শ্রাবন্তী মিত্র
একটা আস্ত গোটা ছুটির দিন হঠাৎ করে পেয়ে গেলে মনের মধ্যে এতরকম পরিকল্পনা খেলা করে, যে মনে হয় এক দিন বুঝি ২৪ ঘণ্টায় নয়, কম করে ৭২ ঘণ্টায় হয়। ফলে, মনের যাবতীয় পরিকল্পনাকে ঝাড়াই-বাছাই করে, সমস্ত কূচিন্তা ও সুচিন্তাকে এক স্থানে জড়ো করে, ইন-বিন-সেফটিপিন গোনার পর যে প্ল্যানটায় হাত পড়ে যায়, সেটাকে খপ করে তুলে নিয়ে বেরিয়ে পড়তে হয় চোখ বুজে। মানে যাকে বলে যেদিকে দু’চোখ যায়, সেদিকে দু’চোখ বুজেই এগিয়ে যাওয়া। এমন করেই মগজে আনতাবড়ি ঢিল মেরে একদিন পৌঁছে গেলাম এক নতুন গ্রামে। আসলে নতুন জায়গা মানে আমার কাছে শহুরে কংক্রিট ছেড়ে মেঠো পথের পাশ দিয়ে ছুঁয়ে দেখা এক টুকরো গ্রাম। আর এ গ্রাম তো নামেও নতুন, আমার চোখেও নতুন। তাই কয়েকটা বিস্কুট, চিড়ে, মুড়ি সঙ্গে নিয়ে সোজা মেট্রো ধরে দমদম, তারপর সেখান থেকে কাটোয়া লোকাল ধরে এগিয়ে যেতে লাগলাম গন্তব্যস্থল অগ্রদ্বীপ স্টেশনের দিকে।
একবার ট্রেনে উঠে পড়লে এন্টারটেনমেন্টের কোনও শেষ নেই। আশেপাশের লোকজন বুঝতেই দেবে না আপনাকে, আপনি একা যাচ্ছেন না দোকা। এইভাবে কখন যে ৩ ঘণ্টা কেটে গেল, বুঝলামই না। নেমে অটোয় উঠে বললাম, কাঠের পুতুলের এলাকা মিস্ত্রিপাড়ায় যাব। দশ টাকা ভাড়া দিয়ে হালকা মেঠো পথ ধরে ক্রমে সবুজের কাছাকাছি পৌঁছলাম। অটো থেকে নেমে যে রাস্তাটা দিয়ে মিস্ত্রিপাড়ার ভেতর ঢুকতে হয়, তার দু’পাশটা সবুজে সবুজ।
পাড়ার ভেতর ঢুকে একের পর এক বাড়ি, ছোট্ট ছোট্ট গলিপথ বেয়ে। সবকটা বাড়িতেই কাজ চলছে। রাস্তার ওপর কাঠ কাটা ও ছাঁটার কাজ করে চলেছেন পুরুষেরা। এরপর একটু ভেতরের দিকে বসে মাটির প্রলেপ দিচ্ছেন আর তার ওপর কাগজ সেঁটে দিচ্ছেন মহিলারা, যাতে মাটি আটকে থাকে কাঠের ছাঁচের গায়ে। এর পরের স্টেপটা সময়সাপেক্ষ। যতক্ষণ না রোদে ভালো করে শুকিয়ে যাচ্ছে, ততক্ষণ রঙের কাজ শুরু করা যাবে না। তবে এরপরেই শুরু হয় আসল খেলা।
কাঠের ছাঁচ থেকে রঙিন পুতুল হয়ে ওঠার গল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ে, প্রায় প্রতিটা পরিবারের আট থেকে আশিরা সকলেই সামিল হন। সারাদিন ধরে ছোট বড় মিলিয়ে কয়েক হাজার পুতুল তৈরি হয় প্রতিদিন এখানে। যদিও বেশিরভাগই প্যাঁচা, তবে এর মধ্যেও রকমফের আছে। এছাড়া কৃষ্ণ, নিতাই গৌর, জগন্নাথ বলরাম সুভদ্রা, ছোটবেলার খেলার সেই রাজা রানী, কিংবা বাঁশি, একতারা সবকিছুই আছে এদিকসেদিক মিশিয়ে মিলিয়ে। তবে এগুলো তো সবই কম সময়সাপেক্ষ কাজ। বেশ কিছু বাড়িতে তৈরি হচ্ছে কাঠের আসবাবপত্র। কী অসীম সাধনা আর ধৈর্যের কাজ, তা না দেখলে বোঝা যাবে না। একটা বাড়িতে দেখলাম লম্বা দরজার সাইজের কাঠের খোদাই করা দুর্গা বানানো হচ্ছে, অর্ডারের মাল। কলকাতায় যাবে। জানি না, এঁরা কত টাকা মজুরি পাবেন, তবে দক্ষতা আর নিপুণতা দিয়ে যে শিল্পকর্ম এঁরা করে চলেছেন অবিরত, তার কোনও তুলনা নেই।
এঁদের প্রত্যেকেই অর্ডার অনুযায়ী কাজ করেন এবং তৈরি হবার পর সামগ্রী বাড়িতে পৌঁছে দেবার ব্যবস্থাও করেন। গোটা গ্রাম জুড়ে প্রায় ৫০-৬০টি পরিবারে, রয়েছেন প্রায় ৩০০-৩৫০ জন শিল্পী। এমনকি অল্পবয়সী ছেলেমেয়েরাও প্যাঁচা কিংবা ছোট ছোট কাঠের পুতুল রং করতে সিদ্ধহস্ত।
একটু করে এগোচ্ছি আর দেখছি, প্রত্যেকের ঘরেই প্রবেশের কিংবা ছবি তোলার ক্ষেত্রে কোনও বাধা-নিষেধ নেই। কিছু না কিনলেও সুন্দর করে সাজিয়ে দেবে কেউ কেউ, শুধু আপনার দেখার বা ছবি তোলার জন্য এবং এঁরা প্রতি মুহূর্তেই চান, কীভাবে এঁদের কাজ আরও প্রচার পাক, পরিচিত হোক, দূরের মানুষের কাছে।
বেলা একটু গড়াতেই ঘুরতে ঘুরতে পৌঁছে গেলাম দিলীপ ভাস্করের বাড়ি। ওঁর মুখ থেকে শুনলাম নতুনগ্রামের কাঠের পুতুল তৈরির ইতিহাস। দিলীপবাবু বললেন, ঘরে ঘরে লক্ষ্মী পুজোতে যে প্যাঁচা-পেঁচির ব্যবহার হয়, সেই প্রয়োজনীয়তা থেকেই মূলত ঘরে ঘরে প্যাঁচা তৈরির কাজ শুরু হয়। আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে হরিপদ রায় চৌধুরী নামে একজন শিল্পী আসেন বোলপুর থেকে, যিনি মূলত উৎসাহ দেন ও শেখান কীভাবে কাঠের প্যাঁচা ছাড়াও পুতুল এবং অন্যান্য জিনিসপত্র বানানো যায়। এর সাথে সাথেই এই কাঠের পুতুল বানানোকে কেন্দ্র করে কীভাবে নতুনগ্রামকে হস্থশিল্পের কর্মস্থল করে তোলা যায়, সেই বিষয়ে নানাভাবে সাহায্য করেন। এরপর শুরু হয় ঘরে ঘরে কাঠের পুতুল বানাবার প্রশিক্ষণ।
১৯৬৬ সালে, দিলীপ ভাস্করের বাবা শ্রী শম্বুনাথ ভাস্কর একটি রাবণ বানাবার জন্য রাষ্ট্রপতি পুরষ্কার প্রাপ্ত হন। তারপর থেকে বংশপরম্পরায় এই কাজ চলে আসছে। এখন সরকার থেকে করাতকলের ব্যবস্থা করায় ধৈর্য ধরে বসে কাঠের ছাঁচ আর তৈরি করতে হয় না। তাই কম সময়ে কাজও বেশ খানিকটা এগিয়ে যায়। দিলীপবাবু বর্তমানে, কলকাতার হেরিটেজ স্কুলে কাঠের পুতুল বানাবার ট্রেনিং দেন ছাত্রছাত্রীদের। নতুন প্রজন্মের কাছ থেকে কিরকম প্রতিক্রিয়া পান জিজ্ঞাসা করাতে উনি বলেন, “ওরা খুব আগ্রহ সহকারে শেখে। যতটা পারে, বানানোর চেষ্টা করে, আর স্কুলের মাস্টাররাও খুব উৎসাহ দেন এদের এই কাজে।”
দিলীপবাবুর সাথে কথাবার্তা সেরে, গ্রামের পথ দিয়ে হাঁটতে-হাঁটতে গিয়ে দেখে এলাম, কাঠিয়া বাবার তপোবন। ভিতরে রয়েছে মন্দির, আশ্রম, গো-শালা, খরগোশ, এবং একটি বিশালাকার ময়ূর। পরেরবার কেউ নতুনগ্রামে গেলে অন্তত ময়ূরটিকে দেখার জন্য একবার কাঠিয়া বাবার তপোবন থেকে ঘুরে আসতে পারেন।
তবে নতুনগ্রামে রুটিরুজির হাল বৃদ্ধি হয়েছে সাম্প্রতিককালে, যখন থেকে কলকাতার বিভিন্ন মেলায় এঁদের কাজকে তুলে ধরবার প্রচেষ্টা নিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গ সরকার। অবশ্য এ ক্ষেত্রে “বাংলা নাটক ডট কম”-কে ধন্যবাদ না দিয়ে থাকা যায় না। প্রতি বছর বাংলার লোকসংস্কৃতির বিভিন্ন শৈল্পিক নিদর্শনকে তুলে ধরবার জন্য যে মেলাগুলি গোটা শীতকাল জুড়ে এঁরা পরিচালনা করে থাকেন, তার মধ্যে “কাঠ পুতুলের মেলা” অন্যতম।
যদিও আজকাল সারাবছরই মানুষ আসেন এঁদের কাছে এবং কমবেশি টুকটাক জিনিস কিনে নিয়ে যান বা অর্ডার দেন, যার ফলে বর্ষার সময় এদের সংসারে এখন আর আগের মত টান পড়ে না। তবে, এখন জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় এবং হস্তশিল্প মেলা ইকো পার্কে স্থানান্তরিত হওয়ায় আগের মতন সেরকম বিক্রি-বাটা হচ্ছে না এবং বহু সামগ্রী ফেরত নিয়ে চলে আসতে হচ্ছে বলে জানান, বেশ কিছু শিল্পীরা। বেশ কয়েক বছর আগে পশ্চিমবঙ্গের “রুরাল ক্রাফট অ্যান্ড কালচারাল হাবস”-এর পক্ষ থেকে নতুনগ্রামে পর্যটকদের জন্য থাকবার একটি ব্যবস্থা করা হয়েছে। বেশ সুন্দর, ছিমছাম এই অতিথিশালার ভেতরে একটি মিউজিয়ামও আছে। তবে মেলার সময় এবং শীতকালে গিয়ে থাকতে চাইলে আগে থেকে বুকিং করে যাওয়াই ভালো, না হলে থাকার জায়গা পাওয়ার সম্ভাবনা বড়ই কম।
অভাব আছে, অভাব থাকবেই। অভাবকে সঙ্গে নিয়েই এগিয়ে যাওয়া প্রতিটা দিন। তবে যেটা আছে এঁদের মধ্যে তার নাম, ভালোবাসা আর আতিথেয়তা, যার জন্য সারাটা দিন একবারের জন্যেও আমার মনে হয়নি যে আমি একা গেছি। কেউ ডাকছেন চা খেতে, আবার কেউ ডাকছেন ভাত খেতে। শেষমেশ এক দিদা বলেন, “তাহলে মুড়ি মেখে দিই? গাজর, শশা, পেঁয়াজ কুঁচি আর কড়াইশুঁটি দিয়ে?” আমি বললাম, “তাই দাও”। তারপর জিনিসপত্র গুছিয়ে হৈ হৈ করে টোটোয় তুলে দেওয়া জনা ছ-সাতেক কচিকাচা মিলে একসাথে। ফিরে আসার সময় মনে হচ্ছিল, আমি বোধহয় আমার গ্রামের পরিবারকে ফেলে রেখে এগিয়ে যাচ্ছি শহরের পরিবারের দিকে। এখানে হয়ত আবার আমাকে ফিরে আসতে হবে, কিছু না কিনলেও এই মানুষগুলোকে দেখতে, এঁদের ভালবাসার টানে।
এক হাতে মুড়ি, অন্য হাতে শিঙাড়া, ব্যাগ ভর্তি প্যাঁচা, পুতুল আর মনের কোণে চিনচিনে একটা ব্যথা নিয়ে উঠে পড়লাম ট্রেনে। বিকেল চারটে পঁয়তাল্লিশের জঙ্গিপুর মেমু। সবুজ ঘাসের ওপর তখন হলুদ আলোর ঝিকিমিকি। শেষ বিকেলের এই মুহূর্তটা আমায় বরাবরই মায়ায় জড়িয়ে রাখে, যেখান থেকে ফেরত আসাটা কঠিন হয়ে পড়ে, ক্রমশ কঠিন। সময়টা কাটতে চায় না। একটা গল্প মনে মনে ফাঁদ পাততে থাকে। ঘুম এসে যায় চোখে, পেট ভরা আদরের ঘুম …