ভবিষ্যতের ভূতেদের জীবনের একটি ছোট্ট ঘটনা

অনীক দত্ত

মানস নাথ

 

নভেম্বর মাসে কলকাতা চলচিত্র উৎসব চলাকালীন প্রতিটা উৎসব প্রাঙ্গণের প্রতিটা কোণায় মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী এবং তৃণমূল কংগ্রেসের একছত্র অধিপতি শ্রীমতী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অজস্র ছবি দেখে পরিচালক অনীক দত্ত কিছু টিপ্পনি কেটেছিলেন। প্রশ্ন তুলেছিলেন চলচিত্র উৎসবে মমতার ছবি দিয়ে সাজানো হবে কেন! খুবই সাধারণ একটি প্রশ্ন, কিন্তু আজকের পশ্চিমবঙ্গে এই প্রশ্নটি প্রকাশ্যে করা কিন্তু খুব সহজ কাজ নয়। এখন রবীন্দ্রজয়ন্তী বা নজরুলজয়ন্তী উৎসবেও রবীন্দ্রনাথ বা নজরুলের চেয়ে মমতা ব্যানার্জির ছবি বড় করে থাকে। এটাই দস্তুর।

ফলে এই নিয়ে টিপ্পনি করে অনীক দত্ত শাসকদলের চক্ষুশূল হয়েই ছিলেন।

টালিগঞ্জ স্টুডিও পাড়ার একছত্র অধিপতি এখন মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসের ভাই স্বরূপ বিশ্বাস। জনশ্রুতি, তার সহযোগিতা ছাড়া কোনও সিনেমাই নির্বিঘ্নে শেষ করার উপায় নেই। এদিক থেকে অনীক দত্ত তো সাপের লেজে পা দিয়েই দিয়েছিলেন।

ফলে ঝামেলাটা শুরু হয়েছিল প্রথম থেকেই। বিভিন্ন হাত ঘুরে ভূতের ভবিষ্যত এবং তার সিক্যুয়েলের রাইট হস্তগত হয় ভেঙ্কটেশ ফিল্মসের। তারা প্রথম থেকেই আপত্তি জানিয়েছিল ভবিষ্যতের ভূত নিয়ে। অনীক দত্ত পরিষ্কার করে দেন এটা কোনওমতেই সিক্যুয়েল নয়, একটি স্বতন্ত্র ছবি। অগত্যা ছবি তৈরি হয়। কিন্তু প্রভূত সমস্যার মোকাবিলা করে। কোনও রকমে শুটিং শেষ করলেও ছবিটা মুক্তি পাবার দিন পিছিয়েই যাচ্ছিল। যাই হোক, শেষ অবধি একটিও কাট ছাড়া ছবিটি সেন্সরের ছাড়পত্রও পায়।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য বাংলা ছবির ডিস্ট্রিবিউশন এবং হল পাওয়ার ব্যাপারটি আজকাল বেঙ্কটেশ ফিল্মস এবং তার কর্ণধার শ্রীকান্ত মেহেতার উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল। যিনি আবার মাননীয়া মমতা ব্যানার্জির কাছের লোক বলে পরিচিত। তাদের হাতেই বেশিরভাগ হল বাঁধা পড়ে আছে। একটা সময় যেমন বাংলার চাষিদের জমি দাদন বা অগ্রিম দিয়ে নীলকররা কিনে নিয়েছিল তেমনই পরিস্থিতি এখন বাংলার চলচিত্র প্রদর্শনশালাগুলোর।

তো অনীক দত্তর ছবি পিছোতে পিছোতে মাধ্যমিক পরীক্ষার সময় রিলিজ হল। যেটা সবচেয়ে ড্রাই টাইম ফিল্ম ব্যবসার নিরিখে। সেন্সর হয়ে যাবার পরেই কলিকাতা পুলিশ সরস্বতীপূজার দিনে স্পেশাল স্ক্রিনিং করে দেখতে চাইলেন সেখানে বর্তমান শাসক দলের বিপক্ষে কিছু কথা আছে কিনা। তারপর ছবি রিলিজ হয়।

এবং সেই রিলিজ হবার একদিন পরেই প্রতিটা হলে কলকাতা পুলিশ থেকে নির্দেশ পাঠিয়ে সিনেমাটি বন্ধ করে দেওয়া হল!! কারণ হিসেবে বলা হল উপর মহলের নির্দেশ। যদিও কোনও জায়গাতেই সেই কথাটা লিখিতভাবে দেওয়া হল না!!

অনীক দত্ত

আজকেও অনেককে ফোন করে জানলাম লেক মল এবং সাউথ সিটি আইনক্সে অনেকেই গিয়ে টিকিট পায়নি। হঠাৎ করে হল কর্তৃপক্ষ জানিয়ে দেয় সব দর্শকের টিকিটের দাম ফেরত দেওয়া হবে, কারণ “ওপর মহল” থেকে চাপ আছে। সেই মতো প্রচুর লোক লাইন দিয়ে টিকিটের দাম ফেরত নেন। তাই হলে দর্শক হচ্ছে না তাই শো বন্ধ এই তথ্য মিথ্যা বলা যায়। আমরা সকলেই জানি এসব কেন হচ্ছে, আর কার অঙ্গুলি হেলনে হচ্ছে! সিনেমার সেন্সর বোর্ড সার্টিফাই করার পরেও পুলিশের এর মধ্যে ঢোকার অর্থ সেন্সর বোর্ডকে অসম্মান করা, তাকে অযোগ্য প্রতিপন্ন করা। সেই জ্ঞানটুকুও নষ্ট হয়ে গেছে।

এ এক অদ্ভুত সময়ের মধ্যে দিয়ে চলেছি আমরা। খবরে প্রকাশ ছবিটিতে শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসকে নিয়ে প্রভূত সমালোচনা খিল্লি করা হয়েছে! ফলে অদ্ভুত এক নীরবতা চারিদিকে। কাশ্মীর পাকিস্তান দেশপ্রেম এই সব বড় বড় ইস্যুর মাঝখানে এ এক ছোট্ট ঘটনা।

আমাদের সো কলড বুদ্ধিজীবীরা যারা ফ্রিডম অফ স্পিচ নিয়ে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন বক্তব্য রাখেন তারাও এক্ষেত্রে চুপই থাকবেন, কারণ পেটে ভাত না থাকলে কীসের সিনেমা? কীসের কবিতা? কীসের গান?

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4662 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...