Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

নামে আন্তর্জাতিক থাকলেই বইমেলা আন্তর্জাতিক হয় না

সুব্রত দাস

 


কলকাতাকেন্দ্রিক এই ব‌ইমেলা আমরা যতই আন্তর্জাতিক বলার চেষ্টা করি না কেন এই মেলা কি উত্তরবঙ্গের প্রকাশকদের হৃদয়তন্তুকে ছুঁতে পেরেছে? আন্তর্জাতিক বললেও, বা সেই কারণে সরকারের তরফে কিছু চেষ্টা হলেও, এই আন্তর্জাতিক শিরোপা কি আদৌ থাকা উচিত? এই ব‌ইমেলায় অন্য রাজ্যের প্রকাশকদের ডেকে কখনও বিষয় বা স্বত্ব আদানপ্রদানের চেষ্টা হয়েছে? আমরা আমাদের পাশের প্রতিবেশী দেশের প্রকাশকদের সঙ্গে কোনও ব্যবসায়িক সম্পর্ক গড়ে তুলতে পেরেছি কি?

 

এবারের কলকাতা ব‌ইমেলা শেষ হল। আবার পরের কলকাতা ব‌ইমেলার প্রস্তুতি শুরু হবে। এমনটাই সময়ের দাবি। কিন্তু সত্যিই কি হয়? কলকাতাকেন্দ্রিক এই ব‌ইমেলা আমরা যতই আন্তর্জাতিক বলার চেষ্টা করি না কেন এই মেলা কি উত্তরবঙ্গের প্রকাশকদের হৃদয়তন্তুকে ছুঁতে পেরেছে? আন্তর্জাতিক বললেও, বা সেই কারণে সরকারের তরফে কিছু চেষ্টা হলেও, এই আন্তর্জাতিক শিরোপা কি আদৌ থাকা উচিত? এই ব‌ইমেলায় অন্য রাজ্যের প্রকাশকদের ডেকে কখনও বিষয় বা স্বত্ব আদানপ্রদানের চেষ্টা হয়েছে? আমরা আমাদের পাশের প্রতিবেশী দেশের প্রকাশকদের সঙ্গে কোনও ব্যবসায়িক সম্পর্ক গড়ে তুলতে পেরেছি কি? এই সম্পর্ক গড়ে তোলার প্রশ্নে ব‌ইমেলা কর্তৃপক্ষ বা রাজ্য সরকারের ভূমিকা না থাকার ব্যর্থতা নিয়ে তো কথা উঠবেই। এখনও থিম কান্ট্রি যে থাকে তাদের প্রকাশক, পরিবেশক, প্রচ্ছদশিল্পী, মার্কেটিং বিভাগের বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটা আদান‌প্রদান‌ করার ব্যবস্থা থাকলে, কে বলতে পারে আমাদের বাংলা প্রকাশক বা থিম কান্ট্রির দেশের প্রকাশকরাও উপকৃত হতে পারতেন না?

এবার থিম কান্ট্রি ছিল ইংল্যান্ড। এঁদের দেশের বিপণন বিভাগের এক দায়িত্বশীল কর্মীর সঙ্গে দেখা হয়েছিল চেন্নাই আন্তর্জাতিক ব‌ইমেলায়। ওঁর দায়িত্ব‌ই হল এআই-নির্ভর বিপণনের মাধ্যমে ব‌ই বিক্রি করা। প্রায় এক‌ই সময়ে কেরলে সাহিত্য সম্মেলনে ইংল্যান্ডের প্রতিনিধিরা এসেছিলেন কবিতা আদানপ্রদানের জন্য। এঁদের আমাদের ব‌ইমেলায় সংগঠিতভাবে নিয়ে এলে লাভ বৈ ক্ষতি হত না। দিল্লি ব‌ইমেলার জন্যও বিভিন্ন দেশ থেকে প্রকাশক ও সরকারি কিছু কর্তাব্যক্তিরা আসেন আমাদের দেশে। সত্যি সত্যি আন্তর্জাতিক ব‌ইমেলা হিসেবে পরিচিত হতে গেলে তাঁদের কাউকে তো ব‌ইমেলায় ডেকে ব্যবসায়িক আদানপ্রদান করাই যেত! ব‌ইয়ের সঙ্গে জড়িত এইসব কর্তাব্যক্তিকে আমাদের ব‌ইমেলায় সংগঠিতভাবে ডাকতে না পারলে আমাদের এই ব‌ইমেলা কখনওই প্রকৃত অর্থে আন্তর্জাতিক হয়ে উঠতে পারবে না।

কিন্তু এমনটা কি হয়? আমাদের তো গরিব দেশ। এনবিটি পরিচালিত দিল্লির ব‌ইমেলাতে একটা স্বত্ব বিনিময়ের জন্য জায়গা থাকলেও অনুবাদের অনুদান বা অন্য রাজ্য বা দেশ থেকে প্রকাশক, লিটারারি এজেন্টদের ডেকে আনার ক্ষেত্রে উদ্যোগ প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। লক্ষণীয় হল এই উদ্যোগের বিষয়ে কয়েক যোজন এগিয়ে আছে চেন্নাই আন্তর্জাতিক ব‌ইমেলা। এই মেলার আয়োজক তামিলনাড়ু সরকার ও তামিনাড়ু টেক্সট ব‌ই করপোরেশেন। এদের উদ্যোগ যত দেখছি তত‌ই কিন্তু আশা হচ্ছে যে দক্ষিণের এই রাজ্য ব‌ই প্রকাশনা শিল্পকে এক দিশা দেখাতে পারে। চেন্নাইয়ে ব‌ইমেলা প্রত্যেক বছর‌ই হত। কয়েক বছর আগে কিছু উৎসাহী ব‌ইপ্রেমী বা ব্যবসায়ী ফ্রাঙ্কফুর্ট ব‌ইমেলা থেকে ঘুরে এসে তামিলনাড়ু সরকারকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন ব‌ই প্রকাশনায় এক বড় উপাদান হল ব‌ইয়ের স্বত্ব। একটি ভাল পাণ্ডুলিপি প্রকাশনার এক মস্ত বড় পুঁজি। পাণ্ডুলিপির মধ্যে দিয়ে প্রকাশনা ব্যবসার একটা দিক যেমন উন্মুক্ত হয় অন্যদিকে সাংস্কৃতিক আদানপ্রদানের এক প্রেক্ষিতও গড়ে ওঠে। আজকের এই বহুধাবিভক্ত পৃথিবীতে এই সাংস্কৃতিক আদানপ্রদানের রাজনৈতিক ও সামাজিক গুরুত্ব অপরিসীম।

চেন্নাই আন্তর্জাতিক বইমেলা

আমরা বাঙালিরা আমাদের প্রতিবেশী রাজ্যের সংস্কৃতি সাহিত্য সম্পর্কে কতটুকু জানি? তামিলনাড়ু সরকার গত দু-বছর ধরে চেন্নাইতে প্রকাশনার সম্মেলন ও স্বত্ব আদানপ্রদানের জন্য রাইটস টেবিলের ব্যবস্থা করেছে। বিদেশি প্রকাশনা ও লিটারারি এজেন্টদের স্বত্ব বিনিময়ের জন্য চেন্নাই ব‌ইমেলায় যোগ দেওয়ার আহ্বান করছেন। এক্ষেত্রে বিদেশিদের ফেলোশিপ দিচ্ছেন। ফেলোশিপ প্রাপ্ত প্রকাশকদের যাওয়া-আসা-থাকা সহ সমস্ত খরচ বহন করছেন। ভারতীয় প্রকাশকদের জন্য রাইটস টেবিলের কোনও ভাড়া নিচ্ছেন না। আমি এবার সেই সম্মেলনে হাজির ছিলাম সস্ত্রীক। এই আন্তর্জাতিক সম্মেলনের মূল মন্ত্রই হল Lets Talk Tamil to the World. বিশ্বে তামিল সংস্কৃতি প্রসারের এই প্রয়াসে উগ্র অস্মিতা নেই, আছে ভালবাসার মেলবন্ধনের এক আকাশজোড়া ইচ্ছে। এই ইচ্ছেকে আগামী প্রজন্মকে, প্রকাশনা জগৎকে সম্মান জানাতেই হবে।

 

এই উদ্যোগ আমাদের দেশে নতুন হলেও অন্য দেশ এই বিষয়ে বেশ খানিকটা এগিয়ে। উন্নত ইউরোপীয় দেশগুলি তো বটেই, আফ্রিকা ও আরব দেশগুলিও নতুনভাবে ভাবছে। পৃথিবীর মধ্যে পাঠকদের ব‌ই কেনার নিরিখে সবচেয়ে এগিয়ে কায়রো ব‌ইমেলা। এই ব‌ইমেলার আয়োজক ওই দেশের ব‌ই করপোরেশন ও মিশরের শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক মন্ত্রক। এঁরা ফি বছর সারা বিশ্ব থেকে ২০ জন প্রকাশক, লিটারারি এজেন্টদের নির্বাচন করেন। ফেলোশিপ প্রাপকদের প্রফেশনাল প্রোগ্রামে যুক্ত করা হয়। উদ্যোক্তাদের মূল উদ্দেশ্য আরব প্রকাশনা সম্পর্কে বাইরের দুনিয়াকে অবহিত করা। এই উদ্যোগে তাৎক্ষণিক ফল পাওয়া যায় না, কিন্তু সাংস্কৃতিক মেলবন্ধনের ফল সুদূরপ্রসারী। আমাদের সর্বসাকুল্যে পাঁচজন আরবি প্রকাশকদের সঙ্গে কথা হয়েছে যাঁদের সঙ্গে আমাদের প্রকাশনার চিন্তার মিল রয়েছে। অন্যান্য ফেলোদের সঙ্গে এক আত্মিক সম্পর্ক আমাদের প্রকাশনার এক অনন্য দুনিয়ার সন্ধান অবশ্যই দিয়েছে। তা থেকে প্রকাশনা লাভবান হবে কি না তা ভবিষ্যৎ বলবে।

কায়রো বইমেলার কিছু মুহূর্ত: বাঁদিকে ফেলোশিপ-এর উদ্বোধনী বৈঠক; ডানদিকে প্রকাশক দিনা কাবিল-এর স্টলে
কায়রোতে সিরিয়ার ছাত্র-যুবরা
ওই ছেলেমেয়েদের বইমেলার সবাইকে দেওয়া কিছু আরবি বার্তা

একটা বিষয় আজ অনুধাবন করতেই হবে কোনও প্রকাশন সংস্থা বা শিল্প একা প্রগতির পথে উন্নতির পথে এগোতে পারে না, সমষ্টিগতভাবেই এগোতে হয়। এইখানেই চেন্নাই আন্তর্জাতিক বইমেলা বা কায়রো ব‌ইমেলা আমাদের কলকাতা ব‌ইমেলা থেকে কয়েক কদম এগিয়ে। কায়রোর বিদেশি ফেলোদের কথায় অনেকবার চেন্নাইয়ের ব‌ইমেলার কথা হল। সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন, অনুবাদ সব মিলে প্রকাশনা শিল্পের প্রসার ঘটে। এর মাধ্যমে কেবল সাংস্কৃতিক অবদান নয়, প্রকাশকরা জাতীয় আয়েও এক ভূমিকা রাখেন। ভুললে চলবে না ব‌ই প্রকাশনার সঙ্গে কিন্তু বহু মানুষ জড়িত। সরাসরি কর্মসংস্থানের প্রেক্ষিতে প্রকাশনার অবদান এড়ানো যাবে না। আমরাও সেইদিনের প্রতীক্ষায় যখন আমরা প্রকাশকরা কাউন্টারে ব‌ই বিক্রি ছাড়াও পাণ্ডুলিপির স্বত্ব কেনা ও বিক্রির কথা ভাবতে পারব। আদানপ্রদানের সূত্রে আজকের বহুধা পৃথিবীতে ঐক্যের সুরতান বাঁধতে পারেন প্রকাশকরাই। এই মূল বিষয়টি বাংলা প্রকাশক ও সরকার যত দ্রুত আত্মস্থ করবেন তত‌ই মঙ্গল। প্রকাশনার মঙ্গল।