আমরা সাফল্যের সঙ্গে অরওয়েলের দুনিয়াকে বাস্তবে পরিণত করেছি!

আমরা সাফল্যের সঙ্গে অরওয়েলের দুনিয়াকে বাস্তবে পরিণত করেছি | শ্বেতলানা গানুশকিনা

শ্বেতলানা গানুশকিনা

 

(খোলা চিঠি, আনা পোলিতকোভস্কায়াকে, ৭ই অক্টোবর, ২০২২)

শ্বেতলানা আলেক্সেভনা গানুশকিনা (জন্ম ৬ই মার্চ ১৯৪২) রাশিয়ার একজন গণিতবিদ এবং মানবাধিকারকর্মী যিনি ২০১০ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য অন্যতম বিবেচ্য ছিলেন বলে শোনা যায়। ১৯৯০-এর দশকে যখন সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের দেশগুলিতে একাধিক হিংসাত্মক সংঘাত শুরু হয় তখন গানুশকিনা রাশিয়ায় একজন মানবাধিকারকর্মী হিসেবে সুপরিচিত হন। তাঁর কাজ বিশেষভাবে উদ্বাস্তু, অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত ব্যক্তি, ও যুদ্ধের ফলে ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্যের জন্য নিবেদিত। এই চিঠিটি নোভায়া গ্যাজেটা পত্রিকার ইউরোপীয় সংস্করণে গত ৭ অক্টোবর প্রকাশিত হয়। বাংলায় অনুবাদ করেছেন অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়

প্রিয় আনা,

আরও একবার, আবারও একবার— আমরা যেন আরও এক ভয়াবহ যুদ্ধের মাধ্যমে জুড়ে গিয়েছি। এই যুদ্ধ, এমনই এক যুদ্ধ, যা কিনা ৯৬-এর চেচেন সংঘর্ষের চেয়েও আরও, আরও অনেক বেশি পরিমাণে ভয়ানক, আরও অনেক বেশি পরিমাণে রক্তক্ষয়ী, ও একইসঙ্গে আরও অনেক বেশিগুণে অদ্ভুত ও অবাস্তব। এমনই এক যুদ্ধ যা কিনা আমাদেরও ভবিতব্যকে একসময়ে জুড়ে দিয়েছিল, আমার এখন সেই চেচেন যুদ্ধেরই সময়কার কথা মনে পড়ছে।

আনা, আমার সেই আগস্ট মাস মনে পড়ে। তুমি ফোন করেছিলে আমায়। জিজ্ঞেস করেছিলে আমি এমন কোনও শিশুকে চিনি কিনা, যে কিনা সেই বছরেরই ১ সেপ্টেম্বর স্কুলে ভর্তি হতে চলেছে। তুমি বোধহয় শান্তিকামী কোনও একটি ছবি সেসময়কার বিশেষ সংবাদ হিসেবে তুলে ধরতে চেয়েছিলে, পূর্ণাবয়ব একটি চিত্রে কোনও এক চেচেন শিশু মস্কোর রাস্তা দিয়ে ফুলের তোড়া হাতে নতুন স্কুলে ভর্তি হতে চলেছে। আমি তোমার আশা পূরণ করতে পারিনি। সেই সময়ের কিছুকাল মাত্র আগেই, অভিভাবকদের মস্কো প্রশাসনের অধীনে রেজিস্ট্রেশন নেই— এমন সমস্ত শিশুদের স্কুলে ভর্তির ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল। একই সঙ্গে আরও একটি বিশেষ আইনের মাধ্যমে চেচেনদের এমন রেজিস্ট্রেশন বা নিবন্ধীকরণের জন্য অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছিল। আমি তোমাকে সেইসব মানুষদের দুর্দশার কাহিনি শুনিয়েছিলাম। যারা কিনা বোমার হাত থেকে, শেলের হাত থেকে বাঁচতে মস্কোতে বসবাসকারী আত্মীয়স্বজনের কাছে পালিয়ে এসেছিল। যারা কিনা সেই সময়ে ভয় পেয়েছিল, যে তাদের আর চাকরি থাকবে না, তাদের ব্যবসা বন্ধ করে দেওয়া হবে, যাদের ভাড়াটে হিসেবে থাকার চুক্তিপত্রকে এক লহমাতে ছিঁড়ে ফেলে, বাজে আবর্জনার ঝুড়িতে ঝেঁটিয়ে ফেলে দেওয়া হবে।

ঠিক তার পরদিনই তুমি, তোমাদের কাগজের সম্পাদকীয় দপ্তরের মাধ্যমে শরণার্থীদের জন্য তোলা আর্থিক সাহায্য নিয়ে আমাদের অফিসে এসে হাজির হয়েছিলে। তাদের জীবন ও সমস্যার সঙ্গে একাত্ম হয়ে জুড়ে গিয়েছিলে। এর পর থেকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এই বিশেষ সমস্যাটিই তোমার কেরিয়র, এমনকি ব্যক্তিগত জীবনেরও ধ্যানজ্ঞান হয়ে থেকে গিয়েছিল। পৃথিবী চেচেনদের সম্পর্কে জেনেছিল, তোমার সম্পর্কে জেনেছিল। সেইদিন থেকে বহুদিন অবধি, নোভায়া গ্যাজেটায় তোমার যে অফিসঘর— সেটিই কি করে যেন বহু, বহু মানুষের সঙ্কটের আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছিল।

এরপর এল একের পর এক চেচনিয়া সফরের বৃত্তান্ত। ২০০০ সাল ও তার পরবর্তীতে আমাদের এই মেমোরিয়াল সংগঠনের অফিস ও শাখা-অফিসগুলিই কার্যত তখন সাংবাদিকদের বেসক্যাম্পে পরিণত হয়েছিল। তুমি আসতে, বিশেষ একেকটি ঘটনা বা পরিবার সম্পর্কে জানতে চাইতে, আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলতে— তাঁদের ধীরেসুস্থে বোঝাতে চেষ্টা করতে, যে আদতে সংবাদমাধ্যমে কোনও খবর প্রচারিত হলে তা তাদের মক্কেলদের নিরাপত্তায় কোনও ব্যাঘাত তো ঘটায়ই না, উলটে তা সুনিশ্চিত করে। এমন সহযোগিতার মাধ্যমে কত জীবনই না আমরা বাঁচাতে পেরেছিলাম।

একেকসময়ে আদালতের বিচারক যাঁরা ছিলেন, তাঁদেরকেও দুটি কঠিন সিদ্ধান্তের মধ্যে একটিকে বেছে নিতে হত— তাঁরা তাঁদের উচ্চতর প্রভুদের নির্দেশকে অমান্য করবেন, নাকি তাঁরা আইনের শাসনের চূড়ান্ত পরাজয়ের নজির হিসেবে তোমার লেখা রিপোর্টাজগুলিতে জায়গা করে নেবেন। সবসময়ে কিন্তু তাঁরা আনুগত্যকেই মেনে নেননি। একেকসময়ে তাঁরাও কিন্তু সাহস দেখাতে পেরেছিলেন।

২০০২ সালে— ডিসেম্বর মাসের শেষদিকে কোনও এক সময়, আমরা চেচেন প্রজাতান্ত্রিক সরকারের কোনও একটি সরকারি ভবনে অবস্থান করছিলাম। আমরা চলে আসার ২০ মিনিট পর ভবনটিকে বোমা বিস্ফোরণে উড়িয়ে দেওয়া হয়। গোটা শহর সেই বিরাট বিস্ফোরণের অভিঘাতে ধোঁয়ায় ঢেকে গিয়েছিল। আমরা সেই বিধ্বস্ত শহরের এক চৌমাথায় দাঁড়িয়ে লোকজনের সঙ্গে কথা বলছিলাম, যাঁরা কিনা কোনওভাবে নিজেদের বাড়ির ধ্বংসস্তূপ ঠেলে বেরিয়ে আসতে পেরেছিলেন, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বুঝে নিতে চেষ্টা করছিলেন। পরবর্তীতে আমরা মস্কো ফিরে এসে সেই বিস্ফোরণে আহতদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছিলাম। এটা আমাকে বলতেই হবে, সেই সময়ে দাঁড়িয়ে তোমার রিপোর্টাজ, তোমার সম্পাদকীয় নিবন্ধগুলি— পক্ষ-নির্বিশেষে সেই বিস্ফোরণে আহতদের সকলের চিকিৎসার অধিকার নিশ্চিত করেছিল।

তোমার সঙ্গে আলাপের একবছর পর শেষবার আমরা একসঙ্গে কাজ করেছিলাম। খাশাভ্যুরৎ (Khasavyurt) শহরের সেই সংঘর্ষের ঘটনা। কেউ বা কারা কিছু চেচেন যুবককে কৌশলে বুঝিয়েছিল (তারা ছিল ডাগেস্তান এলাকার খাশাভ্যুরৎ প্রদেশের বাসিন্দা), সমুদ্রের ধারে কোথাও তারা এলে পরে, তাদের সঙ্গে মুক্ত স্বাধীন চেচেন রাষ্ট্রের বিষয়ে আলোচনা করা হবে। ২০০৬ সালের ১২ অথবা ১৩ জুলাই তারিখের সেই রাত্তিরে, তাদেরকে ভুয়ো সামরিক পোশাকে সাজিয়ে, একটি ভুয়ো অ্যামবুশ বা এনকাউন্টারের মধ্যে তাদের নিয়ে গিয়ে, সকলকে ঠান্ডা মাথায় গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেওয়া হয়। মোট ১৩ জন সেদিন মারা যায়। ৫ জন অত্যাশ্চর্যভাবে প্রাণে বেঁচে থাকে।

সংবাদমাধ্যমের কাছে এই ঘটনাটিকে উগ্রপন্থীদের বিরুদ্ধে পরিকল্পিত অভিযান হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়। সমস্ত বিদেশি সংবাদমাধ্যমের কাছেও এই খবর ছড়িয়ে পড়ে। তারাও এই খবরটিকে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে এক বিরাট সাফল্য হিসেবে প্রচার করতে থাকে। এই দারুণ ‘শ্যুটআউট’-এর জায়গা থেকে প্রচুর পরিমাণে অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার হয়েছে বলেও সরকারি তরফে জানানো হয়। এমনকি নোভায়া গ্যাজেটা অবধি তাদের একটি নিবন্ধে উল্লেখ করে, “এই যুবকেরা যে কোনও উগ্রপন্থী গোষ্ঠীর সঙ্গেই সরাসরি যোগ দিতে যাচ্ছিল, তা মোটামুটি নিশ্চিত করেই এখন বলা যেতে পারে।”

যারা বেঁচে গিয়েছিল, তাদের সকলের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা রুজু করা হয়। নিহতদের পরিবার-পরিজনদের উপরও সরকারি তরফে ক্রমাগত চাপ সৃষ্টি করা হতে থাকে। ২০০৬ সালের ১৬ থেকে ১৮ আগস্ট, আমি নিজে রাসিয়াত ইয়াসিয়েভা-র (তিনি সেসময়ে মেমোরিয়াল সংগঠনের ডাগেস্তান এলাকার খাশাভ্যুরৎ প্রদেশের আইন ও শরণার্থী বিষয়ক যে বিভাগ, সেই বিভাগে আইনজীবী হিসেবে কর্মরত ছিলেন) সঙ্গে খাশাভ্যুরৎ-এর দুটি গ্রাম ও সঙ্গে বৃহত্তর ডাগেস্তান এলাকারও আরও কয়েকটি গ্রামে সফর করি। এই সময়ে আমরা জুলাইয়ের যে সংঘর্ষের ঘটনা, তার ফলে ক্ষতিগ্রস্ত মোট ১৭টি পরিবারের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পাই। এর থেকে আমাদের কাছে যে চিত্র উঠে আসে তাকে ভয়াবহ ও বীভৎস বলে চিহ্নিত করলেও কম বলা হবে বোধহয়।

মস্কোতে ফিরে এসে আমি খাশাভ্যুরৎ-এর বীভৎসতা সম্পর্কে লিখতে চেষ্টা করি। কিন্তু সেই মানসিক অবস্থায় প্রশাসকের অফিসে পূর্ণাঙ্গ তদন্ত চেয়ে একটি আপিলের চিঠি ভিন্ন আর কিছুই লিখে ওঠা আমার পক্ষে অসম্ভব ছিল। সেই সময়ে আমি তোমাকে ফোন করি আনা, এবং আমার সফরের বিষয়ে সবকিছু আমি তোমাকে জানাই।

তুমি সঙ্গে সঙ্গে বলেছিলে, পরদিন সকালেই তুমি আমার কাছে চলে আসবে ও আমার একটি সাক্ষাৎকার রেকর্ড করবে। সেই সাক্ষাৎকারে আমি যা বলেছিলাম, তা ছিল আসলে প্রকৃতপক্ষেই সন্তানহারা সেই সব চেচেন পরিজনদের আকুতি ও প্রত্যক্ষ বিবরণ।

তোমার সেই নিবন্ধ (যার কিনা তুমি শিরোনাম দিয়েছিলে ‘সমুদ্রসৈকতে হঠাৎ সামরিক হয়ে ওঠা কিছু স্কুলছাত্রের জীবনী’), নোভায়া গ্যাজেটাতে প্রকাশিত হয়েছিল। সেই নিবন্ধ খাশাভ্যুরৎ-এর ঘটনার পিছনে লুকিয়ে থাকা আসল সত্যটিকে তুলে ধরে। সেই নিবন্ধ খাশাভ্যুরৎ-এর ঘটনায় নিহতদের পরিবার-পরিজন ও আহতদের সকলকে বাঁচাতে সহায়তা করে। অবশ্যই তারা বেকসুর খালাস পায়নি কোনওভাবেই, কিন্তু তাদের কপালে জোটা শাস্তির পরিমাণ অনেকাংশেই কমে এসেছিল। খুব তাড়াতাড়িই জেলের মেয়াদ কাটিয়ে তারা ছাড়াও পেয়েছিল। খুবই সম্প্রতি যদিও সেই সব পরিবারের মধ্যে একটি পরিবারকে, এতদিন পরে আবারও তাদের সেই ‘পুরনো পাপ’-এর কারণে হেনস্থা করা হয়। সেই পরিবারের বিরুদ্ধে আবারও আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। আমরা আবারও তোমারই সেই নিবন্ধকে ইতিহাস খুঁড়ে তুলে এনে সেই পরিবারটিকে বাঁচাতে সক্ষম হয়েছি।

আমার আরও মনে পড়ছে, জানুয়ারি ২০০৫ সালে, হেলসিঙ্কিতে কোনও এক সম্মেলনে চেচনিয়ার বিষয়ে আমাদের বক্তৃতা ও প্রেজেন্টেশন-পর্ব শেষ হয়ে গেলে পরে, আমরা পর পর দুদিন বিকেলে, বরফ-ঢাকা কোনও এক ছোট্ট কটেজের বারান্দায় বসে একসঙ্গে চা খেয়েছিলাম। সে যেন এক রূপকথার অরণ্য-ঘেরা পরিবেশ। ধন্যবাদ দিই সেই আশ্চর্য মোহময়ী পরিবেশকে আজ, বোধহয় তারই কারণে আমরা সেই দিনগুলোয় হঠাৎ করেই কেন বা জানিনা নিজেদের ব্যক্তিগত বিষয়গুলিকে নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। তুমি, আনা, সেই সময়েই হঠাৎ— আমাকে তোমার সন্তানদের বিষয়ে গল্প শুনিয়েছিলে। তাদের উচ্ছলতা, সঙ্গীতবিষয়ে তাদের পারদর্শিতার কথা, বলেছিলে আমায়।

সেই কথা বলতে বলতে, তোমার সমস্ত মুখমণ্ডল জুড়ে সেই মুহূর্তটিতে, হঠাৎই যেন বা এক জ্যোতি ফুটে উঠেছিল। আমি উপলব্ধি করেছিলাম, তোমার সমস্ত আবেগময় পরিপূর্ণ বিবেকটুকুকে দিয়ে, কতখানি— কতখানি জোরের সঙ্গে তুমি তাদেরকে ভালবাসো।

আনা স্তেপানোভনা পোলিতকোভস্কায়া (৩০ আগস্ট ১৯৫৮-৭ অক্টোবর ২০০৬) ছিলেন একজন রাশিয়ান সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী, যিনি রাশিয়ার রাজনৈতিক ঘটনা, বিশেষত দ্বিতীয় চেচেন যুদ্ধের (১৯৯৯-২০০৫) সময় দীর্ঘমেয়াদে খবর করেছিলেন। চেচনিয়া থেকে তার সাংবাদিকতা, পোলিতকোভস্কায়ার জাতীয় ও আন্তর্জাতিক খ্যাতির অন্যতম কারণ। সাত বছর ধরে, তিনি অনেক ভয়ভীতি ও হুমকি সত্ত্বেও যুদ্ধের রিপোর্টিং বন্ধ করতে অস্বীকার করেন। তাঁকে চেচনিয়াতে রাশিয়ান সামরিক বাহিনি গ্রেপ্তার করেছিল এবং তাঁকে মানসিক নির্যাতনের জন্য একটি প্রহসনমূলক মৃত্যুদণ্ডের পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে অবধি যেতে বাধ্য করা হয়েছিল। ২০০৪ সালে বেসলান পণবন্দি সঙ্কটের সময়, মস্কো থেকে রোস্তভ-অন-ডন হয়ে তিনি বেসলানে উড়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। তিনি সেই সময় চেচেন জঙ্গিদের সঙ্গে মধ্যস্থতার ক্ষেত্রে নিজের পরিচিতিকে কাজে লাগিয়ে সাহায্য করতে চেয়েছিলেন। সেই সময় উড়ানেই তাকে বিষ খাইয়ে হত্যার চেষ্টা করা হয়। ৭ অক্টোবর ২০০৬ তারিখে, পোলিতকোভস্কায়াকে তার অ্যাপার্টমেন্টের লিফটের ভিতর গুলি করে হত্যা করা হয়। এই হত্যাকাণ্ড আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। জুন, ২০১৪ সালে, পাঁচজনকে এই হত্যার জন্য কারাবাসে দণ্ডিত করা হয়। তবে কারা, কোন পরিস্থিতিতে পোলিতকোভস্কায়াকে হত্যার আদেশ দিয়েছিল বা অর্থ জুগিয়েছিল তা এখনও স্পষ্ট নয়। এই হত্যার পিছনে পুতিন প্রশাসন অথবা চেচেন একনায়ক নেতা রামজান কাদিরভেরও হাত থাকতে পারে বলে বিভিন্নজনে সন্দেহ প্রকাশ করেন।

আজকের বিষয়ে তোমাকে আর কীই বা বলব? গত ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২২, আমাদের দেশ রাশিয়ার তরফে ইউক্রেনভূমে সামরিক অভিযান শুরু হয়েছে। সেই সময়কার ঘটনাগুলির চেয়েও, যা আরও, আরও অনেক বেশি পরিমাণে ভয়ানক আজ।

আরও অনেক বেশি পরিমাণে অবিশ্বাস্য, অকল্পনীয় ও আমাদের সমস্ত বোধশক্তি দিয়ে তা অনুভবের বাইরে। হাজারে হাজারে মানুষের মৃত্যু, লক্ষ-নিযুতে বেড়ে গিয়েছে শরণার্থীর সংখ্যা।

শয়ে শয়ে যুবক-যুবতীরা আজ রাশিয়া ছেড়ে চলে গিয়েছে। প্রথম চলে গিয়েছে তারাই, যারা কিনা এই যুদ্ধবাজ স্বদেশের সঙ্গে নিজেদেরকে একাত্ম করে দেখতে চায়নি। যাদের শিক্ষা তাদেরকে এই ক্রমশই ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হয়ে আসা পৃথিবীর বুকে, যে কোনও অংশে দাঁড়িয়ে যে কোনও সময়ে অর্থ উপার্জন করে বেঁচে থাকবার ক্ষমতা দিয়েছে।

তারপর চলে গিয়েছে সেই সব মানুষ, সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মী, গবেষক ও পর্যবেক্ষকেরা সবাই, যারা কিনা বুঝে নিতে পেরেছে যে, এই রাশিয়াতে বসবাস করে আর তাদের পক্ষে নিজের কাজ বা জীবিকাকে চালিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না। গুচ্ছ গুচ্ছ মানুষকে সরকারি তরফে ‘বিদেশি এজেন্ট’-এর তকমায় দাগিয়ে দেওয়া হয়েছে।  তোমার নিজের কাগজ আনা, নোভায়া গ্যাজেটা, আর এখন রাশিয়াতে প্রকাশিত হয় না— মুদ্রিত অথবা বৈদ্যুতিন কোনও মাধ্যমেই। মেমোরিয়ালের যে মানবাধিকার বিভাগ ও আন্তর্জাতিক মেমোরিয়াল সংগঠন, রাশিয়াতে তা ভেঙে দেওয়া হয়েছে। নাগরিক সমাজকে চিরতরে ধ্বংস করা হচ্ছে। আমরা এখন মূলত অনলাইন মাধ্যমেই আলাপ-আলোচনা করতে স্বচ্ছন্দ বোধ করি, যতদিন অবধি অন্তত সেইটুকুও সম্ভব হচ্ছে।

শেষ অবধি প্রশাসনের তরফে ‘আংশিক মোবিলাইজেশন’-এরও ঘোষণা করা হয়েছে। হাজার হাজার মানুষ ইতিমধ্যেই রাশিয়া ছেড়ে পালিয়ে যেতে শুরু করেছে। তারা তাদের পরিবার-পরিজন সমেত পালিয়ে যেতে চাইছে, যদিও সবক্ষেত্রে তা সম্ভব হচ্ছে না। কন্সক্রিপশন অথবা বাধ্যতামূলকভাবে যারা সেনাবাহিনিতে নিযুক্তির জন্য নির্বাচিত, তারাই সবার প্রথমে পালিয়ে যেতে চাইছে। যুদ্ধ-বিরোধী সমস্ত ধরনের কর্মসূচিকে চূড়ান্তভাবে দমিয়ে দেওয়া হচ্ছে। চেচনিয়া থেকেও যে খবর আসছে, তাও অত্যন্ত ভয়ের ও আশঙ্কার। যে সমস্ত মহিলারা সেখানে যুদ্ধ-বিরোধী কর্মসূচিতে সামিল হয়েছিলেন, তাঁদের সকলকে স্থানীয় মেয়রের অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর তাঁদের সকলের স্বামীকে তুলে নিয়ে এসে, বন্দুকের নলের সামনে তাঁদেরকেই, তাঁদের স্ত্রীদের নির্মমভাবে মারার হুকুম দেওয়া হয়। পরদিন সেই সমস্ত মহিলাদের পুত্রসন্তান যাঁরা ছিলেন, তাঁদেরও সকলকে তুলে নিয়ে এসে সেনাবাহিনিতে ভর্তি করে নেওয়া হয়। এর মধ্যে এক মহিলার স্বামী, নিজের স্ত্রীর উপর ওভাবে অত্যাচার করতে বাধ্য হয়ে, ও পরবর্তীতে নিজের ছেলেকে সেনাবাহিনিতে ভর্তি করে নেওয়ার খবর শুনে, এবং সেই ছেলেকে শেষ অবধি ডনেৎস্ক অঞ্চলে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে দেখে, প্রবল মানসিক চাপে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছেন।

কেবল মানুষ নয়, আজকের রাশিয়াতে শব্দকে অবধি অবদমিত করা হচ্ছে। কেবল কিছু শব্দ উচ্চারণের অপরাধেই আজ যে কেউ এই পুতিনের রাশিয়াতে জেলের গরাদের ওপারেও অবধি গিয়ে পড়তে পারে।

তোমার মনে পড়ে আনা, সোভিয়েত-জমানার সেই উক্তিকে— “আমরা কাফকার দুনিয়াকে বাস্তবে পরিণত করতে জন্মেছি!”

আজ আমরা সাফল্যের সঙ্গে অরওয়েলের দুনিয়াকে বাস্তবে পরিণত করেছি!

আমাদের বন্ধুরা আজকাল প্রায়শই, তোমরা যারা আমাদেরকে ছেড়ে চলে গিয়েছ, তোমাদের সম্পর্কে বলে থাকে, “ভালই হয়েছে যে আজ ওরা আর আমাদের মধ্যে নেই। ওদেরকে এ জিনিস দেখতে হল না।”

আমার কিন্তু মোটেও তা মনে হয় না। আমি খুব সত্যি করে চাই, যদি আজ তুমি আমাদের সঙ্গে থাকতে। তোমার কন্ঠস্বর কেবল আমাদের দেশেই নয়, সীমান্ত পেরিয়ে সারা পৃথিবীতেও সোচ্চারে শোনা যেত তখন। সারা পৃথিবীতে এখন এক মিথ্যে ধারণা, মিথ্যে পারস্পেক্টিভ ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। পৃথিবীর আমজনতা মনে করছে, সমস্ত রাশিয়ানরাই বোধহয় এইরকম। তারা সকলেই বোধহয় মনে মনে এই যুদ্ধকে সমর্থন করে। না, একপক্ষে আমি আমি একবারের জন্যও আমার দেশের নামে এখন যা কিছু ঘটে চলেছে, তার দায় সম্পূর্ণভাবে আমার দেশের সমস্ত নাগরিকের উপর থেকে, সমস্ত জনসংখ্যার উপর থেকে সরিয়ে নিচ্ছি না।

কিন্তু এই ‘বিশেষ অপারেশন’এর নামে যা কিছুই হয়ে চলেছে, তার প্রতি আমাদের দেশের মানুষের যেটুকুও বা সমর্থন আছে, তাকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে প্রচারের আমি বিরোধিতা করি।

আনা, প্রিয়তম— এখন তুমি থাকলে সেই বিপুল— বিপুল-সংখ্যক স্বেচ্ছাসেবকদের বিষয়েও রিপোর্টাজ লিখতে পারতে, যারা কিনা সীমান্ত পার হয়ে আসা হাজার-হাজার, লক্ষ-লক্ষ ইউক্রেনীয় শরণার্থীদের সাহায্যার্থে কাজ করে চলেছে। যাদের মধ্যে বহু সংখ্যক রুশ নাগরিকও রয়েছে। অসংখ্য সুস্থিত গণ-সংগঠন আজ গড়ে উঠেছে, যারা কিনা এসমস্ত শরণার্থী মানুষদের রাশিয়া ছেড়ে চলে যেতে সাহায্য করছে অথবা এখানেই নিরাপদ ভাবে তাদের থাকার বিষয়ে ব্যবস্থা করে চলেছে।

এরাই প্রকৃত নাগরিক আজ, পুতিনের “হাতে নাচানো কাষ্ঠপুত্তলি নয় মোটেও, যারা কিনা বিনা প্রশ্নে ক্ষমতার অনুগত থাকে, যাদের কিনা কোনও অধিকারই আজ অবশিষ্ট নেই, এমনকি শান্ত সম্মানজনক মৃত্যুর অবধি নয়,” তোমাকেই উদ্ধৃত করে লিখতে চেয়েছিলাম।

যেমনটা পোলিশ বিরোধী নেতা এ্যাডাম মিচনিক বলেছেন, “দেশপ্রেমকে মাপতে হয় আজ, মানুষের মনের ভিতরে জড়ো হওয়া লজ্জার পরিমাণে, যতটুকু তারা অনুভব করে তাদের দেশের নামে সংঘটিত হওয়া সমস্ত অন্যায়-অপরাধের কারণে…”

আমরা, আমরা অনেকেই আজ লজ্জিত। কিন্তু যেদিন আমরা আমাদের এই সম্মিলিত লজ্জাকে গঠনমূলক কোনও কিছুতে পরিণত করতে পারব, আমাদের দেশের নামে আজ যা কিছু ঘটে চলেছে— তার দায় নিজের কাঁধে নিতে পারব, সেদিনই আমরা এই দেশের সামগ্রিক এক পরিবর্তনকে সূচিত করব।

তুমি, আনা পোলিতকোভস্কায়া, তুমি সেই লজ্জাকে গঠনমূলক কোনও কিছুতে পরিবর্তনের ক্ষেত্রে আলোকময় এক পথ-প্রদর্শক। ভালোবাসা নিও আমার,

ইতি,

শ্বেতলানা গানুশকিনা
৭ অক্টোবর, ২০২২


*আনা পোলিতকোভস্কায়া যে পত্রিকাতে সাংবাদিক হিসেবে কর্মরত ছিলেন, সেই নোভায়া গ্যাজেটার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক দিমিত্রি মুরাতভ ২০২১ সালে নির্ভীক সাংবাদিকতার জন্য নোবেল শান্তি পুরষ্কারে ভূষিত হন। শ্বেতলানা গানুশকিনা যে মানবাধিকার সংগঠনের সঙ্গে জড়িত, সেই মেমোরিয়াল প্রতিষ্ঠান মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় তাদের অবদানের জন্য ২০২২ সালের নোবেল শান্তি পুরষ্কারে সম্মানিত হয়েছে।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4661 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...