Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

কোভিডবিধির গঙ্গাযাত্রা ও অন্যান্য প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন

স্টেশনমাস্টারের কলম

 

আমার-আপনার সক্রিয় উদ্যোগে, সরকারি প্রশাসনের সহযোগিতায় এবং উদ্বাহু সমর্থনে, জনপ্রতিনিধিগণের প্রত্যক্ষ উৎসাহ ও প্ররোচনায়, অবশেষে, আমরা অত্যন্ত সফলভাবে কোভিড অতিমারির আরও একটি মহাতরঙ্গকে বাস্তবায়িত করিয়া তুলিতে পারিলাম। এই কারণে, সংশ্লিষ্ট সকল ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে আমাদিগের আন্তরিক ধন্যবাদ। ভবিষ্যতে, সুযোগ পাইলে আমরা পুনর্বার একইভাবে অতিমারির পরবর্তী তরঙ্গগুলিকে সাফল্যের সহিত সংঘটিত করিতে পারিব, এবং প্রয়োজনের সময় আপনাদের সার্বিক সমর্থনে কোনও ব্যত্যয় ঘটিবে না, এমন আশা রাখি।

বস্তুত, এইটুকু লিখিয়াই সম্পাদকীয় নিবন্ধ শেষ করা যাইতে পারিত। গত প্রায় দুই বৎসর ধরিয়া কোভিড-অতিমারি লইয়া ধারাবাহিকভাবে কথা বলিয়া যাওয়ার পর, নিরাপত্তাবিধি পালন ও অন্যান্য সতর্কতা অবলম্বনের বিষয়ে সমাজের বিভিন্ন মহল হইতে নিরন্তর চেতাবনী প্রাপ্ত হইবার পর, কী করিলে ব্যাধিটির মোকাবিলা করা সম্ভব সে বিষয়ে লক্ষবার একই কথা বলিয়া ও শুনিয়া যাওয়ার পর অধিক কহিবার আর অবকাশ থাকে না— তখন কেবল আপন মূঢ়তা, কাণ্ডজ্ঞানহীনতা ও অপরিণামদর্শিতায় চমৎকৃত হইয়া নীরব থাকিতে হয়— নির্বাক থাকিয়া মুগ্ধনেত্রে দেখিতে হয়, কীভাবে, কত সুনিশ্চিতভাবে, কী সযত্ন নৈপুণ্যে আমরা আপন ধ্বংস আপনি ডাকিয়া আনিতে পারি— এ মারণ মহোৎসবে অংশগ্রহণ করিয়া কীভাবে পিপীলিকার ন্যায় আপনাপন মৃত্যু নিশ্চিত করিয়া যাইতে পারি। একে যদি ধন্যবাদ না-দিই, ধন্যবাদ দিব কাহাকে?

এ পর্যন্ত পড়িয়া যদি মনে হয় আমরা কথা বলিতেছি কোভিডের নব্য-অবতার ওমিক্রন বিষয়ে; সবিনয়ে সেই ভ্রান্তি সংশোধন করিয়া দিতে চাহিব। না, আমরা কোভিডের কোনও ভ্যারিয়েন্ট লইয়া কথা বলিতেছি না। কোন ভ্যারিয়েন্টের সংক্রাম্যতা ও মারণক্ষমতা কতদূর, কোন ভ্যাক্সিনের কয়টি ডোজে তাহার প্রতিরোধ সম্ভব, নূতনতর কোনও অবতারে এই ব্যাধি ভবিষ্যতে আরও প্রাণঘাতী হইয়া উঠিতে পারিবে কি না— ইত্যাদি প্রশ্নসমূহের নিরসন করিবেন চিকিৎসকেরা; আমরা নাদান মানবকুল সেসব লইয়া মাথা না-ই বা ঘামাইলাম। আমরা বরং ভাবিতেছি অন্য কথা। গত দুই বৎসরে এটুকু অন্তত প্রমাণিত যে, অপরাপর সকল ভাইরাসের সহিত কোভিড ভাইরাসের এক মৌলিক সাদৃশ্য রহিয়াছে— উভয়েই মানবশরীরে প্রবেশের জন্য মানবের অনুমতির অপেক্ষায় থাকে। আমরা ঢুকিতে দিই বলিয়াই সে ঢুকিতে পায়— এই সত্যটি অতিসরলীকৃত মনে হইতে পারে বটে, অপিচ তাহা সত্য হইতে সুদূরবর্তী নহে। এমন নহে যে, ভাইরাসের ভয়ে ইন্দুরের ন্যায় গর্তে সেঁধানোই প্রাণে বাঁচিবার একমাত্র উপায়— বস্তুত, তাহা যেমন সম্ভব নহে, তেমনই বাস্তবোচিতও নহে। কাজেকর্মে বহু মানুষকে নিত্যদিন বাহির হইতেই হইবে, বিশেষত ভারতের মতো বিপুলসংখ্যক অসংগঠিত শ্রমিকের দেশে মানুষকে অনির্দিষ্টকাল ধরিয়া গৃহবন্দি করিয়া রাখিলে তাহার ফল কী পরিমাণ বিষময় হইতে পারে, তাহা আমরা গত দুই বৎসরকাল ধরিয়া মর্মে-মর্মে বুঝিতেছি। কিন্তু, এসব যেমন সত্য, তেমনই, ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত স্তরে সামান্য কিছু সতর্কতা অবলম্বন করিলে যে এই ভাইরাসকে রুখিয়া দেওয়া যায়— অন্তত ইহার উপদ্রবের মাত্রা অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণ করা যায়— তাহাও তো প্রমাণিত। পুনরুক্তি মার্জনীয়, কিন্তু আমি পথেঘাটে আমার মুখচ্ছদ বস্ত্রখণ্ডটি নিয়মিত ও যথাযথরূপে ব্যবহার করিব, বারংবার হাত ধুইব, পারতপক্ষে ভিড় এড়াইয়া চলিব— কেবল এই সাধারণ কয়েকটি আচার পালন করিলেই আমরা এই ভাইরাসটির মোকাবিলা করিতে পারি— তাহাকে নির্মূল করিতে না-পারিলেও তাহার বিরুদ্ধে একটি সচেতন প্রতিরোধ গড়িয়া তুলিতে পারি।

অথচ সেসব কিছু না-করিয়া আমরা কার্যক্ষেত্রে তাহার ঠিক বিপরীত কাজগুলিই করিয়াছি— বস্তুত এখনও করিয়াই চলিতেছি। জনশ্রুতি যে, আপনার ভাল পাগলেও বুঝে, কিন্তু আমাদিগের ব্যক্তিগত ও সামূহিক আচরণের প্রতি দৃষ্টিপাত করিলে সে বাক্যে ভরসা রাখা চলে না। গত বৎসর কোভিডের দ্বিতীয় তরঙ্গের প্রাণঘাতী রূপ প্রত্যক্ষ করিবার পরেও, বিপুল প্রাণহানি ও সমাজজীবনের সমস্ত ক্ষেত্রে তাহার ভয়াবহ পরিণামের চিহ্ন অদ্যপি বহন করিয়া চলিলেও, আমাদের বোধোদয় হয় নাই। সম্প্রতি বর্ষশেষ ও বর্ষবরণের উৎসবে, আরও সম্প্রতি একাধিক নির্বাচনে ও গঙ্গাসাগরমেলায় আমাদিগের আচরণ দেখিয়া মনে হয় নাই যে, আমরা একটি আপৎকালের মধ্যে রহিয়াছি। যেখানে গোটা দেশের মানুষ এমন এক ব্যাধির সহিত লড়াই করিতেছেন, সেখানে তাঁহাদিগেরই একটি বৃহৎ অংশ মুক্তকচ্ছ দায়িত্বহীনতায় সেই ব্যাধিকে আহবান করিয়া আনিতেছেন— এ বিচিত্র কাণ্ডজ্ঞানহীনতাকে ব্যাখ্যা করিবার ভাষা আমাদিগের জানা নাই। শুধু সাধারণ মানুষই বা কেন, এ-বিষয়ে প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের ভূমিকাও কিছুমাত্র কম নহে। তাঁহারা বিপদ বুঝিয়াও না-বুঝিয়া, মানুষকে আমোদে ও উৎসবপালনে সর্বপ্রকার উৎসাহ দিয়া এবং প্রয়োজনের সময় সে আমোদের রাশ নিয়ন্ত্রণে নিস্পৃহ থাকিয়া কার্যত তাহাদের আরও বেশি করিয়া আমোদে ভাসিবার প্ররোচনা দিয়াছেন। ভুলিলে চলিবে না, কোভিডের এই প্রবল তৃতীয় তরঙ্গের সময়েই লক্ষাধিক মানুষের সমাগমে গঙ্গাসাগর মেলার আয়োজন করা হইয়াছে। মেলা একবৎসর বন্ধ থাকিলে দেশের ও দশের পারমার্থিক কী ক্ষতি হইত, সে ব্যাখ্যা জনপ্রতিনিধি হইতে সরকার, এমনকী বিচারবিভাগের কাছেও পাওয়া যায় নাই। তাহা হইলে কী ধরিয়া লইব? ঘরে আগুন যাহাতে না-লাগে তাহার বন্দোবস্ত না-করিয়া আগুনকে উত্তমরূপে ছড়াইতে দেওয়া, ও সেই কার্য সুসম্পন্ন হইবার পর সে আগুন নির্বাপনের চেষ্টাকে কেবল কাণ্ডজ্ঞানহীনতা বলিয়া কর্তব্য সারিব? নাকি, সে আচরণের পশ্চাতে আরও গভীর কোনও উদ্দেশ্যের সন্ধান করিব?

চার নম্বর প্ল্যাটফর্মের এই সংখ্যায় আমরা আমাদের সীমিত সামর্থ্যের মধ্যে এই প্রশ্নগুলিরই উত্তর খুঁজিতে চাহিয়াছি। আমরা জানি, প্রশ্নগুলি অস্বস্তিকর, হয়তো বা তাহাদের উত্থাপনও বিপজ্জনক; কিন্তু আজ বা কাল, প্রয়োজনীয় প্রশ্নগুলি তো তুলিতেই হইবে।

আলোচ্য বিষয়ে প্রচ্ছদনিবন্ধগুলি লিখিয়াছেন জয়ন্ত ভট্টাচার্য, শঙ্কর রায় এবং স্বপন ভট্টাচার্য

গত কয়েকদিনের মধ্যে আমরা হারাইয়াছি শাঁওলি মিত্র, বিরজু মহারাজ, নারায়ণ দেবনাথ-সহ একাধিক স্মরণীয় ব্যক্তিত্বকে। এই সংখ্যায় রহিল তাঁহাদিগের প্রতি স্মরণ ও শ্রদ্ধানিবেদন। লিখিলেন গৌতম উপাধ্যায়, অর্ক পৈতণ্ডী, জয়রাজ ভট্টাচার্য, শরমিনুর নাহার, শুভম চক্রবর্তী, শতানীক রায়, দীপঙ্কর দে, যশোধরা রায়চৌধুরী

এতদ্ব্যতীত কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, বিশেষ নিবন্ধ, অনুবাদ সাহিত্য, অন্যগদ্য, ফটোফিচার, অণুগল্প, ধারাবাহিক উপন্যাস ও রচনা এবং স্টিম ইঞ্জিন, হুইলার্স স্টল, ভালো খবর-এর ন্যায় অপরাপর সকল নিয়মিত বিভাগ যথাযথ প্রকাশিত হইল।

পরিশেষে, আশা, এই মুহূর্তে দেশে কোভিডের তৃতীয় তরঙ্গ যেমন ক্রমে শীর্ষে পঁহুছিতেছে, প্রাকৃতিক নিয়মেই তাহা একদিন শেষও হইবে। কিন্তু মধ্যবর্তী কয়েক সপ্তাহে যে বিপুল ক্ষতি সা সাধিত করিয়া যাইবে, তাহার মূল্য দিতে হইবে আরও বহুদিন ধরিয়া। সেই মূল্য চুকানোর কালে আমাদিগের যেন স্মরণে থাকে যে, এই ক্ষতি আমরা নিজেরাই আহ্বান করিয়া আনিয়াছিলাম।

ভাল থাকিবেন বলিতে পারিলে ভাল হইত, কিন্তু, বলিতেছি না। বরং ভাবিয়া দেখুন, ভাল থাকিতে চাহেন কি না…

সম্পাদকমণ্ডলীর পক্ষে
অভীক ভট্টাচার্য