অন্তেবাসী — ১২তম পর্ব

পীযূষ ভট্টাচার্য

 

পূর্ব প্রকাশিতের পর

সমস্ত বিষয়টা নির্ভর করছে মেজমাসির বিশ্বাসের ওপর। কেননা ব্রিটিশ আমলের স্টেশনমাস্টারের কোয়ার্টারে প্রথমদিকে ইংরেজরা তো ছিলই, তারপর কত জাতের লোকেরা যে ছিল তার হিসেব জানা না থাকায় সবসময়ই একটা আতঙ্ক তাড়া করে বেড়াত। ভিন্ন ভিন্ন জাতের হরেকরকম দেবতা। তার মধ্যে নির্দিষ্ট কোনও এক দেবতা নিশ্চয় রুষ্ট হয়ে বেলুদির শরীরে বাসা বেঁধে ওঁত পেতে আছে— মেয়েটাকে শেষ করে ছাড়বে শেষ পর্যন্ত। সেই অচেনা দেবতার খপ্পর থেকে নিজের সন্তানকে রক্ষা করবার জন্য নিজের দেবতার কাছে অন্তহীন প্রার্থনার জন্য কাউকে কিছু না বলে তরতরিয়ে উপরে উঠে গেল।

হঠাৎ কেন যেন মনে হল সিঁড়ির এই ধাপগুলো যেমনভাবে তৈরি হয়েছে তা বেশ সামঞ্জস্যপূর্ণ। কেবলমাত্র কোয়াটারের প্রবেশ-সিঁড়িটা একটু বেখাপ্পা। নিজের তো রীতিমতো অসুবিধা হত প্রথম প্রথম। তারপর অবশ্য সহ্য হয়ে যায়। এখন কেন জানি মনে হয় পাহাড়ের বুক খুঁড়ে যে সিঁড়ি তৈরি হয়েছে উঠবার শেষ ধাপে এসেই সে সবকিছুকে তছনছ করে দিয়েছে। যদি বলি এ হচ্ছে ধর্মীয় বিশ্বাস! কোনও গৃহে পৌঁছতে গেলে তোমাকে শেষ ধাপে এসে চিন্তা করতেই হবে, এক দণ্ডের জন্য হলেও থামতে হবে, এই গৃহে তোমার প্রবেশাধিকার আছে না নেই সেজন্য। আবার বেরিয়ে আসবার সময় সেই থমকে দাঁড়ানো। যেন মনে করিয়ে দেওয়া— তুমি যাচ্ছ যাও, ঘরে যারা থেকে গেল তারা তোমার আত্মার আত্মীয়।

কয়েক মুহূর্তের জন্য থমকে দাঁড়ানোই যেন জীবনকে জীবন সম্পর্কে সচেতন করে দেওয়া। এ এমনই এক বিশ্বাস যে সমস্ত দিনের শেষে নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে ফিরে এলে তখনই যেন মনে পড়ে যায় জীবন থেকে একটা দিন খসে পড়ল। আর নিজস্ব ঘরে ঢুকে বিছানায় ঘুমিয়ে পড়লে কিছুক্ষণের জন্য হলেও মৃত্যুর চিরনিদ্রার মহড়া হয়ে যায়।

কিন্তু বাহকেরা সিঁড়ির প্রথম ধাপে পা দেওয়ার প্রস্তুতির মধ্যে বুঝতে পারে এভাবে হবে না। একদিকে কাত হয়ে যেকোনও সময় বিপত্তি হতে পারে। তাই কালুদাকে বলে চেয়ারের মাঝখানটা সামলাতে। মা তার সঙ্গে জুড়ে দেয় সেফটি বেল্টের মত কিছু একটা ব্যবস্থার কথা। কথাটা কালুদার মনে ধরতেই মাথা নেড়ে ‘ঠিক’ বলে ওঠে।

ইতিমধ্যে অবশ্য মেজমাসি ঠাকুরঘর থেকে প্রদীপ টদীপ জ্বালিয়ে এনে রীতিমতো বরণ করার প্রস্তুতি নিতে দেখেই বেলুদি হেসে উঠল। রক্তিম আভাতে মুখটা ছাপিয়ে উঠতেই মেজমাসি মাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠল ‘একটু রক্ত হয়েছে মনে হয়।’

উত্তরে মা কি বলেছিল জানা নেই তবে আমি যে ফিসফিসিয়ে বলেছিলাম ‘ও নেগেটিভ’ তা কিন্তু মনে আছে। এও মনে আছে একদম শেষ ধাপে পৌঁছে কালুদা চিৎকার করে উঠেছিল ‘সামাল হো!’ যদিও এই শব্দটি প্রথম শোনা, অর্থ জানতাম না তখন। পরবর্তীতে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বুঝেছি শব্দটির মর্মার্থ।

কোয়ার্টারে ঢুকবার মুখে সিঁড়ির শেষ ধাপে কী হবে এই আশঙ্কা। কিন্তু সামাল হো ধ্বনি পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে প্রতিধ্বনি তুলবার আগেই বেলুদি ঘরে পৌঁছে যায়। আমি তো অবাক, কেননা রামছাগল আগেভাগেই ঘরে ঢুকে দাঁড়িয়ে আছে! কিন্তু কোন পথে এল? এই প্রশ্নের মধ্যে বেলুদি হেসে বলে ওঠে ‘বাচ্চু বাড়ির পিছন দিকে একটা পায়ে হাঁটা পথ আছে। ওই পথেই এসেছে।’

বাবলু সেই পথটা যে মেথরদের যাতায়াতের পথ, তা বলে উঠবার আগেই বেলুদি দিয়ে ঠোঁটে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দেয় বাবলুকে— এখন চুপ। কেননা ওরা সকলেই জানে মেজমাসি যদি বুঝতে পারে এই কথা তবে রামছাগলের শুদ্ধিকরণ করেই ছাড়বে। কিন্তু মেজমাসি ব্যস্ত ছিল চেয়ারবাহকদের বকশিশ দিতে। একটা বয়ামে ঠাসা খুচরো পয়সা থেকে একমুঠ পয়সা না গুনে সকলের হাতে তুলে দেওয়ার পর কালুদা হাত পাততেই একটা হাসির রোলের মধ্যে মেজমাসি বলে ওঠে ‘দিদি কি এভাবেই চেয়ারে বাঁধা থাকবে?’ –এটা হচ্ছে সেফটি বেল্ট। চেয়ারের বাঁধা মাফলারটি খুলে নিয়ে নিজের গলায় জড়িয়ে নিতেই বেলুদি বড় বড় চোখ করে নিষেধ করে। কিন্তু কালুদা হেসে উড়িয়ে দিয়ে বাহাদুরকে হুকুম দেয় ‘অ্যাম্বুলেন্সটাকে এবারে নিয়ে যা…’

কথা শেষ না করে মাকে কালুদা বুঝিয়ে দেয় এ হচ্ছে পাহাড়ি পাকদণ্ডী পথের অ্যাম্বুলেন্স। নিজে কিন্তু আশ্চর্য চিনেমাটির বয়ামের নজরদারি করে চলেছিলাম। বাইরে দেখে বুঝবার উপায় নেই। দিনে দুবার— প্রথম আপ এবং ডাউন ট্রেন চলে যাওয়ার পর মেসোমশাই যখন একবার কোয়ার্টারে ফিরে আসে খাওয়াদাওয়া করবার জন্য তখন একবার, আবার বিকেলে আপ ডাউন ট্রেন চলে যাওয়ার পর চা খাবার জন্য যখন আসা— এই দুবারই এই বয়ামে খুচরো পয়সা রাখে। অবশ্যই না গুনতি করে রাখা এবং বাড়ির সকলেই প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে যার যেমন হাতের মুঠ তা ভর্তি করেই নেয় এবং তা না গুনেই নেয়। আমার মনে হয় বেলুদিও নিত রাজরোগের কবলে পড়বার আগে। আর আমি ম্যাজিক বয়ামের দিকে তাকিয়েছিলাম যে বয়াম খুচরো পয়সা জন্ম দেওয়ার ক্ষমতা ধরে। যখন বয়ামটিকে মেজমাসি ঘরে রেখে এল তখন চটকা ভেঙে দেখি রামছাগল আর এ ঘরে নেই। বেলুদির সঙ্গে উঠে গেছে।

ডাউন ট্রেনের ছেড়ে যাওয়ার হুইসেলের শব্দ মিলিয়ে যেতেই বাড়িটার দুটি স্টোভের জ্বলে ওঠার শব্দ শাঁ শাঁ করে ভরিয়ে দিল। আর এরই মধ্যে রামছাগলের মালকিন কখন যে নিজের বাড়ি থেকে পোশাক পাল্টে ফিরে এসেছে বুঝতেই পারিনি। মেসোমশাই যে ঘরে আমরা থাকি অর্থাৎ বাঘের ঘর থেকে চেয়ার এনে বেলুদির মুখোমুখি বসলেন। অন্যদিনের মত বাড়ি এসেই সেই আশ্চর্য বয়ামের ধারেকাছে গেলেনই না। আর বেলুদি লেপটাকে বসে বসে ইগলু বানিয়ে মেসোমশাইকে ডেকে উঠল— বাবা!

এই ডাক স্টোভের শব্দে কারও কাছে না পৌঁছবার কথা। তথাপি কিভাবে যে পৌঁছে যায় সেদিন ছিল বোধগম্যের বিষয়। আজও তাই।

বাড়িময় স্টোভের শাঁ শাঁ আওয়াজ ছাড়া অন্য কিছুই নেই। অন্য কিছুই ছিল না। তবুও অদ্ভুত এক নৈঃশব্দ ঘিরে রেখেছিল সকলকে।

 

আবার আগামী সংখ্যায়

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4649 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...