Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

জঁ লুক গোদার: অনন্ত নক্ষত্রবীথি তুমি, অন্ধকারে — ষষ্ঠ বর্ষ, পঞ্চম যাত্রা

স্টেশনমাস্টারের কলম

 

আটের দশকের মাঝামাঝি। পিভি নরসিংহ রাওয়ের হাত ধরে ভারতবর্ষ উদার অর্থনীতিতে প্রবেশ করার আগের সে যুগে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রীষ্মের সন্ধ্যা আসত— প্রেমের মতোই— মহাসমারোহে। সন্ধ্যার মুখে ফুটবল-পেটানো বালকেরা পুকুরে হাতমুখ ধুয়ে কর্দমাক্ত জার্সি ও মোজা কেচে গৃহমুখী হওয়ার পর যেই একটু দখিনা বাতাস বইত, নারকেলপাতায় একটু সরসর— অমনিই দিবসের সেই প্রোজেইক পুকুর যেন কোন পূর্ণচাঁদের মায়ায় নিমেষে পালটে সোয়ান লেক— শানবাঁধানো পৈঠেয় জ্যোৎস্নার পোশাক খুলে রেখে সেই মায়াসরোবরে নাইতে নামত জলপরিরা। তেমনই এক মায়াসন্ধ্যায়, অনতিদূরের গান্ধিভবনে একপাল ছেলেমেয়ের সঙ্গে গোদারের ‘ব্রেথলেস’ দেখতে ঢুকছিল এক তরুণও। হায়, যদি সে জানত… খারাপ প্রিন্টের খসখস ও প্রায়-শুনতে-পাওয়া-যায়-না এমন অডিও-সংবলিত পরের দেড় ঘন্টায় তার ভবিষ্যৎ তছনছ করে দেওয়ার সব ষড়যন্ত্র সম্পূর্ণ হয়ে রয়েছে!

গোদারের সঙ্গে তার প্রথম পরিচয় অবশ্য কিছু আগেই, বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে সহপাঠীদের মুখে-মুখে ঘোরা গল্পের মাধ্যমে। ফিল্ম স্টাডিজ-এর এক প্রবল সিনিয়ার তাকে শুনিয়েছিল যাদবপুরেরই এক যুগলের গল্প— যেখানে ছেলেটির নাছোড় প্ররোচনার মুখে মেয়েটি জানায়, “তোমার সঙ্গে গোদার দেখতে আমি কক্ষনও যাব না।” কেন এ-হেন বিচিত্র প্রতিজ্ঞা, তা-ও অচিরেই খোলসা করে অকুতোভয় সে মেয়ে বলে, “অন্য ডিরেক্টরদের ছবি দেখার সময় তুমি আমায় কত প্রেমের কথা-টথা বলো, কিন্তু সেই সেবার যখন গোদার দেখতে নিয়ে গেলে, সারাক্ষণ কিচ্ছুটি বলোনি, হল থেকে বেরিয়ে কেবল আকাশের দিকে মুখ করে বলেছিলে, ‘তোমার ইয়ে, মানে কনুইটা, কী সুন্দর!’ এর পরেও তোমার সঙ্গে গোদার? কক্ষনও নয়।” বলাই বাহুল্য, সে গল্পে বিদ্রুপের শাণিত অভিমুখ ছিল স্পষ্টতই তখনকার তরুণ প্রজন্মের সিনেমা-বাফদের প্রতি, যদিও শ্রোতা ছাত্রটির কাছে সে গল্পের বার্তা পৌঁছেছিল একেবারেই অন্য চেহারায়— গোদারের প্রতি এক অনন্য সম্ভ্রমবোধ জাগিয়ে তুলে। এমন কিছু নিশ্চয় আছে ওঁর ছবিতে, যাতে তা দেখতে-দেখতে প্রায়ান্ধকার প্রেক্ষাগৃহে পার্শ্ববর্তিনীর ইঙ্গিতপূর্ণ আহ্বান সম্পূর্ণ ভুলে যাওয়া সম্ভব হতে পারে! কী সে জিনিস? কী সেই এমন কিছু?

এর কয়েকদিনের মধ্যেই তার কানে আসবে জীবনানন্দের ভাঙা ঠোঁটে “থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার অলুক্‌ গোদার”, এবং তৃতীয় শ্রেণির সেই প্যারডি থেকে সে সযত্নে কুড়িয়ে নেবে ‘অলুক্‌’ বিশেষণটি… ভাবতে বসবে, এখানে অলুক্‌ কি নিছকই জঁ লুক-এর সঙ্গে ধ্বনি মেলানোর প্রয়োজনে, নাকি সত্যিই নিজের ছবি ও তার দর্শকদের মধ্যে অনপনেয় এক বিভক্তিচিহ্নের মতো নিজে দাঁড়িয়ে থাকেন গোদার… ছবির বিষয়বস্তু থেকে তাঁকে মুহূর্তের জন্যও হঠানো যায় না বলেই তিনি অলুক্‌!

ত্রিংশতিবর্ষ পরে সেই প্রায়বিস্মৃত বালকটির উল্লেখ এই সম্পাদকীয় নিবন্ধে এ-কারণেই জরুরি যে, সে বালক নিছক বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্য পড়তে এসে ছায়াছবির নবতরঙ্গের মায়ায় পথভ্রষ্ট এক অর্ফিউসমাত্র ছিল না, সে ছিল বস্তুত এক যুগচিহ্ন। সে সত্যিই এক আশ্চর্য সময় যখন আমরা ধীরে ধীরে পরিচিত হচ্ছি গোদারের ছবির সঙ্গে— বুঝে নিতে চাইছি তাঁর ছবির ভাষা, প্রকরণ ও শৈলী; তৃতীয় বিশ্বের এক শহরের আলো-অন্ধকারের বাস্তবতার প্রেক্ষাপটের সঙ্গে মিলিয়ে পড়তে চাইছি তাঁর বিষয়ভাবনা ও চিন্তাবিশ্বের নিরন্তর ভাঙচুর। ইতিহাসকে স্বীকার করতে গেলে, সে চেষ্টা আশির উপান্তে এসে নয়, বস্তুত শুরু হয়েছে মধ্য-ষাট থেকেই, কিন্তু তার পরে— যখন বয়স গিয়েছে চলে কুড়ি কুড়ি বছরের পার— তখনও গোদারের সঙ্গে বোঝাপড়া পুরোপুরি শেষ হয়নি আমাদের।

তাঁর মৃত্যু, প্রকৃত প্রস্তাবে, সেই বোঝাপড়ারই পথ নতুন করে খুলে দিল আরও একবার। তাঁকে নিয়ে এত বছর ধরে এত কথা বলা হয়ে যাওয়ার পরেও (স্রেফ তথ্য হিসেবে উল্লেখ থাক যে, গোদার ও তাঁর ছবি নিয়ে এ-যাবৎ যত লেখালেখি হয়েছে আধুনিক ছায়াছবির আর কোনও পরিচালককে নিয়ে তত হয়নি) গোদার এখনও এক প্রহেলিকা— অনন্ত নক্ষত্রবীথি, তিনি, অন্ধকারে…

আদ্যন্ত এক আইকনোক্লাস্ট, যিনি সেই পঞ্চাশের শুরু থেকেই তৎকালীন মূলধারার ফরাসি ছবির প্রতি বীতশ্রদ্ধ, একের পর এক প্রশ্ন করছেন, উত্তর খুঁজছেন (মনে রাখতে হবে, মাত্র ঊনিশ বছর বয়সে লেখা গোদারের সিনেমা-বিষয়ক প্রবন্ধের পরিণতিবোধ দেখে পরবর্তী সময়ে চমকে যাবেন এরিখ রোমার ও আঁদ্রে বাজাঁ, আর তার কয়েক বছরের মধ্যেই বাজাঁর সঙ্গে লম্বা শটের বিপরীতে ছোট দৈর্ঘের শটের কার্যকারিতা প্রসঙ্গে তাঁর সেই ঐতিহাসিক মতান্তর), আর সেই প্রশ্ন করা ও উত্তর খোঁজার প্রক্রিয়ায় সিনেমার সে-যাবৎ সঞ্চিত ইস্ত্রি-করা যাবতীয় অভিজ্ঞতা মুহূর্তে লাট হয়ে পৌঁছে যাচ্ছে লন্ড্রিব্যাগে… মধ্য-পঞ্চাশে ফ্রাঁসোয়া ত্রুফো, ক্লদ শাব্রল ও আরও জনাকয়েক সমমনস্কর সঙ্গে মিলে শুরু করছেন নতুন ধারার ছবি যা অচিরেই ‘ন্যুভেল ভাগ’ বা নবতরঙ্গ নামে ঢেউ তুলবে সারা পৃথিবীতে… বড় বাজেটের কোম্পানি-ছবির নিরাপদ ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে এসে হ্যান্ডহেল্ড ক্যামেরা নিয়ে নেমে পড়ছেন রাস্তায়… হলিউডের বস্তাপচা মডেলকে আস্তাকুঁড়ে ফেলে ‘টুওয়ার্ডস আ পোলিটিক্যাল সিনেমা’ প্রবন্ধে ঘোষণা করছেন সিনেমার কাজ বাস্তবকে অনুকরণ করা নয়, কারণ সে নিজেই বাস্তবের একটি চলমান অংশ… আইডেন্টিফিকেশনের চেনা রাস্তায় না-হাঁটিয়ে দর্শককে নাকানিচোবানি খাওয়াচ্ছেন ব্রেখটীয় এলিয়েনেশনের অস্বস্তির মধ্যে… গোল গল্পের অভ্যস্ত ছককে অস্বীকার করে ছবি সাজাচ্ছেন ডকুমেন্টরির ধাঁচে… গুলিয়ে দিচ্ছেন কাহিনির শুরু ও শেষ… যথেচ্ছ জাম্পকাটের ব্যবহারে এতদিনের ছবি দেখার অভিজ্ঞতাকেই মুহূর্মুহু নস্যাৎ করে দিচ্ছেন— সেই সবকিছুই, যা নিয়ে এত বছর ধরে এত কথা বলা হয়ে যাওয়ার পরেও, এখনও তিনি এক দূরের নীহারিকা। আশ্চর্য নয় যে, পরবর্তী পরিচালকদের ওপরে তাঁর প্রভাব নিয়ে কথা বলতে গেলে সে আলোচনা শেষ হয় না কিছুতেই— তারান্তিনো থেকে তারকোভস্কি, কুমার সাহনি থেকে মৃণাল সেন— তালিকা কেবল দীর্ঘতর হতে থাকে।

ফুরনোর নয়, তবু সেই না-ফুরনো আলোচনারই নানা খণ্ডাংশ নিয়ে চারনম্বর প্ল্যাটফর্মের এবারের সংখ্যা। লিখলেন সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়, মৈনাক বিশ্বাস, সায়ন্তন দত্ত, মহাশ্বেতা আচার্য, পিটার ব্র্যাডশ। গোদারের সবক’টি ছবি, তাঁর সৃষ্টির সবক’টি পর্যায় কি এই আলোচনায় ধরতে পারলাম আমরা? অবশ্যই নয়। তবে, তাঁর ছবির বিষয়-ভাষা-অন্বয়-প্রকরণ-দর্শন ইত্যাদির খানিক ছাপ সম্ভবত ধরা রইল নিবন্ধগুলির মধ্যে, যা নিঃসন্দেহে পাঠকদের অনেক ভাবনার খোরাক জোগাবে।

এ ছাড়া কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ও অন্যান্য ধারাবাহিক সমস্ত বিভাগ যথাযথ প্রকাশিত হল।

বিজয়ার শুভেচ্ছাসহ,

ইতি।

 

সম্পাদকমণ্ডলীর পক্ষে,
অভীক ভট্টাচার্য