Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

লেনিনের সঙ্গে কিছুক্ষণ

লেনিনের সঙ্গে কিছুক্ষণ -- অশোক মুখোপাধ্যায়

অশোক মুখোপাধ্যায়

 

[১৩]

[১৪]

জেনেভা, সুইজারল্যান্ড। ১৯১৪ সালের এক সকাল। ভ্লাদিমির ইলিচ উলিয়ানভ অনেকক্ষণ ধরে পায়চারি করছেন ঘরের বারান্দায়। সকালের খবরের কাগজগুলি এখনও দলা পাকানো অবস্থায় টেবিলের উপরে। খোলা বা পড়া হয়নি। নাস্তা খাওয়ার পর কফির গ্লাস হাতে নিয়েও শেষ করে উঠতে পারেননি। নাদেজদা ক্রুপস্কায়া বললেন, ইলিচ, তুমি কি খুব দুশ্চিন্তায় আছ কিছু নিয়ে? কফিটা অন্তত শেষ করো।

–ও হ্যাঁ, ভুল হয়ে গেছে। ধন্যবাদ নাদিউশা।
–আমাকে বলা যায় সমস্যাটা?
–হ্যাঁ, কেন নয়? চলো ভেতরে। বলছি, বসো।

ঘরের ভেতরে ঢুকে দুজনে বসলেন পাশাপাশি একটা সোফায়। লেনিন বললেন, কার্লের কাউকে পাঠানোর কথা। গতকাল সন্ধের মধ্যেই। কদিন আগে আমি একটা জরুরি চিঠি পাঠিয়েছিলাম। উত্তরটার জন্য অপেক্ষা করছি। দেরি হওয়ার কথা নয়।

–ও, এই কথা? তা কী ছিল তোমার চিঠিতে? কোনও খবর?
–একদম নয়। আমরা প্রবাসী কমরেডরা বাসেলের বিগত সম্মেলনে যুদ্ধ বাজেট নিয়ে যে আলোচনা করেছিলাম, সেটা ওনাকে মনে করিয়ে দিয়েছি। আমাদের আন্তর্জাতিক মঞ্চ থেকে একটা সাধারণ প্রস্তাব নিতে হবে। প্রতিটি দেশের সোশাল ডেমোক্রেটিক পার্টিকে নিজের নিজের দেশের যুদ্ধ প্রয়াসের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে একটা যৌথ বিবৃতির খসড়া। কার্ল সম্মতি দিলেই আমরা সেটা যে যার দেশের পার্টির কাছে পাঠাব অনুবাদ করে কাজে লাগানো আর প্রেসে দেবার জন্য।
–তোমার কি মনে হয়, কার্ল ইচ্ছে করেই দেরি করছেন? নাদেজদা জিগ্যেস করলেন।
–কথাটা আমার মাথায় এলেও— ইলিচ কফির কাপে একটা লম্বা চুমুক দিয়ে বলতে লাগলেন— আমি এটা বার বারই মন থেকে তাড়ানোর চেষ্টা করছি। অন্যরা যাই বলুক, কার্ল একটা দৃঢ় অবস্থান নেবে বলেই আমার এখনও বিশ্বাস।

না, সেই চিঠি আর আসেনি।

লেনিন প্রভূত আস্থা স্থাপন করলেও জার্মান সোশাল ডেমোক্রেটিক দলের নেতা এবং দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের এঙ্গেলস-পরবর্তীকালে অবিসংবাদিত তাত্ত্বিক প্রবক্তা, কার্ল কাউটস্কি, তাঁর সেই বিশ্বাসের মর্যাদা রাখতে পারেননি। তিনি তখন ভাবছেন, সাম্রাজ্যবাদ সারা দুনিয়া জুড়ে এত বিকশিত হবে যে তার আর যুদ্ধের প্রয়োজনই পড়বে না। সে তার নিজের স্বার্থেই শান্তি বজায় রাখবে। ওদিকে, যুদ্ধ তখন প্রায় লাগ-লাগ।

শুধু তাই নয়, বাসেল সম্মেলনে সর্বসম্মতভাবে গৃহীত সিদ্ধান্তকে অগ্রাহ্য করেই বিভিন্ন দেশের কমিউনিস্ট পার্টিগুলি (তখনও তাদের বেশিরভাগ দল সোশাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি নামেই পরিচিত) নিজ নিজ দেশের বুর্জোয়া সরকারের যুদ্ধপ্রস্তুতিকে সমর্থন জানাতে শুরু করল। লেনিন সবচাইতে বেশি অবাক হলেন, যখন শুনলেন, মার্ক্স এঙ্গেলসের সান্নিধ্য-ধন্য এবং ইউরোপের সবচাইতে পুরনো শক্তিশালী এবং বনেদি মার্ক্সবাদী দল জার্মান সোশাল ডেমোক্রেটিক পার্টি পর্যন্ত রাইখস্ট্যাগ অধিবেশনের ভোটে যুদ্ধবাজেটকে সমর্থন করে বসল। প্রবীণ নেতা, মার্ক্স এঙ্গেলসের সহকর্মী, অউগুস্ট বেবেল, তখন বলছেন, “জার্মানির এক ইঞ্চি জমিও বিদেশির হাতে তুলে দেব না।” ফরাসি সমাজতন্ত্রী নেতা জাঁ জরস বিবৃতি দিলেন, কমিউনিস্ট ইস্তাহারে মার্ক্স এঙ্গেলসের ঘোষণা— শ্রমিকশ্রেণির কোনও দেশ নেই— এক আজগুবি এবং অনৈতিহাসিক দাবি।

সেই চিঠির উত্তর কেন আসেনি, তিনি এত দিনে বুঝতে পারলেন। মাঝখান থেকে নাদিউশার বানানো অত সুন্দর কফিটা সেদিন ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল।

 

ৎসিমারহ্বাল্ড সম্মেলন ১৯১৫

এই প্রসঙ্গেই এসে পড়েছিল ৎসিমারহ্বাল্ডের নাম। ১৯১৪ সালের আগস্ট মাসে ইউরোপ জুড়ে শুরু হয়ে যায় প্রথম বিশ্ব মহাযুদ্ধ। লেনিন তখন চলে এসেছেন বার্ন শহরে। তিনি খানিকটা ভেবেছিলেন এই যুদ্ধে যুদ্ধরত দেশগুলির সমাজবাদী দলের নেতারা হয়ত প্রকাশ্যে যুদ্ধবিরোধী অবস্থান নিতে পারুক বা না পারুক, নিজ নিজ দেশের যুদ্ধপ্রস্তুতিতে সহায়ক কোনও ভূমিকা অন্তত পালন করবে না। কিন্তু, আগেই বলেছি, যুদ্ধ বাধার সঙ্গে সঙ্গে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের সদস্য দলগুলি এই সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের সক্রিয় শরিক হয়ে গেল। বেশিরভাগ দল তাদের দেশের শাসক বুর্জোয়াশ্রেণির যুদ্ধপ্রস্তুতিতে সহায়তা করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। বাজেটে ভোট দিয়ে, নিজ নিজ দলের সদস্যদের মধ্যে যুদ্ধে যোগদানের প্রচার চালিয়ে তারা শ্রমিকশ্রেণিকে বুর্জোয়াদের লেজুড়ে পরিণত করতে উদ্গ্রীব হয়ে পড়ল।

প্রবাসী আর এক রুশ কমরেড, বলশেভিক নেতা, গ্রেগরি জিনোভিয়েভ (১৮৮৩-১৯৩৬), তাঁকে একদিন প্রশ্ন করলেন, যে সমস্ত দল আন্তর্জাতিকের একের পর এক অধিবেশনে এই সেদিন পর্যন্ত যুদ্ধবিরোধী প্রস্তাব পাশ করল, বক্তৃতা দিল, তারা কীভাবে এই যুদ্ধকে পুঁজিবাদবিরোধী বিপ্লবী গৃহযুদ্ধে পরিণত করার পরিবর্তে রাতারাতি বুর্জোয়াশ্রেণির কাছে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ করতে পারল?

লেনিন বললেন, অনেকদিন ধরেই এই সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছিল। এর আগেকার অধিবেশনগুলিতে বসেই আমরা অনেকে টের পাচ্ছিলাম, চূড়ান্ত মুহূর্তে আসল লড়াই থেকে পালিয়ে যাওয়ার প্রবণতা অনেক নেতাকেই গ্রাস করেছে। এক দিকে পার্লামেন্টারি ক্ষমতার ভাগাভাগিতে প্রলুব্ধ হয়ে অনেকেই সংগ্রামের রাস্তা এবং কারখানার দরজা থেকে সরে যেতে চাইছে। অন্য দিকে দেশপ্রেমের বুলি আওড়ে সস্তার জনপ্রিয়তা পাওয়াও এর আর একটা লক্ষ্য।

–নিজেদের রাজনৈতিক অবস্থান ওরা ভুলে গেল কীভাবে?
–জানি না। তবে, ওরা যাই করুক আর যে কারণেই করুক না কেন, এ হল আন্তর্জাতিক শ্রমিক আন্দোলনের প্রতি সরাসরি নির্লজ্জ বিশ্বাসঘাতকতা।
–আমাদের এখন তাহলে কী করণীয়, কমরেড ইলিচ?

লেনিনের মুখ গম্ভীর হয়ে গেল। তিনি ধীরে ধীরে খুব দৃঢ়তার সঙ্গে বললেন, প্রথমে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের সঙ্গে সমস্ত রকমের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করতে হবে। যে সমস্ত সোশাল ডেমোক্রেটিক দল এই ঘৃণ্য সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধপ্রয়াসকে সাহায্য ও সহযোগিতা করছে তাদেরকে নিয়ে আর এক সঙ্গে চলা যাবে না। এদের সমালোচনা করে আমাদের প্রিয় কমরেড রোজা যে মন্তব্য করেছিলেন জানেন তো?

–না শুনিনি। কী বলেছেন?
–ওনার মতে, এটা একটি দুর্গন্ধবাহী পচা শব। আমিও তাঁকে সমর্থন করি। মৃতদেহ দিয়ে তো আর কাজ হয় না। সংখ্যায় কম বা সাংগঠনিকভাবে দুর্বল হলেও যারা দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের এই উগ্র জাতীয়তাবাদী অবস্থানকে সমর্থন করতে চাইছে না তাদের আলাদা মঞ্চে সংগঠিত করার চেষ্টা করতে হবে।
–আমরা কি তাহলে আবার একটি নতুন আন্তর্জাতিক গড়ার কথা ভাবব?
–আমি সেরকমই ভাবছি এবং চাইছি। লেনিন প্রায় স্বগতোক্তি করলেন, তবে চাইলেই তো হবে না কমরেড। কজনকে সঙ্গে পাব দেখতে হবে। মূলস্রোতের দলগুলিকে আমরা পাচ্ছি না। বিভিন্ন দেশের কিছু কিছু ছোটখাটো শক্তি হয়ত আমাদের সঙ্গে আসবে। যদি ভরসা পায়। চেষ্টা তো অবশ্যই করতে হবে। বিপ্লবের প্রভূত সম্ভাবনা এইভাবে চোখের সামনে ধ্বংস হয়ে যেতে দিতে তো আর পারি না।

লেনিন তখন অস্থির হয়ে উঠলেন। তিনি নতুন একটি আন্তর্জাতিক ফোরাম গড়ে তোলার প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসাবে চাইলেন বিপ্লবী আন্তর্জাতিকতাবাদীদের একটি মঞ্চে সমবেত করতে। যার ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত হল ৎসিমারহ্বাল্ড সম্মেলন।

প্রথমে কিছু ছোট উদ্যোগ নেওয়া হল।

যুদ্ধবিরোধী সভার প্রস্তুতি হিসাবে একটি সম্মেলনে লেনিনের আহ্বানে কিছু আন্তর্জাতিকতাবাদে বিশ্বাসী প্রথমে মিলিত হলেন ১৯১৪ সালে সুইজারল্যান্ডেরই লুগানো শহরে। ওই বছরই সুইডেনের স্টকহোমে এবং ডেনমার্কের কোপেনহেগেন শহরে আরও দুটো বৈঠক হল। কিন্তু এই সব বৈঠক যুদ্ধবিরোধী কোনও সর্বসম্মত গ্রহণযোগ্য সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারল না। তার কিছু দিন পরে, বার্নে ১৯১৫ সালের মার্চ মাসে অনুষ্ঠিত হল বামপন্থী মহিলা সংগঠনগুলোর এক বৈঠক। আলেক্সান্দ্রা কোলোনতাই, ইনেসা আর্মান্দা এবং ক্লারা ৎসেটকিনের উদ্যোগে জার্মানি, ফ্রান্স, ব্রিটেন, ইতালি, হল্যান্ড, পোল্যান্ড এবং রাশিয়ার মোট ২৯ জন মহিলা প্রতিনিধির উপস্থিতিতে একটি গোপন সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এর মধ্য দিয়ে ইউরোপের বুকে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের বিরুদ্ধে মহিলাদের প্রতিরোধ একটা ভাষা পেল। কিন্তু উল্লেখযোগ্য সিদ্ধান্ত কিছু করা গেল না। মাসখানেক বাদে সেখানেই আবার সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী যুব সংগঠনগুলির একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনও অনুষ্ঠিত হল। কিন্তু সেখানেও সর্বসম্মতভাবে গ্রাহ্য কোনও যুদ্ধবিরোধী প্রস্তাব গ্রহণ করা গেল না।

এই পরিস্থিতিতে একটি বৃহত্তর আন্তর্জাতিক সম্মেলনের প্রয়োজনীয়তা সমস্ত বিপ্লবী নেতারা অনুভব করতে পারলেন। লেনিন এবং জিনোভিয়েভ সে সময়ে বার্নেই বসবাস করছিলেন। তাঁরা এরকম একটি উদ্যোগের সঙ্গে প্রথম থেকেই যুক্ত ছিলেন। ঠিক হল বার্নের কাছেই ৎসিমারহ্বাল্ড নামক পাহাড় ঘেরা ছোট্ট একটি গ্রামে ১৯১৫ সালের সেপ্টেম্বরের ৫-৮ তারিখ একটি সম্মেলন হবে। এই সম্মেলনের দায়িত্ব গ্রহণ করেন সুইস সমাজতন্ত্রী নেতা রবার্ট গ্রিম ও তাঁর সহযোগীরা। তবে এই সম্মেলনে শুধু বিপ্লবী বামপন্থীরাই আমন্ত্রণ পেলেন, তা নয়। যুদ্ধবিরোধী সমস্ত দল ও ব্যক্তিকেও ডাকা হল। লেনিন সম্ভবত সম্মেলনের আগেই বুঝতে পেরেছিলেন, আগের সমস্ত সম্মেলনের মতোই এবারেও বামপন্থীরা সংখ্যালঘিষ্ঠই থাকবেন। সুইজারল্যান্ড যুদ্ধে কোনও পক্ষেই যোগদান করেনি। ফলে সেই দেশে তখনও যুদ্ধের হাঁকডাক নেই। চতুর্দিকে বোমাবারুদের বর্ষণ ও গর্জনের মধ্যেই পক্ষীতত্ত্ববিদের ছদ্মবেশে ৩৮ জন ইউরোপীয় সমাজতন্ত্রী ৎসিমারহ্বাল্ডে সমবেত হলেন, যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য:  লেনিন, জিনোভিয়েভ, লিওন ত্রতস্কি, মার্তভ, কার্ল রাদেক, কোলোনতাই, বার্থা থ্যালেইমার, ভিক্তর চের্নভ, রবার্ট গ্রিম প্রমুখ।

এই সম্মেলনে লেনিন তাঁর মতামত পুরোটা গ্রহণ করাতে পারেননি ঠিকই; কিন্তু অনেক জোড়াতালি দিয়ে হলেও যুদ্ধের বিরুদ্ধে, দেশ বা দেশের কিছু অংশ দখল করে নেওয়ার বিরুদ্ধে, প্রতিটি জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের সপক্ষে যে সর্বসম্মত প্রস্তাব গৃহীত হল তা পরবর্তী সময়ে সারা ইউরোপের বামপন্থী মহলে শান্তির দাবিতে গড়ে ওঠা লড়াইয়ে একটি শক্তিশালী অস্ত্র হয়ে উঠল। তাতে বলা হল:

This struggle is the struggle for freedom, for the reconciliation of peoples, for Socialism. It is necessary to take up this struggle for peace, for a peace without annexations or war indemnities. Such a peace, however, is only possible if every thought of violating the rights and liberties of nations is condemned. Neither the occupation of entire countries nor of separate parts of countries must lead to their violent annexation. No annexation, whether open or concealed, and no forcible economic attachment made still more unbearable by political disfranchisement. The right of self-determination of nations must be the indestructible principle in the system of national relationships of peoples.

এই সম্মেলনেই লেনিন সহ অন্যান্য বিপ্লবীরা বামপন্থীরা অন্তত এটুকু আস্থা পেলেন যে তারা এখন থেকে আরও বেশি সংগঠিত হয়ে যুদ্ধবিরোধী প্রচারে নামতে এবং সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনে প্রভাব বিস্তার করতে পারবেন। লেনিন অনুভব করলেন যে ৎসিমারহ্বাল্ডের পর থেকে যুদ্ধবিরোধী সমাজতন্ত্রীদের এখনই না হলেও অচিরেই হয়ত আরও বেশি সংখ্যায় যুদ্ধের সঙ্কটের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বিপ্লবী সংগ্রাম গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তার দিকে আকৃষ্ট করা যাবে এবং এই বিপ্লবী বামপন্থীরাই তৃতীয় আন্তর্জাতিক গড়ে তোলার একটি প্রস্তুতি-কেন্দ্র হিসাবে কাজ করবে।

অন্যতম সংগঠক কমরেড ইনেসা আর্মান্দা তাঁর সন্দেহ গোপন রাখেননি, আপনার গৃহযুদ্ধের আহ্বান কিন্তু বেশিরভাগ প্রতিনিধিরই পছন্দ হচ্ছে না, কমরেড ইলিচ।

–এটা একটা কঠিন শপথ, লেনিন বোঝালেন, সংগঠনের তেমন কোমরের জোর না থাকলে এটা একটা বাগাড়ম্বর হয়ে দাঁড়াবে। এক একটা দেশের সেনাবাহিনী তাদের হাতের অস্ত্র তাদেরই শাসকশ্রেণির এবং রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ঘুরিয়ে ধরবে— এটা কোনও প্রস্তাবে বা ভাষণে বলা যত সহজ, কাজে রূপ দেওয়া ততটাই কঠিন। রাষ্ট্র যাদের রিক্রুট করছে তাদের মধ্যে জোরদার প্রচার করা এবং প্রভাব ও সংগঠন থাকা দরকার। পুরনো যে সমস্ত দলের এই জোর ছিল, তারা পিছিয়ে গেছে। আর যারা আমাদের সঙ্গে যোগ দিচ্ছে তাদের প্রায় কারওই সেরকম জোর নেই। ওদের আমি দোষ দিই না।
–তাহলে এই স্লোগানের উপর এত গুরুত্বদানের প্রয়োজন কী? যেটুকু সকলে মানতে পারবে, সেই অবধি বলাই তো এই মুহূর্তে ভালো ছিল।
–না কমরেড আর্মান্দা, কথাটা শুনিয়ে রাখতে হবে। ভাসিয়ে রাখতে হবে। বার বার করে বলতে হবে। দরকার হলে আমরা আবার একটা সভা করব। বা একাধিক। কোনও একটা দেশেও যদি একটাও দল এই স্লোগানে আস্থা রেখে এগিয়ে যেতে পারে সেই সম্ভাবনাকেও মাথায় রাখা দরকার। বিপ্লবের জন্য এরকম সুযোগ বারবার আসবে না।
–আপনি যে এত গুরুত্ব দিচ্ছেন এই স্লোগানে, আমরাই কি পারব একে রূপ দিতে?
–দেখাই যাক না। চেষ্টা তো করতে হবে।

লেনিনের চেষ্টায় যে কোনও খামতি ছিল না, এক বছরের মধ্যেই বোঝা গেল। আর স্লোগানটাও যে অবাস্তব ছিল না, তিনি যে যুদ্ধের ফলে শাসকশ্রেণির ঘরে বাইরে সঙ্কটের সুযোগ গ্রহণ করে ক্ষমতা দখলের একটা নীল নকশা তৈরি করে ফেলেছেন মনে মনে, তাও তিনি এই সম্মেলনের দুই বছরের মাথায় হাতে কলমে প্রমাণ করে ছাড়লেন।

নাম তো বললাম। কিন্তু এই ইনেসা আর্মান্দা (১৮৭৪-১৯২০)-কে কি আমরা চিনি?

চলুন, এই সুযোগে লেনিনের হাতে গড়া সেই শিষ্য সম্পর্কেও দুচার কথা অন্তত বলে নেওয়া যাক।

ফরাসি পিতামাতার এই সন্তান খুব ছোটবেলায় পিতাকে হারিয়ে বড় হয়েছিলেন মস্কোতে দাদুদিদিমার কাছে। ১৯০৩ সালে তিনি বলশেভিকদের সঙ্গে রাজনীতিতে যোগ দেন এবং আমৃত্যু একজন আপসহীন বিপ্লবী হিসাবে সংগ্রাম করে গেছেন। বহুবার গ্রেপ্তার ও নির্বাসিত হয়েছেন জারের পুলিশের হাতে এবং একাধিকবার নির্বাসনক্ষেত্র থেকে ইউরোপে পালিয়ে গেছেন। সেখানে ১৯০৮ সালে পারি শহরে লেনিনের সঙ্গে তাঁর দেখা হয় এবং তখন থেকে তিনি ইউরোপে বসে লেনিনের নির্দেশে নানারকম কঠিন দায়িত্ব পালন করে গেছেন।

১৯১২ সালে লেনিন যখন কিছু চিঠিপত্র দিয়ে ইনেসাকে রাশিয়ার ভেতরে দলের সঙ্গে যোগাযোগ করতে গোপনে পাঠালেন, দুজনেই জানতেন, এই যাত্রায় অনেক ঝুঁকি আছে। আবার যথারীতি গ্রেপ্তারি শেষে ইউরোপে ফিরে এসে লেনিনের নেতৃত্বে ১৯১৫-১৬ সালে দুটো আন্তর্জাতিক সম্মেলনে নানারকম দায়িত্ব পালনেও তিনি ছিলেন অগ্রণী ভূমিকায়। রুশ, ফরাসি, জার্মান, ইংরাজি, স্প্যানিশ, প্রভৃতি অনেকগুলি ভাষা জানা থাকায় তাঁর পক্ষে এই সব দায়িত্ব পালন সহজ হয়েছিল।

জানা যায়, ৎসিমারহ্বাল্ড সম্মেলনের আগে যে মহিলা এবং যুব সম্মেলন হয়েছিল, যেখানে লেনিন নিজে স্বাভাবিক কারণেই সরাসরি অংশগ্রহণ করতে পারতেন না, বাইরে এক কফি শপে বসে থাকতেন। সেখানে ইনেসা মাঝে মাঝে সম্মেলন সভা থেকে বেরিয়ে এসে তাঁর সঙ্গে দেখা করে পরিস্থিতি জানিয়ে যেতেন এবং পরামর্শ নিয়ে আবার ভেতরে গিয়ে সম্মেলনের কার্যক্রমে যোগ দিতেন।

আর্মান্দার সঙ্গে লেনিনের তীব্র বাদানুবাদ হত। বহু বিষয়েই তাঁরা দুজন একমত হতেন না। বিপ্লবের পরে ব্রেস্ট-লিটভস্ক চুক্তিরও তিনি ছিলেন কট্টর সমালোচক। কিন্তু তাঁর সাহস, নিষ্ঠা, প্রত্যুৎপন্নতা এবং সাংগঠনিক দক্ষতার জন্য লেনিন তাঁকে খুব পছন্দ করতেন। তাঁর গানের জন্যও। পিয়ানোয় তিনি চমৎকার সব সুর ফুটিয়ে তুলতে পারতেন।

১৯২০ সালে ইনেসা আর্মান্দা আকস্মিকভাবে মারা যান। সেই বছরেই তিনি একটা মেয়েদের পত্রিকা বের করতে শুরু করেন— কমিউনিতস্কা। চারটে সংখ্যা বের করার পর পঞ্চম সংখ্যায় তাঁরই স্মৃতি-আলেখ্য প্রকাশিত হয়। আসলে, ১৯১৭ সালের দু দুটো বিপ্লব এবং তারপরের তিন বছরব্যাপী প্রতিবিপ্লবী গৃহযুদ্ধকালীন সময়ে দলের বহুরকম কাজে সাংগঠনিক দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কঠোর পরিশ্রমের ফলে তিনি খুব ক্লান্ত ও অসুস্থ হয়ে পড়েন। তখন সেপ্টেম্বর মাসে কমরেড লেনিন তাঁকে ককেশাসে গিয়ে কিছু দিনের জন্য বিশ্রাম নিতে বলেন। লেনিনের জানা ছিল না, সেখানে তখন ব্যাপকভাবে কলেরা মহামারির আকারে ছড়িয়ে পড়েছিল। সেই সংক্রমণে আর্মান্দাও আক্রান্ত হয়ে পৌঁছনোর একদিন পরেই মৃত্যুমুখে ঢলে পড়েন। তাঁরই পরামর্শে ককেশাস যাওয়ার কারণে লেনিন এই ঘটনায় খুবই মর্মাহত হয়েছিলেন। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, লেনিন যেন একেবারে ভেঙে পড়েছিলেন।

পাঠকদের অনেকেই সম্ভবত জানেন না, ইনেসার সঙ্গে লেনিনের নাম জড়িয়ে পশ্চিমা গণমাধ্যমে কয়েকজন লেখক বেশ একটা রসালো রোম্যান্টিক গল্প বানিয়েছেন এবং তার বাজার কাটতি খুব খারাপ নয়। আমরা বামপন্থীরা এই সব বিপ্লবীদের সম্পর্কে খোঁজখবর না রাখলেও বুর্জোয়া প্রচারযন্ত্র তার কাজ দিব্যি গুছিয়ে করে চলেছে।

 

কিয়েনঠাল সম্মেলন ১৯১৬

একে সেইকালে অনেকে দ্বিতীয় ৎসিমারহ্বাল্ড সম্মেলন বলেও বর্ণনা দিতেন। কিন্তু এই সম্মেলনটির কথা তেমন শোনা যায় না। কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাস সংক্রান্ত বইপত্রে এর কথা বিশেষ কেউ লেখেনি বা লেখে না। সম্ভবত, যুদ্ধের ভয়ঙ্কর ডামাডোলের মধ্যে এই সম্মেলন তেমন সাফল্য না পাওয়ার কারণেই এই অনুল্লেখ বলে আমার ধারণা। কিন্তু লেনিন যে সেদিন বিশ্বযুদ্ধের বিরুদ্ধে কমিউনিস্টদের কতটা জোর দিয়ে সমবেত করতে চেয়েছিলেন, যাতে বুর্জোয়াশ্রেণির সেই পারস্পরিক হিংস্র কামড়াকামড়ির সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন দেশে শ্রমিকশ্রেণির অভ্যুত্থান ও বিপ্লব সংঘঠিত করে ফেলা যায়— তা একটার পর একটা সভা সম্মেলন সংগঠিত করার এই নিরন্তর প্রচেষ্টা থেকেই বোঝা যায়। আমরাও সেদিক থেকেই একে বর্তমান প্রজন্মের মার্ক্সবাদীদের কাছে তুলে ধরার প্রয়োজন অনুভব করছি।

আসলে ৎসিমারহ্বাল্ড সম্মেলনের পর দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের পরিচালক সংস্থা— আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক ব্যুরো— সেই সম্মেলনে অংশগ্রহণকারীদের বিরুদ্ধে ব্যাপক সমালোচনা ও নিন্দার ঝড় বইয়ে দেয়। প্রতিটি দল তাদের মুখপত্রে সেই সম্মেলনের সদস্য দলগুলির নেতাদের বিরুদ্ধে প্রচুর বিষোদ্গার ও কুৎসা করতে শুরু করে। যেহেতু এই দলগুলির প্রচারযন্ত্র তত শক্তিশালী ছিল না, এই সব প্রচার অনেকটা একতরফা হতে থাকে।

রবার্ট গ্রিমকে সভাপতি ও কয়েকজনকে সদস্য করে ৎসিমারহ্বাল্ড সম্মেলন থেকেও একটা আন্তর্জাতিক পরিচালনা সংস্থা গঠন করা হয়। এর নাম ছিল আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক কমিশন। লেনিন একে বার্ন কমিশন বলতেন এবং আড়াইতম আন্তর্জাতিক হিসাবে গণ্য করতেন। এই কমিশন ৎসিমারহ্বাল্ড সম্মেলনের আহ্বান নামে একটা প্রচারপত্র প্রকাশ করে। তাতে সম্মেলনের সাধারণভাবে গৃহীত যুদ্ধবিরোধী সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হয়।

রবার্ট গ্রিম কমিউনিস্ট নন। তিনি সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করেন আর লেনিনকে খুব শ্রদ্ধা করেন।

সেই গ্রিম একদিন কমরেড লেনিনের কাছে এলেন এবং বললেন, এই জঘন্য অপ্রপচারের বিরুদ্ধে আমাদের কিছু একটা করা দরকার। আপনি কী বলেন?

–হ্যাঁ, অবশ্যই কিছু করতে হবে। লেনিন উত্তর দিলেন, এবং দেখতে হবে তা যেন কাজের কাজ হয়। আপনি কমিশনের একটা বর্ধিত সভা ডাকুন। সেখানে আমরা এই বিষয়েই কথা বলি। সকলের মতামত নিই।
–যুদ্ধের মধ্যেই?
–হ্যাঁ, দেখুন না, কত জন আসতে পারে।

এও লেনিনের সাংগঠনিক স্বভাবের একটা অপরিত্যাজ্য বাতিক ছিল। যে কোনও প্রশ্নেই আনুষ্ঠানিকভাবে সভা সমিতি সম্মেলন আহ্বান করে সকলের মত নেওয়া। তিনি জানতেন, এরকম সভা মানেই বিস্তর তর্কবিতর্ক। যার অনেকটাই হয়ত অবান্তর এবং কালক্ষয়ী। ব্যাপক পরিমাণে বাজে কথার হুল্লোর সত্ত্বেও লেনিন চাইতেন, এরকম সভা যত বেশি সংখ্যায় হয়, ততই ভালো। নিছক সমর্থকদের সঙ্গে ঘরে বসে কথা বলে এবং সমর্থন নিয়ে কোনও বড় কাজ করা তিনি পছন্দ করতেন না। তাঁর মতের বিরোধীদের কথাও তিনি মনোযোগ সহ শুনতে চাইতেন। এই সব সভা থেকে নিষ্পন্ন সিদ্ধান্তকেই তিনি যৌথ জ্ঞান বলে অভিহিত করতেন।

গ্রিম ৎসিমারহ্বাল্ড সম্মেলনের সদস্য দলগুলির কাছে একটা সার্কুলার পাঠালেন। তাতে ১৯১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে একটা বর্ধিত সভা আহুত হল। পাঁচ তারিখ থেকে আট অবধি। সেখানে দফায় দফায় আলোচনার পর ঠিক হল, আবার বড় করে একটা সম্মেলন ডাকা হবে। সুইজারল্যান্ডের পার্টির পক্ষ থেকে রবার্ট গ্রিমই দায়িত্ব নিলেন সম্মেলন আয়োজন করার।

এবার সম্মেলনের জায়গা নির্ধারিত হল ব্লুএমলিস-আল্পস পাহাড়ের পাদদেশে কিয়েনঠাল নামক গ্রামে। সম্মেলন চলল সাত দিন ধরে— ২৪ এপ্রিল থেকে ৩০ এপ্রিল। হোটেল ব্যারনের ভোজনকক্ষে এক বিশাল টেবিলের চার পাশে বসে বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা আলোচনা বিতর্ক চালালেন।

759017 01.06.1956 The house where the Kienthal International Socialist Conference was held in 1916. Alexey Bushkin / Sputnik

কারা ছিলেন এই সম্মেলনে?

সার্বিয়ান সোস্যাল ডেমোক্রেটিক দলের তরফে ত্রিশা কাস্লেরোভিচ;
ফরাসি সোস্যালিস্ট পার্টির যুদ্ধ বিরোধী গ্রুপের পক্ষ থেকে পিয়রব্রিজোঁ, জাঁ পিয়র রাফাঁ-দুয়েঁ, আলেক্সান্দ্র ব্লাঁক;
ইতালির সোস্যালিস্ট পার্টি থেকে ওদিনো মরগারি ও আরও ছজন;
পর্তুগিজ সোস্যালিস্ট পার্টির থেকে এদমন্দো পেলুসো;
রাশিয়ার বলশেভিকদের তরফে ভ্লাদিমির লেনিন, গ্রেগরি জিনোভিয়েভ এবং ইনেসা আর্মান্দ;
রাশিয়ার মেনশেভিকদের তরফে জুলিয়াস মার্তভ এবং পাভেল আক্সেলরদ;
পোল্যান্ড থেকে কার্ল রাদেক, মিতসিলাভ ব্রনস্কি, ব্রনিস্লাভ স্তাইন;

এরকম মোট ৪৩ জন প্রতিনিধি।

তালিকা থেকেই মালুম, অন্য দেশের তো বটেই, এমনকি রাশিয়ার ভেতরের মেনশেভিক এবং সোস্যালিস্ট রেভলিউশনারিদের প্রতিনিধিও এই যুদ্ধবিরোধী সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন। সেই ১৯১৬ সালেও মেনশেভিকদের সঙ্গে ওঠাবসা করা যায় না, কিংবা সোশালিস্ট রেভলিউশনারিদের সঙ্গে কোনও কথা নয়— লেনিনের এরকম কোনও ধাতব মনোভাব ছিল না। কিছু কিছু প্রশ্নে তিনি এমনকি মেনশেভিক কমরেড মার্তভের প্রস্তাবকেও সমর্থন জানিয়েছিলেন।

পাক্কা বলশেভিক গ্রেগরি জিনোভিয়েভ লেনিনের কাণ্ড দেখে কিঞ্চিত বিরক্ত হলেন। মেনশেভিকদের এত পাত্তা দেওয়া কেন?

সম্মেলনের এক ফাঁকে কফি বিরতিতে বাইরে বেরিয়ে এসে তিনি সরাসরি জিজ্ঞেস করলেন, কমরেড ইলিচ, আপনি দেখছি এখনও এই মার্তভদের বেশ ভালোমতো বিশ্বাস করেন?

লেনিনের সিধে উত্তর, যতক্ষণ কেউ একেবারে সরাসরি প্রতিবিপ্লবের শিবিরে যোগ না দিচ্ছে, আমি প্রত্যেককেই বিশ্বাস করি। করতে চাই। অবিশ্বাস করে আমাদের নিজেদের ক্যাম্প ছোট করে ফেলে লাভ কী?

–ওরা তো গৃহযুদ্ধ বা বিপ্লব চাইছে না এখন।
–কিন্তু মেনশেভিকরা এখন এই বিশ্বযুদ্ধের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে চাইছে। শান্তির সপক্ষে প্রচার চালাতে আগ্রহ দেখাচ্ছে। বিপ্লব যদি করতে হয়, এটুকুরও প্রয়োজন আছে— আপনি কি তা অস্বীকার করেন?
–তা করি না, গ্রেগরি বলেন, তবে এই দোদুল্যমান শক্তিকে নিয়ে যুদ্ধবিরোধিতাই বলুন, বিপ্লবই বলুন, কদ্দূর যাওয়া যাবে আমার কিন্তু ঘোর সংশয় আছে।

লেনিন হেসে ফেলেন, সংশয়টা আবার ঝেড়ে ফেলে দেবেন না যেন। আমরা এক সঙ্গে পা ফেলতে ফেলতেই কড়া নজর রাখব, এদের কে কখন কী ভূমিকা নিচ্ছে। প্রতিক্রিয়াশীল অবস্থান নিলেই আমাদেরও কঠোর সমালোচনা করতে হবে।

আলোচ্য কিয়েনঠাল সম্মেলন থেকে কমরেড লেনিন সেদিন যে প্রস্তাব গ্রহণ করাতে চেয়েছিলেন, তাতে এক দিকে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের বিরোধিতা ছিল, অন্য দিকে ছিল নিজ নিজ দেশের বুর্জোয়া শাসনের বিরুদ্ধে অস্ত্র ঘুরিয়ে তাক করার আহ্বান। প্রথম অংশটি যতটা ব্যাপক সমর্থন লাভ করেছিল, দ্বিতীয় অংশটি সেই সম্মেলনেও তেমন সমর্থন পায়নি। ফলে গৃহীত চূড়ান্ত প্রস্তাবে শুধুমাত্র যুদ্ধবিরোধিতার স্লোগানই জায়গা পায়। কিন্তু লেনিনের কাছে এর ইতিবাচক দিক ছিল এটা পরিষ্কার হয়ে যাওয়া যে সময়ের ডাকে কে কতটা সাড়া দিচ্ছে এবং কীভাবে এগোচ্ছে। তিনি আর মাত্র কয়েক বছর পরে (১৯১৯) যে তৃতীয় আন্তর্জাতিক সংগঠন গড়ে তুলবেন, তাতে কারা থাকবে না থাকবে, সেই দুই সম্মেলনের বিতর্কে অনেকটাই ঠিক হয়ে গিয়েছিল।

সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতান্ত্রিক সমাজ ভেঙে পড়ার পর আজ কারও মনে হতে পারে, এই সব পুরনো ইতিহাসের ঘটনাবলির অভিলেখ ঘেঁটে কী লাভ। লাভ একটাই: আগামী দিনের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের অভিযানের জন্য শিক্ষা নেওয়া, পাথেয় সংগ্রহ করে রাখা। লেনিন কেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলতে চলতেই জারতন্ত্র এবং বুর্জোয়া শাসনের নিগড় ভেঙে ফেলতে পারলেন, অন্যত্র কোথাও সেই লক্ষ্য কেন সফল হল না, এই সব পুরনো কাসুন্দির মধ্যেই তার উত্তর নিহিত রয়েছে। এই কাসুন্দি ঘেঁটেই আমরা লেনিনের থেকে আমাদের কালের রাস্তাও খুঁজে পাব। যদি বুঝতে পারি। রাস্তাটা এক রকম হবে না। এক তো হবেই না। কিন্তু রাস্তা কীভাবে চিনব, সেই কায়দা হয়ত শিখতে চাইলে চিনে ফেলতেও পারি।


ঋণ: লেনিনের সঙ্গে কিছুক্ষণ থাকতে গিয়ে ৎসিমারহ্বাল্ড সম্মেলনের ব্যাপারে আমি আমার এক অনুজ বন্ধু, শিলিগুড়ি সূর্য সেন মহাবিদ্যালয়ের প্রবীন অধ্যাপক ডঃ বিকাশ রঞ্জন দেব-এর লেখা, সেস্টাসের বাংলা মুখপত্র “প্রেক্ষা”-য় প্রকাশিত একটি প্রবন্ধের সাহায্য নিয়েছি।

চিত্র পরিচিতি:

১। ইনেসা আর্মান্দা;
২। হোটেল ব্যারন, কিয়েনঠাল (সুইজারল্যান্ড);
৩। কিয়েনঠাল সম্মেলনে প্রতিনিধিদের স্বাক্ষর যুক্ত কাগজের এক পৃষ্ঠার একাংশ।