কলকাতা বইমেলা: কিছু প্রশ্ন, কিছু সংশয়   

স্বপন ভট্টাচার্য

 



প্রাবন্ধিক, গদ্যকার, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক

 

 

 

কলকাতা বইমেলার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আছে। আর কিছু না হোক, ফুটফলে বা সংখ্যাতে তো বটেই। বছরকার এই মেলার দিকে তাকিয়ে থাকেন যেমন পাবলিশার ও বই বিক্রেতারা তেমনই লেখক সে তিনি পূর্ণ সময়ের বা খুচরো যাই হোন না কেন, ছোট-বড় প্রায় সব সংবাদপত্র ও প্রতিষ্ঠান, লিটল ম্যগাজিনের লেখক সম্পাদকেরা, খাবারের দোকানের স্টলমালিকেরা, বিভিন্ন দূতাবাস, বিভিন্ন ইউনিভার্সিটি ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের পাবলিক রিলেশন শাখা, ধর্মপ্রচারকেরা, গুরুভাইদের দল, পুলিশ থেকে শুরু করে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের প্রচারযন্ত্র, লোকশিল্প ও হস্তশিল্পের সঙ্গে যুক্ত অসংগঠিত শিল্পক্ষেত্রের অনেক মানুষ ও সংগ্রাহকেরা, যুবক-যুবতীরা যারা গানের আড্ডা জমাবেন, কবি-আবৃত্তিকার-খুচরো গায়ক-লোকসংগীত শিল্পী যাঁরা গিল্ডের বা সরকারের ডাক পাবার অপেক্ষায় থাকেন বছরভর খেলায়-মেলায়- তালিকা দিতে গেলে এই পাতায় আঁটবে না। সুতরাং বইমেলাকে কেবল ব্যবসা ভাবলে চলে না বিশেষত বহু অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমজীবির রুটিরুজির সংস্থানও যেখানে বইমেলা-নির্ভর। এদের মধ্যে যেমন ছাপাখানার কর্মীরা আছেন তেমনই আছেন কলেজ স্ট্রিটের মোটবাহকের দল, ডেকোরেটিং শিল্পের সঙ্গে যুক্ত বহু কর্মী এবং আরও অনেকে। এবং অবশ্যই শিশু-কিশোরের দল যাদের কেউ কেউ হয়ত বইমেলা থেকেই ‘পাঠক’ হয়ে ওঠার প্রথম প্রেরণা পাবে-এমনটা ভাবতে ভালো লাগে, থাকবে তারাও যারা  বইমেলার ক’টা দিন মোবাইল ছেড়ে বইয়ের বায়না ধরলেও ধরতে পারে এবং থাকবে তাদের অভিভাবকেরাও যাদের অনেকেই ফেসবুকে ‘বইমেলায় তিন্নি বইয়ের পাতায় মগ্ন’ ছবি লটকানোর কথা একমাস আগে থেকেই ভেবে রেখেছেন। বইমেলার প্রায় জন্মলগ্ন থেকেই যে শিশুমেলার চরিত্র আছে, সেটা অস্বীকার করা যায় না আর ছোটদের বই বাদ দিয়ে বইমেলা বৈচিত্র ও বাণিজ্য দু’ইয়েরই দফা রফা, সন্দেহ নেই।

বইমেলার শুরু ও প্রতিষ্ঠা ময়দান থেকে, সে যুগের কথা ইতিহাসপূর্বকালের কথা বলে মনে হয়। তখন ধুলোর কারণে নাকে মুখে রুমালচাপা দিয়ে থাকতে হত। মাস্কের চল ছিল না, থাকলে হয়ত সকলেই সানন্দে মাস্ক পরেই বইমেলায় যেতেন। স্টলে বসতেন যারা তাদের দু’সপ্তাহ ধরে এই ধুলিঝড়ের মধ্যে থাকতে হত- তাদের স্বাস্থ্যের ওপর কী প্রভাব পড়ত তার কোনও সমীক্ষা হয়ে থাকলে বোঝা যেত কেবলমাত্র এই কারণেই অকালে তাদের কতজন দীর্ঘকালীন রোগের শিকার হয়েছেন। জায়গা বদলে বইমেলা মিলনমেলায় আসার পর ধুলো কিঞ্চিৎ কমে থাকবে, এখনকার মেলাপ্রাঙ্গণে ধূলোর সমস্যা তুলনায় অনেক কম আর খোলা জায়গাও খুব অপ্রতুল নয়। এবারের বইমেলায় শুনেছি খোলা জায়গা আরও অনেক বাড়বে যেহেতু স্টলের আয়তন কমে যাচ্ছে এবার। কোভিড বিধি মেনে মাস্ক আবশ্যিক করা হচ্ছে, বড়দের অধিকাংশেরই ধরেই নিচ্ছি ভ্যাকসিন নেওয়া হয়ে গিয়ে থাকবে সুতরাং ঘোঁট- ভোট- জোট- মেলা-খেলা, সবই যদি হতে পারে বইমেলা হতে বাধা কোথায়? বইমেলা নিয়ে বঙ্গবাসীর আবেগের কথা গঙ্গাসাগর মেলার সঙ্গে কোনওভাবেই তুলনীয় নয়, তবে কিনা এটা লোকালাইজড এবং সাংস্কৃতিক (যদি সেভাবে মেনে নিতে নেহাত অসুবিধে না থাকে আর কী!) আর ওটা সর্বভারতীয় আর ধার্মিক। ফলে গঙ্গাসাগর ‘কোভিড বিধি মেনে’ যে অলৌকিক নিয়মে করে ফেলা গেল, বইমেলা তার থেকে অনুপ্রেরণা পাবে না কেন ? ফলে, ভাবতে মন নেচে ওঠার কথা যে বইমেলা তাহলে হচ্ছে। স্টল নির্মানের কাজ চলছে পুরোদমে, লটারি সারা, পাঁচশতাধিক স্টলের স্থান নির্বাচিত হয়ে গেছে, মাঝে আর মাত্র কটা দিন, এখান থেকে পিছিয়ে আসার কোন মানে হয় না। কোভিড নিয়ে আমরা বুঝে গেছি ও এখন আর কোভিড নেই, ওমিক্রন হয়ে গেছে। বিশেষজ্ঞরা বলেই দিয়েছেন ও সবার হবে, কেউ বাদ থাকবেন না আর হলে ভয় পাবেন না, ধরে নিন তিন-চার দিনের ফ্লু মত হয়েছে, ওষুধ-বিষুধ ছাড়াই প্রায় সবাই সেরে উঠছেন । সুতরাং, মেলার মাঠ থেকে আলাদা করে কোভিড রেখচিত্র ভয়াবহ রকমের উর্ধমুখী হবে –এ সমস্ত অতি সাবধানী কথা বছরকার আবেগকে দমিয়ে দিতে পারে তবে তা হবে নেহাতই অযৌক্তিকভাবে। সব মেনে নিলে, প্রশ্ন আসে যেটা তাহলে ইস্কুল কী দোষ করল? বাচ্চারা অনলাইনে বাড়িতে বসে মাস্টারমশাইদের মুখোমুখি হচ্ছে কেন? পরীক্ষা কেন আবার ভার্চুয়াল মোডে ঘোষণা করে দেওয়া হল, সে তো বইমেলা পেরিয়ে বেশ কয়েকদিন বাদে হবার কথা। তাহলে বইমেলা কি ফর অ্যাডাল্টস ওনলি? বাচ্চাদের বাদ দিয়েই তা হবে এবারের মত? এসব জিজ্ঞাসা থেকেই সংশয়ের জন্ম- বইমেলা এবার হওয়া উচিত কি না? এখানেই ধান ভানতে গিয়ে শিবের গীত আমায় একটু গাইতেই হবে।

 

ঘটনা এই যে সংক্রমণ হারের একটা পাহাড়-প্রমাণ বৃদ্ধি চোখ  কান খোলা রাখলে দিব্যি মালুম পাওয়া যাচ্ছে। কোভিডের নবতম ভ্যারিয়ান্ট ওমিক্রন প্রথম সনাক্ত হয়েছিল নভেম্বর মাসে বোতসোয়ানায়। সেখান থেকে দক্ষিণ আফ্রিকা হয়ে সারা বিশ্বে পাড়ি দিয়েছে সে। দেখা গেল,  ভ্যাকসিনসঞ্জাত ইমিউনিটিকে বা এক-দুইবার কোভিডে ভুগে ওঠা লোকের অ্যান্টিজেনিক অভিজ্ঞতাকে ওমিক্রন খুব একটা পাত্তা দিচ্ছে না। কেন এবং কীভাবে তা পারছে ওমিক্রন তা একটু হলেও স্পষ্ট হচ্ছে। ইঁদুরের ফুসফুসে বা কৃত্রিম মানব-ফুসফুস তৈরি করে সেখানে ওমিক্রন সংক্রমণ ঘটিয়ে দেখা গেছে পূর্বতন ভ্যারিয়ান্টগুলোর তুলনায় এটির ফুসফুসে আক্রমণ করবার ক্ষমতা বেশ কিছুটা কম। কোভিডের প্রকোপ নাক থেকে ফুসফুসে পৌঁছালেই সেটি মারাত্মক হয়ে ওঠে।  আগেকার ভ্যারিয়ান্টগুলো ফুসফুসে প্রবেশ করতে একটা প্রোটিনের সাহায্য নিত যেটা ফুসফুসের কোষেরই একটা উপাদান যেটা ওমিক্রন, দেখা যাচ্ছে,  চিনতে ব্যর্থ হচ্ছে, ফলে ফুসফুসে প্রদাহ সৃষ্টি করার ক্ষমতা এটির সীমাবদ্ধ। এই কারণে বেশিরভাগ মানুষই সাধারণ সর্দি- জ্বরের মতই দু-চার দিন ভুগে সেরে উঠছে। কোমর্বিডিটির কারণে ব্যতিক্রম থাকতেই পারে, তবে মোটের উপর রোগী সেরে উঠছে তাড়াতাড়ি, যদিও সংক্রমণ হার ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এই বৃদ্ধিও ওমিক্রনের শ্বাসনালীর উর্ধাংশে সীমাবদ্ধ থাকার সঙ্গে সম্পর্কিত। নাক-মুখ থেকে যত ড্রপলেট বাতাসে মিশতে পারে ফুসফুস থেকে তা হওয়া সম্ভব নয়। ফলে এই নবতম ভ্যারিয়ান্টের R মান ( একজন আক্রান্ত মানুষ কতজন সুস্থ মানুষকে সংক্রামিত করতে পারে সে হার) প্রায় ৫/৬ এ পৌঁছেছে যেখানে আগে তা ১.৩/১.৪ এর মত ছিল। বাচ্চাদের নাসিকাপথ সরু এবং নবজাতকেরা মুখ দিয়ে শ্বাস নিতে পারে না বলে ওমিক্রনের ঘনত্ব বাচ্চাদের আপার রেসপিরেটরি ট্র্যাক্টে তুলনায় বেশি হবারই কথা। এই কারণে শিশুরা আক্রান্ত হচ্ছে অন্য ভ্যারিয়ান্টের তুলনায় বেশি হারে।

বলা দরকার, এই ঢেউয়ের প্রকোপ থেকে দক্ষিণ আফ্রিকা নিজে মুক্ত হয়েছে মাত্র একমাসের মধ্যেই। ব্রিটেন তৃতীয় ঢেউয়ে হাসপাতালে ভর্তির হার অর্ধেক হয়েছে বলে জানিয়েছে। একটা গতিপথ অনুমান আমাদের সরকারি বিশেষজ্ঞরাও করে থাকবেন, তাই তো পুরভোট পিছিয়ে দেওয়া হল মাসখানেক, অতএব বইমেলা কেন পিছোবে না সেটা আমার বুঝতে কিছু অসুবিধে হচ্ছিল! নীতিগতভাবেই যে মেলা শিশুদের উপস্থিতি ছাড়া ভাবাই যায় না, তা স্কুল খোলার আগে হওয়া উচিত নয় বলেই আমার মনে হয় । বাচ্চারা কি মেলায় সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং মেনে সারাক্ষণ মাস্ক পরে থাকতে পারবে,  না সেটা পারতে দেওয়াটা উচিত হবে?  আমরা কি পারি না আর কিছুদিন পিছিয়ে আর একটু ভয়মুক্ত পরিবেশে স্বতস্ফূর্ততা বজায় রেখে বইমেলা শুরু করতে? গত বছর বইমেলা হয় নি, এ বছরও তা তোলা থাক তা আমরা যারা মেলার মাঠেই কিছুটা অক্সিজেন পাই বছরকার মত, তারা কেউই নিশ্চয় চাইবো না, কিন্তু অবশ্যই চাইবো সংক্রমণ এই দফায় ফণা নামিয়ে রাখা পর্যন্ত অপেক্ষা করা হোক। তাতে বইমেলা, ফুটফল এবং বাণিজ্য, উভয় দিক থেকেই সফলতর হবার সম্ভাবনাও যে বেশি তা প্রায় নিশ্চিতভাবেই বলা যায়।

 

শেষ কথা যেটা বলতে ইচ্ছে করছে তা হল তৃতীয় ঢেউ একে বলাই যায় তবে ভাইরাস নিয়ে যারা চর্চা করেন, তারা মানবেন এখানেই শেষ বলাটা খুব প্রিম্যাচিওর হয়ে যাবে। ভাইরাসের জিন বিন্যাসে বদল সবচাইতে স্বাভাবিকভাবে আসে যে পদ্ধতিতে তাকে বলে মিউটেশন। ভাইরাসের ক্ষেত্রে বিশেষত ইনফ্লুয়েঞ্জা বা করোনাভাইরাসের মত আরএনএ ভাইরাসের ক্ষেত্রে মিউটেশনের হার আর পাঁচ রকম ভাইরাসের তুলনায় বহগুণ বেশি। এছাড়া, দুটো ভিন্ন ভিন্ন ভ্যারাইটি নিজেদের মধ্যে জিন আদান প্রদান করে তৃতীয় কোন ভ্যারিয়েন্টের জন্ম দিতে পারে – রিকম্বিনেশন যার নাম। এই সব কয়টি সম্ভাবনা প্রথম থেকেই খোলা ছিল, ওমিক্রন এসে যাবার পরেও খোলা আছে। একথা ঠিক, যত বেশি মানুষ সংক্রামিত হবে ততই গোষ্ঠী প্রতিরোধক্ষমতা বা হার্ড ইমিউনিটি তৈরি হবে অন্তত হওয়াটা বিজ্ঞানের নিয়মে হওয়া উচিত।  টিকা নিয়ে অথবা সংক্রমণের হার বেড়ে মানবশরীর করোনাকে সম্পূর্ণ রুখে দিতে পারবে এমনটা যদি নাও হয়, সে ক্রমে সহাবস্থানে রপ্ত হয়ে উঠবে এটা বলা হয়ত যায়, তবে তা এখনই কিনা অর্থাৎ এই তৃতীয়ই শেষ ঢেউ কিনা তা বলা অসম্ভব। যে যুক্তিতে ইস্কুল বন্ধ থাকে, ভোট পিছিয়ে যায়, সেই যুক্তি যদি ভুল না হয়, তাহলে বইমেলা অবশ্যই পিছিয়ে যাওয়া উচিত এই লেখা যখন অন্তিম চরণে পৌঁছেছে, ঠিক তখনই খবর পাওয়া গেল তা মাসখানেক পিছোনোর সিদ্ধান্ত পাকা হয়েছে। যুক্তি আবেগের উপর স্থান পেলে কার না ভালো লাগে?

Facebook Notice for EU! You need to login to view and post FB Comments!
About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4411 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...