শূন্যে ফেরার আখ্যান: অথরশিপ ও জঁ-লুক গোদার

সায়ন্তন দত্ত

 



চলচ্চিত্রের ছাত্র ও গবেষক

 

 

 

So my unconscious was correct, but it’s the cinema that got things right, more or less right, what is said isn’t necessarily right, often what the author says is even less right, because the author is present in what he does, not in what he says.

–জঁ-লুক গোদার[1]

.

(There is) a kind of interplay between surface and hidden meaning. Without knowing it himself, an author may speak one thing to the conscious while whispering another to the subconscious.

–কার্ল মার্কস[2]

 

এক.

জঁ-লুক গোদার লা সিনোয়াজ ছবিটি নির্মাণ করেন ১৯৬৭ সালে। ফরাসি ভাষায় ‘লা সিনোয়াজ’ শব্দের আভিধানিক অর্থ চৈনিক মহিলা, কিন্তু গোদার যখন ছবি তৈরি করছেন, অর্থাৎ ৬৭-র ফ্রান্সে এর সাধারণ অর্থ ধরা হত মাওবাদী। অর্থাৎ গোদারের ছবি সেই বিপ্লবী ছেলেমেয়েদের বিষয়ে তৈরি যারা ৬৭-র ফ্রান্সে ক্রমশ অতিবিপ্লবী, র‍্যাডিকাল মাওবাদী সংগঠনের দিকে এগোচ্ছেন, যাঁরা রুশ স্টালিনিজমকে ত্যাগ করে চিনের পদ্ধতিকে গ্রহণ করতে উৎসুক। ১৯৬৬ সালে মাও তাঁর সাংস্কৃতিক বিপ্লবের কথা ঘোষণা করেন, আর বাঙালি মাত্রই আমরা ৬৭-র নকশালবাড়ি বিদ্রোহ এবং পিকিং রেডিও ঘোষিত সেই বসন্তের বজ্রনির্ঘোষের কথা জানি। প্রসঙ্গত, এই পিকিং রেডিও প্রেরিত বার্তা একাধিকবার এই ছবিতে শোনা যায়, অবশ্যই তা নির্মিত (ফিকশনালাইজড) এবং ফরাসিতে।

লা সিনোয়াজ ছবিটি প্রায় গোটাটাই একটি ফ্ল্যাটবাড়ির মধ্যে নির্মিত। কলেজের ছুটিতে কিছু ছেলেমেয়ে একসঙ্গে জড়ো হয়ে তাদের চারপাশের রাজনৈতিকভাবে উত্তাল পরিস্থিতিতে নিজেদের করণীয় কর্তব্য, এবং রাজনৈতিক তত্ত্ব আলোচনা করছে, আপাতভাবে ছবির বিষয় এই। কিন্তু চিত্রপরিচালকের নাম যখন জঁ-লুক গোদার, তখন তাঁর কোনও ছবির বিষয়ের উল্লেখে সেই ছবি নিয়ে প্রায় কিছুই বলা হয় না, কারণ ছবিটির সমস্ত উপাদানই ছবিটির আঙ্গিকে লুকিয়ে রয়েছে।

গোদারের প্রথম পর্বের এর আগের ছবিগুলির মতই এ ছবিও সারাক্ষণ নানা বিষয় নিয়ে ভাবতে থাকে, তা নিয়ে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য/প্রশ্ন রাখতে থাকে। যেমন, ‘শব্দ’ আসলে কী? ফিকশন আর রিয়েলিটি কী, লুমিয়ের-মেলিয়ের-এর সিনেমার সম্পর্ক কী? অজস্র উদ্ধৃতি আসতে থাকে, যার বিষয় মার্কসবাদ/লেনিনবাদ থেকে রাজনৈতিক শিল্পের সম্ভাবনা, সঙ্গে ‘ইমেজ সাউন্ড জাক্সটাপোজিশন করে ক্রমশ নির্মিত হতে থাকা কোলাজ। এইসব প্রসঙ্গে আমি যাচ্ছিই না, কারণ বহুচর্চিত এবং বহু-আলোচিত এইসব বিষয় পাঠক আরও অনেক জায়গাতেই পাবেন।[3] আমার উদ্দেশ্য এই জটিল ইমেজ/সাউন্ডের সমুদ্রে একটি বিশেষ বিষয় অনুসন্ধান করা— অথরিয়াল ইন্টেনশন[4]। সেই সূত্রে, এই ২০২২ সালে শিল্পীর মৃত্যুর পর রাজনীতি থেকে শিল্পের পরিসরে যখন অথরশিপ নিয়ে আলোচনা হয়, তখন এক শতকেরও বেশি সময় পেরিয়ে এসে আমরা কীভাবে এই প্রশ্নের সম্মুখীন হতে পারি, তা নিয়েও কিছু ভাবনাচিন্তা করার চেষ্টা করা হবে। পরবর্তী প্রশ্নগুলি তাই মুখ্যত লা সিনোয়াজ কেন্দ্র করে হলেও, আমরা ভেবে দেখতে পারি, সমসময়ের কোনও ছবিকেও এই প্রশ্নের সামনে দাঁড় করালে কী উত্তর মিলতে পারে! যা আমরা পর্দায় দেখছি, যা সংলাপ হিসেবে বলা হচ্ছে, তাই কী কোনও ছবি আমাদের বলতে চায়? নাকি (এই ছবির ক্ষেত্রে) প্রায় বোম ফেলার মত ইমেজের যে কোলাজ আসে, তার আলাদা কোনও, স্বাধীন বক্তব্য আছে? ফিল্মে কি সবসময়েই ইমেজ আর সাউন্ড, আর কথিত সংলাপের সম্পর্ক— এক্ষেত্রে সংঘর্ষ, তা থেকেই কোনও চতুর্থ অর্থ তৈরি হয় না? গোটা ছবি জুড়ে এভাবে প্রায় দৃশ্য ধরে ধরে এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা যায়। কিন্তু আমি আলোচনার সুবিধের জন্য বেছে নিয়েছি এমন একটা দৃশ্য, যেখানে যা বলা হবে, তার সরাসরি প্রমাণ আমার কাছে আছে— অর্থাৎ বারবার অথর ইজ ডেড[5] বলে প্রমাণ করতে হবে না অথরিয়াল ইন্টেনশনকে ছাপিয়ে শিল্পে অর্থ লুক্কায়িত হয়ে থাকে। তাই, সে পর্বে যাওয়ার আগে খানিক ভূমিকা করে নেওয়া যাক।

 

দুই.

লা সিনোয়াজ ছবিটি প্যারিসে যখন মুক্তি পেয়েছিল, তখন ফিল্মের অন্যতম প্রধান ইন্সপিরেশন— লুই আলথুসারের মাওবাদী ইকোল নরমালের ছাত্রগোষ্ঠী— তাঁরা এতটাই রেগে গেছিলেন সে ছবি দেখে যে গোদারকে সরাসরি অভিযোগ করেছিলেন, তিনি রোম্যান্টিসিজমের জন্য তাঁদেরকে এক্সপ্লয়েট করেছেন।[6] গোদার এর উত্তরে অবশ্য কী বলেছিলেন জানা নেই, কিন্তু এতদিন পর, প্রায় অর্ধশতক পরে ছবিটি দেখতে বসে মনে হয়, সেই ছাত্রদের রেগে যাওয়ার কারণ খুব একটা ভুল ছিল না— তাঁদের মনে হয়েছিল ছবিটি তাঁদের দলকে নিয়ে ঠাট্টা করছে। এত কথা বলার উদ্দেশ্য একটিই— তিপ্পান্ন বছর পর ছবিটি দেখতে বসে ছবিটিকে মনে হয় একটি দীর্ঘ প্যারোডি, যেখানে বৈপ্লবিক বিশ্বাস বা সংগঠনের বাস্তবিক প্রতিরূপায়ণের বদলে, ছবিটি যে বাস্তব নির্মাণ করে— তা ক্যারিকেচারসুলভ— যা কিনা আবার গোদারের প্রথম পর্বের ছবির হালকা মেজাজের সঙ্গে খাপ খায় (বাস্তব এবং তার প্রতিরূপায়ণ নিয়েও ছবিটিতে বেশ কিছু ভাবনাচিন্তা উসকে দেওয়া হয়)। আর অর্ধশতক পর তৃতীয় বিশ্বের এক দর্শকের কাছে ছবিটি জরুরি হয়ে যায় এই কারণেই— সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পরে, মাও-র সাংস্কৃতিক বিপ্লবে গণহত্যার বিবরণ জানার পরে, সারা পৃথিবী জুড়েই বামপন্থী রাজনীতির দিশা দেখার পরে যখন বিপ্লব নিয়ে আশা-আকাঙ্খার দোলাচল যখন ম্রিয়মাণ— তখনই ছবিটি প্রফেটিক হয়ে ওঠে। কারণ সে শুধুমাত্র মে, ’৬৮-র ছাত্রবিপ্লবের আভাস দেয় তা না, বরং তার অর্ধশতক পরবর্তী পৃথিবীর বামপন্থী রাজনীতি সংক্রান্ত হতাশা নিয়েও আশ্চর্যরকম সচেতন থাকে। শুধু দৃশ্যে, শব্দে বা কোলাজে নয়, সংলাপেও— যেখানে ইজিপ্সিয়ান পরিত্যক্ত বাচ্চাদের ভেড়ার সংস্পর্শে আসার সঙ্গে পরিত্যক্ত বিপ্লবী সদস্য নিজেদের তুলনা করে। ছবিটি টেক্সট হিসেবে অজস্র অর্থের সম্ভাবনা উসকে দেয়, কিন্তু আমরা যেভাবে ভাবনাচিন্তা করছি, তাতে আমাদের প্রশ্ন করতে হয়, তার সবচেয়ে জরুরি অথর, পরিচালক জঁ-লুক গোদার, তিনি কি তা নিয়ে সচেতন ছিলেন?

এই প্রশ্নের খুব সহজ উত্তর দেওয়া যায়— না। শুধুমাত্র এই জন্যেই নয় যে তিনি ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক শিল্পের দিকে ঝুঁকবেন আগামী ছয় বছরে; শুধু এইজন্যেই নয়, সিনেমার ইতিহাসে ওঁদের জিগা ভের্তভ গ্রুপ বিকল্প, প্রতিস্পর্ধী, রাজনৈতিক সিনেমার অন্যতম মুখপাত্র হয়ে থাকবে। বরং এই জন্যে— ছবিটি নির্মাণের সময় সচেতনতার হিসেব কষলে অথর হিসেবে তিনি ভাবতেই পারেননি তাঁর তৈরি শিল্পেরই অর্থস্তরের নানান সম্ভাবনার কথা। প্রমাণ? একটি নির্দিষ্ট দৃশ্য।

 

তিন.

ভিভরে সা ভি (১৯৬২) যারা দেখেছেন তাঁরা জানেন, ছবিটির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশে গোদার তাঁর নিজের শিক্ষক এক দার্শনিককে এনে ছবিটির অর্থনির্মাণের সম্ভাবনাকে কতটা নিজের অথরশিপের বাইরে নিয়ে গিয়েছিলেন। পদ্ধতির দিক থেকে তা আকর্ষণীয়, কারণ সেই দার্শনিক, ব্রাইস পাঁরা, যে কথাগুলো বলছেন, সেগুলো গোদারের লিখিত সংলাপ নয়। গোদারের প্রশ্নের উত্তরে তিনি নিজে থেকেই তাঁর কথা ক্যামেরার সামনে বলেন। ফলত পদ্ধতির বিচারেই শিল্পী তাঁর শিল্পের দরজাটা খুলে রেখে দেন, যেখানে অন্য কোনও চিন্তক/দার্শনিক/শিল্পী তাঁর কাজে কন্ট্রিবিউট করতে পারেন। প্রায় একইরকমের একটি দৃশ্য আমাদের আলোচ্য লা সিনোয়াজ ছবিতেও আসে, যা নিয়ে আমরা কথা বলব।

ফ্রান্সিস জঁসঁ (Francis Jeanson), তৎকালীন ফ্রান্সে আলজেরিয়ার পক্ষে থাকা বামপন্থী ইন্টেলেকচুয়াকদের মধ্যে যিনি বিখ্যাত, তাঁকে এ ছবিতে সংলাপ চালাতে দেখা যায় প্রায় প্রধান চরিত্র, ভেরোনিকা-র (Anne Wiazemsky) সঙ্গে। ছবিতে আমরা দেখি চরিত্রের সঙ্গে দার্শনিকের সংলাপ— কিন্তু আসলে জঁসঁ কথা বলেন ন্যন্তের ইউনিভার্সিটিতে তাঁর ছাত্রী আনা-র সঙ্গে। (সেই নন্ত্যের, যেখান থেকে মে ’৬৮-র আন্দোলনের সুত্রপাত) জঁসঁ যখন ন্যন্তেরে দর্শনের অধ্যাপক ছিলেন, এই ছবির ভেরোনিকা, অর্থাৎ আনা তখন নন্ত্যেরের ছাত্রী। অতএব শিক্ষক-ছাত্রীর কথোপকথনকেই গোদার সরাসরি নিয়ে আসেন তাঁর ছবিতে। আনা এবং তার বৈপ্লবিক দলের সদস্যরা তখন তাদের রোজকার বলা তাত্ত্বিক এবং ভায়োলেন্ট বিপ্লবের কথাবার্তাকে আক্ষরিক অর্থে, মূর্ত বাস্তবে দেখতে চাইছে। সংশ্লিষ্ট দৃশ্যের শুরুতেই দেখা যায় আনা বলছে, তার অনেক শত্রু— যেমন বুর্জোয়া সমাজের সবাই, কম্প্রাদর বুর্জোয়া, জমিদার, প্রতিক্রিয়াশীল সংস্কারপন্থী ইন্টেলেকচুয়াল— সবাই। এরপরে দীর্ঘ একটি মোনোলগ আসে, যেখানে জঁসঁ বলতে থাকেন তিনি তাঁর পরিচিত প্যারিসের গণ্ডি ছেড়ে গ্রামে গিয়ে কোনও বইয়ের কাজ করতে চাইছেন।

কথাবার্তা চলতে চলতে স্পষ্ট বোঝা যায় ভেরোনিকা/আনা সরাসরি হিংসাত্মক অ্যাকশনের পক্ষে, তারা বম্বিং করে ইউনিভার্সিটি বন্ধ করে দিতে চায়। বোমা ফেলে ছাত্রছাত্রী আর শিক্ষকদের মেরে ফেললে বিশ্ববিদ্যালয় এমনিই বন্ধ হয়ে যাবে— আনা এ-বিষয়ে বেশ নিশ্চিত মতামত দিতে থাকে। ঠিক এই মুহূর্তেই আমরা দেখি, গোদার কাট করে জঁসঁ-র একটি ক্লোজ-আপে চলে যান। বেশ অ্যাম্বিগুয়াস একটি ক্লোজ-আপ, সঙ্গে চলন্ত ট্রেনের ছায়ায় জঁসঁ-র মুখের অভিব্যক্তিও ঢাকা পড়ে যায়। এই ক্লোজ-আপটি গুরুত্বপূর্ণ, কারণ জঁসঁ তখনও পর্যন্ত কোনও কথায় আনার বিরোধিতা করেননি। আনা বলতে থাকে তার সঙ্গে তার দলের সদস্য হিসেবে আরও দু-তিন জন আছে, এবং তারাই সবার আগে এই কাজ করে সমগ্র দেশের প্রগতিশীল জনগণকে জাগ্রত করতে চায়। তার শিক্ষকের অভিব্যক্তিতে সমর্থনের সূচক না দেখে, সে এবার আলজেরিয়ার যুদ্ধের সময় জঁসঁ-র এহেন একটি কাজকে মনে করিয়ে দেয়।

গোদারের আনাকে সমর্থনসূচক টাইটেল আসে। কিন্তু, তারপরেই অধ্যাপক জঁসঁ-র দীর্ঘ মনোলগ শুরু হয়। যেখানে আনাকে তিনি বোঝানোর চেষ্টা করেন, বলেন, তুমি জানো বর্তমান ব্যবস্থা বিশ্রী, কিন্তু ভবিষ্যৎ নিয়ে তোমার কোনও পরিকল্পনা আছে? আনা বলে তা নিয়ে সে এখনই ভাবিত নয়। শান্তভাবে জঁসঁ আনাকে বোঝাতে থাকেন তার জুভেনাইল চিন্তাভাবনার দৈন্যের কথা— সে যখন বিপ্লব বুঝতে সক্রিয়ভাবে কাজ করতে চাইছে, তখন বিপ্লব ‘আবিষ্কার’ না করে তাকে শ্রমিকদের সঙ্গে কাজ করার পরামর্শ দেন জঁসঁ। অল্পবয়সি যে কোনও সৎ কিন্তু নিজে বিশ্বাসে অন্ধের মতো অটল রাজনৈতিক কর্মীর মতো আনা বলেই চলে, বোমা ফেলা উচিত নয় কেন, আমাকে বুঝিয়ে বলুন! জারিস্ট রাশিয়া থেকে শুরু করে আলজেরিয়ার বিপ্লব, সমস্ত তুলনা টেনেও আনা জঁসঁ-র সহমত আদায় করতে ব্যর্থ হয়। দৃশ্যটির শেষ সংলাপ হয়, জঁসঁ বলছেন, তোমরা অন্ধের মত ছুটে চলেছ।

 

চার.

গোদারের ছবি তৈরির কায়দা সম্পর্কে যাঁরা অবগত আছেন তাঁরা জানেন, তিনি প্রায়শই এই জাতীয় দৃশ্যে নিজে অধ্যাপক/দার্শনিকদের সঙ্গে কথা বলতেন, তারপর অভিনেতাকে জুড়ে দিতেন আলাদা করে। (আব্বাস কিয়ারোস্তামি যে পদ্ধতিতে সম্পূর্ণ টেস্ট অফ চেরি নির্মাণ করেছিলেন) এ দৃশ্যেও খানিকটা তাইই হয়, কারণ আনা যা বলে, অনেকটাই গোদার নিজে ইয়ারফোনের মাধ্যমে আনার কানে ফিসফিস করে বলে দেন। মজার বিষয় হল— ছবি বানাবার সময়, অর্থাৎ ১৯৬৭ সালে গোদার তখন সরাসরি আনার বলা কথাগুলির পক্ষে ছিলেন এবং বোম মেরে ইউনিভার্সিটি বন্ধ করে দেওয়া জাতীয় টেররিস্ট ব্যপারস্যাপারের প্রতি তার স্পষ্ট সিম্প্যাথি ছিল। অর্থাৎ তিনি ছবিতে দেখাতে চেয়েছেন যে তিনি আনার চরিত্রটির প্রতি সহমর্মী। কিন্তু অর্ধদশক পরে, আজকের দিনে দাঁড়িয়ে নিতান্ত গোঁড়া মাওবাদী ছাড়া যে কেউ ছবিটি দেখলে বুঝতে পারবেন কার তর্কের জোর বেশি। মজার ব্যপার— আমি শুরু থেকে বলছিলাম প্রমাণের কথা, যেখানে অথর নিজেই স্বীকার করবেন তাঁর নির্মিত ছবিতে অর্থের নানান বিপরীত সম্ভাবনার কথা। রিচার্ড ব্রডি, যিনি গোদারের প্রামাণ্য ক্রিটিকাল বায়োগ্রাফি লিখেছেন এভরিথিং ই সিনেমা নামে, তিনি ২০০০ সালে গোদারকে এই প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করলে গোদার যা বলেন, আমি পুরোটা নীচে উদ্ধৃত করছি—

Yes, but that’s typical of the unconscious, because I was naively on Anne Wiazemsky’s side and I made her say my own ideas in regard to Jeanson, but today, what remains is that Jeanson is rather correct. So my unconscious was correct, but it’s the cinema that got things right, more or less right, what is said isn’t necessarily right, often what the author says is even less right, because the author is present in what he does, not in what he says.

অর্থাৎ, সংক্ষেপে, এই হল টিপিক্যাল আনকনশাস, কারণ আমি আনার পক্ষে ছিলাম, জঁসঁ-র বিরূদ্ধে বলা ওর কথাগুলো আমারই কথা। কিন্তু আজকে বোঝা যায়, জঁসঁই ঠিক। সিনেমায় সঠিক জিনিসটা আছে, আমার ইচ্ছে-ব্যতিরেকেই। কারণ সিনেমায় যা বলা হয় তাই সবসময় ঠিক নয়, আর ফিল্মের অথর (পড়ুন ডিরেক্টর) যা বলেন, তাও সবসময় ঠিক নয়। অথর উপস্থিত থাকেন তিনি কী করেন তার ভিত্তিতে, তিনি কী বলেন তার ভিত্তিতে নয়।

বোঝাই যাচ্ছে, ২০০০ সালে প্রৌঢ় গোদার তাঁর আগেকার অথরিয়াল ইন্টেনশনকে ঝেড়ে ফেলে ফিল্ম-টেক্সটে বেশি মনোযোগী হতে চান। এই বিপ্লব, এই বিদ্রোহ, এই আগামী হিংসাত্মক ঘটনার যে রোম্যান্টিক ছবি তাঁর ফিল্ম আঁকতে থাকে, তাঁর সচেতন ইচ্ছে-ব্যতিরেকেই সেখানে প্যারোডি, ক্যারিকেচর তৈরি হতে থাকে— আগামী বিপ্লবকে ছাড়িয়ে তা প্রফেটিক হতে থাকে আরও আগামীর জন্য, যে আগামীতে বিপ্লব নেই, বিপ্লবের কোনও সুনির্দিষ্ট আশাও নেই— কোন একটি নির্দিষ্ট পথ নেই যে পথেই মানবের ক্রমমুক্তি হবে।

আমার বক্তব্য এই নয় যে ২০০০ সালে গোদার এ-কথা বলেছেন বলেই একমাত্র ফিল্মটির পরিবর্তিত পাঠটি ভ্যালিড হয়। বরং, বহুকাল ধরে, অ্যাকাডেমিক পরিসরের বাইরে আমরা বলার চেষ্টা করি— যেকোনও শিল্পে স্রষ্টা কী চান তাই শিল্পের একমাত্র অর্থ নির্মাণ করে না— শিল্পে গলিঘুঁজিতে, নানান ইশারায়, আভাসে নানান অর্থ নির্মিত হতে থাকে স্রষ্টার অজান্তেই। ঘটনাচক্রে এই ঘটনায় প্রমাণ দেওয়া যায়, কারণ পরিবর্তিত গোদারের নিজেরই বক্তব্য হাতের কাছে আছে। কিন্তু কেন জন ফোর্ড দ্য সার্চার্স (১৯৫৫), কিংবা ক্লিন্ট ইস্টউড আনফরগিভেন (১৯৯২) তৈরি করেন, বা সাহস করে যদি বলিই, পোলান্সকি চায়নাটাউন (১৯৪৭) বা রিপালশন (১৯৬৫) বানাতে পারেন— এর একটিই উত্তর— শিল্পকে শিল্পীর চেয়ে আলাদা করে দেখা। সচেতন গোদার ’৬৭তে ভাবতে পারেননি জঁসঁ ঠিক বলছেন— কিন্তু তিনি শুধু তাঁর নিজের বক্তব্যের বিরোধী বক্তব্যটাও ফিল্মে রেখে যান— গোদারের ছবির ফর্ম এই সন্দর্ভের সম্ভাবনাকে উসকে দেয় যেখানে তাঁর বিরোধী বক্তব্যও তাঁর ছবিতেই থেকে যেতে পারে।

 

পাঁচ.

যেকোনও শিল্পকর্মের নিবিড় পাঠ থেকেই হয়তো এই ধরনের চিন্তাভাবনা উঠে আসতে পারে— কিন্তু জঁ-লুক গোদারের ছবির বিশেষত্বের কথা আমাদের ভুলে গেলে চলবে না। গোদার ভাবনাচিন্তার বেলায় যাই ভেবে থাকুন না কেন, শুরু থেকেই তাঁর উদ্দেশ্য ছিল নিজের সচেতন ভাবনার বাইরে বিপরীতধর্মী একটি পরিসরকে সক্রিয়ভাবে উন্মুক্ত করে রাখা। গোদারের ছবির আঙ্গিক আমাদের এইটিই শেখাতে পারে, কীভাবে ছবি বানাতে বানাতে সেই ছবিটি সম্পর্কেই সন্দিগ্ধ হয়ে উঠতে পারা যায়, কোনও চিন্তা করতে করতে তার বিপরীতকে কীভাবে জায়গা ছেড়ে রাখতে হয়। রাজনৈতিকভাবে নির্দিষ্ট মতামতের দিকে অনেকটা ঝুঁকে গিয়েও নিরন্তর কর্ষণের এই পরিসরটিকে জিইয়ে রাখা খুব সহজ কাজ নয়, গোদার যেটুকু নির্মাণ করতে সফল হয়েছিলেন।

আমরা যদি এইবার গোদারের মৃত্যুর সমকালীন রাজনীতি এবং সিনেমার দিকে তাকাই, তাহলে এই প্রশ্নটি করে রাখা বোধহয় খুব একটা অবাঞ্ছিত নয়, আমরা কি আদৌ জঁ-লুক গোদারের কোনওরকম প্রভাব বহন করছি? শুধুমাত্র বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল বলে নয়, সারা বিশ্বেই রাজনীতির পরিসরে বক্তব্য বিষয়ের প্রতি বক্তার ঘোরতর বিশ্বাসের কথা আমরা সর্বত্র দেখতে পারি, আর শিল্পে তো নির্মাণের আগে থেকেই প্রত্যেকে রাজনৈতিক সঠিকতা বজায় রাখার প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত। জঁ-লুক গোদার এমন শিল্পী, যিনি শেখাতে চেয়েছিলেন চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে করতে আমরা চলচ্চিত্র নামক মাধ্যমটাকেই প্রশ্নের সম্মুখে ফেলে দেব, যেখানে পুঁজিবাদ থেকে (আমাদের যুগে) পরিবেশ, সমস্ত একাকার হয়ে থাকবে। তিনি শেখাতে চেয়েছিলেন ফেসবুকে তাঁর প্রয়াণের পরে পোস্ট করলে তা যেন ফেসবুকের অর্থনীতি এবং রাজনীতি বিষয়ে সচেতন হয়, ডেটা ক্যাপিটালিজম আর ইমেজ অ্যালগরিদমের জটিল ক্রিয়াকে উপেক্ষা করে যেন তাঁকে (বা কাউকেই) স্মরণ না করা হয়। তিনি চেয়েছিলেন তাঁর অবিচুয়ারি যেন সবার আগে অবিচুয়ারি লেখার প্রক্রিয়াটাকেই প্রশ্নের মুখে ফেলে দেয়। সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, শৈল্পিক— সমস্ত দিকেই নিরন্তর প্রশ্ন করে যাওয়া, প্রশ্নের বশবর্তী হয়ে থাকাটাই তাঁর বহুমুখী কাজের প্রধানতম যোগসূত্র হয়ে শেষদিন অবধি বেঁচে ছিল। ১৯৬৮ সালে, মে ‘৬৮র সেই উত্তাল সময়ের ঠিক পরেই তিনি ফরাসি টেলিভিশনের জন্য নির্মিত ছবি জয় অফ নলেজ-এ একটি সংলাপ ব্যবহার করেন— “The problem is: to get back to zero.”— সমস্যাটা হল, কীভাবে শূন্যে ফিরে যাওয়া যায়।

মৃত্যু পর্যন্ত জঁ-লুক গোদার বারবার শূন্যে ফিরে যেতে চেষ্টা করেছেন। এ লেখায় আলোচিত দৃশ্যটি তারই ছোট্ট একটি নিদর্শন।


[1] রিচার্ড ব্রডির Everything is Cinema: The Working Life of Jean Luc Godard বইয়ের পনেরো নম্বর অধ্যায়ে উদ্ধৃত।
[2] ফরাসি লেখক Eugene Sue লিখিত The Mysteries of Paris উপন্যাসটি সম্পর্কে কার্ল মার্কস এই মন্তব্য করেন। অমিতাভ চট্টোপাধ্যায় লিখিত ‘চলচ্চিত্র সমাজ ও সত্যজিৎ রায়’ বইয়ের ২১৩ পাতায় উদ্ধৃত।
[3] জঁ-লুক গোদারকে নিয়ে লিখিত অন্তত দুটি বইয়ের নাম এই প্রসঙ্গে করা যায়— Richard Roud-এর লেখা Godard, এবং Colin MacCabe-র লেখা Godard: Images, Sounds, Politics
[4] শিবাজী বন্দোপাধ্যায় তাঁর অথ বি-নির্মাণ প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন, কেন অথরের বাংলা হিসেবে লেখক কথাটি ব্যবহার করা উচিত নয়। আমি এই লেখায় মূল অথর শব্দটিই ব্যবহার করছি। শিবাজী বন্দোপাধ্যায়ের প্রবন্ধটি পাওয়া যাবে আলিবাবার গুপ্তভাণ্ডার প্রবন্ধ সঙ্কলনে।
[5] রোলা বার্থ লিখিত বিখ্যাত প্রবন্ধ The Death of the Author.
[6] রিচার্ড ব্রডির Everything is Cinema: The Working Life of Jean Luc Godard বইয়ের পনেরো নম্বর অধ্যায়ে উদ্ধৃত।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4650 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...