেয়েদের যা দিয়েছে।

সক্ষমতার এমন তরঙ্গে ভেসে আসে সংশয়ের কচুরিপানা। নেহাৎ অনিচ্ছায় যদি কারওকে খেলায় নিতে হয়, তখন খেলুড়েদের চোখেচোখে কথা হয়ে যায়, পুঁচকেটি হয়ে যায় ‘এলেবেলে।’ মেয়েদেরও আইনের চাপে নিতে হচ্ছে বটে, কিন্তু এলেবেলে করার প্রবল চেষ্টাও চলেছে। এক তো রাজনৈতিক দলগুলো করিয়ে-বলিয়ে পার্টিসদস্য মেয়েদের বাদ দিয়ে নেতার বউ-বোনকে টিকিট দিল। ‘সরপঞ্চ-পতি’ নামে অলিখিত একটা পদও তৈরি হল। কিন্তু এত করেও সামাল দেওয়া গেল না। ক্রমশ দেখা গেল, পঞ্চায়েত ব্যবস্থাটাই এলেবেলে হয়ে গেল। এ রাজ্যে গত দশ বছরে গ্রাম পঞ্চায়েত পরিণত হয়েছে এডিএম-বিডিও-দের ফিল্ড অফিসে। কে তার প্রধান, সে কতগুলো ভোটে জিতেছে, তাতে কী এসে যায়?  মেয়েরা যখন ক্ষমতা পেল, তখনই স্বাধীনতা কমল পঞ্চায়েতের, এ কি কাকতালীয়? সংসদে মহিলা সংরক্ষণ হওয়ার কথায় যেমন আশা জাগে, তেমন ভয়ও। একেই বিতর্ক ছাড়া বিল পাশ হয় আজকাল। মেয়েরা এক-তৃতীয়াংশ আসনে বসলে হয়তো হইচই আর মুলতুবি, এই হবে সংসদের সরকার-নির্দিষ্ট কারবার।

শিক্ষাতেও তাই। সর্বশিক্ষা অভিযানের কুড়ি বছর, শিক্ষার অধিকার আইনের দশ বছর পূর্ণ হল, আর বোর্ড পরীক্ষার মার্কশিটও এলেবেলে হল। দলিত, দরিদ্র, মেয়ে, এরা যে নম্বরে ছাড়িয়ে যেতে পারে, পেতে পারে এমন সুযোগ যা উচ্চবর্ণ পুরুষের প্রার্থিত, সেই সম্ভাবনার জন্যই কি নম্বর অর্থহীন হল? এ যদি অকারণ ত্রাস বা ‘প্যারানইয়া’ বলে মনে হয়, তা হলে মনে করতে হবে গত পাঁচ-সাত বছরে ভারতে কাজের জগতে কতখানি কোণঠাসা হয়েছে মেয়েরা। মেয়েদের সন্তানসংখ্যা কমছে, উচ্চশিক্ষা বাড়ছে, অথচ মেয়েরা আসছে না কাজের জগতে। অতিমারিতে যত পুরুষ কাজ হারিয়েছে, মেয়েরা তার কয়েকগুণ। আজ বড় জোর ২০ শতাংশ কর্মক্ষম মেয়ে ভারতের শ্রমবাহিনির অংশ, ইতিহাসে যা নিম্নতম। অর্থনীতির কোনও তত্ত্বে এর ব্যাখ্যা মেলেনি, বাঘা বিশেষজ্ঞরাও ‘জেন্ডার স্টিরিওটাইপ’ নিয়ে আক্ষেপ করছেন। একই সঙ্গে, পণপ্রথা বিন্দুমাত্র কমেনি, বরং আরও নির্লজ্জ, নিষ্ঠুর হয়েছে। আজ ভারত উচ্চশিক্ষায় যত খরচ করে, তার চাইতে ঢের বেশি খরচ করে বিয়ের জাঁকজমকে।

এমন নয় যে সফল, সার্থক মেয়েরা আমাদের চোখের সামনে নেই। আছে বইকি, বহু কাজে, বহু পেশায় রয়েছে। ভারতের সংবিধান, সুপ্রিম কোর্ট, নারী আন্দোলন যেটুকু দরজা খুলে দিয়েছে, তার ফাঁক দিয়েই সে সব জীবন নিজের পরিসর তৈরি করে নিয়েছে। কিন্তু এইসব উজ্জ্বল শিখার পাশাপাশি কত না অন্ধকার। সংসারের হাজারটা খুঁটিনাটি কাজ, পরিণামহীন, অর্থহীন অভ্যাসের মরুভূমিতে হারিয়ে যাওয়া কতশত জীবন-নদী। মেয়েরা ভাবে, ‘এ আমার দুর্ভাগ্য।’ মিলিয়ে দেখলে বোঝা যায়, এ আসলে সমাজের দুরভিসন্ধি। সম্পদের অধিকার মানুষকে যে স্বাধীনতা দেয়, কিছুতেই তা মেয়েদের দিতে রাজি নয় এ দেশ। তাই স্কুলশিক্ষা, উচ্চশিক্ষা, ভোকেশনাল ট্রেনিং-এর কাঁটাবন পেরিয়েও মেয়েরা কাজের জগতের চৌকাঠ পেরোতে পারে না। উত্তরাধিকারে সমান অংশ পাওয়ার আইন পাশ হলেও বাপ উইল করে সম্পত্তি দিয়ে যায় ভাইদের, মেয়ের প্রাপ্যটুকু পণ হিসেবে তুলে দেয় জামাইয়ের হাতে। রোজগেরে মেয়ের বেতনের টাকা ভোগদখল করবে স্বামী ও পরিবার, দরকার হলে কেড়ে নিয়ে। উলটে মেয়েরা ধমক খায়, ‘ফিরতে দেরি হল কেন, বাড়িতে কাজ নেই?’ মেয়েদের যা কিছু সম্পদ— শরীর, শ্রম, অর্থ— কিছুই আসলে তার নিজের নয়, এই বিধান উনবিংশ থেকে একবিংশ অবধি বয়ে চলেছে। রামমোহন লিখছেন, সতীদাহের কারণ হল মহিলা আত্মীয়দের প্রতি দেশীয় রাজাদের অতিরিক্ত হিংসে (excessive jealousy of their female connections, operating in the breasts of Hindu princes…) যা থেকে তারা শোকাকুলা সদ্যবিধবাকে পুড়িয়ে মারার প্রথা শুরু করেছিল। সতীদাহ ব্রিটিশরা বন্ধ করেছিল, কিন্তু এই ‘অতিরিক্ত হিংসে’, যার জেরে মেয়েদের যে কোনও সম্পদের মালিকানাই ভাইদের কাছে, দেওর-ভাসুরের কাছে ‘বাড়াবাড়ি’ মনে হতে থাকে, তা আজও বহু জীবন জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করে দিচ্ছে।

সম্পদের অধিকার মেয়েদের চিনিয়ে দিতে পারে, পরিবারের অধিকারের সীমা কতটুকু। তাই সম্পদের অধিকার মেয়েদের দিতে নারাজ কাপুরুষ পরিবার, আর পুরুষতান্ত্রিক রাষ্ট্র। আর সম্পদহীনতা মানেই তো স্বাধীনতাহীনতা। পরিবারের সকল সম্পত্তিতে, পরিবারের পুরুষের সকল সম্পদে, কন্যা ও বধূর সমান ও স্বতন্ত্র অধিকার চাই। এই হল মেয়েদের গৃহশ্রমের স্বীকৃতি, সম্পর্কের স্বীকৃতি, মেয়েদের মানবাধিকারের স্বীকৃতি। রাষ্ট্র যত দিন তা না মানবে, ততদিন চলবে স্বাধীন দেশের স্বাধীনতার আন্দোলন।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4661 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...