আমরা চলেছি এই প্রেতমিছিলে…

কৃষক মিছিল মুম্বই

অর্ক

 

একজন কৃষক নিশান হাতে নাচছিলেন। নাচের ছন্দে ছন্দে লাল শালুটা দুলছিল। একটু ঠাহর করে দেখলাম, ঝান্ডার লাঠির মাথায় একটা ফুল বাঁধা। আমরা যেমন ঘর সাজাই ফুল দিয়ে, তেমন। অথবা, গৃহদেবতা। ছোটবেলায় দেখতাম, পাড়াতুতো এক ঠাকুমা বালগোপালের পুজো করছেন। তাঁর স্বামী মারা গিয়েছিলেন অনেকদিন, ছেলেমেয়েরাও বিদেশে। ছোট্ট, ছিমছাম একতলা বাড়িতে শুধু তিনি আর গোপাল থাকতেন। গোপালকে আদর করতেন, বকতেন, কখনও কখনও অভিমান। নাসিক থেকে ১৮০ কিলোমিটার পেরিয়ে আসা ওই পতাকাটাকে দেখে মনে হচ্ছিল, এই যেন আরেক গোপাল। মনে হচ্ছিল, ধর্ম হোক বা আদর্শ, খুব ভেতর থেকে ভালোবাসলে হয়তো আত্মীয় হয়ে ওঠে তারা। সেই ছোট্টবেলা থেকে হরেক কিসিমের বঙ্গবামের মিছিল দেখেছি, কখনও তো চোখে পড়েনি নিশানের মাথায় ফুল বেঁধেছেন কেউ।

যাদবপুরের এইটবি মোড়ে একটি লেনিন-মূর্তি রয়েছে। দীর্ঘদিন আবক্ষ মূর্তি ছিল। কয়েক বছর আগে রাত্রিবেলা কে বা কারা মূর্তিটা ভেঙে দিয়ে যায়। তারপর ওই জায়গাতেই পূর্ণাবয়ব মূর্তি তৈরি হয়েছে। ওই এলাকার মানুষজন, দোকানদার, রিকশচালকদের অনেকেই এক মহিলাকে চেনেন। ঈষৎ খ্যাপাটে ওই বৃদ্ধা প্রতিদিন সকালে যাদবপুরে বাজার করতে আসেন। তারপর বাড়ি যাওয়ার আগে কিছুক্ষণ লেনিনের সামনে দাঁড়ান। গল্প করেন। রাগারাগি করেন। দু’একবার কাঁদতেও দেখেছি। নেহাতই সাংসারিক অনুযোগ সে সব। পরিবারের অশান্তি, টাকাপয়সার টানাটানি — এইরকম। অন্ধ লেনিনের পাথরের চোখ কফি হাউজের দিকে তাকিয়ে থাকে। বৃদ্ধা গুরুত্ব দেন না। মহারাষ্ট্রের কৃষকদের দেখে ওই বৃদ্ধাকে মনে পড়ছিল।

আমাদের স্মৃতি তো আদতে অসংখ্য ইমেজের সমাহার। তার মধ্যে আচমকাই একেকটি ইমেজ শালপ্রাংশু হয়ে ওঠে। কিছুদিন আগে যেমন দেখেছিলাম স্ত্রীর মৃতদেহ কাঁধে দানা মাঝিকে। সে ছবি দেখে মনে হচ্ছিল, ভারতবর্ষের আত্মা গোটা মানচিত্রটা ঘাড়ে নিয়ে হাঁটছে। লং মার্চ মুম্বই পৌঁছনোর পর সোস্যাল মিডিয়ায় একের পর এক ফাটা পায়ের ছবি ভাইরাল হয়ে গেল। আমাদের মধ্যবিত্ত বিপ্লববিলাসের আঁচে তা দিয়ে তৈরি হল চমৎকার সব ইমেজ। আমরা দেখলাম, হাজার হাজার গ্রামীণ জনতার মিছিল ভারতের অর্থনৈতিক রাজধানীতে ঢুকে পড়েছে। একের পর এক শপিং মল, মার্কেট কমপ্লেক্স, ভিনদেশি গাড়ির শো-রুম পেরিয়ে আজাদ ময়দানের দিকে হাঁটছে। হাঁটতে হাঁটতে মিছিল একটার পর একটি উড়ালপুল পেরোচ্ছে। দু’পাশের উঁচু বাড়িগুলির ছাদ, বারান্দা, ব্যালকনিতে ভিড় করে দাঁড়িয়ে এক আশ্চর্য দৃশ্যের সাক্ষী থাকছেন মুম্বইকরেরা। গোটা ব্যাপারটাই কেমন যেন ম্যাজিক্যাল! মুম্বই মানে তো মন্নত। মুম্বই মানে অমিতাভ। মুম্বই মানে ক্রিকেট, শিবসেনা, এনসিপি। এই নতুন মুম্বইয়ের সঙ্গে মরে হেজে যাওয়া বম্বের মিল নেই কোনও। এই মুম্বই থেকে লাল পতাকাকে ঝেঁটিয়ে বিদেয় করে দিয়েছেন বাল ঠাকরে। সেখানে এমন মিছিল! সত্যি!

‘অতই সহজ আমাদের মেরে ফেলা

আমাদের পায়ে রাত্রিচক্র ঘোরে

আমরা এসেছি মহাভারতের পর

আমরা এসেছি দেশকাল পার করে’

আসলে কয়েকটা মিছিল এমনই অলৌকিক হয়। যাবতীয় টাইম-ফ্রেম ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। একটা সময়ের শরীরে আরও অনেকগুলো সময় ঢুকে পড়ে। গোটা রাজপথ জুড়ে পড়ে থাকে সময়ের কোলাজ। আখতারুজ্জামান এমনই এক মিছিলের কথা লিখেছিলেন। উনসত্তরের টালমাটাল ঢাকা শহরে দাঁড়িয়ে ওসমান বুঝতে পারছিল না মিছিলে আসা লোকগুলো ঠিক কারা! ঢাকা শহরে এত লোক থাকে! তার মনে হচ্ছিল, ইতিহাসের সব অলিগলি বেয়ে ওই মিছিলে ঢুকে পড়েছে নানা সময়ের মানুষ। ছাত্র ইউনিয়নের ছেলে চিৎকার করছে — ‘শহীদের রক্ত’, কাটা আঙুল শূন্যে ছুড়ে নীল চাষি উত্তর দিচ্ছে — ‘বৃথা যেতে দেব না’। ওসমান দেখছিল, মিছিলে হাঁটছে সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহের মানুষজন, গলার দড়ি ছিঁড়ে নেমে আসা সিপাহী বিদ্রোহের শহীদ, বেনিয়ান পরা স্বদেশী আন্দোলনের ছেলে, পকেটে পিস্তল। মহারাষ্ট্রের মিছিলও ঠিক তেমন, অসংখ্য সময়ের সমাহার। আজাদ ময়দানে রাত্রিবেলা বিশ্রাম নিচ্ছেন কৃষকেরা। সেখানেই একপাশে পাশাপাশি বসে কথা বলছেন দুই বন্ধু, অথবা প্রতিপক্ষ — এস এ ডাঙ্গে, বি টি রনদিভে। আছেন কমরেড এস এস মিরাজকর। আছেন গিরনী কামগড় ইউনিয়নের ৬ মাস ধরে চলা ঐতিহাসিক ধর্মঘটের কর্মীরা। মধ্যরাতেই হাঁটতে শুরু করল মিছিল। সোলাপুর কমিউনের শ্রেণিযুদ্ধে হেরে ৮৮ বছর ধরে ফাঁসিতে ঝুলতে থাকা চার শ্রমিক নেমে এলেন। নাসিকের অম্বিকা শিন্ডের হাত থেকে নিশান ধরলেন মাল্লাপ্পা ধনশেট্টি, শ্রীকৃষাণ সরদা, কুরবান হুসেন আর জগন্নাথ শিন্ডে। মিছিল এগোচ্ছে। বি আর আম্বেদকারের মূর্তিতে মালা দিচ্ছেন কৃষক সভার কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। মূর্তির ঠিক পিছনেই দাঁড়িয়ে আছেন কমরেড আর বি মোড়ে, সামরাও পারুলেকর, গোদাবরী পারুলেকর। ১৮০ কিলোমিটার পেরিয়ে আসা কৃষকদের খোতি ব্যবস্থার বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা চওদার লেক সত্যাগ্রহের কথা বলছেন। বলছেন, আদিবাসী বিদ্রোহের গল্প। দু’বছর ধরে গোটা থানে অঞ্চল অচল করে দিয়েছিলেন আদিবাসীরা। পাশে ছিল কমিউনিস্ট পার্টি। তালশারি তহশিলের কাছে শান্তিপূর্ণ কৃষক মিছিলে গুলি চলেছিল। কমরেড জেথ্যা গাঙ্গড়-সহ ৫ জন শহীদ হয়েছিলেন। ব্রিটিশের শাসনকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে তিন বছরের জন্য সমান্তরাল সরকার গড়ে উঠেছিল পশ্চিম মহারাষ্ট্রের সাতারা আর সাংলি জেলায়। নেতৃত্ব দিয়েছেন নানা পাতিল, মানুষ যাঁকে আদর করে ডাকত ‘ক্রান্তিসিংহ’ বলে। মিছিল এগোচ্ছে। নৌ বিদ্রোহের কথা বলছেন শহীদ কমল ধোন্ডে। ৫ দিনে বোম্বের ৪০০ শ্রমিককে গুলি করে মেরেছিল ইংরেজ সরকার। কমলের সঙ্গেই ছিলেন অহল্যা রঙনেকর, কুসুম রনদিভেরা। শরীরে বুলেট নিয়ে কোনওমতে বেঁচে ফেরা ওই কমরেডরাও কৃষক সভার লং মার্চে সামিল।

আমরা শুনেছি, কমিউনিস্টরা মৃত। এ মিছিলে যাঁরা হাঁটলেন, তাঁরা কেউই আর বেঁচে নেই। এ মিছিল লাশের মিছিল। বিদর্ভের আত্মহত্যা করা কৃষক থেকে শুরু করে গোরখপুরে দম আটকে মরা শিশু — আসমুদ্র হিমাচলে যত মরা মানুষ আছেন, এ প্রেতমিছিল মিছিল তাঁদের সবার।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4887 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...