Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

দ্বিতীয় চেতনার নির্বাসনে

দ্বিতীয় চেতনার নির্বাসনে -- দেবেশ রায়

দেবেশ রায়

 

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ২০১-এ পা রাখলেন। তাও তাঁকে জানার-চেনার এখনও কত বাকি। এমত সময়ে আমাদের চোখে পড়ল দেবেশ রায়-এর 'দ্বিতীয় চেতনার নির্বাসনে' প্রবন্ধটি। ঈশ্বরচন্দ্রের কাজের নানা অভিমুখ নিয়ে তর্ক তুলেছেন দেবেশ, যা তাঁর দেখার অভিনবত্বে নতুন হয়ে ওঠে। 'এবং মুশায়েরা' প্রকাশিত দেবেশ রায়ের প্রবন্ধ সংগ্রহ (জানুয়ারি ২০১৮) থেকে প্রবন্ধটির তৃতীয় অংশ তুলে আনা হল চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম-এর এ মাসের স্টিম ইঞ্জিন বিভাগের জন্য।

সমাজসংস্কারে বিদ্যাসাগর বিবাহ ব্যবস্থাটাকেই তাঁর প্রধান বিষয় হিশেবে বেছে নিলেন, তার কারণ সেখানেই পরিবার জীবনের কেন্দ্র। বিধবাবিবাহের পক্ষে দুটি আর বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহের বিরুদ্ধে তাঁর তিনটি পুস্তিকার প্রধান যুক্তিই ছিল বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহের ফলে বিধবার সংখ্যা বেড়ে যায়, স্বামীস্ত্রীসন্তানের পারিবারিক সংগঠন তৈরি-ই হতে পারেনা- আর তারই ফলে সামাজিক বিন্যাসের গুণগত পরিবর্তন ঘটে যাচ্ছে৷ বিদ্যাসাগরের সমাজসংস্কারের কর্মসূচি কোন কোন নির্দিষ্ট ব্যবস্থার সংস্কারমাত্র এমন ভুল তখনো এখনো অনেকেই করেছেন৷ বিধবা রমণীদের দুঃখবেদনায় তিনি আন্দোলিত হয়ে থাকতে পারেন, তাঁর অপার মনুষ্যত্ব সেই দুঃখবেদনার কারণ দূর করে দেবার আকাঙ্ক্ষায় চঞ্চল হয়ে থাকবে– তবে শুধুমাত্র এই একটি প্রথার বিলোপমাত্র তাঁর উদ্দেশ্য কখনোই ছিল না। তাই ‘বাল্যবিবাহের দোষ’ সম্পর্কে প্রচার পুস্তিকা থেকে বিধবাবিবাহ আন্দোলনের ভেতর দিয়ে বহুবিবাহ সম্পর্কিত আন্দোলন পর্যন্ত প্রসারিত দুইটি দশক ধরে সমাজবিধানের শাস্ত্রে নতুন ব্যাখ্যা উপস্থাপনে তাঁর প্রয়াসের অনালস্য৷

বিদ্যাসাগরের উদ্যোগের পক্ষে প্রধানতম ছিল তাঁর সহমর্মিতাবোধ, শাস্ত্র সেখানে উপায় মাত্র– এমন একটি ভাগ দীর্ঘকাল করা হয়ে আসছে। বালিকা সন্তানের বৈধব্যে কাতর ঢাকার রাজা রাজবল্লভ ত বিদ্যাসাগরের শতাধিক বছর আগে বিধবাবিবাহের শাস্ত্রীয় অনুমোদন পেয়েও প্রথাটি প্রবর্তন করতে পারেননি। ১৮৩৭ সাল নাগাদ ব্রাহ্মসমাজের নেতৃত্বে বিধবাবিবাহের পক্ষে খবরের কাগজে ও সভাসমিতিতে জোর আলোচনা চালানো হচ্ছিল, — ওই সময়ই বোম্বাই সরকার ত একটা কমিটি বসিয়েছিলেন বিধবাবিবাহ সম্পর্কে কর্মচারী ও পণ্ডিতদের মত যাচাইয়ের উদ্দেশ্যে। ১৮৩৯ সালে সোসাইটি ফর অ্যাকুইজিশন অব জেনারেল নলেজ-এর সভায় মহেশচন্দ্র দেব বিধবাবিবাহের পক্ষে ও বহুবিবাহের বিপক্ষে ইংরেজিতে যে-বক্তৃতা করেছিলেন, শ্রীগৌতম চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত, ‘অ্যাওকেনিং ইন বেঙ্গল’ প্রথম খণ্ডের ভূমিকায় তার অংশবিশেষ পড়লেও (পৃষ্ঠা, ভূমিকা ৩৫), এর প্রায় ষোল বছর পর লেখা বিধবাবিবাহ সম্পর্কিত বিদ্যাসাগরের প্রথম পুস্তকের শেষাংশ মনে পড়ে যায়– দুজনের ভাবনাচিন্তা বলা-কওয়ার এতই মিল।

তবু যে ইয়ং বেঙ্গল বা তরুণ ব্রাহ্মসমাজ বা বোম্বাই সরকার বা রাজা রাজবল্লভ, এরা নন, বিদ্যাসাগরই বিধবাবিবাহ আন্দোলনের নেতা তার কারণ অন্যরা সবাই যখন এটাকে একটা সংস্কারযোগ্য প্রথামাত্র ভাবছেন, বিদ্যাসাগর তখন এটাকে নিয়েছিলেন সমাজসংস্থিতি ফিরিয়ে আনার একটা উপায় হিশেবে।

আর এখানেই তাঁর ব্রাহ্মণত্বের সক্রিয়তা,– সমাজের অন্ধতার সামনে। মনুষ্যত্বের প্রবর্তনা যাঁর ভেতরে এত প্রবল যে প্রবাসী বাঙালি কবি আর কোন উন্মাদরোগগ্রস্তা উভয়েরই সেখানে আশ্রয় মিলে যায় সমমর্যাদায়– বিধবাদের পুনর্বিবাহের বিধি খোঁজার জন্য সংস্কৃত কলেজের গ্রন্থাগারে রাত্রিযাপনের ব্যবস্থা করার কোন প্রয়োজন তাঁর ছিল না৷ বা বহুবিবাহপ্রথা ক্রমে ক্রমে অচলিত হয়ে আসছে– এমন যুক্তি খণ্ডন করার জন্য গ্রামে গ্রামে সার্ভে করে ঘোরার দরকারও পড়ত না তাঁর।

সংস্কৃতশাস্ত্রে পারঙ্গম বিদ্যাসাগরের ব্রাহ্মণত্বের সম্মুখে এটাই ছিল সেদিনের কর্তব্য– লোকাচারকে অপ্রমাণ করে শাস্ত্রাচারকে পুনরুদ্ধার করা। তাই বিধবাবিবাহবিষয়ক পুস্তকের প্রথমাংশ তাঁকে ব্যয় করতে হয় ধর্মশাস্ত্র কাকে বলে ও ধর্মশাস্ত্রকার কারা– এই সংজ্ঞা নির্ধারণে। শুধু তাই নয়, কোন শাস্ত্র কোন যুগে প্রযোজ্য এও তাঁর আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠ, না হলে পরাশরসংহিতার বিধানটিকে সামাজিকতায় স্থাপন করা যায় না বলে। বিধবাবিবাহের শাস্ত্রীয়তা প্রতিপাদনের অন্যতম প্রধান অবলম্বন হয়ে ওঠে পুনর্বিবাহিতা বিধবার পুত্রের পিতৃসম্পত্তি অধিকারে বৈধতা প্রমাণ। তাই প্রসঙ্গত হিন্দুশাস্ত্রের সম্পত্তিবিধানের গ্রন্থগুলিও আলোচনায় এসে যায়– এমন-কি দত্তক-মীমাংসাও। যদিও সরাসরি কোথাও বলেননি, তবু কি বিদ্যাসাগর ধনসম্পত্তির সঙ্গে এই সামাজিক প্রথার সম্পর্কটি কোন এক ভাবে দেখতে পেয়েছিলেন।

বিধবাবিবাহ বিষয়ক দ্বিতীয় পুস্তকের আয়তন যে এত বেড়ে যায় তার একমাত্র কারণ ত এই যে তিনি কোন শাস্ত্রীয় আপত্তি-ই আলোচনা থেকে বাদ দিতে চান নি। তাই বিধবাবিবাহের বিষয়টি শাস্ত্রের পুনর্বিচারের এমন একটি বিপ্লবী উপলক্ষ হয়ে উঠতে পারে। বোম্বাই সরকারের কমিশন, ইয়ংবেঙ্গলের ভাষণ বা তরুণ ব্রাহ্মদের প্রস্তাব যে কার্যকর হতে পারে নি তার কারণ এই সবগুলিই ছিল শাস্ত্রবিধিরক্ষিত ব্যুহমধ্য হিন্দুসমাজের ওপর বাইরে থেকে আঘাত। সহস্র বর্ষের দক্ষ অনড়তা এ-সমাজের বাইরের আবরণটিকে শক্ত ও পিচ্ছিল করে ফেলেছিল যে বাইরের সেই আঘাতগুলি কোন লক্ষে সংহত হতে পারছিল না।

কিন্তু বিদ্যাসাগরের আঘাত ছিল ভিতর থেকে।

হিন্দু সমাজের মানুষ হিশেবে, শাস্ত্রাধিকারী ব্রাহ্মণের পূর্ণ মর্যাদা নিয়ে– এই ব্রাহ্মণ নতুন ব্যাখ্যায় শাস্ত্রকে উপস্থিত করেছেন, সমাজের নতুন সংস্থানের জন্য।

বিদ্যাসাগরের সংস্কারের লক্ষে তাই তথাকথিত শাস্ত্রশাসিত এই হিন্দুসমাজ। বহুবিবাহবিরোধী পুস্তিকায় তিনি ব্রাহ্মণসমাজের কৌলীন্য প্রথার ইতিহাস উদঘাটন করেন– তার অশাস্ত্রীয়তা প্রমাণ করতে। কায়স্থসমাজের প্রচলিত আচারও তিনি বিচারে আনেন। ফলে ব্যাপারটা দাঁড়ায় যে এই নতুন ব্রাহ্মণ শাস্ত্রেরই বিধান দিয়ে যান, দুর্ভাগ্যবশত লোকাচারের সঙ্গে সে বিধানের মৌলিক বিরোধিতা। রামমোহনের বেদান্ত আবিষ্কারে প্রাচীন ভারতের গৌরবের দিকে চোখ ফিরেছিল আমাদের। কিন্তু বেদান্তের ধ্যান ত বাঙালি হিন্দুসমাজের আচারে ছিল না। বিদ্যাসাগর বাঙালি হিন্দুসমাজের হিন্দুতা আর সামাজিকতাকে স্বীকার করে নিয়ে তাকে শাস্ত্রের ভিত্তি, স্মৃতি ও শ্রুতির নববিধান দিতে চেয়েছিলেন, হিন্দুসমাজবিন্যাসে ব্রাহ্মণের যে অধিকার, তা প্রয়োগ করেছিলেন৷ বহুবিবাহ বিষয়ক প্রথম পুস্তকে এ-অধিকার ত ঘোষণাই করেন-

কৌলীন্যমর্যাদা ব্যবস্থাপনের পর, ১০ পুরুষ গত হইলে দেবীবর ঘটকবিশারদ কুলীনদিগের মেলবন্ধন করেন।… যে যে কুলীন একবিধ দোষে দূষিত, দেবীবর তাহাদিগকে এক সম্প্রদায়ে নিবিষ্ট করেন। সেই সম্প্রদায়ের নাম মেল।  মেল শব্দের অর্থ দোষমেলন অর্থাৎ দোষ অনুসারে সম্প্রদায় বন্ধন।… কৌলীন্যমর্যাদা ব্যবস্থাপনের পর, দশপুরুষ অতীত হইয়াছে; এবং কুলীনদিগের মধ্যে নানা বিশৃঙখলাও ঘটিয়াছে। সুতরাং কোন নতুন প্রণালী সংস্থাপনের সময় উপস্থিত হইয়াছে। প্রথমতঃ ব্রাহ্মণদিগের মধ্যে বিশৃঙখলা উপস্থিত দেখিয়া বল্লালসেন, উহা নিবারণের অভিপ্রায়ে, কৌলীন্যমর্যাদার সংস্থাপন করেন৷ তৎপরে, কুলীনদিগের মধ্যে বিশৃঙখলা উপস্থিত দেখিয়া, দেবীবর উহা নিবারণের আশায়, মেলবন্ধন করেন। এক্ষণে, কুলীনদিগের মধ্যে অশেষবিধি বিশৃঙখলা উপস্থিত হইয়াছে, অমূলক কুলাভিমান পরিত্যাগ ভিন্ন, উহা নিবারণের আর কোন উপায় নাই।

বিদ্যাসাগর নিজের জন্য দেবীবরের উত্তরাধিকারটিই বেছে নেন যাতে তাঁর সংস্কার প্রস্তাব হিন্দুস্মৃতি শাস্ত্রধারার অন্তর্গত থেকে যায়। হিন্দুরক্ষণশীলতাকে তিনিই যে কঠিনতম আঘাত হেনেছিলেন তার কারণ তিনিই ছিলেন সে সমাজের সন্নিহিত, যেখান থেকে আঘাতটি হয়ে উঠতে পারে সবচেয়ে পরাক্রান্ত। তাই বিদ্যাসাগরের বিতণ্ডা-পুস্তিকাগুলিতে উল্লেখও থাকে না ইংরেজ আগমনের ফলে পরিবর্তিত অবস্থার অথচ বাত বার শাস্ত্র থেকে আসে উদ্ধৃতি বা প্রচলিত বিধানের নতুন ব্যাখ্যা। ব্রাহ্মণ হিশেবে সমাজ তাঁকে যে অধিকার দিয়েছিল তিনি সেই অধিকার ব্যবহার করেছিলেন, এক মুহূর্তের জন্য সে অধিকার ছাড়েননি।

সংস্কৃত কলেজে শিক্ষিত ও সংস্কৃতব্যবসায়ী হিন্দুব্রাহ্মণ সমাজের সামাজিক ভূমিকা উনিশ শতকের ইতিহাসে পুনর্বিচারের বিষয়৷ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশিত ১৭৫৭ থেকে ১৯০৫ সালের হিস্ট্রি অফ বেঙ্গল (শ্রীনরেন্দ্রকৃষ্ণ সিংহ সম্পাদিত) গ্রন্থে শ্রী রমেশচন্দ্র মিত্র মহাশয় ১৮৪৪ থেকে ১৮৬৪-র শিক্ষার ইতিহাস সম্বন্ধে আলোচনায় একবাত উল্লেখ করেছেন এই পুনির্বিচারের প্রয়োজন। প্রথম বাংলা অভিধানের প্রণেতা রামচন্দ্র তর্কবাগীশ বিদ্যাসাগররেও পূর্বে বিধবাবিবাহের শাস্ত্রানুমোদন আবিষ্কারক। সংস্কৃত কলেজের ছাত্র শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্ন প্রথম বিধবাবিবাহ করেছিলেন। প্রথম বাংলা সংবাদপত্র সমাচার দর্পণের পেছনে ছিল পণ্ডিত জয়গোপাল তর্কালঙ্কারের মেহনত। প্রাণকৃষ্ণ বিদ্যাসাগর, জয়নারায়ণ তর্কপঞ্চানন, ভূদেব মুখোপাধ্যায়, বিহারীলাল চক্রবর্তী, তারানাথ তর্কবাচস্পতি, দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণ, শিবনাথ শাস্ত্রী, রামনারায়ণ তর্করত্ন– এই কীর্তিমানদের তালিকায় আর একবার অনুতাপের কারণ ঘটে যে রেনাসাঁসের প্রাণপ্রবাহ হিন্দুসমাজের ভেতরের অংশটিতে কী আলোড়ন এনেছিল তা এখনো আলোচনা হয় নি।

তবু, এতেই ত আরো সাক্ষ্য জুটে যায় যে হিন্দুব্রাহ্মণসমাজের একটা নিজস্ব পদ্ধতি ছিল সামাজিক আন্দোলনে গিয়ে মেশার। বিদ্যাসাগরে সেই পদ্ধতির শ্রেষ্ঠ প্রকাশ। কিন্তু তবু তিনি হিন্দুব্রাহ্মণসমাজের প্রতিনিধি নন। তাঁর চরিত্রের আধার হিশেবে কাজ করেছে পারিবারিক সূত্রে পাওয়া ও সংস্কৃত কলেজে লালিত এই ধারাটি। আর সেই কারণেই সামাজিক জীবনের কেন্দ্র সংস্থাপনের উদ্দেশ্যে সামাজিক সংস্কার সাধনের জন্য শাস্ত্রের নতুন ব্যাখ্যার বনিয়াদে তৈরি বিতণ্ডাপুস্তিকার আধারে সৃষ্টি হয়ে যায় বাংলা গদ্য ভাষা। ফোর্ট উইলিয়ামের চেষ্টায় গদ্য কিন্তু ঐতিহাসিক অর্থে জন্মলাভ করেও বাস্তবঅর্থে স্বীকৃতি পায় না– এই সামাজিক অন্বয়ের অভাবে।

 


*বানান অপরিবর্তিত