Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

অদ্ভুত আঁধার এক

কৃষকদের দুরবস্থা

সত্যব্রত ঘোষ

 

অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ পৃথিবীতে আজ,
যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দেখে তারা;
যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই – প্রীতি নেই –
করুণার আলোড়ন নেই
পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।
যাদের গভীর আস্থা আছে আজো মানুষের প্রতি,
এখনো যাদের কাছে স্বাভাবিক বলে মনে হয়
মহৎ সত্য বা রীতি, কিংবা শিল্প অথবা সাধনা
শকুন ও শেয়ালের খাদ্য আজ তাদের হৃদয়।

এই পঙক্তিগুলি লেখার সময়ে জীবনানন্দ যে ত্রাস অনুভব করেছিলেন, তার উৎসে ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং মনুষ্যসৃষ্ট মন্বন্তর। সঙ্গে জড়িয়ে ছিল তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের সংকটবোধ। কবি জীবনানন্দের মেধা ও মননের প্রতিনিধিস্বরূপ কবিতাটিকে মনে রাখলে আমরা হয়তোবা আশ্বস্ত হতাম। কিন্তু আমরা সে সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত। সম্প্রতি চারপাশে দমন এবং পীড়নের মাত্রা যেভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, তা্র মাঝে আজও জীবনানন্দকে অমোঘ মনে হয়।

***

গত বছর মার্চ মাসে প্রায় ৩০,০০০ কৃষক দীর্ঘ ছয়দিন পদযাত্রা করে নাসিক থেকে মুম্বাই পোঁছান। তাঁদের এক প্রতিনিধি দলকে মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফড়নবিস আশ্বাস দিয়েছিলেন যে কৃষকদের অভিযোগগুলি খতিয়ে দেখতে একটি উচ্চপর্যায়ের প্যানেল গঠন করা হবে। সরকারী সেই প্যানেল এবং তার কার্যকরীতা বিষয়ে সম্পূর্ণ নিরাশ এবং বিক্ষুব্ধ কৃষকরা সম্প্রতি আবার একটি পদযাত্রার আয়োজন করেন। কিন্তু কৃষকরা যাতে নাসিকে জমায়েত হয়ে পদযাত্রা শুরু না করতে পারেন, সেই উদ্দেশ্যে বিভিন্ন গ্রামে তাঁদের আটকে রাখবার চেষ্টা করে রাজ্য প্রশাসন। তা অগ্রাহ্য করে কৃষকদের এই পদযাত্রা আয়োজিত হচ্ছে। আগামী ২৭শে ফেব্রুয়ারি তাঁদের পৌঁছানোর কথা ভারতের বানিজ্যিক রাজধানী মুম্বাইতে। গত বছরের দাবিগুলির পাশাপাশি এবারে সর্বভারতীয় কৃষক সমিতির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে যে সরকারের কাছে তাঁদের আরও দুটি দাবী থাকবে। এক, মহারাষ্ট্রের অর্ধেক কৃষি এলাকাকে খরা-কবলিত অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করতে হবে। দুই, সর্বভারতীয় কৃষক সমিতির রাষ্ট্রীয় অধ্যক্ষ শ্রী অশোক ধাওলে দাবী করেন প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার আগে গুজরাটের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী প্রায় ৪৪০টি জনসভায় কৃষকদের আশ্বাস দিয়ে এসেছেন, যে বিজেপিকে ক্ষমতায় আনলে স্বামীনাথন কমিটি কৃষকদের উন্নতির স্বার্থে যে সুপারিশগুলি করেছে, তা তিনি কার্যায়িত করবেন এবং ন্যুনতম সহায়ক মূল্য হিসেবে দেড় গুণ টাকা উৎপাদন মূল্য হিসেবে কৃষকদের দেবেন। ক্ষমতায় আসবার পর সরকার এই বিষয়ে পদক্ষেপ নিয়েছে বটে, কিন্তু তা স্বামীনাথন কমিটির সুপারিশগুলি অনুসরণ করে নয়। এর ফলে সরকারি উদ্যোগ সত্ত্বেও কৃষকদের দুরাবস্থার সুরাহা হয়নি। উৎপাদন পিছু তাঁদের আয়ে আদৌ কোনও বৃদ্ধি হয়নি। অতীতের সেই ফাঁকা আশ্বাসগুলির কথা পদযাত্রায় অংশগ্রহণকারী বিক্ষুব্ধ কৃষকেরা সোচ্চারভাবে এবার মনে করিয়ে দেবে ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে।

শুধু কৃষকদের প্রতিই নয়, সৈনিকদের প্রতিও সরকারের যত্নশীলতার অভাব প্রকট। এক সপ্তাহের বেশি সময় হয়ে গেল, পুলওয়ামায় গাড়ি বোমা বিস্ফোরণ ঘটেছে। গাড়িবোঝাই আরডিএক্স নিয়ে ফিদায়েন-দের এমন আক্রমণ সিরিয়া এবং মধ্য এশিয়ার যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলগুলিতে এতকাল ঘটত বলে জানি। ভারতে এবার তার প্রথম প্রয়োগ ঘটাল জঙ্গিরা। কাপুরুষোচিত এই জঘন্য আক্রমণের পূর্বাভাস স্বরাষ্ট্র দপ্তর যে পায়নি, তা নয়। সুরক্ষা আধিকারিকেরা সেই তথ্যের ভিত্তিতে সিয়াচেন এবং কাশ্মির সীমান্তের অন্যান্য পোস্টগুলিতে আকাশপথে সেনাবাহিনীকে পৌঁছে দেওয়ার দাবী জানান। কিন্তু যে কোনও কারণে তা নাকচ করে সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষ। (গতকাল জানা গেল, এবার থেকে সেনাবাহিনীকে এই সুযোগটি দেওয়া হবে। প্রয়োজনীয় অর্থ এবং ব্যবস্থাদি যদি বরাদ্দই করা যায়, তাতে প্রথমে কার্পণ্য করবার কারণ রহস্যজনক নয় কি?)

সে যাই হোক, নিহত জওয়ানদের শহিদ ঘোষণায় তৎপরতার কোনও অভাব চোখে পড়েনি আমাদের দেশে। বস্তুত, এই তৎপরতা এমন একটি পর্যায়ে বর্তমানে পৌঁছেছে যে কে দেশপ্রেমিক এবং কে দেশদ্রোহী, তার সহজ চিহ্নিতকরণে জটিলতা ক্রমশই বাড়ছে। একদিকে আমরা দেখছি, “জঙ্গি সন্দেহে নিরীহ কাশ্মিরবাসীর উপর নির্যাতনের ঘটনা ঘটলে তাঁদের পাশে দাঁড়াব” – এই মর্মে ঘোষণা করবার ‘অপরাধ’-এ বরিষ্ঠ সাংবাদিক বরখা দত্তকে সামাজিক মাধ্যমগুলিতে এমনভাবে হেনস্থা করা হচ্ছে যে বাধ্য হয়ে তাঁকে জাতীয় মহিলা কমিশনের শরণাপন্ন হতে হয়েছে। অন্যদিকে, উত্তর প্রদেশের ফিরোজাবাদ জেলার নাগলা কেওল গ্রামের তথাকথিত উচ্চজাতির সদস্যরা পুলওয়ামার জঙ্গি আক্রমণে শহিদ বীর সিং-এর দেহাবশেষের সৎকার করবার স্থানটুকু দিতে অসমর্থ ছিল, কারণ তিনি নিম্নজাতিভুক্ত। কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপে অবশ্য ঘৃণ্য এই জাতপাতের বিষয়টি নিষ্পত্তি হয়েছে। তবে ‘ক্যারাভান’ পত্রিকার সাপ্রতিক সংখ্যায় প্রকাশিত পুলওয়ামা শহিদদের জাতিভিত্তিক তালিকা নতুন করে ঘৃতাহুতির আয়োজন করবে না তো?

পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার প্ররোচনা এখন ভারতের আকাশে বাতাসে। তবে যখনই পাকিস্তানের সঙ্গে বাণিজ্যিক সমস্ত সম্পর্কগুলি ছিন্ন করবার প্রসঙ্গটি উঠছে, তখন সংশ্লিষ্ট মহল কূটনৈতিক উত্তরে তা এড়াবার চেষ্টা করে চলেছে। করাচি থেকে চিনির আমদানি বন্ধ করবার সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়ে ভারতের দোলাচল স্পষ্ট। সর্বশেষ পাওয়া খবর অনুযায়ী, আগামী ১৬ই জুন ম্যানচেস্টারে পাকিস্তানের সঙ্গে ২০১৯-এর ক্রিকেট বিশ্বকাপের ম্যাচটি ভারত খেলবে কিনা, তার সিদ্ধান্ত অনির্দিষ্টকালের জন্য ঝুলিয়ে রেখেছে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক আমাদের ভাবতে হচ্ছে। সাম্প্রতিক জঙ্গি আক্রমণের পরে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ পাকিস্তানের কড়া নিন্দা করলেও আমাদের অন্য প্রতিবেশী রাষ্ট্র চিন যেভাবে পাকিস্তানকে নিরপরাধ হিসেবে সাব্যস্ত করতে উন্মুখ, তা ভারতের সামগ্রিক সুরক্ষার পক্ষে যথেষ্ট চিন্তনীয় একটি বিষয়।

পুলওয়ামা এবং কাশ্মিরের অন্যত্র জওয়ানদের মৃত্যুতে আমরা সবাই শোকাকুল। এবং ক্রুদ্ধও বটে। যা শুধুমাত্র প্রতিশোধস্পৃহায় প্রশমিত হবে না। কারণ, রাষ্ট্রের উদাসীনতায় পীড়িত আমরা। আমাদের সুরক্ষায় যাদের প্রাণ নিবেদিত, তাঁদের ও তাঁদের পরিবারের সুরক্ষায় আমাদের এই রাষ্ট্রব্যবস্থা কি আদৌ যথেষ্ট সহমর্মী? ১৯৬৫ সালে পাকিস্তানকে যুদ্ধে পরাস্ত করবার আনন্দোৎসব উদযাপনের সূচনায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী একটি তাৎপর্যপূর্ণ শ্লোগানে দেশকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন : জয় কিষান, জয় জওয়ান। আজ, ৫৩ বছর পর আমরা দেখছি, কৃষকরা তাঁদের ফসলের উচিৎ মূল্যের দাবিতে বিক্ষুব্ধ হয়ে বারবার রাস্তায় নামছেন। জওয়ানরা নিজেদের আবেগকে সংযত করে তাঁদের বাড়ি থেকে বিদায় নেওয়ার সময়ে আত্মীয় পরিজনদের বলেন,

ফিরে এলে কথা হবে। নাহলে মোমবাতি নিয়ে মিছিলে যোগ দিও।

(আজ্ঞে হ্যাঁ, গতকাল সন্ধ্যায় চলন্ত রেল কামরায় বসে কাশ্মিরে নিজেদের পোষ্টে ফেরৎ যাওয়ার পথে দুই জওয়ান ফোনেতে তাঁদের প্রিয়জনদের এইভাবে বিদায় সম্ভাষণ জানাচ্ছিলেন, যা আমি পাশে বসে নীরবে শুনেছি। নীরবে। শুভেচ্ছাটুকুর উষ্ণতা ছাড়া আমার আর কীই বা দেওয়ার আছে?)

***

আসন্ন লোকসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে ক্ষমতাসীন এবং বিরোধী দলগুলির ঘুঁটি সাজানো দেখছি আমরা। পাঁচ বছর আগে যে প্রতিশ্রুতিগুলি দেওয়া হয়েছিল, তার অধিকাংশই অপূর্ণ রয়ে গেছে। সাধারণ মানুষ তা উপলব্ধি করেছে। এই উপলব্ধিকে হাতিয়ার করে বিরোধী পক্ষের মাথারা জোটবদ্ধ হতে চাইছেন। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন বিজেপি ইতিমধ্যেই টের পেয়েছে যে সবকা সাথ, সবকা বিকাশ-এর পরিবর্তে দেশের মানুষদের ধর্ম এবং জাতির নিরীখে যেভাবে বিভাজিত করা হয়েছে, তাতে স্লোগানটি পরিবর্তিত হয়ে এখন হয়ে উঠেছে আপনা সাথ, আপনা বিকাশ। আম্বানি এবং আদানিদের স্বার্থরক্ষা কৃষকদের অস্তিত্বরক্ষার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

দেশের উন্নয়নকে নোটবন্দি করবার পর আমরা শুনেছি অযোধ্যায় রাম মন্দির গড়ে তোলবার দাবিতে তথাকথিত হিন্দুত্ববাদীদের হুঙ্কার, যা সুপ্রিম কোর্টের আদেশকে ছাপিয়ে যেতে উদ্যত। (তবে মন্দির হলেই যে দেশের তথা হিন্দুজাতির উন্নয়ন ঘটবে, এমন সমীকরণে যারা আস্থা রাখেন, তাঁদের অন্তত একটি বিষয়ে অবহিত থাকা উচিৎ। গুজরাটের ভদোদরা থেকে একশো কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে কেভাড়িয়া কলোনিতে প্রতিষ্ঠিত ১৮২ মিটার উঁচু সর্দার বল্লবভাই প্যাটেলের ইউনিটি অফ ইণ্ডিয়া মূর্তিটি কিছু পর্যটনপ্রেমীর গন্তব্যস্থল হলেও এলাকার মানুষদের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতিতে কতটা উন্নতি ঘটাতে পেরেছে বা দেশের গৌরব কতটা বৃদ্ধি করেছে, তা এখনও অস্পষ্ট।) এবার পুলওয়ামা জঙ্গিহানা পরবর্তী সময়ে দেশপ্রেম এবং দেশদ্রোহিতার বিভাজন পদ্ধতিটিকে নির্বাচন প্রচারে যুযুধান রাজনৈতিক দলগুলি কেমনভাবে ব্যবহার করবে, তা নিয়ে কৌতূহল থাকবে।

***

পশ্চিমবঙ্গে ইদানিং ছেলেধরা, কিডনি চোর ইত্যাদি গুজব তুলে গণপিটুনির বেশ কিছু ঘটনা ঘটে চলেছে। এর সঙ্গে কলকাতা শহরে ভূতদের উপর চোরা আক্রমণও যথেষ্ট কৌতূহলপ্রদ। গত ১৫ই ফেব্রুয়ারি অনীক দত্তের সাম্প্রতিক ছবিটি বিভিন্ন প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেল বটে। কিন্তু তার পরদিনই হঠাৎ করে কলকাতার প্রেক্ষাগৃহগুলি তার প্রদর্শন নিষিদ্ধ হল। আজ, এক সপ্তাহ বাদেও কর্তৃপক্ষের কেউ নিশ্চিত বলতে পারছে না ভারতের সার্টিফিকেশন বোর্ডের ছাড়পত্র পাওয়ার পরেও শহরবাসী ছবিটি দেখা থেকে বঞ্চিত কেন। অথচ উত্তর চব্বিশ পরগণার বিভিন্ন প্রেক্ষাগৃহে ছবিটি প্রায় পূর্ণ দর্শকাসনে নিয়মিত প্রদর্শিত হয়ে চলেছে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী কয়েক দিন আগে আয়োজিত একটি সাংবাদিক সম্মেলনে পুলওয়ামার জঙ্গিহানার কাণ্ডটির রহস্যজনক দিকগুলির দিকে ইঙ্গিত করেছেন। কিন্তু সেখানে এক সাংবাদিক “ভবিষ্যতের ভূত” ছবির প্রদর্শন বন্ধের রহস্যের দিকটি নিয়ে প্রশ্ন করলে মুখ্যমন্ত্রী স্পষ্ট জানান, “আমি এই বিষয়ে কিছু বলব না। এটি অন্য ব্যাপার।”

বস্তুত, ব্যাপারটি ‘অন্য’ বলেই আমরা কৌতূহলী। কিউব বা ইউএফও (স্যাটেলাইটের সাহায্যে ডিজিটাল সিনেমা প্রক্ষেপণের দুই কার্যকরী ব্যবস্থা)-র সার্ভার এই বিশেষ ছবিটির ক্ষেত্রেই কেন বিকল তা প্রযোজক, পরিচালক বা কেউই জানে না। ইতিমধ্যে প্রেক্ষাগৃহের মালিকদের কাছে আইনি নোটিস পাঠান হয়েছে। দুদিন আগে প্রযোজকদের পক্ষ থেকে জানানো হয় যে প্রেক্ষাগৃহ মালিকদের বিরুদ্ধে তাঁরা কলকাতার সদ্য ভারপ্রাপ্ত পুলিশ কমিশনারের কাছে একটি অভিযোগ জানিয়েছেন। কিন্তু এই নিবন্ধটি লেখবার সময় অবধি তাঁর দপ্তরে সেই অভিযোগ এসে পৌঁছায়নি। অবশ্য এলেও তিনি আদৌ কি ইতিবাচক পদক্ষেপ নিতে পারবেন? কলকাতার অদ্ভুত অন্ধকারে পুলিশের মৌখিক নির্দেশে অলৌকিক শক্তি ভর করে যে! যার আরাধনা হয় রাজনৈতিক দপ্তরের বন্ধ ঘরগুলিতে।

এবছরের জাতীয় নাট্য উৎসব উপলক্ষে রবীন্দ্র সদন, গিরীশ মঞ্চ প্রভৃতি সংলগ্ন এলাকাগুলিতে ফ্লেক্সের সংযত ভাব লক্ষণীয় ছিল। আমরা তখনই বুঝেছি কলকাতা ফিল্মোৎসবে ফ্লেক্সঢাকা নন্দন চত্বর নিয়ে অনীক দত্তের তির্যক মন্তব্যটি ক্ষমতাসীন দলের অন্তরে আঘাত করেছে। কিন্তু, এর আগে থেকেই অনীক দত্ত যথেষ্ট সন্দেহভাজন হয়ে উঠেছিলেন। যখন তিনি কলকাতা শহরের বিভিন্ন ফিল্ম স্টুডিয়োতে “ভবিষ্যতের ভূত” চলচ্চিত্রায়িত করছিলেন। ছবিটির বিভিন্ন দৃশ্যের বাস্তব অনুষঙ্গগুলি কলাকুশলীদের একটি অংশ রাজনৈতিক নেতাদের গোচরে আনছিলেন। চলচ্চিত্রায়ন প্রক্রিয়ার পর্বটিতেই বিভিন্নভাবে অসহযোগের মধ্যে দিয়ে প্রত্যক্ষে এবং পরোক্ষে বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছিল পরবর্তীকালে কী ঘটতে পারে।

সামগ্রিকভাবে চলচ্চিত্র নির্মাণের সঙ্গে যুক্ত দুটি বিষয় নিয়ে অল্প কিছু কথা এক্ষেত্রে জরুরি। প্রথমত, চলচ্চিত্র একটি শ্রম-নির্ভর শিল্প। আলো এবং বৈদ্যুতিক সংযোগে দক্ষ কলাকুশলীদের পেশাদারী অংশগ্রহণ ছাড়া বানিজ্যিক ছবির শ্যুটিং অসম্ভব। সাম্প্রতিককালে এই কলাকুশলীদের দক্ষতার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে, তাঁরা শাসক দলের প্রতি বিশ্বস্ত কিনা, এই প্রশ্নটি। বোম্বে (অধুনা মুম্বাই) চলচ্চিত্র শিল্পে যে কলাকুশলীরা যুক্ত, তাঁদের অধিকাংশই দীর্ঘ সময় ধরে শিবসেনা দলের সদস্য। এই মানুষগুলির পেশাদারি দক্ষতার প্রশ্নে রাজনৈতিক পরিচয়টি মুখ্য হয়ে ওঠেনি বলেই জানি। তবে কলকাতার ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্রটি বাস্তব হয়ে ওঠবার ফলে পরিস্থিতিটি ক্রমশ চিত্রগ্রাহক তথা পরিচালক এবং প্রযোজকদের হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে। যে কলাকুশলীদের চিত্রগ্রাহক নির্বাচন করছেন, তাঁরা ছবিটিতে শুরু থেকে কাজ করলেও সেই মুহূর্ত থেকে কাজ করতে পারবেন না বলে জানিয়ে দেন, যখন তাঁরা উপলব্ধি করেন শাসকদল এই ছবির বিষয়বস্তু সম্পর্কে অসন্তুষ্ট। দ্বিতীয়ত, বানিজ্যিক ছবি নির্মাণের সময়টিতে সংশ্লিষ্ট অভিনেতা এবং কলাকুশলীদের বিষয়বস্তু সম্পর্কে গোপনীয়তা বজায় রাখবার শর্তটি থাকে। বহুক্ষেত্রে তা লিখিত চুক্তি হিসেবে থাকে। কিন্তু এক্ষেত্রে দৈনন্দিন চুক্তিতে যারা ছবিটিতে প্রযুক্তিগত কাজগুলিতে অংশ নিয়েছেন, তাঁদের ক্ষেত্রে শর্তটি অলিখিত একটি অনুরোধ হিসেবে বজায় রাখবার কথা। “ভবিষ্যতের ভুত”-এর পরিণতি দেখলে বোঝা যায় কলাকুশলীদের একাংশ এই অনুরোধটি রক্ষার প্রয়োজন অনুভব করেননি। এবং সেই কারণেই বিতরক সংস্থা ভেঙ্কটেশ ফিল্মস ছবিটির মুক্তির অনেক আগেই আইনগত জটিলতা সৃষ্টি করে। যার জন্য ছবির পোস্টারে পরিচালককে জানাতে হয় এটি “ভূতের ভবিষ্যৎ”-এর সিক্যুয়েল নয়।

এখানে লক্ষণীয় বিষয় একটি। এযাবৎ কোনও রাজনৈতিক অথবা ধর্মীয় সংগঠন “ভবিষ্যতের ভূত” ছবিটি প্রদর্শনে দৃশ্যত বাধা সৃষ্টি করেনি, যেমনটা সঞ্জয় লীলা বনশালির “পদ্মাবত” ছবিটির চিত্রায়ন এবং মুক্তির সময়ে সমস্ত দেশ দেখেছে। পশ্চিমবঙ্গের শাসক দলের নেত্রী, যিনি মুখ্যমন্ত্রীও বটে, তখন প্রকাশ্যে সঞ্জয় লীলা বনশালিকে আমন্ত্রণ জানিয়ে বলেছিলেন পশ্চিমবঙ্গে তিনি নিশ্চিন্তে ছবিটির প্রদর্শনী উদ্বোধন করতে পারেন। অসহিষ্ণুতার তপ্ত হাওয়ায় সারা দেশ যখন দিশাহারা, মুখ্যমন্ত্রীর সাহসী আশ্বাসে কলকাতার মানুষ হিসেবে আমরা গর্বিত হয়েছি। সেই একই মানুষ যে কলকাতায় “ভবিষ্যতের ভূত” ছবিটির প্রদর্শনে বাধা হয়ে উঠেছেন, তা বিশ্বাস করা তাই কঠিন। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে পশ্চিমবঙ্গের সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রটিতে অনুপ্রেরণা-র বহর যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে একটি ধারণা তৈরি হওয়া অস্বাভাবিক নয়। হয়তো বা তা অবাস্তব বা ছেলেমানুষি।

প্রায় প্রত্যেক পরিবারে শিশুদের আচরণ নিয়ন্ত্রণ করেন তাদের অভিভাবকেরা। শিশুরা কী পড়বে, পরবে, বলবে, লিখবে, খাবে, শিখবে, করবে সেই বিষয়ে অভিভাবকই হল শেষ কথা। শিশুরা বায়না করলে অথবা অবাধ্য হলে অভিভাবক বকুনি দেবেন। পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে মনে করলে শিশুদের দৈহিক এবং মানসিক শাস্তি দিতে অভিভাবক পিছপা হন না। কারণ, শিশুদের এই “বোধ” নেই কোনটা তাদের জন্য ভালো বা মন্দ। কারণ, শিশুর উপর অভিভাবক হিসেবে নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করাটা আমাদের সমাজে এখনও স্বীকৃত। উপরের এই ছয়টি বাক্যে “শিশু” শব্দটির পরিবর্তে “পশ্চিমবঙ্গবাসী” ব্যবহার করলে বর্তমান নিয়ন্ত্রণের স্বরূপটি জাজ্বল্যমান হয়ে উঠবে। এই নিষ্পেষণই ক্রমশ যে আমাদের নিয়তি হয়ে উঠছে, তা ভেবে শিশুদের মতো আমরাও ক্রমশ অস্থির হই। কবে দিদি মেনে নেবেন যে ইতিমধ্যে আমাদের দায়িত্বজ্ঞান জন্মেছে, আমরাও বড় হয়েছি?

***

কভি আপনে শোচা আপ ভি গলত হো সকতে হো? আপনে আব তক যো বিসোয়াস কিয়া কি হমারে জিন্দগি অ্যায়সেই হোঙ্গে, উয়ো গলত ভি হো সকতে হ্যাঁয়?

জোয়া আখতার পরিচালিত “গাল্লি বয়” ছবিটির শেষাংশে ছেলে তার বাবাকে এই মোক্ষম প্রশ্নটি করে। বাবা অবশ্য নিজের অবস্থানে অনড় থেকে উত্তরে জানায় আমি তোর থেকে বেশি দেখেছি জীবন। তাই আমি জানি এটাই সত্যি। ধরাভি বস্তিতে একটি ড্রাইভারের পরিবারের বড় ছেলেটির বড় হয়ে ওঠার গল্প বলতে গিয়ে জোয়া আখতার স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে আমাদের নিভৃত আবেগটিকে স্পর্শ করেছেন। আমাদের। যাদের আকাঙ্খাপূরণে বারবার এমনভাবে ছেদ পড়ে যেতে থাকে যে ভুলে যাই আকাঙ্খা বলে কোনও কিছু আমাদেরও ছিল। অবদমিত রাগের বিস্ফোরণ ঘটতে থাকে উদ্ধত উচ্চারণ আর প্রকাশভঙ্গীতে। লেখা শব্দগুলির মধ্যে দিয়ে বয়ে চলে গনগনে আগুনের স্রোত। মুরাদ তার বাবাকে বোঝায়, “হমারা সচ অগর হমারা সপনে কো সচ নহি বনানে দেতা, তো হম অপনা সচ হি বদল দেঙ্গে।”

নিজের স্বপ্নকে সত্যি করতে পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি পরিবর্তন ঘটানোর জন্য যে ইস্পাতের দৃঢ়তা প্রয়োজন, তা আরেকবার মনে করিয়ে দেয় “গাল্লি বয়”। আমেরিকার কালো মানুষদের ঘেটোগুলিতে অনুরণিত র‍্যাপ গানের ছন্দকে ভারতের তথাকথিত পরিশীলিত সাংস্কৃতিক বৃত্তে বিসদৃশ মনে হতো এতদিন। কিন্তু র‍্যাপ গানের মধ্যে দিয়ে অকবির কবি হয়ে ওঠবার যে নিবিড় সাধনা, সেই সাধনাকেই পর্দায় ফুটিয়ে তুলল রিমা কাগতি এবং জোয়া আখতারের চিত্রনাট্য, ডিভাইন এবং জাভেদ আখতারের কথা, জয় ওজা-র রূঢ় বাস্তবোচিত চিত্রগ্রহণ, নকুল কামতে-র শব্দ পরিকল্পনা দেবজিত চাংমাই-এর সুচারু শব্দ মিশ্রণ এবং বিজয় মৌর্যের তীক্ষ্ণ সংলাপ। “আপনা টাইম আয়েগা” – এই বিশ্বাস যে আদৌ অসম্ভব নয়, তা বাস্তবে পরিণত হওয়ার জন্য যে একটি নির্দিষ্ট যাত্রাপথ অতিক্রম করতে হয়। নকল অ্যাডিডাসের পরিধানে অভ্যস্ত শরীরে আসল অ্যাডিডাস পণ্য ব্যবহার যে একধরণের অর্জন, তার কথাই বলে “গাল্লি বয়”।

না, এই ছবির প্রয়োগগত বা নান্দনিক দিকগুলি নিয়ে বিস্তৃত আলোচনার পরিসর নয় এটি। ইচ্ছেও নেই। কারণ, অদ্ভুত এক আঁধারে আচ্ছন্ন সময়টিতে যে ভাবনাগুলি এই বিক্ষিপ্ত মনে জমা হয়েছে, তা উজার করেছি এখানে। লিখতে লিখতে পদযাত্রায় সামিল সেই অদেখা কৃষকটির দীর্ঘশ্বাসে চমকে উঠেছি। আশাহত, ক্লান্ত পায়ে যিনি দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে চলেছেন শুধুমাত্র এই আশ্বাসটুকু পাবেন বলে যে তাঁর পরিবার ভবিষ্যতে একটু ভালোভাবে বাঁচবে। আঙুলগুলিতে সেই তরুণ সৈনিকটির শক্ত কব্জির জোর অনুভব করছি লিখতে লিখতে, যার জীবন কর্তব্যে সমর্পিত হলেও নিয়তি সম্পূর্ণভাবেই রাজনৈতিক সূত্রে গ্রন্থিত। নিজেকে প্রমাণ করবার লড়াইয়ে চুল পাকিয়ে ফেলা স্বপ্নসন্ধানী সেই চলচ্চিত্রকারের চিৎকার কানে বেজেছে, যিনি এখনও মেনে নিতে পারেননি যে, আষ্টেপিষ্টে বেঁধে ফেলা এই সমাজব্যবস্থার মাঝে তার স্বাধীন ভাবনাগুলিকে রূপ দেওয়ার প্রশ্রয় তিনি কারো কাছে আর পাবেন না। তবুও এর মাঝে “গাল্লি বয়” যখন পর্দায় নিজের স্বপ্নকে খুঁজে পেয়ে সময়কে নিজের অনুকূলে আনে, কে জানে কেন, এই অদ্ভুত অন্ধকারেও আলো জ্বলে উঠতে দেখি তখন।