Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

ক্ষুধার রাষ্ট্র

স্টেশনমাস্টারের কলম

 

ভারতীয় কৃষিচক্র অনুসারে কার্তিক ও অগ্রহায়ণ হেমন্তকাল— ফসলের ঋতু। হেমন্ত আমাদের নবান্নের ক্ষণ— উচ্ছ্বসিত ধানের সময়। এই সময় কৃষক দীর্ঘ শ্রমদানের শেষে, মাঠের নতুন শস্য মহানন্দে ঘরে তোলেন। শস্য বিক্রির অর্থে পরিবারের শিশুদের নতুন জামা-জুতো হয়, নবান্নকে কেন্দ্র করে মাসাধিককাল ধরে চলে নানান কৌম উৎসব। নতুন চালের গন্ধে ভরে ওঠে গৃহস্থের ভিটে। শস্যের লোভে ধানের গোলায় হানা দেয় মেঠো ইঁদুরের দল। লক্ষ্মীপ্যাঁচা উড়াল দেয় গেরস্থের ঘরের চালে। কবির ভাষা ধার করে বলতে গেলে, এ এক এমন সময়, যখন ধানের অদ্ভুত রসে নেচে ওঠে ঈশ্বরী বালিকা। কিন্তু কী পরিতাপের বিষয়, এমন সম্পন্নতার মাঝেই প্রতিবছর আমাদের হাতে এসে পৌঁছয় বিশ্ব ক্ষুধা সূচক সমীক্ষার ফলাফল। আবিশ্ববিস্তৃত ও ভিন্ন ভিন্ন ভূ-রাজনৈতিক বলয়ে ক্ষুধা পরিস্থিতির অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ এবং তার ভিত্তিতে অধিকাংশ দেশগুলির অবস্থানের ক্রমতালিকা জ্ঞাপক এই সমীক্ষায় আমাদের জন্য সুসংবাদ কখনওই থাকে না— এবারেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। প্রতিটি দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও অগ্রগতির এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নির্ণায়ক এই রিপোর্টের প্রকাশকাল, অতএব, অন্তত ভারতবাসীদের জন্য, বড়ই পরিহাসময়! প্রতিবছরই উৎসবের মাস অক্টোবরে আমরা খবর পাই, ক্ষুধা-সারণীতে ক্রমশ নীচের দিকে নামছে আমাদের দেশ, শিশুপুষ্টির জরুরি নিক্তিতে অতল গহ্বরে তলিয়ে যাচ্ছে।

বিশদ হওয়ার আগে, ক্ষুধাসূচক নিয়ে একটা-দুটো কথা বলে নেওয়া দরকার। আয়ারল্যান্ডের ‘কনসার্ন ওয়ার্ল্ডওয়াইড’ এবং জার্মানির ‘ওয়েল্টহাঙ্গার হিলফে’ সংস্থা যৌথভাবে ২০২১-এর বিশ্ব ক্ষুধাসূচক রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। ক্ষুধাসূচকের ভিত্তিতে নির্মিত ক্রমতালিকায় এ বছর অর্থাৎ ২০২১ সালে ১১৭ টি দেশের মধ্যে ভারতের অবস্থান ১০১ তম (স্কোর ২৭.৫)। গত বছর, ২০২০ সালে ১০৭ টি দেশের মধ্যে ভারতের অবস্থান ছিল ৯৪। অর্থাৎ সহজভাবে বললে, গত এক বছরে ক্ষুধা-সারণীতে আমাদের দেশ সাত ধাপ পিছিয়ে পড়েছে।

অবশ্য বিষয়টি গাণিতিকভাবে অতটা সরল নয়, কারণ এ বছরে আরও বেশ কটি নতুন দেশ আলোচনায় ঢুকে পড়েছে। যে চারটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করে এই ক্ষুধাসূচকের স্কোর পরিমাপ করা হয়, তা হল— ১) দেশের মোট জনসংখ্যার কত শতাংশ অপুষ্টির শিকার, ২) পাঁচবছরের কমবয়সি শিশুদের কত শতাংশ ‘ওয়েস্টিং’-এর শিকার (শিশুদের ওজন তাদের উচ্চতার নিরিখে কম হলে তাদের ‘চাইল্ড ওয়েস্টিং’-এর শিকার বলে ধরা হয়— এটি অতি গভীর অপুষ্টির লক্ষণ), ৩) পাঁচবছরের কমবয়সি শিশুদের কত শতাংশ ‘স্টান্টিং’-এর শিকার (শিশুদের উচ্চতা তাদের বয়সের নিরিখে কম হলে তাদের ‘চাইল্ড স্টান্টিং’-এর শিকার বলে গণ্য করা হয়— এটা ধারাবাহিক ও প্রজন্মান্তরে বাহিত অপুষ্টির লক্ষণ), এবং ৪) দেশে পাঁচবছরের কমবয়সিদের মধ্যে মৃত্যুর হার কেমন (আন্ডার-ফাইভ মর্টালিটি)।

শিশুদের পুষ্টি বা তার অভাব-সংক্রান্ত আলোচনায় এই সূচকগুলি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত; এবং নির্দিষ্টভাবে পাঁচবছরের কমবয়সি শিশুদের নিয়েই এই সূচকগুলির পরিমাপ করা হয়, কারণ জন্মের পর থেকে পাঁচ-ছ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুদের শারীরিক, মানসিক ও বৌদ্ধিক বিকাশ ঘটে সবচেয়ে বেশি— তাই এই বয়ঃসীমার মধ্যে অপুষ্টির আক্রমণ শিশুর ভবিষ্যৎ জীবনের ওপর দীর্ঘমেয়াদি ও অপরিবর্তনীয় প্রভাব বিস্তার করে। এখানে উল্লেখ করা দরকার, ক্ষুধার স্কোর যে দেশের যত বেশি, সে দেশ তত বেশি ক্ষুধাকাতর, এবং ক্ষুধা-সূচকের ক্রমতালিকায় তার অবস্থান তত নীচের দিকে। যেমন, এ বছর ক্ষুধাসূচকে প্রথম স্থানটিতে ভাগাভাগি করে অবস্থান করছে মোট ১৮টি দেশ, যারা প্রায় ক্ষুধাহীন, এই দেশগুলির প্রতিটির স্কোর বা ক্ষুধা-মাণক ৫-এরও কম। মেক্সিকোর স্কোর ৮.৫ এবং ক্রমতালিকায় তার অবস্থান ৩৯তম। ভিয়েতনামের স্কোর ১৩.৬, অবস্থান ৬১তম।

প্রসঙ্গত, গত কয়েকবারের মতোই এ বছরও প্রতিবেশী দেশগুলির মধ্যে আমাদের চেয়ে ভালো অবস্থানে আছে পাকিস্তান (অবস্থান ৯২), বাংলাদেশ (৭৬) এবং নেপাল (৭৬)। গোটা এশিয়ায় শুধু একটিমাত্র দেশ ক্ষুধা-তালিকায় আমাদের পেছনে রয়েছে— আফগানিস্তান (১০৩)। অর্থাৎ এ কথা ভাবলে লজ্জায় মাথা কাটা যাওয়ার উপক্রম হয় যে, অর্ধশতকের বেশি সময় ধরে নানা অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতায় দীর্ণ তথাকথিত পিছিয়ে পড়া ও কৌলিন্যহীন দেশ আফগানিস্তানের তুলনায় ধন্য-ধান্য-পুষ্প-ভরা ভারতবর্ষ ক্ষুধা-সূচকে মাত্র দু ধাপ এগিয়ে।

এই প্রসঙ্গ ও প্রেক্ষিতটিকে আলোচনার কেন্দ্রে রেখেই নির্বাচন করা হয়েছে চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম-এর নভেম্বর সংখ্যার প্রচ্ছদভাবনা। প্রচ্ছদকাহিনির লেখাগুলিতে ক্ষুধাসূচক থেকে প্রাপ্ত তথ্যগুলি খুঁড়ে দেখার চেষ্টা করা হয়েছে। এ কথা অস্বীকার করার কারণ নেই, এই ক্ষুধাসূচক উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের কাছে এক তথ্যের স্বর্ণখনি, যাকে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে বিশ্লেষণ করলে অপুষ্টি দূরীকরণের অভিমুখে নানা মূল্যবান পথনির্দেশ পাওয়া যেতে পারে। অথচ, আমাদের দেশের শাসক এই তথ্যভাণ্ডার প্রকাশ পাওয়া ইস্তক একে ভুল, মিথ্যে ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে অস্বীকৃতি জানিয়ে আসছেন। এই অস্বীকৃতি কি যথার্থ? আমাদের দেশ কি ক্ষুধা ও অপুষ্টির নিবারণে যথেষ্ট আন্তরিক ভূমিকা পালন করছে? যদি সত্যিই প্রশাসনিক প্রচেষ্টা আন্তরিক হয়, তা হলে চলতি অর্থবর্ষের (২০২১-২২) বাজেটে শিশুপুষ্টির নিরিখে ব্যয়বরাদ্দ, পূর্ববর্তী অর্থবর্ষের (২০২০-২১) বাজেটের তুলনায় ১৮.৫ শতাংশ কমিয়ে দেওয়া হল কেন? কোভিড অতিমারি ও তার সঙ্গে যুক্ত নানা আর্থসামাজিক ঘটনা-দুর্ঘটনা কী প্রভাবে ফেলল ভারতের ক্ষুধা মানচিত্রে? সমস্যার শেকড় কোথায়? খাদ্য-উৎপাদনে? বণ্টনে? সাধারণ্যে বুনিয়াদি শিক্ষার অভাবে? নাকি চূড়ান্ত অর্থনৈতিক বৈষম্যপীড়িত এই সমাজব্যবস্থায় সর্বব্যাপী ক্ষুধার জাল থেকে আমাদের খুব শিগগির মুক্তি নেই?

ক্ষুধার রাষ্ট্র-শীর্ষক প্রচ্ছদভাবনার অন্তর্গত নিবন্ধগুচ্ছে এমন একাধিক প্রশ্ন তোলা হয়েছে, যা রাষ্ট্রের পক্ষে যতই অপ্রিয় হোক না কেন, অত্যন্ত জরুরি। উত্তর খুঁজেছেন শচীন কুমার জৈন, আকাঞ্চা সিং, তুহিন দেব, অংশুমান দাশ এবং উর্বা চৌধুরী

এ ছাড়াও রইল আমাদের অন্যান্য নিয়মিত বিভাগগুলি। যেমন, কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, বিশেষ নিবন্ধ, অন্যগদ্য, অনুবাদ সাহিত্য, ফটোফিচার, অণুগল্প, ধারাবাহিক উপন্যাস ও রচনা। আপনারা জানেন আমাদের মাসিক মেল ট্রেনে কিছু বিশেষ কামরাও থাকে— স্টিম ইঞ্জিন, সবুজ স্লিপার, হুইলার্স স্টল, ভালো খবর। থাকল সেগুলিও।

ভালো থাকবেন। আপনাদের মতামতের প্রত্যাশী থাকলাম…

 

সম্পাদকমণ্ডলীর পক্ষে,
দেবব্রত শ্যামরায়