আমি

আমি -- প্রকাশ কর্মকার

প্রকাশ কর্মকার

 

শিল্পী প্রকাশ কর্মকার বাংলার তথা ভারতের গর্ব, প্রকৃত অর্থে একজন বিস্ময়কর প্রতিভা। ছবি আঁকায় আন্তর্জাতিক মানের অসংখ্যা কাজের পাশাপাশি, তাঁর আত্মজীবনী 'আমি'-ও তাঁরই মতো সাহসী ও ছকভাঙা। বাংলাভাষায় এমন সৎ ও অকপট আত্মকথনের সাহস আর কজন দেখিয়েছেন, তা হাতে গুণে বলা যায়। স্বাধীনতা-পূর্ব দাঙ্গাবিধ্বস্ত কলকাতা শহরে কৈশোর কাটিয়েছেন প্রকাশ। কৈশোরে পিতৃহারা প্রকাশ পরিবেশ ও পরিস্থিতির দোষে প্রচুর অপকর্মের সঙ্গী হয়েছেন সেসময়, পরবর্তীকালে সে নৈরাজ্যের অভিজ্ঞতা ক্ষতের মতো ছায়া ফেলেছে তাঁর ছবিতে ও কবিতায়। বন্ধু শিবনারায়ণ রায় 'আমি'-র ভূমিকায় লিখছেন— “প্রকাশ কিছুই রেখেঢেকে লেখেনি; পাঠক পাঠিকার কোনো তোয়াক্কা না রেখেই আপনাকে অনম্বর করে দিয়েছে। সত্যের যেটা বাম মুখ সেটিকে অশ্লীল অথবা কুৎসিত বিবেচনায় যাঁরা এড়িয়ে যেতে অভ্যস্ত, এই খসড়া তাঁদের বিব্রত, হয়তো বিপর্যস্ত করবে।” রেনেসাঁস পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড থেকে ২০০৩ সালে প্রকাশিত প্রকাশ কর্মকারের সেই আত্মজীবনী থেকে উদ্ধৃত করা হল সামান্য একটি অংশ, চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম-এর স্টিম ইঞ্জিন বিভাগের পাঠকদের জন্য।

ওই মুসলমান পাড়া কেন হঠাৎ খালি হয়ে গেল তা বুঝলাম অনেক পরে। কারণ পাড়ার মধ্যে থেকে মুসলমানদের সঙ্গে লড়াই করতে করতে বাইরের জগৎ থেকে আমরা প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে ছিলাম। ইতিমধ্যে স্বাধীন হওয়ার চেষ্টা চলছে অর্থাৎ ভারতবর্ষ দুভাগ হচ্ছে। পাকিস্তান ও ভারত। তখন অতশত বোঝার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। শুধু জানতাম দেশটা কদিন পরে ভাগ হবে। শুনেছিলাম নোয়াখালিতে ভীষণ দাঙ্গা। বাংলাদেশ থেকে কাতারে কাতারে লোক বর্ডার পেরিয়ে আসছে। যদিও বর্ডার বলে কিছু ছিল না, তবু স্থানীয় প্রশাসন বা মাস্তানরা একটা জায়গা আন্দাজ করে অনেক জায়গা বর্ডার হিসেবে বানিয়ে নিয়েছিল। সেইসব কাল্পনিক বর্ডার পেরিয়ে অনেকের অনেক কিছু গেছে। পরে যখন দেশ ভাগ হল তখন আরও খারাপ অবস্থা, শুধু মানুষ-পুঁটলির বন্যা। আগে স্টেশনগুলো ভরল তারপর রাস্তাগুলো ভরে যাওয়ার পর পাড়াগুলো ভরতে শুরু করল। আস্তে আস্তে দেখলাম, প্রথমে আমাদের পাশের দোতলা মাঠকোঠা ভরে গেল। বাড়িটা মাটির যা আগেই বলেছি এবং হেলে গিয়েছিল। সেই পরিত্যক্ত বাড়িটাতেই বাস্তুহারা লোক ঢুকে গেল। এক রাতে আমাদের পাড়ার ওদিকটায় যে মুসলমান বস্তি খাল হল, সে রাতেই ভোরের দিকে আমরা গিয়েছিলাম। অনেক নতুন মুখ ছিল যারা এক রাতেই পুঁটলি নিয়ে আমাদের পাড়ায় ঢুকেছে। আমরা চিনি না, তবু ওদের আমরা উদ্বাস্তু বলে আশ্রয় দিয়েছিলাম। ওদের মধ্যে কিছু যুবকের লুটপাট করার প্রবণতা দেখে আমরা আশ্বস্ত করেছিলাম। বলেছিলাম, লুটপাট করো না, তার চেয়ে বস্তির এক-একটা বাড়ি দখল করে বসে যাও, দেখি আমরা কি করতে পারি। যদিও আমাদের করণীয় কিছুই ছিল না। আমরা নিজেরাই বিধ্বস্ত হয়ে আছি। দু-তিনদিনের মধ্যে আমাদের পাড়ার বাসিন্দারা আসতে শুরু করেছে। মাসি পাড়া ছেড়ে কোথাও যায়নি। কিন্তু মাসির বোনকে কোথাও দেখিনি। মাসিও কিছু বলত না। কিন্তু আমার মনে হয় ওকে কেউ মারেনি। ও স্বেচ্ছায় কারও সঙ্গে চলে গেছে।

স্বাধীনতা পর্ব শেষ হলে সময় আরও দ্রুতগামী হয়ে উঠল। একদিন শুনলাম গান্ধীজি বেলেঘাটায় আসবেন। গান্ধীজির কথা ভালভাবে জানি, আমরা সবাই নেতাজির ভক্ত ছিলাম। নেতাজি আসছেন জানলে আমি অনেক উৎসাহ পেতাম। কিন্তু নেতাজি না এসে গান্ধীজি আসছেন এক মুসলমান বাড়িতে। ওদিকটা অর্থাৎ বেলেঘাটার কাটা খালের দিকটায় ভরপুর মুসলমান পাড়া। এদিককার অর্থাৎ কাঁকুড়গাছির দিক থেকে যত মুসলমান এবং পূর্ব বেলেঘাটা আর ফুলবাগান থেকে যত মুসলমান সব ওদিকে আর খিদিরপুরের দিকে চলে গেছে বা হতে পারে পূর্ব পাকিস্তান হওয়ার পর যত পশ্চিমি মুসলমান ছিল তাদের পূর্ব পাকিস্তানে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে হিন্দুদের বাড়িতে। এইসব ঘটনা অনেক পরে জেনেছি। কারণ, জানতে হয়েছে যে হঠাৎ কেন এক রাতের মধ্যে এত বড় তিন মাইল বস্তি খালি হয়ে গেল। যা হোক এক গরমের দুপুরে আমরা দু-তিন জন মিলে গান্ধীজিকে দেখতে গেলাম। অনেক পরিচিত মুসলমান বন্ধুর সঙ্গে দেখা হল। তারাও শুধু হাসল। গান্ধীজির অহিংসার বক্তৃতা শোনার ইচ্ছা ছিল না, যদিও ইচ্ছে ছিল আরও অন্য কোন নেতাদের যদি দেখা যেত যেমন নেহেরু। নেতাজিকে ওই সময় বারবার মনে পড়ছিল। কিন্তু নেতাজির হদিশ কেউ দিতে পারত না৷ নলিনীদা— যিনি আমাকে পিস্তল দিয়ে ফরওয়ার্ড ব্লক করার দীক্ষা দিয়েছিলেন, সেই নলিনীদা বা গিরিজাদাকে জিজ্ঞাসা করেও কোন সদুত্তর পাইনি। শুধু বলতেন, জাপানে বন্দী হয়ে আছেন আমেরিকানদের হাতে। ওই সময় বেলেঘাটায় সুকান্ত থাকত। সুকান্ত কবিতা লেখে। সরোজদাদের বন্ধু। গিরিজাদাদেরও। কিন্তু ওরা সুকান্তের বিষয়ে উদাসীন, কেননা সুকান্ত তখন কম্যুনিস্ট কবি। একবার আমরা সবাই গিয়েছিলাম ওকে দেখতে। ও তখন রোগশয্যায়। শেষে একদিন শুনলাম, সুকান্ত মারা গেছে। প্রায় দু-তিন বছর পর ওর কবিতার বই দেখে কবিকে চিনতে পেরে আমার খুব ভাল লেগেছিল। কিন্তু সুকান্ত তখন আর ইহজগতে নেই। সেইরকম অনেকেই নেই, আবার অনেকে এল, কী পাড়াতে বা অন্য পাড়ায়। কম্যুনিস্টরা সংগঠিত হচ্ছে। হচ্ছে ফরওয়ার্ড ব্লকও। আমরা সবাই চাঁদা তুলতে বেলেঘাটার খালের পাশে যে গ্যাস কোম্পানি ছিল, সেখানে যেতাম মাসে মাসে। সেই কারখানায় ইউনিয়ন করেছিলাম আমরা।

নলিনীদারা তখন মুক্তারামবাবু স্ট্রিটে থাকতেন৷ ওর সঙ্গে সবসময় যোগাযোগ রাখতে হত। কম্যুনিস্ট পার্টি ও ফরওয়ার্ড ব্লকের মধ্যে একটা ঝগড়া যা আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু গিরিজাদাদের মতো আমি সবসময়ের জন্য পার্টি করতে পারতাম না। কারণ আমার দুই বোন বা সংসার আছে। দুই বোনকে ফেলে দিয়ে কোথায় যাব? এমনিতে অনেকদিন যাইনি, ওই হরি ঘোষ স্ট্রিটে যাওয়ার পরিস্থিতও ছিল না। গান্ধীজি আসার পর ওই অঞ্চলে সবকিছু পরিষ্কার হয়ে গেল। অর্থাৎ দু-তিন দিনের মধ্যে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে দাঙ্গা শেষ হয়ে গেল। মুসলমানরা তাদের সর্বস্ব ছেড়ে কেন চলে গেল, এত লোক তাদের ঘর বাড়ি সংসার, আবাল্য স্মৃতি ছেড়ে, রুজি রোজগার ছেড়ে কোথায় চলে গেল বা চলে যাচ্ছে, তা হঠাৎ বুঝতে পারলাম না। মায়াহীন এ পরিত্যক্ততা আমি মানতে পারিনি। কিন্তু আমি না মানলেও বা আমরা না মানলেও এই চলে যাওয়ার পিছনে অন্য এক মানসিকতা ছিল অর্থাৎ বিনিময়। বিনিময় মানে ওখান থেকে চলে আসা লোকেদের সম্পত্তিগুলো এ দেশ থেকে চলে যাওয়া লোকগুলি দখল নেবে। কার কতটা সম্পত্তি, কত সম্পত্তি কত সহজে কে আগে দখল করবে – তাই নিয়ে নিশ্চুপ ব্যস্ততায় মত্ত। যেমন আমাদের পাড়ায় যে উদ্বাস্তু পূর্ব পাকিস্তান থেকে এল বা আসতে শুরু করেছে, যারা কাতারে কাতারে নিঃস্ব হয়ে এসেছে, তাদেরকে যখন ওই বস্তি দখল করতে বলা হল, তখন তারা ভাবতেই পারল না, যে এরকম বিনা বাধায় কেউ কারো সম্পত্তি দখল করে নিতে পারে অর্থাৎ দশ-বারো দিনের মত ওই বস্তিগুলোতে সমানে লুট হল। সেই লুট হওয়া মাল ঢেলে বিক্রির ব্যবস্থা হল। বিক্রির ব্যবস্থা মানে যে যেমন পারছে টাকা দিয়ে বা না দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ওই মাল। ওই মালের মধ্যে যে কত রকমের জিনিস ছিল তা ভাবা যায় না— যেমন অজস্র ফুলদানি থেকে শুরু করে অজস্র, বড় হাঁড়ি, কড়াই, খাট পালঙ্ক, দড়ির খাটিয়া, তোষক, বালিস, ট্রাঙ্ক, সিন্দুক ইত্যাদি। আমাকে দুটো ফুলদানি কেউ দিয়েছিল। অনেকগুলি বড় ঘড়ি তাল করে রাখা একটা জায়গায়। পরের দিন দেখা গেল সেইগুলি আর নেই। আমাদের পাড়া ছিল ওই বস্তিতে ঢোকার প্রথম পাড়া। সুতরাং কাতারে কাতারে লোক এসে আমাদের পাড়ায় আগে থামত। লোক মানে ছোট পরিবার। বৃদ্ধ শিশু যুবতী প্রৌঢ় যুবক সব মিলিয়ে এমন একাকার হয়ে গেছে যে বোঝা যায় না। শুধু বাক্সপ্যাঁটরা আছে বা মাদুর বিছানা গুণে বলা যেতে পারত। আমাদের পাড়াতেই থাকতে থাকতে চলে যেত অন্যত্র। ওই বস্তি ভর্তি হয়ে গেলে বোঝা যাচ্ছে, অনেক খোঁজখবর করেও এরা আর কোথাও যেতে পারছে না সুতরাং আরও শহরতলির দিকে যেতে হবে। কীভাবে যাবে তা এদের জানা নেই তবে ওদিকটায় অর্থাৎ বাগমারী বা ফুলবাগানের কাছে অনেক বড় বড় কারখানা ছিল, দোতলা বস্তি ছিল, ছিল অনেক বড় চা-এর দোকান বা হোটেল। সেগুলো তখনও ফাঁকা দেখতাম। এইসব যাওয়ার জায়গা ওদেরকে বলতেই ওরা চলে যেত। খোঁজাখুঁজি করে আবার ফিরে আসত বিকেলের দিকে। কেউ আবার আসত না। বাক্সপ্যাঁটরা দেখে কিছুটা হদিশ করা যায় অর্থাৎ অত ভিড়ের মধ্যে কটা বাক্সপ্যাঁটরা নিয়ে একেবারে চলে গেল কেউ। ভীষণ দুর্ভিক্ষ শুরু হয়েছিল আগে। সম্ভবত ১৯৪৩ সালে আমাদের পাড়াতেই অনেকে মরে ছিল, তবে তারা উদ্বাস্তু ছিল কিনা তা জানি না। সেই যে মাটির দোতলা বাড়ি ছিল, ওই বাড়িতে কিছুদিন বাদে একে একে সবাই মরত। এবারও তাই হচ্ছে অর্থাৎ মরার জন্য ওই দোতলা মাঠকোঠা এখন ভর্তি। রেশনের দোকান আগেও ছিল এবং এখনও আছে কিন্তু এদের কে খেতে দেবে? টাকাই বা কোথায় এদের? সবে স্বাধীন হয়েছে দেশ। মৃত্যুর স্বাধীনতা পেতে হলে জানলে কবুল করতেই হবে। তবু এদের সেই একই কথা। একটু ফ্যান দাও। ওরা বুঝতে পারছে না যে এখন ভাতের ফ্যান কেউ ফেলে না।

 


*বানান অপরিবর্তিত

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4661 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...