“বিপ্লব ছিল জাত অভিনেতা” : কথোপকথনে অরুণ মুখোপাধ্যায়

কাবেরী বসু

 

গত ৩০শে নভেম্বর ছিল বাংলা নাট্যজগতের একটি শোকের দিন। চলে গেলেন অভিনেতা পরিচালক বিপ্লবকেতন চক্রবর্তী। সুকৌশলী অভিনেতা হিসাবে আত্মপ্রকাশ থিয়েটারের মঞ্চে হলেও টেলিভিশন এবং বড় পর্দাতেও তাঁর যাতায়াত ছিল সাবলীল। 'চেতনা' নাট্যদলের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক এবং বর্ষীয়ান অভিনেতা অরুণ মুখোপাধ্যায় অভিনয়জীবনের শুরু থেকেই দেখেছেন বিপ্লবকেতন চক্রবর্তীকে। অনুজপ্রতিম বিপ্লবকেতনের চক্রবর্তী সম্বন্ধে চার নম্বর প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে কথা বললেন এই বর্ষীয়ান অভিনেতা ও পরিচালক, চেতনা-র কর্ণধার। পত্রিকার পক্ষে কথা বললেন কাবেরী বসু

প্রথমেই যেটা জানতে চাইব, বিপ্লবকেতনবাবুর সঙ্গে আপনার পরিচয় কবে এবং কীভাবে?

ডেট-সাল-তারিখ সেভাবে বলতে পারব না। আমরা আসলে এক জায়গায় থাকতাম, হাওড়ার শিবপুর অঞ্চলে। খুব কাছাকাছিই বাড়ি ছিল আমাদের। বিপ্লবের বাবা ছিলেন একজন অত্যন্ত গুণী মানুষ, তিনি স্কুলশিক্ষক ছিলেন, কিন্তু পালা লেখা থেকে শুরু করে গানে সুর দেওয়া, অভিনয় করা সবই তিনি করতেন। তাঁর নিজের দল ছিল ওখানেই। সেই দলের সূত্রেই ওঁর সঙ্গে পরিচয় ছিল। বিপ্লব তখন খুবই ইয়ং।

উনি চেতনায় এলেন কীভাবে?

বিপ্লবের সঙ্গে পরিচয় ছিল তো। তা আমার দল যখন তৈরি হল কাছাকাছির মধ্যে অনেককেই ডেকেছিলাম। অনেকে গিয়েছিল অনেকে যায়নি। বিপ্লব ছিল তারই মধ্যে একজন। প্রধানও বলা যায়। আমাদের দলটা তৈরি হয়েছিল প্রধানত রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের নিয়েই, যদিও কয়েকজন বাইরে থেকেও ছিল। বিপ্লব নিজেও একজন রাজ্য সরকারি কর্মচারীই ছিল। ও অ্যাসেম্বলিতে চাকরি করত। ওর রক্তে অভিনয় এবং সুর দুটোই ছিল। প্রথমদিকে একটু দ্বিধাও ছিল কিন্তু ‘মেরীবাবা’ যখন করল তখন তো খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল।

উনি ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত চেতনায় ছিলেন, কিন্তু একটা জিনিস… মানে যাঁরা মোটামুটি খোঁজখবরও রাখেন তারাও ওনাকে যেন চেনেন ‘মেরীবাবা’র চরিত্রর জন্যই, আর পরবর্তীকালে তো টিভি বা অন্যান্য মাধ্যমে কমেডিয়ান… তবে কি এটা বলা যায় যে, ‘মারীচ সংবাদ’-এর মেরীবাবা চরিত্র ওনার অন্যান্য চরিত্রকে ম্লান করে দিয়েছিল? এ বিষয়ে আপনার কী মনে হয়?

না, এটা বোধহয় ঠিক না। এটা তো মঞ্চে। মঞ্চের থেকে বেরিয়ে অন্য একটা মাধ্যমে তো অভিনয়ের রকমফের ঘটে, ও যে বেসিকালি ভালো অভিনেতা সেটা এখানেই বোঝা যায় যে অন্যান্য মাধ্যমেও ও সাকসেস পেয়েছে। কারণ ওর কমেডি সেন্সটা খুবই প্রখর ছিল। খুবই দক্ষ অভিনেতা ও। স্বভাবতই ‘মেরীবাবা’র সঙ্গে তুলনা আনার প্রয়োজন দেখা দেয় না। চুনিপান্না সিরিয়ালেও ওর খুব সুনাম হয়েছিল। খুব স্বাভাবিক অভিনেতা ছিল ও একজন। সহজাত অভিনেতা যাকে বলে। শুধু মেরীবাবা-ই তো নয়, আমাদেরই অন্যান্য নাটকে ও যে অভিনয় করেছে সেগুলোতেও ওর দক্ষতা ও দেখিয়েছে। জগন্নাথে ‘গাঙ্গুলীমশাই’চরিত্রে খুব ভালো অভিনয় করেছে। ‘জ্যেষ্ঠপুত্র’তে ও আর পীযূষ গাঙ্গুলী অভিনয় করত। সে নাটকও বহু প্রশংসা পেয়েছে। ‘ভালোমানুষের পালা’তেও অভিনয় করত। সেটা আবার সিরিয়াস চরিত্র। ও দুধরনের অভিনয়তেই খুব পোক্ত ছিল। কমেডিটা ওর স্বাভাবিক জায়গা হলেও সিরিয়াস চরিত্রতে এই নাটকে খুব ভালো অভিনয় করেছিল।

এবার আমি একটু থিয়েটারওয়ালার প্রসঙ্গে আসছি। চেতনার পরে উনি যখন থিয়েটারওয়ালা তৈরি করলেন তখন আমরা ডিরেকটর বিপ্লবকেতন চক্রবর্তীকে পাই। অভিনেতা বিপ্লবকেতন চক্রবর্তী এবং ডিরেকটর বিপ্লবকেতন চক্রবর্তীর মধ্যে মিল বা অমিল বা তার কাজের ধরন সম্পর্কে আপনি যদি কিছু বলেন…

বিপ্লব চেতনাতেও ডিরেকশন দিয়েছিল। ‘ভূতের বরে’ নামে একটা নাটকে ও ডিরেকশন দেয় এবং তাতে মূল চরিত্রে অভিনয়ও করে। ওর মধ্যে ডিরেকটর সত্তাটা ছিল। মিল অমিলের প্রশ্ন নয়। ওর ডিরেকশন দেবার প্রবণতা ছিল এবং সেটা আমিও বুঝতাম, তাই ওর দল তৈরির। বিষয়ে সবসময়েই আমার নেপথ্য সমর্থন ছিল। ওদের দ্বিতীয় প্রযোজনায় আমারই লেখা একটা নাটক ও চায় এবং সেই সূত্রে দীর্ঘদিন আমার সঙ্গে সেই নাটক নিয়ে আলাপ আলোচনাও করে, ও কিছু চেঞ্জও করে এবং ডিরেকটরকে সেইটুকু চেঞ্জ করার জায়গা আমি সবসময়েই দিই। ওকেও দিয়েছিলাম। আমার সঙ্গে ওর সম্পর্ক সবসময়ে ভালোই ছিল।

এই থিয়েটারওয়ালা পর্বে আপনার পছন্দের নাটক কী কী?

‘বাঘু মান্না’র কথাই সবার আগে বলব, ওটাই আসল। নাটকটা খুব ভালো করেছিল। মূল চরিত্রে অভিনয়ও করেছিল। আর যা করেছিল, সবই প্রায় ভালো কিন্তু এখন আমার স্মৃতিতে নেই। নাটকের নাম বা চরিত্রের নাম সেভাবে কিছুই মনে পড়ে না। ‘বাঘু মান্না’টায় যেহেতু আমি একটু বেশি জড়িত ছিলাম, বেশ কয়েকবার দেখেওছি। সত্যপ্রিয় সরকার এবং আমাদের দলের নন্দিতা রায়চৌধুরী এবং ওর মেয়েরাও অভিনয় করেছিল তাতে। ওর মেয়েরাও তখন দক্ষ অভিনেত্রী হয়ে উঠতে শুরু করেছে। ওদের প্রায় সব নাটকই আমি দেখেছি তবে বয়স হচ্ছে তো, তাই আর ডিটেলসে মনে নেই।

আচ্ছা কমেডি অভিনেতা হিসেবে আমরা দ্বিজেনবাবুকেও দেখেছি, বিপ্লবকেতন চক্রবর্তীকেও দেখেছি, একই সিরিয়ালেও দেখেছি। টিভিটা যে খারাপ সেটা বলছি না কিন্তু ওঁরা যে মাপের অভিনেতা টিভিতে কি সেই মাপের চরিত্র ওঁরা পেলেন? সাধারণ দর্শকের একটা বড় অংশের কাছেই ওঁরা কমেডিয়ান বা ভাঁড় হিসেবে রয়ে গেলেন, এটাকে আপনি কীভাবে দেখবেন?

কমেডিয়ান আর ভাঁড় একসঙ্গে উচ্চারণ করলে চলবে না। টিভিটাএকটা অন্য মাধ্যম, যেটা অনেক বেশি লোক একসঙ্গে দেখে,তার প্রস্তুতি তার নেপথ্য সমস্ত ব্যবস্থাপনা সবই আলাদা। থিয়েটারের দলের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। একটা দলে তুমি যেটা যতখানি স্বাধীনতা নিয়ে করতে পারো, যে এক্সপেরিমেন্টটা করতে পারো, টিভি বা মিডিয়া বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেটা করে না, লোকেযেটা বেশি পছন্দ করবে সেটা করারই চেষ্টা করবে। সেটা সবসময় ভাঁড়ামি হয় না আবার কখনও কখনও হয়ও বটে। আবার মঞ্চেও হয়। মঞ্চে যারা কমেডি অভিনয় করে তারাও কি কখনও সখনও বেশি বাড়াবাড়ি করে না? এটাকে ওভাবে ভাগ করা যায় না, দর্শকের কাছে গ্রহণযোগ্যতা বাড়াবার জন্য অভিনয়টা কখনও করতে হয় সেভাবে। সেখানে সবসময় স্ক্রিপ্টও অত যত্ন করে লেখা হয় না। একটা নাটক আমরা কতদিন ধরে লিখি, কাটাকুটির মধ্য দিয়ে যাই, দরকারে রিহার্সালেও চেঞ্জ করি, এমনকি শো নেমে গেলেও তারপরেও চেঞ্জ হতে থাকে টুওয়ার্ডস পার্ফেকশন, এবারে টিভি মিডিয়াতে তো সেই সুযোগই নেই। সেখানে আজকেই স্ক্রিপ্ট দিল, আজকেই করতে হবে। দক্ষ অভিনেতা ছাড়া সেখানে সাফল্য পাওয়া সম্ভবই নয়। আমি যেটুকু বুঝি দুটোর কর্মপদ্ধতিই একেবারে আলাদা। থিয়েটারে আমরা একটা চরিত্র নিয়ে মাজাঘষার সময় পাই। তাই কোনটা ভালো কোনটা মন্দ না বলে দুটো যে আলাদা এটা আগে বুঝে নিতে হবে। থিয়েটারের একটা অংশের মধ্যেও এই প্রবণতা আছে হাল্কা নাটক করার বা লোকে যেটা ভালো বলবে সেটা করার। ওখানে অনেক লোককে ক্যাটার করতে হয়, তাই হয় বেশি লোকের জন্য কাজ।

অভিনেতা বিপ্লবকেতন চক্রবর্তীকে নিয়ে কিছু বলুন…

অভিনেতা বিপ্লবকেতন অত্যন্ত বুদ্ধিমান এবং স্মার্ট অ্যাক্টর, চেহারাটা ছোটখাটো ছিল, সেটাতে হয়তো কমেডি অভিনয়ে কিছুটা সুবিধেও হয়, কিন্তু ও ছিল জাত অভিনেতা। মুখের এক্সপ্রেশন থেকে শুরু করে সবেতে পারফেক্ট।

অভিনেতা বিপ্লবকেতন চক্রবর্তী গুরু বলে কাউকে মানতেন বলে আপনার জানা আছে?

গুরু বলে আলাদা করে কাউকে মানত কিনা জানি না, আমাকেই মানত বোধহয় (হেসে)।

অভিনেতা বিপ্লবকেতনের আলাদা কোনো বৈশিষ্ট্য বলতে গেলে আপনি কী বলবেন?

ওর সেন্স অফ টাইমিং, যেটা কমেডি অভিনয়ের প্রধান অস্ত্র। অসম্ভব ভালো টাইমিং ছিল ওর। সেই টাইমিং সেন্স সকলের থাকে না, যেমন রবি ঘোষ সম্পর্কে এক কথায় বলা যায় কী অসম্ভব টাইমিং ছিল, বিপ্লবও তেমনই।

শেষ প্রশ্ন, এখনকার অভিনেতাদের সঙ্গে বিপ্লবকেতনের তুলনা করতে চাইলে আপনি কার কথা বলবেন?

আমি আসলে এখন সব কাজ দেখে উঠতে পারি না তো। এখনকার অভিনেতাদের সঙ্গে তুলনা বলতে হলে… অনেকেই আছে আমি ভুলে যাচ্ছি… তাই বোধহয় যে দু-একজনের নাম মনে আসছে, সেগুলি না বলাই ভালো। কারও নাম বাদ দিলে সে আবার ভাববে আমার কথা বলছে না। কিন্তু আসলে বয়সের কারণেই দেখাটাও কম হয়। অভিনয় দেখলে তো অভিনয়ের কথা বলব, সিনেমাই দেখা হয় না কত দিন, হলে গিয়ে দেখতে পারি না, না দেখলে কাজের কথা জানতেই পারি না। সিরিয়ালও দেখার সুযোগ হয় না। বিপ্লবকে যত কাছ থেকে যতভাবে দেখেছি, অন্যদের তো সেভাবে দেখতেই পাচ্ছি না। নাম অনেকই আছে নিশ্চয়ই… যাদের নাম আমার মনে পড়ছে না অথবা যাদের কাজ আমার দেখার সুযোগই হয়নি। কাজেই নামটামের দিকে বেশি না যাওয়াই ভালো (হাসি)।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4596 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...