শ্রেষ্ঠ খেলনা

শ্রেষ্ঠ খেলনা -- একটি রুশ উপকথা | তর্জমা: লীলা সরকার

একটি রুশ উপকথা

 

মূল রুশ থেকে তর্জমা: লীলা সরকার

গল্পটিকে বিপ্লবোত্তর সোভিয়েত রাশিয়ার প্রচলিত একটি আধুনিক লোকগাথা বলা যেতে পারে। রাশিয়ায় ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনের নেতৃত্ব যে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল, তার ফলে বদলে গিয়েছিল রাশিয়ার সমাজ। সম্পত্তির ওপর ব্যক্তিমালিকানার অবসান হয়ে সর্বহারার একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এই সমাজভাবনার আদর্শ ছিল, কারও খাওয়া-পরার অভাব থাকবে না, সকলে তাদের সাধ্যমত শ্রম দেবে, রাষ্ট্রনির্মাণে অংশগ্রহণ করবে এবং পরিবর্তে রাষ্ট্র তাদের প্রয়োজন মেটাবে। বিলাসিতা থাকবে না, তবে কোনও মানুষের সুস্থ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনযাপনের জন্য যা প্রয়োজনীয়, তার কোনও অভাব হবে না। রাষ্ট্র ব্যক্তি ও সমষ্টির দায়িত্ব নেবে। ১৯৯১ সালে নানা কারণে দীর্ঘ সাত দশকের এই সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রটির পতন হয়, তা সারা বিশ্বের সাম্যবাদী চেতনায় বিশ্বাসী মানুষের কাছে একটি বিশাল আঘাত। যাই হোক, চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম-এর জুন সংখ্যার প্রচ্ছদ নিবন্ধের বিষয় ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনের দেড়শ বছরের জন্মবার্ষিকী। সেই ভাবনার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বেছে নেওয়া হয়েছে এবারের স্টিম ইঞ্জিন— যা বিপ্লবোত্তর রুশ সমাজের একটি খণ্ডচিত্র, যা বুঝিয়ে দেয় কমরেড লেনিন তাঁর দেশের সাধারণ মানুষদের কী চোখে দেখতেন।

 

একদিন পেত্রোগ্রাদ থেকে একজন শ্রমিক লেনিনের সঙ্গে দেখা করতে এলেন। শ্রমিকটি একজন কমিউনিস্ট, সেইজন্য বিপ্লবের বহু আগে থেকেই লেনিনের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ছিল।

ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন তাঁকে দেখে খুব খুশি হলেন এবং সমাদর করে আরাম-চেয়ারে বসিয়ে তাঁকে নানা বিষয়ে প্রশ্ন করতে লাগলেন— পেত্রোগ্রাদে শ্রমিকদের জীবনযাত্রা কেমন… তাদের কাজকর্মই বা কেমন চলছে… ইত্যাদি। শ্রমিকটি ধীরে ধীরে লেনিনের সবকটা প্রশ্নেরই উত্তর দিলেন। শ্রমিকের কথা শেষ হলে লেনিন তীক্ষ্মদৃষ্টিতে তাঁর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন— “আচ্ছা কমরেড, তোমার কী হয়েছে বলো তো? তোমাকে এত বিমর্ষ দেখাচ্ছে কেন?”

শ্রমিকটি বেশ খানিকক্ষণ চুপ করে রইলেন, তারপরে ধীরে ধীরে বললেন, “জানেন ভ্লাদিমির ইলিচ, আমার স্ত্রী বেঁচে নেই। আমার একমাত্র সম্বল আমার ছেলে। কিন্তু তাকে ভালোভাবে মানুষ করতে পারছি না। আমি বাড়িতে না থাকলে সে নিঃসঙ্গ বোধ করে, আর মনমরা হয়ে থাকে। আশেপাশে তার সমবয়সী বন্ধুও কেউ নেই, যার সঙ্গে একটু খেলাধুলো করতে পারে। আমি যে তাকে কিছু খেলনা কিনে দেব তারও কোনও উপায় নেই, কারণ পেত্রোগ্রাদে খেলনার দোকানের বড়ই অভাব। তাই ছেলেটিকে বাড়িতে ফেলে এলেই ওর নিঃসঙ্গতার কথা মনে পড়ে, আর আমার মন খারাপ হয়ে যায়।”

লেনিন খুব মন দিয়ে শ্রমিকটির কথা শুনছিলেন। ওঁর কথা শেষ হলে জিজ্ঞাসা করলেন— “তোমার ছেলের বয়স কত?”

“সাত বছরে পড়েছে, ভ্লাদিমির ইলিচ”— শ্রমিকটি উত্তর দিলেন।

লেনিনের আরও কিছু জিজ্ঞাসা করবার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তেই তাঁর সেক্রেটারি ঘরে ঢুকে জানাল, লেনিনের মিটিং-এ যাবার সময় হয়েছে। শ্রমিকটি তাড়াতাড়ি উঠে বিদায় নিলেন। পরদিন তিনি পেত্রোগ্রাদে চলে গেলেন, লেনিনের সঙ্গে আর দেখা হল না।

দুমাস কেটে গেল। প্রতি রবিবার শ্রমিকটি রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াতেন খেলনার দোকানের সন্ধানে৷ কিন্তু দেশে তখন গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। কারখানাগুলিতে কাজকর্ম বন্ধ, ফলে সামান্য যে কটি দোকান আছে তাতেও খেলনার অভাব।

এরকমই একদিন ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত ও ব্যর্থমনোরথ শ্রমিকটি বাড়ি ফিরে এলে প্রতিবেশীরা জানাল, “তোমার কাছে একজন সৈনিক এসেছিল, একটা প্যাকেট রেখে গেছে সে।”

তাড়াতাড়ি ঘরে ঢুকে এসে শ্রমিকটি এক নজরে দেখল, তার ছেলেটি ঘরের এককোণায় বসে রয়েছে। বাবাকে বিষণ্ণদৃষ্টিতে দেখে নিয়ে বলল— “আজও আনতে পারোনি?”

শ্রমিক তার কথার কোনও উত্তর না দিয়ে ঘরের এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখলেন, জানালার তাকের উপর একটি প্যাকেট রাখা। প্যাকেটটি তুলে নিয়ে তিনি পড়লেন, লেখা রয়েছে, ‘সোভিয়েত জনগণের কমিসারের প্রতিনিধি কর্তৃক প্রেরিত’। তাড়াতাড়ি প্যাকেটটা খুলে ফেললেন তিনি। একি! নিজের চোখ দুটোকেই যেন বিশ্বাস করতে পারছিলেন না তিনি— প্যাকেটটিতে রয়েছে বাচ্চাদের খেলনা।

“খেলনা! কি মজা! সতিকারের খেলনা! দুনিয়ার সেরা খেলনা!”— ছেলেটি আনন্দে লাফাতে লাগল।

কৃতজ্ঞতায় তার বাবার চোখে তখন জল এসে গিয়েছে। লেনিন এত মহানুভব! দেশের কত সমস্যা, কত কাজ নিয়ে তিনি ব্যস্ত, তবুও তিনি তাঁর মতো একজন সামান্য শ্রমিকের দুঃখের কথা মনে রেখেছেন।

ছেলের দিকে পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে নরম সুরে তিনি বললেন, “হ্যাঁ বাবা, তুমি সত্যি কথাই বলেছ, পৃথিবীর সেরা খেলনাগুলিই তুমি পেয়েছ।”

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4660 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

আপনার মতামত...