বৈপ্লবিক আন্দোলনের জন্য বৈপ্লবিক তত্ত্ব চিরকালই বড় জরুরি

উর্বা চৌধুরী

 


লেখক শিক্ষাকর্মী ও রাজনৈতিক কর্মী

 

 

 

শিক্ষাকে এমন এক উপকরণ বানানোর প্রস্তাব দিয়েছিলেন ভ্লাদিমির লেনিন, যা দিয়ে মানুষ সমাজের প্রেক্ষিতে নিজের শ্রেণিগত অবস্থানকে দৃঢ়ভাবে বুঝে নিতে পারবে। শিক্ষার এমন নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য সম্পর্কে নিশ্চিত হতে বেশ অবাক লাগে। ওঁর নানা সময়ের নানা মৌলিক লেখা বা বক্তৃতা পড়তে পড়তে বারবার প্রশ্ন ওঠে— শিক্ষা ঠিক কোন কাজে ব্যবহার্য বলে সিদ্ধান্ত করেছিলেন? পড়ে মনে হয়, লেনিনের সিদ্ধান্তে শিক্ষা হল এমন এক বুনিয়াদি হাতিয়ার যা আমাদের চেতনাকে শান দেবে, শোষণের শিকল থেকে মুক্তি যে আমাদেরই একান্ত চাওয়া, চাপিয়ে দেওয়া কোনও চাওয়া নয়— সে কথাকে যুক্তি দিয়ে আমাদের চেতনায় প্রতিষ্ঠা করবে, এবং শিক্ষাই সেই যুক্তির জোর যার বলে সেই শিকল কাটার জন্য উদ্যোগী হব আমরাই।

১৯১৮ সালের ২৮শে অগাস্ট বিপ্লবের ঠিক পরপরই রাশিয়ার প্রথম শিক্ষা কংগ্রেসে ভ্লাদিমির এক বক্তৃতায় বলেন— যে বুর্জোয়া রাষ্ট্র যত পরিশীলিত সে রাষ্ট্র তত বেশি ইস্কুলকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করবে। বস্তুত ইস্কুলগুলিকে সেই সব রাষ্ট্র বুর্জোয়াদের শ্রেণিগতভাবে সুবিধাজনক রীতিবিধির যন্ত্রের মতো করে ব্যবহার করার বন্দোবস্ত চালিয়ে এসেছে। ইস্কুলগুলিকে বুর্জোয়া জাতিবোধে টইটম্বুর করে রাখা হয়েছে। পুঁজির মালিকদের নিরন্তর আজ্ঞা মেনে চলার মতো কিছু অনুচর আর যোগ্য কর্মী যোগান দেওয়াই যেন ইস্কুলের লক্ষ্য। যুদ্ধ আমাদের দেখিয়েছে আধুনিক প্রযুক্তির বিস্ময়গুলিকে কেমন করে লক্ষ লক্ষ শ্রমিক খতম করার কাজে ব্যবহার করা যায়, আবার কেমন করে সেই বিস্ময়গুলি দিয়েই পুঁজিপতিরা নিজেদের জন্য বিপুল মুনাফা তৈরি করে ফেলতে পারে, কেমন করে যুদ্ধ বাধিয়ে নিজেদের ভাগ্য গড়ে নিতে পারে। তবে আমরা সত্য দিয়ে মিথ্যাকে নগ্ন করে যুদ্ধকে ধীরে ধীরে নড়বড়ে করে দিতে পেরেছি। শিক্ষা পরিমণ্ডলে আমরা আদতে বুর্জোয়া ব্যবস্থাকে নিকেশ করার কাজ করি। সকলের সামনে আমরা ঘোষণা করছি যে, যে শিক্ষা জীবন ও রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন, সে শিক্ষা সর্বৈব মিথ্যা, কপট। সাবেক বুর্জোয়া সংস্কৃতির উৎকৃষ্ট কোনও প্রতিনিধি যে অন্তর্ঘাত সারতে চায় তার মানে ঠিক কী? এই অন্তর্ঘাত যেকোনও আন্দোলনকারীর চেয়ে, যেকোনও বক্তৃতার চেয়ে আর লক্ষ লক্ষ প্যাম্ফলেটের চেয়েও স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দিতে পারে যে, এই অন্তর্ঘাতীরা শিক্ষাকে নিজেদের সম্পত্তি বানিয়ে রাখতে চায়, ব্যবহার করতে চায় সেই অস্ত্র হিসাবে যা দিয়ে এরা সাধারণ মানুষের উপর কর্তৃত্ব করবে।

এই পর্যন্ত লিখেই হঠাৎ একেবারে হালের এক হকিকতের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। আজকের পৃথিবীটার দিকে তাকালে যা যা দেখতে পাব, তার মধ্যে, নতুন আবিষ্কার না হলেও, নতুন এক কাণ্ডের প্রবণতা বার বার নজর কাড়ছে। অতিমারি পরিস্থিতিতে সরকারি বেসরকারি দুভাবে পরিচালিত ইস্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতেই ইন্টারনেটের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা শিক্ষকের দেওয়া পাঠ গ্রহণ করবে। এ প্রসঙ্গে ভিন্ন ভিন্ন মত উঠে এসেছে বারবার— সবচেয়ে বিশ্লেষিত যে মতটি উঠে এসেছে, তা হল ভারতবর্ষের মতো দরিদ্র মানুষের দেশে এই বন্দোবস্ত শিক্ষার মূল লক্ষ্য যত না ছুঁতে পারবে তার চেয়ে বেশি শিলমোহর লাগিয়ে দেবে দেশগুলিতে চলতে থাকা বিত্তগত ও শ্রেণিগত বৈষম্যকে। আমরা জানতে পারলাম‌ গত সাতদিনে ভারতে সরকারি ইস্কুলে পড়া এক শিশুর মা, সরকারি ইস্কুলে পড়া আরেক চোদ্দ বছর বয়সি শিশু আত্মঘাতী হয়েছে। কারণ, তারা কেউ আধুনিক ফোনসেট কিনতে পারেনি, অনলাইন ক্লাসের সুবিধা পেতে পারেনি, ভয় পেয়েছে সমাজের সুবিধাপ্রাপ্তদের থেকে আরও অনেকটা পিছিয়ে পড়ার।

শিক্ষার মতো নাগরিকের বুনিয়াদি অধিকারকে কেন্দ্র করে একটি দেশে যখন কোনও আইন হয় তখন তা সাধারণত সর্বজনীন শিক্ষার কথাই বলে চলে। ভারতেও তাইই হয়েছে। এদেশের শিক্ষার অধিকার আইন ২০০৯-এর ৫ নম্বর চ্যাপ্টারের দিকে যদি খেয়াল করা যায়, দেখা যাবে তাতে লেখা রয়েছে— শিশুর পাঠক্রম এবং মূল্যায়ন প্রক্রিয়া স্থির করার জন্য সরকারের অধীনে যে একাডেমিক অথরিটিটি তৈরি হবে তাকে নজর রাখতে হবে, পাঠক্রম এবং মূল্যায়ন প্রক্রিয়া যেন দেশের সাংবিধানিক মূল্যবোধের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ হয়, তা যেন শিশুর সার্বিক বিকাশে সাহায্য করে, শিশুর জ্ঞাননির্মাণে, তার মধ্যেকার সম্ভাবনার, প্রতিভার, পূর্ণ শারীরিক ও মানসিক বিকাশে সহায়ক হয়, শিশু যেন হাতেকলমে কাজ করে, আবিষ্কার ও অন্বেষণের মধ্যে দিয়ে শেখে, তার লেখাপড়ার মাধ্যম যেন মুখ্যত মাতৃভাষা হয়, তার শেখার মূল্যায়ন যেন কোনও বিষয়কে তার বুঝতে পারা ও তা প্রয়োগ করার ক্ষমতার নিরন্তর ও সামগ্রিক মূল্যায়নের দ্বারাই হয় এবং শিশু যেন পাঠক্রম ও মূল্যায়ন প্রক্রিয়ার সাহায্যে ভয়মুক্ত, উৎকণ্ঠাহীন, মতপ্রকাশে স্বচ্ছন্দ একজন মানুষ হয়ে উঠতে পারে- আইনের এই অংশটি এমন অনেক “ভাল” কথা বলেছে যা রাষ্ট্রকে সুনিশ্চিত করতে হবে। আবার এই আইনের সিকিটিকেই যদি উল্টে দেখি তাহলে দেখব, বেসরকারি ইস্কুলের ক্ষেত্রে এই “মহতী” আইনটির নব্বই শতাংশই প্রযোজ্য নয়। সরকারি ইস্কুলে ‘শিক্ষা’-র মানে আর বেসরকারি ইস্কুলে ‘শিক্ষা’-র মানে কি তবে ভিন্ন বলে রাষ্ট্রই মেনে নিচ্ছে! এই বৈষম্যেরই কি ফলাফল তবে ওই অনলাইন ক্লাসগুলি! বেশি সুযোগ, বেশি এগিয়ে যাওয়া কি তবে তাদের জন্যই যারা শিক্ষাকে নানাভাবে কিনে উঠতে পারবে? এখন ভারতবর্ষের সরকারি ইস্কুলে যে বাচ্চারা মুখ্যত পড়াশুনা করছে তারা কি তবে অনলাইন ক্লাস কিনে উঠতে পারা বাচ্চাদের সঙ্গে একই ছন্দে এগোবে না? অন্তর্ঘাতীরা কি তবে এভাবেই শিক্ষাকে নিজেদের সম্পত্তি বানিয়ে রাখতে চায়, ব্যবহার করতে চায় সেই অস্ত্র হিসাবে যা দিয়ে এরা সাধারণ মানুষের উপর কর্তৃত্ব করবে। লেনিনের বলা “অন্তর্ঘাত” কি আসলে এমনই?

লেনিন বক্তৃতায় বলছেন— অন্তর্ঘাতীরা শিক্ষাকে ব্যবহার করে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ার কাজকে বারবার বিঘ্নিত করতে চায়, প্রকাশ্যে শ্রমজীবী মানুষের বিপক্ষে দাঁড়ায় তাঁরা।… শ্রমজীবী মানুষ শিক্ষার জন্য তৃষ্ণার্ত, সংগ্রামে জেতার জন্য শিক্ষার হাতিয়ারটি তাদের খুব প্রয়োজন। দশজনের মধ্যে নজনই জেনেছেন যে, জ্ঞান তাঁদের মুক্তির সংগ্রামের হাতিয়ার, শিক্ষার অভাবই তাঁদের যাবতীয় ব্যর্থতার মূলে। তাঁদেরই কাজ হবে সকলের জন্য শিক্ষালাভের পথ খুলে দেওয়া। এই কাজ আমরা এখন দৃঢ়নিশ্চয় হয়ে করতে পারব, কারণ মানুষ নিজে হাতে এই নতুন, সমাজতান্ত্রিক রাশিয়া গড়েছে। নিজেদের অভিজ্ঞতা, ব্যর্থতা, ত্রুটি থেকে শিখছে মানুষ। তাঁরা দেখেছেন সংগ্রামে জিতে যেতে শিক্ষা কতটা অপরিহার্য হয়ে দাঁড়ায়। প্রতিষ্ঠানগুলি ভেঙে পড়া সত্ত্বেও, অন্তর্ঘাতী বুদ্ধিজীবীদের আপাত জয় সত্ত্বেও সংগ্রাম মানুষকে শিখিয়েছে যে, ভাগ্য তাঁদের নিজের হাতে তুলে নিতেই হবে। মানুষের প্রতি যাঁরা প্রকৃতই দরদি, সবচেয়ে ভাল শিক্ষক যাঁরা, তাঁরা যদি এগিয়ে আসেন, সমাজতান্ত্রিক জয় তবেই সুনিশ্চিত হবে।

কলকাতা শহরের একটি চমৎকার ঘটনা এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করি— বছর খানেক আগে এক গুচ্ছ কিশোর কিশোরী সদ্য সরকারি আবাসিক ইস্কুল থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষা দেয়। এর পর একটি ব্যাগ তৈরির কোম্পানি ওদের প্রশিক্ষণের সুযোগ দিতে চায়, তবে এটি কোনও সরকারি উদ্যোগ ছিল না। এভাবে মাস দুয়েকের প্রশিক্ষণের শেষে কোম্পানির কর্ণধার এই কিশোর কিশোরীদের সেই কোম্পানিতেই কাজ করার প্রস্তাব দেন। বিস্ময়ের কথা হল “মেঘ না চাইতে জল”-এর মতো রোজগারের এমন প্রস্তাব ওই দলের প্রত্যেকে একসঙ্গে প্রত্যাখ্যান করে, একসঙ্গে বলে “আমরা আরো একটু পড়তে চাই, অন্তত কলেজটুকু পাশ করি?” সেই সময় দেখার সুযোগ হয়েছিল কোম্পানির মালিকের আর সেই কিশোরকিশোরীদের দৃষ্টিকোণের দ্বন্দ্ব। মালিক বোঝাচ্ছেন “কাজ না করলে খাবি কী? এত পড়াশুনা করে লাভ কী?” কিশোরকিশোরীরা বলে “রোজগার করব, আরেকটু পড়ি, আমাদের পড়তে ভাল লাগছে।” মালিক রেগে গিয়ে বলেন “এই জন্য এদের জন্য কিছু করতে নেই, আমার ট্রেনিং-এর সব পয়সা জলে গেল।“ কিশোরকিশোরীরা একই কথা বলে চলে “রোজগার করব, আরেকটু পড়ি, আমাদের পড়তে ভাল লাগছে।” শেষতক সেই মালিক হাল ছাড়েন। শিক্ষা যে কেবল রোজগারের প্রাগায়োজন নয়, নিজের শ্রেণিগত অবস্থানকে খুঁটিয়ে চিনে নেওয়ার, শ্রেণিগত বঞ্চনার শিকল কাটার সহযোগী উপকরণই যে শিক্ষা, সেই দর্শনকে সহজে পুঁজির মালিক প্রতিষ্ঠা হতে দেবে না— এ কথা আমরা বুঝেছি, সংগ্রাম তো সেই শোষণের বিরুদ্ধেই।

আবাসিক ইস্কুলের এই কিশোরকিশোরীরা মূলত কলকাতার সবচেয়ে উৎপীড়িত অংশ থেকে আসা। শিশুশ্রমে নিযুক্ত থাকা, ভিক্ষাবৃত্তিতে যুক্ত থাকা, খেতে না পাওয়া এই বাচ্চারা যখন ইস্কুলে প্রথম আসে তখন মূল জটিলতা তৈরি হত এদের স্কুলছুট হওয়ার প্রবণতাকে কেন্দ্র করে। শিক্ষা যেন এদের কাছে ছিল এক বায়বীয় উপকরণ, যা হোমেও লাগে না যজ্ঞেও না। ঘটনাটি চমৎকার লাগল এখানেই— তারা হয়তো কোনওভাবে দেখেছে সংগ্রামে জিতে যেতে শিক্ষা অপরিহার্য হয়ে দাঁড়ায়। শিক্ষার অভাবই হয়তো তাদের যাবতীয় ব্যর্থতার মূলে! নিশ্চিত করে, জরিপ করে বলতে পারি না যে, শিক্ষা তাদের চেতনাকে কতটা নাড়া দেয়, তবে কিছু বাচ্চা তো বলেছিল— আমরা কিচ্ছু জানতাম না, এখন কত কী জানি, আরো জানতে ইচ্ছা করে, রোজগার তো করবই, আরেকটু পড়ি। রাষ্ট্রের প্রবণতা যে বিদ্যালয় শিক্ষাকে সাত তাড়াতাড়ি “পেশাদারি শিক্ষা”-র দিকে ঠেলে দেওয়া, তা আমরা বারবার দেখে ২০১৯ সালের ভারতের নতুন জাতীয় শিক্ষানীতির ফিকিরও তেমনই, লক্ষ্য কেবলই শ্রমজীবীকে “শিক্ষিত কর্মচারি” বানানো। শিক্ষার মধ্যে দিয়ে সচেতন শ্রমজীবী তৈরি হয়ে ওঠার বিপদ অনেক— উৎপাদন ব্যবস্থায় পুঁজির মালিকের পুঁজি যে শ্রমিকের শ্রমশক্তির থেকে অধিক দড় নয়, মুনাফার সিংহভাগ যে মালিকের হকের নয়— ন্যায্যতার এত সব গূঢ় সত্য জানায় তো শিক্ষাই!

শিক্ষা প্রসঙ্গে আলোচনায় বিপ্লব পরবর্তী সোভিয়েত ইউনিয়নে শিক্ষানীতি কেমন ছিল তা নিয়ে আগ্রহ থেকেই যায়। বিপ্লবের আগে রাশিয়ায় লক্ষ লক্ষ শিশুর ইস্কুলে যাওয়ার পরিস্থিতিই ছিল না। সে সময় বহু বিদগ্ধজন হলফ করে বলতেন, সব শিশুই লেখাপড়া করতে চায় এমন নয়, সবাই পাঠ্যসূচিমাফিক ইস্কুলের পাঠ নিতে সক্ষম নয়। এই দুরভিসন্ধিপূর্ণ সিদ্ধান্তকে ভেঙেছিল বিপ্লব পরবর্তী সোভিয়েত রাষ্ট্র। দাবী করেছিল, প্রতিটি মানুষের শিক্ষিত হয়ে ওঠার নিজস্ব ও বিশেষ প্রবণতা আছে, সমাজের ও ইস্কুলের কাজ হল সেই নিজস্বতা ও বিশেষত্বগুলিকে খুঁজে বার করে প্রত্যেকজনের শিক্ষালাভের উপায় তৈরি করা।

বিপ্লবের পরবর্তীতে সোভিয়েত সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১২১-এ বলা হয়েছে— ইউএসএসআর-এর নাগরিকদের শিক্ষার অধিকার হবে সুরক্ষিত। সর্বজনীন, বাধ্যতামূলক, বুনিয়াদি শিক্ষার দ্বারা এই অধিকার নিশ্চিত করা হবে। অবৈতনিক উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা থাকবে, উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অসংখ্য ছাত্র-ছাত্রীর রাষ্ট্রীয় উপবৃত্তি প্রদান করা হবে। স্কুলশিক্ষার ভাষাগত মাধ্যম হবে স্থানীয় মাতৃভাষা। অবৈতনিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় খামার, ট্রাক্টর স্টেশন এবং যৌথ খামারে কর্মরতদের বৃত্তিগত, প্রযুক্তিগত ও কৃষি সংক্রান্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করা হবে।

আট থেকে পনেরো বছর অবধি স্কুলশিক্ষা ছিল বাধ্যতামূলক। পনেরো বছর পর্যন্ত স্কুলজীবন শেষ করে আগ্রহীরা উচ্চশিক্ষার পথ বেছে নিতে পারতেন। বিপ্লব পরবর্তী সময়ে স্কুলশিক্ষা নিয়ে ভ্লাদিমির লেনিন বলেছিলেন – জীবনের ঝড়গুলি থেকে গা বাঁচিয়ে, কেবলমাত্র ইস্কুলের গণ্ডিতে আটকে থাকা শিক্ষা বা দীক্ষায় আমরা বিশ্বাসী নই।… আমাদের ইস্কুল থেকে মানুষ জ্ঞানের মূল সূত্রকে খুঁজে পাবে, তাদের মধ্যে স্বাধীনভাবে সাম্যবাদী মতবাদ গড়ে তোলার ক্ষমতা তৈরি হবে। ইস্কুলের শিক্ষার সঙ্গে উৎপাদনশীল শ্রমের যুথবদ্ধতায় গড়ে ওঠা ভবিষ্যত নিয়ে কল্পনা করতে শিখিয়েছিলেন ভ্লাদিমির।

কারখানায় চলা ইস্কুল, পেশাগত শিক্ষার একাডেমি, বিশ্ববিদ্যালয়, বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিশেষ আগ্রহ তৈরি হয় এসময়ের প্রাক-স্কুল শিক্ষার বন্দোবস্তটি সম্পর্কে পড়তে গিয়ে। সোভিয়েতের সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জীবনদৃষ্টিতে শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরই তাকে সমাজের সম্পদের মতো করে দেখা হত, তাই শিশু কেবল পরিবারের দায়িত্ব নয়, দায়িত্ব ছিল সমাজের, রাষ্ট্রের। মূলত কারখানা, যৌথখামারের মতো বিভিন্ন কর্মস্থল ও কিছু বাসাকে কেন্দ্র করে শিশুদের জন্য অসংখ্য ক্রেশ তৈরি হয়। কেবল বাবা-মা নন, বিভিন্ন কারখানার বিভাগ, ট্রেড ইউনিয়নের কমিটি, স্বাস্থ্য-দপ্তর এই ক্রেশগুলি সুষ্ঠুভাবে চালানোর কর্তব্য পালন করত। কেবল শিশুর বেড়ে ওঠায় ক্রেশগুলি সফল হয়নি, এই ক্রেশগুলির কারণে নির্দ্বিধায় সোভিয়েতের মহিলারা কাজে যেতেন। চমৎকার লাগে ভেবে যে, ঘরের বাইরের পৃথিবীতে পা রেখে নারীদের কর্মজীবী হয়ে বাঁচার প্রত্যয়ের জন্য, স্বাধীনতার জন্য একটি রাষ্ট্রের কত যত্নশীল হওয়া প্রয়োজন, কত দূর ভাবা উচিত, কত কর্তব্য পালন করতে সে বাধ্য, তা আজ থেকে একশ বছর আগে দেখিয়েছিল সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন।

ভ্লাদিমির লেনিনের লেখাগুলি বা বক্তৃতাগুলি পড়তে, বিপ্লব পরবর্তী সোভিয়েতকে জানতে অবসরে বেশ স্বস্তি হয়। কিন্তু সবচেয়ে স্বস্তি হয় তখন, যখন অন্ধগলি পার করার সময় ওঁর কথাগুলি আমাদের মতো শ্রমজীবী মানুষের হাতে হাত রাখে। বুঝে উঠতে পারি, কোনও রোমান্টিক স্বপ্ন নয়, ন্যায্যতা আর শ্রেণি সংহতির সেরা যুক্তির কথা বলেছিলেন ভ্লাদিমির লেনিন।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4648 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...