Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

ছকে রাখা চিত্রনাট্যে জাফরাবাদ ও আম অসহায়তা

গৌতম সরকার

 




লেখক প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।

 

 

আমি হিন্দু। এটাও যে পরিচয়, ছোটবেলায় ভাবনাটাই আসেনি। কেউ তা জিজ্ঞাসাও করত না। অনেকে বাবার নাম, মায়ের নাম জানতে চাইতেন। কোথায় থাকি, জিজ্ঞাসা করতেন। আর জানার বিষয় ছিল, আমি কোন ক্লাসে পড়ি। উচ্চমাধ্যমিকে ওঠার পর, একটা বাড়তি প্রশ্ন ছিল, কোন স্ট্রিম? আর্টস না সায়েন্স, নাকি কমার্স? ব্যস, আমার পরিচয় বলতে তো ওটুকুই। তবে হ্যাঁ, ভর্তির ফর্মে বা রেশন কার্ডের দরখাস্তে ধর্মীয় পরিচয় লিখতে হত। সেটাকে ধর্তব্যের মধ্যে আনার দরকারই বোধ করতাম না। মনে হত, আরে, এ আবার বলার কী আছে? আমি তো হিন্দুই। সেটা আবার চ্যালেঞ্জড্ হবে কেন? বাড়িতে ধার্মিক পরিবেশ। মা নিয়মিত চণ্ডীপাঠ করেন, গীতা পড়েন। ঘরে দেবদেবীর ছবি, বিগ্রহে ঠাসা।

বাবা ঋষি অরবিন্দের শিষ্য। যৌবনে নাকি বাড়িতে কিছু না জানিয়ে পণ্ডিচেরি গিয়ে দীক্ষা নিয়ে এসেছেন। বাড়ির দরজায় ভিতরের দিকে অরবিন্দের ছবি ঝুলত। ছবিতে বাবাকে মাথা ঠুকতে দেখিনি কখনও। কিন্তু অরবিন্দের দর্শন নিয়ে গাদা গাদা বই পড়তে দেখতাম। মায়ের আগ্রহে ফি-বছর বাড়ির উঠোনে ভারত সেবাশ্রমের সন্ন্যাসীরা যজ্ঞ করতেন। আমাকে আবার বলতে হবে নাকি যে, আমি হিন্দু? ধারণাটা পাল্টে গেল আমার জীবনের ছ’টি দশক পার হওয়ার পর। এনআরসি অসমে শুরু হতেই বাংলায় শুরু হয়ে গেল নথি জোগাড়ের লম্ফঝম্প। আমার কন্যা তাগাদা দিচ্ছে, “তোমার কাগজপত্রগুলো ঠিক করে রাখো, বাবা। বিপদে পড়বে যে।” আমি নির্বিকার। ততদিনে শুনে নিয়েছি, হিন্দু হলে কোনও নথি দেখাতে হবে না। বলে দিয়েছেন দিলীপ ঘোষ। তিনি রাজ্য বিজেপির সভাপতি। সর্বভারতীয় শাসকদল বিজেপি। আইন তো তারাই বানায়।

আমার চিন্তা কী? নাহয় ধ্বনি দেব, ‘গরব সে কহো হম হিন্দু হ্যায়।’ হা হতোস্মি।

আমার সেই বিশ্বাসে জল ঢেলে দিল আমার কন্যাই। এযুগের মেয়ে, আমাদের চেয়ে চালাক চতুর। আমাদের মতো সকাল হতেই খবরের কাগজে ঘাড় গুঁজে না-থাকলেও হালহকিকৎ জানে। খোঁজখবর রাখে। সে বলল, “বাবা, তুমি যে হিন্দু, তার প্রমাণ কী? তোমার তো পৈতা নেই, টিকিও নেই। দীক্ষাটিক্ষাও নাওনি। তার ওপর আমাদের যা পদবি, তা মুসলমানেরও হয়। তুমি কী করে বিশ্বাস করাবে, তোমার রক্তে হিন্দুর জিন আছে?” শুনে সত্যিই আমার মাথাটা ঘুরে গেল। এই প্রথম ভাবতে হল, হিন্দু পরিচয়টা তাহলে এখন দরকার। সত্যিই দরকার। দিল্লির মহল্লায়, রাজপথে, অলিতে, গলিতে দিন কয়েক আগে নাম জানার আগে ধর্ম জিজ্ঞাসা করা হচ্ছিল। ধর্মীয় পরিচয়টা পছন্দ না-হলে চলছিল বেদম প্রহার। এসব শুনে মনে হচ্ছে, জীবনের প্রান্তবেলায় প্রাণটাই না কোনদিন যায়।

হ্যাঁ, দিল্লির সাম্প্রতিক দাঙ্গা এই ভয়টাকে সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। শুধু মুসলমানের নয়, আতঙ্কটা হিন্দুরও। আসলে আমাদের পরিচয়ের ক্ষেত্রে ধর্মটা অগ্রাধিকারের তালিকায় চলে এসেছে। বাপু, নামধাম পরে জানলেও হবে, আগে ধর্মটা বলো দেখি। কোনও ঘটনা বা দুর্ঘটনার জন্য একটা প্রেক্ষিত লাগে, একটা পরিসর লাগে। ধর্মনিরপেক্ষ বলে কথিত দেশটায় স্বাধীনতার সাত দশক পর দিল্লির দাঙ্গারও প্রেক্ষিত আছে। পরিসর আছে। আমাদের মনে ধর্মীয় পরিচয়টাকে অগ্রাধিকারের তালিকায় তুলে দেওয়া সেই প্রেক্ষিত। পরিচয়জনিত বিপন্নতা বোধ হল সেই পরিসর। এসবে আমাদের হাত নেই। না হিন্দুর, না মুসলমানের। পরিচয়ের প্রয়োজন আমাদের মনে গেঁথে দেওয়া হয়েছে। পরিচয়ের বিপন্নতা আমাদের বোঝানো হয়েছে। বছরের পর বছর ধরে। অনেকটা স্লো পয়জনিংয়ের মতো।

ছোটবেলায়, এমনকি তরুণ বয়সেও উৎসবে মাতব, হুল্লোড় করব বলে ক্লাবের দুর্গাপুজোয় নাম লেখাতাম। আমরা বুঝতেও পারিনি, কবে থেকে আমাদের কেউ কেউ পুজোয় মাতেন নিজের ধর্মীয় পরিচয়টা জাহির করতে। সঙ্কট তৈরি হয়েছে নানাভাবে। আমার বাবা, কাকা, জেঠা দেশভাগের সময় উদ্বাস্তু হয়ে ভারতের আর এক খণ্ডে এসেছিলেন। সেজন্য তাঁদের আক্ষেপ ছিল, ক্রোধ ছিল না। মুসলমানকে গালি দিতেও শুনিনি। গোলি মারো শালোঁকো তো দূরের কথা, কখনও বলতে শুনিনি, মুসলমানদের জন্য আমাদের দেশ ছাড়তে হয়েছে। এখনকার প্রজন্ম কিন্তু বলে। ক্রোধের সঙ্গে বলে। দেশভাগের পর দাঙ্গা হয়েছে বটে। সেটা কোনও ঘটনার তাৎক্ষণিক ফলশ্রুতি থেকে হয়েছে, গুজবের জেরে ঘটেছে। পিছনে চক্রান্তও থাকত।

কিন্তু সর্বব্যাপী ঘৃণা, বিদ্বেষের তখন জন্ম হয়নি। যা আজ হয়েছে। ভিন্ন ধর্ম মানেই এখন চরম শত্রুতা। ছায়াও মাড়ানো যাবে না। ঘৃণা, বিদ্বেষ তো হিংসার জন্ম দেবেই। এই ‘নফরত’-এর বোধ জাগিয়ে তোলা হয়েছে মুসলমানদের মনেও। মুজিবর রহমান কিন্তু হিন্দুদের হাতে খুন হননি। গান্ধিজিকেও মুসলমানরা হত্যা করেনি। সন্ত্রাসবাদ দূরের কথা, ইসলামিক মৌলবাদ শব্দবন্ধনীও তখন মাথাচাড়া দেয়নি। হিন্দুদের সংগঠিত করার প্রয়াসেও উগ্রতা পাকাপাকি ঠাঁই নিতে পারেনি তখনও। হিন্দু মৌলবাদের তখন ভ্রূণাবস্থা। ধর্মীয় কারণে হিংসা তাই তখন সর্বাত্মক চেহারা নিতে পারেনি। কিন্তু আজকের প্রেক্ষিতটা তৈরি হচ্ছিল তখনই। বলা ভালো তৈরি করার চক্রান্তটা শুরু হয়ে গেছিল।

ইংরেজদের ডিভাইড অ্যান্ড রুল ততটা পারেনি। পারল ভারতীয় উপমহাদেশের স্বাধীন দেশের কুচক্রীরা। এরা শুধু শাসকের মদত নয়, কোনও কোনও ক্ষেত্রে বিরোধীদের প্রশ্রয় পেত। ভোট রাজনীতির কৌশলের কারণে দলগুলি সাম্প্রদায়িকতায় ইন্ধন জোগাত। মেরুকরণ শব্দটা এখন আমরা খুব শুনি। তখন অচেনা শব্দ ছিল। তবে তোষণ শব্দের প্রচলন ছিল। মুসলমানদের ভোটব্যাঙ্ক হিসেবের প্রবণতা সব দলের ছিল। কেউ ধোয়া তুলসিপাতা নয়। আর হিন্দুত্ববাদী বা ইসলামিক দলগুলির গ্রহণযোগ্যতাই ছিল না। সেই পরিস্থিতি ৩৬০ ডিগ্রি ঘুরে দিল্লির বর্তমান অবস্থা তৈরি হল। দিল্লির সাম্প্রতিক বিধানসভা নির্বাচনে বৃত্তটা সম্পূর্ণ হলে। সংসদীয় রাজনীতিতে সংখ্যার নিরিখে দিল্লিতে বিজেপি গোহারা হারল বটে, কিন্তু বিজেপির ভাবনা জিতে গেল।

হিন্দুত্বের উগ্র চেহারাটা নির্বাচনী প্রচারে প্রকাশ্যে এল। লাগাতার ভেদাভেদের রাজনৈতিক প্রচার প্রভাবিত করল হিন্দুদের একটা অংশকে। হিন্দুত্বের চেহারা যত উগ্র হল তত পাল্টা মুসলিম মৌলবাদের খেলা শুরু হল। বিপন্নতার বিপদ দেখিয়ে শুরু হল পাল্টা সংগঠন বিস্তার। দু পক্ষেরই মূল অস্ত্র পরস্পরের প্রতি ঘৃণা উস্কে দেওয়া। মনে রাখা প্রয়োজন, দাঙ্গা বা সঙ্ঘর্ষ, যাই বলা হোক না কেন, এক হাতে তালি বাজে না। চাই দুই পক্ষ। কাউকে উস্কানি দিতে হয়। আর কাউকে প্ররোচনার ফাঁদে পা দিতে হয়। দরকার হয় একটা অজুহাত। দিল্লির প্রেক্ষিত তৈরি হয়েছিল এই শর্তগুলির প্রত্যেকটা মেনে। না জিততে না পারলেও নির্বাচনী প্রচারে দিল্লিতে মেরুকরণের কাজটা সাফল্যের সঙ্গে করতে পেরেছিল।

আসলে এই চেষ্টাটা বছরের পর বছর ধরে সঙ্ঘ পরিবারের কর্মসূচি ছিল। এতদিন তাতে ভারতবাসী আস্থা রাখেনি। এদেশের বহুত্ববাদী দর্শনে বিশ্বাস থাকাটাই সেই ব্যর্থতার কারণ। কিন্তু এতদিন পরে বিষবৃক্ষে ফল ধরল, তার কারণ শুধু বিজেপির প্রচার কিংবা সঙ্ঘ পরিবারের ‘অন্য’ আর নানা ধরনের সক্রিয়তা নয়। মেরুকরণ মোকাবিলায় বিজেপি বিরোধী দলগুলির দিশাহীনতাও। বিরোধীদের এই হতবুদ্ধি দশার কারণ ভোটের রাজনীতির সঙ্কীর্ণতা। এর বীজ অবশ্য দীর্ঘদিন ধরে অঙ্কুরিত হচ্ছিল। ভোটব্যাঙ্ক সুরক্ষিত করার তাগিদে সব রাজনৈতিক দলই কোনও না কোনওভাবে সাম্প্রদায়িকতার তাস খেলেছে। সেটা তোষণ হোক বা সংখ্যালঘু বা দলিত এলাকায় প্রার্থী মনোনয়ন ঘিরে হোক।

যোগ্য প্রার্থী না-থাকলেও শুধু ভোট কমে যাওয়ার ভয়ে কখনও অন্য সম্প্রদায়ের কাউকে মনোনয়ন দেওয়ার কথা ভাবেই না কোনও দল। এ-ব্যাপারে কংগ্রেসের পাশাপাশি তৃণমূল, সিপিএম ইত্যাদি দলগুলি সমানভাবে দুষ্ট। তাদের কাছে ভোটে জেতাটাই প্রধান লক্ষ্য। সমাজের হিতসাধন শুধু দলীয় কর্মসূচিতে। দিল্লির এবারের বিধানসভা ভোটটাতেও তাই হয়েছে। বিজেপি অরবিন্দ কেজরিওয়ালের ঘোষিত শত্রু। দিল্লিতে এখন প্রধান প্রতিপক্ষও বটে। কংগ্রেস বা অন্য দলগুলির অস্তিত্ব নেই বললেই চলে। অরবিন্দ কেজরিওয়াল ও তাঁর আম আদমি পার্টি কিন্তু সুযোগ পেয়েও বিজেপির মেরুকরণের রাজনীতির বিরুদ্ধাচরণ করল না। বরং ওই রাজনীতির সুবিধা করে দিল।

একসময় নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে সরব, বিজেপির বিরুদ্ধে স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ তোলা আপ হঠাৎ এই সব প্রশ্নে নীরব হয়ে গেল। ভোটের প্রচারে এই বিষয়গুলি নিয়ে মৌনীবাবা হয়ে গেলেন কেজরিওয়াল। দিল্লি ভোটের এই সময়কালেই শাহিনবাগের জন্ম। ভারতীয় রাজনীতিতে এক ব্যতিক্রমী প্রতিবাদ। দৃঢ় কিন্তু হিংস্র নয়। অনমনীয় কিন্তু গণতন্ত্রের পরিসরের বাইরে নয়। পুলিশ মিছিল আটকে দিলেও অশান্ত হয় না প্রতিবাদ। গুলি চালিয়ে প্ররোচনা সৃষ্টির চেষ্টা হলেও জমায়েতে উত্তেজনা ছড়ায় না। ওরা শুধু বসে থাকে। বলে, গুলি চালালে চালাও। আমাদের নাগরিক না মানলে আমরা সরব না।

প্রতিবাদীরা জানিয়ে দেয়, মেরে হটিয়ে দেওয়ার শক্তি রাষ্ট্রযন্ত্রের আছে। তোমরা সেই ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারো। কিন্তু আমরা সরব না। বেয়াড়া শাহিনবাগ বরং প্রশ্ন করে। বড় অস্বস্তিকর প্রশ্ন। সুপ্রিম কোর্টের মধ্যস্থতাকারীদের মুখের ওপর জানতে চায়, আমাদের বসে থাকাটা নিয়েই শুধু আলোচনা হবে? আমাদের সমস্যাটা নিয়ে নয়? ওরা প্রশ্ন করল, নরেন্দ্র মোদি সবকা সাথ নীতির কথা বলেন, তারপর তাঁর মন্ত্রীসভার এক সদস্য গোলি মারো শালোকোঁ স্লোগান দেয় কী করে? ওরা জানতে চাইল, ভোটের আগে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ যে শাহিনবাগকে ইলেকট্রিক শক দেওয়ার কথা বললেন, তা কি সবকা সাথ নীতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ?

অস্বস্তির একশেষ। দেশের রাজধানীর বুকে বসে শাহিনবাগ সরকারকে কার্যত চ্যালেঞ্জ ছুড়ছে, মুখে ঝামা ঘষে দিচ্ছে। অথচ সরকার কিছু করতে পারছে না। বরং দেশি, বিদেশি মিডিয়ার ফোকাস বাড়ছে শাহিনবাগের ওপর। এর মধ্যে গোঁদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো ট্রাম্পের সফর। ওভাল অফিস আবার বলে রেখেছে, ভারতে ধর্মীয় স্বাধীনতা সুরক্ষিত কিনা, সফরের সময় জানতে চাইতে পারেন ট্রাম্প। দেশের কর্তাদের ভয় হওয়া স্বাভাবিক, শাহিনবাগ ফোকাস কেড়ে নিলে ট্রাম্পের সফর থেকে ফায়দা কেড়ে নেওয়ার পরিকল্পনা না ভেস্তে যায়। বিশ্বের সামনে না ভাবমূর্তির বারোটা বাজে।

আমরা জানি, ট্রাম্প ভারতে রওনা হওয়ার আগে জাফরাবাদ জন্ম নিল। তার পরের ঘটনাক্রম আর বলার অপেক্ষা রাখে না। আগে বলেছিলাম, দাঙ্গায় কারও প্ররোচনা থাকে, কারও সেই প্ররোচনার ফাঁদে পা দেওয়ার থাকে আর একটা অজুহাত লাগে। দিল্লির দাঙ্গা বেঁধেছে এই তিনটি শর্তকে পূরণ করে। মেরুকরণের প্রচারে হিন্দুত্ববাদীদের প্ররোচনা, পাল্টা মুসলিম সমাজের একাংশের ঘৃণ্য, সঙ্কীর্ণ প্রস্তুতি, উগ্র মৌলবাদী প্রচার তো ছিলই। দেশলাইয়ের কাঠিটা জ্বালিয়ে দিল জাফরাবাদ। তাতে বাড়ি জ্বলল, স্কুল পুড়ল, মন্দির-মসজিদে আগুন লাগলে, প্রাণ গেল, জখম হলেন অনেকে। আর যেটা পুড়ে খাক হয়ে গেল, সেটা হল পারস্পরিক বিশ্বাস।

ধাক্কা খেল সহাবস্থান, সমন্বয়ের ভারতীয় সনাতন সংস্কৃতি। সঙ্ঘ পরিবার ইতিমধ্যে জেনে গিয়েছে বিরোধীদের আরও হতবুদ্ধি করে দেওয়া গিয়েছে। ওরা এখন নির্বিষ। বিপুল সংখ্যাধিক্যে জিতলেও দাঙ্গার বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার আর দম নেই কেজরীদের। অমিত শাহের কাছে আর্জি জানানো আর রাজঘাটে প্রার্থনায় বসে পড়ার বাইরে আর কিছু করার উপায় নেই আপের। নিজেদের অ্যজেন্ডায় বিরোধীদের বেঁধে ফেলেছে হিন্দুত্ববাদীরা। ওদের তৈরি চিত্রনাট্য মেনেই চলতে হবে বিরোধীদের। কংগ্রেস একমাত্র সোচ্চার। তবে তা তাদের ভোটব্যাঙ্কের স্বার্থে। বিজেপিকে রাজধর্ম মনে করাতে গিয়ে পাল্টা খোঁচায় বিদ্ধ হয়েছে কংগ্রেস।

খোঁচা খাওয়ার যথেষ্ট কারণ নিশ্চয়ই আছে। শাসন ক্ষমতায় থাকার সময় কংগ্রেস রাজধর্ম পালন করেছে, এমন কথা হলফ করে বলার উপায় নেই। আমাদের দেশে সব দলের ক্ষেত্রেই কথাটা খাটে। নাহলে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন, এনআরসি-র প্রতিবাদে আদাজল খেয়ে মাঠে নেমে পড়েছিলেন যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, দিল্লির হিংসার সময়ে তাঁর অবস্থান অনেকটা যেমন বেণী তেমনি রবের মতো। সঙ্ঘর্ষ শুরুর পরপরই আমরা পরিস্থিতির দিকে নজর রাখছি বলে সেই যে ওড়িশায়  গিয়ে বসলেন, একটি শব্দও করলেন না। পুরীতে গিয়ে দেশের কল্যাণ কামনায় জগন্নাথকে পুজো দিলেন, যেমন কলকাতায় এসে অমিত শাহ কালীঘাটে পুজো দিয়েছেন দেশের কল্যাণ কামনায়।

চিত্রনাট্যগুলি কেমন মিলে যাচ্ছে যেন। যিনি সুযোগ পেলে মোদি, অমিত শাহকে গালমন্দ না করে এতদিন অন্নগ্রহণ করতেন না, তিনি বলে বসলেন, দিল্লির হিংসার জন্য অমিত শাহের পদত্যাগ দাবি করা এখন কাজের কথা নয়। এখন দরকার দিল্লিকে স্বাভাবিক করা। হক কথা বটে। কিন্তু বিড়াল যদি মাছ খাওয়া ছেড়ে দেওয়ার কথা বলে, তাহলে সন্দেহটা খচখচ করবেই। আসলে অরবিন্দ কেজরিওয়াল হোন আর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, এই বিরোধীদের পেড়ে ফেলেছে বিজেপি। গেরুয়া শক্তির পাতা ফাঁদে পা দিয়ে ফেলেছে বিরোধীরা। এখন শাঁখের করাতের দশা। শাহিনবাগ নিয়ে বেশি কিছু বললে হিন্দু ভোট এককাট্টা হয়ে বিরুদ্ধে যাবে ভেবে মৌনীবাবা সাজলেন কেজরী।

আর দিল্লির হিংসায় প্ররোচনা সৃষ্টিকারীদের দিকে আঙুল উঠলে বাংলার মেরুকরণ চূড়ান্ত হয়ে যাবে ভয়ে মমতা কোনও মন্তব্য করার ঝুঁকি এড়িয়ে চার দিন বসে থাকলেন ভিন রাজ্যে। আগুন লাগলে সবার ঘর ছাই হয়ে যেতে পারে। এই সহজ সত্যটা এঁরা কাকের মতো চোখ বন্ধ করি অবিশ্বাস করতে চান। তা কিন্তু সম্ভব নয়। যে কারণে ভোটে জিতেও দাঙ্গা ঠেকাতে পারলেন না কেজরিওয়াল। আর কলকাতার রাজপথে কেউ গোলি মারো শালেকো স্লোগান দিয়েও পার পেয়ে যাচ্ছে মমতার অসহায়তায়। সংখ্যালঘু তোষণের এত বড় সুযোগ পেয়েও তিনি একবারের জন্যও পার্ক সার্কাসে গেলেন না। শাহিনবাগের ছকে চলছে পার্ক সার্কাস।

অন্যদিকে, বিজেপির ছকে দেওয়া চিত্রনাট্যে ফেঁসে গিয়েছে মুসলিম সমাজের একাংশ। তাছাড়া মুসলিম মৌলবাদীরাও ঘোলাজলে মাছ ধরতে আর একধরনের উস্কানি সৃষ্টি ও চক্রান্তে মত্ত। মর্মান্তিক হলেও সত্যি যে, গোলি মারো শালোকো রাজনীতি আপাতত দেশের ভবিতব্য, যতক্ষণ না তিক্ত হতে হতে আপামর জনতা আর একটা আরব বসন্ত না ঘটিয়ে ফেলে। মনে রাখতে হবে, ভোটের নিরিখে কোথাও হয়তো বিজেপি হারতে পারে, কিন্তু বিজেপির দর্শন আপাতত ফ্রন্টফুটে জায়গা পেয়ে গিয়েছে। ফ্যাসিবাদী এই প্রবণতার সামনে আমরা বড় অসহায় এখন। দেশের যে কোনও জায়গায় আরও আরও জাফরাবাদ হওয়ার সমস্ত শর্তই মজুত।