Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

অন্তেবাসী — ২০তম পর্ব

পীযূষ ভট্টাচার্য

 

পূর্ব প্রকাশিতের পর

গির্জার ক্রুশচিহ্নের ওপর একটা পাখি যে জীবনের উড়ান ভুলে ঠায় ভিজে চলছে…

এরকম এক পংক্তিতে আগের পর্বটি শেষ হয়েছিল। মাঝখানে বেশ কয়েক মাসের ব্যবধান ঘটে গেছে। এই ব্যবধান নিঃসঙ্গ করেছে নিজেকে। সে-সময়ে মাঝেমধ্যেই মনে হত পৃথিবী যেন হিমাঙ্কের নীচে পৌঁছে বরফের খণ্ড হয়ে ক্রমশ পরিবর্তিত হয়ে উঠছে নিরেট বরফের পাষাণে। জল কোথাও নেই তাই বরফের ভেসে ওঠার কোনও সম্ভাবনা নেই— আর এসব ঘটে ধীর অতি ধীর গতিতে আর আমি বসে থাকি যে-কোনও মানুষের মতন সেই পাখিটির দৃষ্টি এড়িয়ে বাঁচতে। শেষাবধি একটা দিনের শেষে মনে হয় পাখিটির নজর এড়াতে পারিনি।

তখনই মনে হয় মনুষ্যত্বের গুরুভার থেকে কোথাও উড়ে চলে যাই। কোনও স্বপ্নের কথা বলছি না আমি, বলতে চাইছি যুক্তিহীনতায় আশ্রয় খুঁজতে পালিয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু তা না হয়ে বর্তমান বা ভবিষ্যতের বাস্তবতার মধ্যে পাখির বসে থাকার ভঙ্গির ছায়া পড়ে একসময়। তখন বাধ্য হই— এ হচ্ছে অতীত এবং অতীত বলেই সম্বোধন করতে হয় কেননা যাত্রাপথ সতত পরিবর্তনশীল।

এটা কোনও প্রাককথন বা উত্তরকথন নয়। এই কথনটি মূলত অভ্যন্তরীণ হওয়া সত্ত্বেও কেন জানি মনে হচ্ছে বরফে পরিণত হওয়া, কি মৃত্যুতে পৌঁছে যাওয়া। পিছন ফিরলেই তো কাঞ্চনজঙ্ঘা, হিমশৈলতার হাতছানি। ঋতুর কোনও পরিবর্তন ঠিকমতন বোঝা যাচ্ছে না এইমুহূর্তে। ক্রমাগত একইরকমের আবহাওয়ার জন্য এক অসহায়তা বোধ। তার মধ্যে বিরক্তি প্রকাশ পায় না— বরং সৃষ্টি হয় বহমান এমন একটা সময় যেখানে শুধুমাত্র বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়।

পাখি কিন্তু এসবের মধ্যে হিমশৈলতায় হিমালয়ের সংলগ্ন হতে চাইছে। এখানে যেন প্রাসঙ্গিকতা খুঁজতে চাওয়াটা বড্ড মূর্খামির কাজ।

দার্জিলিঙে বসে থাকা পাখিকে জীবনে কোনওদিন দেখিনি। পাখি কি ক্রুশের ওপরে বসে নিজের অজান্তে ক্রুশবিদ্ধ হয়ে গেছে কিনা জানি না। এতদিন পরেও হঠাৎ কোনও পাখি সামনে দিয়ে উড়ে চলে গেলে থমকে দাঁড়িয়ে চিনবার চেষ্টা করি গির্জায় ক্রুশচিহ্নের ওপর বসে থাকা সেই পাখি কি উড়ে গেল! পাখাসটে অতিক্রমণের হিসেবনিকেশ কোনওদিনই করা হয়নি— পথের একটা দূরত্ব কেবল জানি মাত্র। আকাশপথে উড়ে যাওয়ার দূরত্ব, নক্ষত্র-আলোকের জটিল হিসেব না-জানা সত্ত্বেও কেবল মনে হয়— পাখির এই উড়ানের ভঙ্গি কেবলমাত্র অনঙ্গ পাখিদেরই থাকে।

গির্জার প্রার্থনাঘরের মাথাতে ক্রুশচিহ্নের ওপরে যে বৃষ্টি-ভেজা পাখি বসেছিল, ফেরার পথে একবারও তাকে পিছন ফিরে দেখা হয়নি। সেদিনই কি বুঝতে পেরেছিলাম অচিন এক বাস্তবতার কথা। এখনও নিজেকে বুঝিয়ে উঠতে অক্ষম— অতীতের মধ্যে যে কল্পনা থাকে তাকে কী করেই বা নিজের সঙ্গে, জীবনের সঙ্গে, জুড়ে নেওয়া যায়। কেননা কালের নিয়ম অনুযায়ী বদলে যাচ্ছে এক একটি দিন— একে জীবনের অতীত না বলে বরং বলা যায় এ হচ্ছে এমনই এক অতীত যার সঙ্গে মিশে আছে বহুদূরের অতীত।

 

গির্জা থেকে বের হয়েই পাহাড়ি সিঁড়ি, তা বেয়ে নামবার সময়ে ভীষণ মনোসংযোগের প্রয়োজন—পা হড়কে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে আর তাকে বানচাল করে এগিয়ে যেতে হয়। ক্ষণিকের জন্য চলা থামিয়ে দিই। পিছনে লাফিয়ে নামছে বাবলু, সে আমার যাত্রাপথ দখল করে নেবে। নিজে যদি স্থানচ্যুত হতাম একটা ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটে যেত। মৃত্যু পর্যন্ত পৌঁছে গিয়ে যবনিকা পড়ত। কিন্তু পাহাড়ি রাস্তায় অভ্যস্ত বাবলু আমাকে বাঁচিয়ে সিঁড়ির ধাপে দাঁড় করিয়ে দেয় পেছন থেকে।

লক্ষ করলাম বাবলুর মাথায় পরা নেপালি টুপি স্থানচ্যুত না হয়ে টুপির কুর্কি দুটি জিঘাংসায় জ্বলে উঠবার অপেক্ষায়। বাবলুর এই লম্ফঝম্পের কারণই হচ্ছে সকাল থেকে বৃষ্টি— টাইগার হিলে যেতে না-পারার হতাশা। এমনকি বৃষ্টিকে গালাগালি দিয়েছিল আমাকে শুনিয়ে যাতে মা বা নানমাসির কানে না-পৌঁছয়। নীচু স্বর হওয়া সত্ত্বেও আমাকে অবশ্য শুনতেই হয়েছে। গালাগালির অর্থ বুঝতে না-পারা সত্ত্বেও কান গরম হয়ে গিয়েছিল। নিজের দৌড় তো ‘শালার ব্যাটা শালা’। কে জানি সেদিন প্রথম শোনাতে মনে হয়েছিল বিকৃত যৌনতা বিষয়ক এই গালিগালাজ— যদিও তা আরও বিকৃত হয়েছে বর্তমানে— কেননা শব্দের সঙ্গে অনেক আকার-ইঙ্গিত জুড়ে গেছে সময়ের ব্যবধানে। এগুলিই গালিগালাজের পরিভাষা।

কিন্তু সেই মুহূর্তে ছিল বৃষ্টি বাঁচিয়ে পাহাড়ি সমতলে পৌঁছে যাওয়ার প্রচেষ্টা। বড় বড় ছাতাগুলো খোলা হয়ে গেছে— নানমাসির রেইন কোটের ভেতরে বোন— মা ছাতার ভেতরে ডুবে গেছে। এতসব কিছুর মধ্যে বৃষ্টি সিঁড়িপথ ছেড়ে দিয়ে রাস্তায় ছুটছে।

মেঘটা সরে গেল। কিছুক্ষণের জন্য দাঁড়িয়ে গেলেন নানমাসি, যেন মেঘ সরে যাওয়ার জন্য প্রার্থনায় রত প্রভুর কাছে। হঠাৎই একসময় দূরের আকাশে রামধনু-ছটা দেখতে পেয়ে বুকে ক্রুশচিহ্ন এঁকে নিলেন। বোন কিন্তু ক্রুশচিহ্নের মধ্যেই থেকে গেল। তাতে কী হয়েছে— নানমাসির মুখ তো ভরে আছে খুশিতে— বৃষ্টি আর হবে না।

“বাহাদুর আসেনি?” স্টেশনমাস্টার জোশেফ জানিয়ে দেয় বড় সাহেব ইন্সপেকশনে আসছেন বলে বাহাদুরের কাজ পড়ে গেছে। কিন্তু কথার ফাঁকে স্টেশনমাস্টার কয়েকটা টিকিট নানমাসির হাতে দেয়— তিনি আবার মার হাতে তুলে দেন— দুটি হাফটিকিট, মারটা ফুল, বোনের কোনও টিকিট নেই কেন জানতে চাইলে নানমাসি বুঝিয়ে দেন— ও হচ্ছে এখনও দেবশিশু, তাই টিকিট লাগবে না। ততক্ষণে রেইনকোটের ভেতর থেকে বোন মুখ বের করে মার দিকে হাত বাড়াচ্ছে। মা বোনকে কোলে নিতে গেলেই বোন নিঃশব্দে টয়লেট করে দিয়েছে। মা বোনকে শাসন করতে গেলে নানমাসি মাকে থামিয়ে দেয়— দিনের মধ্যে কতবার তোমার কোলে টয়লেট করে কাপড়চোপড় ভিজিয়ে দিচ্ছে তার হিসেবটা কে দেবে? আমার কাপড়ে তো এই একবার— আবার কবে নতুন অতিথি আসবে কে জানে! দূর আকাশে কিছু একটা খুঁজবার জন্য বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে একসময় দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাকে তাড়া দেয় উঠে পড়ে— মেয়েটার ঠান্ডা লেগে যাবে তো!

মা টিকিটগুলো আমার কাছে জমা দিয়েই উঠে গেল ট্রেনের কামরায়— বাবলু উঠেই ঘোষণা করে ঘুম স্টেশনে সুড়ঙ্গপথ এবার সে দেখবেই।

 

ক্রমশ