ভয়

শামিম আহমেদ

 

ছেলেবেলায় গ্রামে বিদ্যুৎ-সংযোগ ছিল না, তাই বিজলি বাতিও ছিল না। চার পাশ ছিল ঘন অন্ধকার। ভূতের ভয়, জিনের ভয়, দৈত্য-দানো আসত সেই অন্ধকার বেয়ে। আর ছিল মারের ভয়। ঠিক সময়ে পড়তে না বসা কিংবা বেশি খেলাধূলার অপরাধে বা নানারকম কারণে জুটত শারীরিক লাঞ্ছনা।

আলো আসার পরেও সেই ভয় কাটেনি, সে বাস করে মনের গভীর অন্ধকারে। তার সমূল উৎপাটন আজও সম্ভব হয়নি। এ তো গেল গড় মানুষের ভয়। এমন অভিজ্ঞতা কম-বেশি সকলের।

কিন্তু অন্য ভয়ও তো কালে-কালে গেড়ে বসেছে হৃদয়ে, মনে ও শরীরে। সে হল সংখ্যালঘুর ভয়। কে সংখ্যালঘু? যে বেশির ভাগ মানুষের সুরে সুর না মিলিয়ে অন্য সুরে গান করে, সেই তো সংখ্যালঘু। তবে তাকে যে সংখ্যায় লঘু হতে হবে এমন কোনও কঠিন নিয়ম নেই। অপর পক্ষ যদি সংখ্যায় অল্প হয় কিন্তু শক্তিশালী, তাহলে উলটো দিকের বেশিরভাগ কম শক্তিসম্পন্ন মানুষও সংখ্যালঘু হয়ে যায়। যা দেখেছি মহিলাদের ক্ষেত্রে, গ্রামের চাষাভুষো মানুষদের ক্ষেত্রে। বাড়িতে চারজন মহিলা, দুজন পুরুষ, সেখানে মহিলারা ভয় পান পুরুষদের। হাজারখানেক চাষা ভয় পান গুটিকয়েক বড়লোক ক্ষমতাবানকে।

স্কুল থেকে কলেজে ঢোকার সময় বুঝতে পারি, ভয় এক ভয়ঙ্কর জিনিস। তাকে ত্যাগ করা সম্ভব হয় না। সব সময় বুকে নিয়ে ঘুরে বেড়াতে হয়। কলেজ জীবনে এসে আবিষ্কার করি, কলেজের শিক্ষার্থী হয়ে আর পাঁচজনের মতো হওয়া যায় না কারণ সেখানে ধর্মের পরিচয় বলে একটা বিষয় আছে। শহরের সবচেয়ে নামী কলেজও তার থেকে ব্যতিক্রম নয়। সবাই যেখানে থাকবে, সেখানে তুমি বাস করতে পারবে না কারণ তোমার ধর্ম আলাদা। এই ‘বৈষম্য’ নতুন ভয়ের সঞ্চার করে। এই ভীতি কাটে না। কালে কালে তা বৃদ্ধি পেতে পেতে এমন জায়গায় পৌঁছয় যেখানে দেখা যায়, ভয় এবং মন-শরীর অভিন্ন হয়ে গেছে। কোনও সৃজনশীল কাজ, কোনও অন্য ভাবনাচিন্তাকে ভয় এসে গ্রাস করে ফেলছে। সে মন বেয়ে শরীরে পৌঁছতে বেশি সময় নেয় না। যখন হাঁটতে হাঁটতে কোনও পথ অতিক্রম করি, তখন দেখি আসলে রাস্তা হাঁটছে ভয়ের পিণ্ড।

সেই রাস্তাও আসলে আমাদের পথ নয়। আমাদের ‘সংখ্যালঘু’ ছায়া সেখানে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়ে বাকি মানুষকে ছায়া দেয়।

আমার ভয় আসলে অন্যের আনন্দ। সেই অন্যরা আমাদের ভয়ের ওম নেয় শীতকালে, গ্রীষ্মে আমাদের ভয় তাদের মৃদুমন্দ হাওয়া দেয়। এই অব্দিও ঠিক ছিল। কিন্তু অন্যেরা যখন দেখতে চায় আমার ভয়ের শরীরে কোন রঙের রক্ত আছে, তখন আসে খুনখারাপির প্রসঙ্গ। আমার বিশ্বাস কেন আলাদা হবে! আমার মতামতের কারণে আমাকে হত্যা পর্যন্ত করা যায়, সে তো অত্যাচারী শাসকের চিরকালের বাণী! সেই হত্যার ভয়, নিজের অস্তিত্বের সমূলে বিনষ্টির ভয় সংখ্যালঘুর হৃদয়কে সব সময় আন্দোলিত করে। সেই হৃদয় থাকে বুকের বাঁদিকে, ফাঁকা বুকপকেটের ঠিক নীচে।

ফাঁকা বুকপকেট নিয়ে যখন সে বা আমি কাজ করতে যাই বাইরে, অন্য প্রদেশে; সদা সন্ত্রস্ত থাকি এই বুঝি কেউ জেনে গেল আমার নাম, যে নামের ভিতরে ঘাপটি মেরে আছে আমার ধর্মপরিচয়। কিংবা আমার পোশাক বলে দিচ্ছে আমি কে, তখন ভয় এসে চাদরের মতো চারদিক থেকে মুড়ে ফেলে আমাকে। কিন্তু সেই চাদর আড়াল করতে পারে না আমাকে। আমি আরও বেশি উন্মুক্ত হতে থাকি। আমার টিফিন বাক্স নিয়ে সন্ত্রস্ত থাকি। কেউ রুটি আর পুঁইশাকের চচ্চড়িকে ‘ভয়ানক’, ‘বিপজ্জনক’ কোনও বস্তু ভেবে আমাকে পিটিয়ে মেরে ফেলবে না তো!

সাবধানের মার নেই। কিন্তু সাবধান হওয়ারও কোনও রাস্তা নেই। ওরা আমার দশ আঙুলের ছাপ, চোখের মণি সব কিছুর ছবি নিয়ে রেখেছে। ওরা ঠিক চিনে নেবে আমার হাতের কাজ, চোখের দৃষ্টি। আমি ভয়ে কুঁকড়ে যাই।

কুঁকড়োতে কুঁকড়োতে টের পাই, আমি এই ভয়ের দেশে বহিরাগত। আমি কি জানি, আমি কোথা থেকে এসেছি? কোনখানে কুড়িয়ে পেয়েছিল আমার মা আমাকে? কোথায় আমার বাবার জন্মের কাগজ-নথি? তাদের বাপ, তাদের মা কোথা থেকে এসেছিল? কবে কবে তারা সব জন্মেছিল, কোন কোন অঞ্চলে? কোথায় মরেছিল? ওরা সেই সব তথ্য জানতে চায়। আমাকে ভয় দেখায়। বলে, এই সব তথ্য না দিলে, তথ্যে ভুল থাকলে আমাকে নিয়ে যাবে ডিটেনশন ক্যাম্পে। সেখানে আটক করে রাখবে আমাকে, আমাদের। কোটি কোটি আমাকে। তার পর?

আবার ভয়। আমাদের সস্তা মজুর হিসাবে কিনে নেবে বহুজাতিক সংস্থা। কিংবা আমাদের চালান করে দেওয়া হতে পারে মায়নমারের খনিতে ক্রীতদাস হিসাবে, ঠিক যেমন ১৫০ বছর আগে আমাদের পূর্বপুরুষদের চালান দেওয়া হয়েছিল বিভিন্ন জায়গায়। সেটা ছিল ১৮৭৩ সাল। ইংরেজ সরকার। কলাকাতার সুরিনাম ঘাট থেকে সস্তার শ্রমিকদের চালান দেওয়া হত দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন দেশে। আখের খেতে কাজ করত আমাদের পূর্বপুরুষরা। ঋতুকালীন সময়ে মেয়ে শ্রমিকদের কাজ যাতে কামাই না হয় তাই তাদের জরায়ু কেটে বাদ দেওয়া হত। কে চালান দিত আমাদের সেই পূর্বপুরুষদের? সরকার। ইংরেজ সরকার। ইংরেজদের ভয় পেত দেশের গরিব মানুষ। সেই ভয়কে জয় করে একদিন তারাই ইংরেজ সরকারকে উৎখাত করেছিল।

আজ আমাদের কোটি কোটি মানুষকে ভয় দেখাচ্ছে অল্প কিছু লোক। দুর্ভাগ্যক্রমে তারা আমাদের শাসক, ক্ষমতাবান। তারা সংখ্যায় অল্প কিন্তু তারা সংখ্যাগুরু। আমরা সংখ্যায় অনেক বেশি, কিন্তু আমরাই এখন সংখ্যালঘুতে রূপান্তরিত হয়েছি। ধর্মের কারণে নয়, অত্যাচার-অত্যাচারিতের নিরিখে। কেন বেশি মানুষ সংখ্যালঘু আর কেনই বা অল্প মানুষ সংখ্যাগুরু? এমন সমীকরণের মূলে সেই ভয়। এই সংখ্যালঘুত্ব ক্ষমতাহীনতার।

ভয় আর ক্ষমতার সম্পর্ক বড় নিবিড়।

আমাদের ভয় বা ক্ষমতাহীনতা আসলে ওদের ভয় কিংবা ক্ষমতাহীনতা হওয়া উচিত ছিল। নীতিশাস্ত্রের ঔচিত্য শুধু নয়, এ হল যৌক্তিক ঔচিত্য। আমাদের ভয়কে যতদিন না ওদের ভয়ে রূপান্তরিত করা যাবে, ততদিন ভয় বা ক্ষমতাহীনতা কিংবা গণতন্ত্রহীনতা থেকে মুক্তি নেই আমাদের। ভারতীয় দর্শন বলে, দুঃখমুক্তি হল মোক্ষ বা নির্বাণ। এই দেশে ভয়ের মুক্তি হল নির্বাণ। কিন্তু ‘ভয়’ মুক্ত হলে সে যাবে কোথায়? তার তো একটা আধার দরকার, যেখানে সে বাস করবে।

ভয়কে পাঠাতে হবে অত্যাচারী শাসকের হৃদয়ে, তার মননে ও শরীরে।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4649 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...