নীহারকান্তি হাজরা
নদ-নদীর সঙ্গমভূমে
অধ্যায় ১: পর্ব ১। পর্ব ২। পর্ব ৩। পর্ব ৪। পর্ব ৫। পর্ব ৬। পর্ব ৭। পর্ব ৮। পর্ব ৯
অধ্যায় ২: পর্ব ১। পর্ব ২
বৃত্তির বৃত্তান্ত
আমাদের স্কুলের একটু দূরে ছিল মোহনলাল গোয়েঙ্কার গেঞ্জিকল। বাঁকুড়া জেলায় বা তখনকার সমস্ত মফস্বলের মধ্যেই প্রথম। এই গেঞ্জিকলের উৎপাদনগুলি চালানোর জন্যে বড়বাজারে একটি বড় দোকান ছিল। সাইনবোর্ড ‘বাঁকুড়ার গেঞ্জি’। বাস্তবিকপক্ষে কারখানার কর্মচারীরাই কেবলমাত্র এগুলি অঙ্গে তোলায় বাধ্য ছিল। জাতীয়তাবাদে উৎসাহিত হয়ে যাঁরা এগুলি একবার মাত্র পরিধান করেছিলেন, একমাত্র ব্রাহ্মণ ছাড়া আর কারও এগুলি কাজে আসেনি। কারণ একবার কাচার পরই এগুলি উপবীতের আকার পেত। দৈর্ঘ্য এবং প্রস্থের বিপরীতমুখী গোলমাল সমাধা করতে না-পারায় গেঞ্জিকলের গঙ্গাযাত্রা ঘটল। তবে এখানকার টেকনিশিয়ানদের কাজের অভাব হল না। এবার জেলার মানুষের দুঃখের অবসানের জন্যে দ্বারকেশ্বরের উপর সেতু নির্মাণে গোয়েঙ্কারা নেমে পড়াতে তারাই এর বাস্তুকার হয়ে গেল।
জেলার দক্ষিণ দিক থেকে যে পথটি শহরে ঢুকতে চেয়েছে, সেটির ছেদ ঘটেছে দ্বারকেশ্বরের দক্ষিণ তীরের একটি বর্ধিষ্ণু জনপদে এসে। রাজগ্রাম।
এই গ্রামে এবং অন্যত্র বেশ কিছু ভেড়ার পাল এবং তাদের মহাজনদের বাস ছিল। শ-দুয়েক ভেড়ার এক একটি ভেড়ার পালকে দুজন বিহারির হাতে তারা
জেলার দক্ষিণ থেকে আসা যানবাহনগুলি এই রাজগ্রামে এসে যাত্রা শেষ করত। নদীটি এখানে বেশ একটি বাঁক নিয়ে পূর্বমুখী হয়েছে। এর ফলে নদীটির প্রসার এখানে অনেকটা কম। এখানেই তৈরি হয়ে চলল সেতু। গোটা দুই-তিন কর্মকাণ্ড বর্ষার জল-প্লাবনের খাদ্য হওয়ার পর সেতুটি খাড়া হয়ে গেল, কিন্তু অপরিণত পিলফারগুলি স্রোতধারার আঘাতে দুরু দুরু বক্ষ হয়ে তার কাঁপুনি সেতুটির প্রতিটি অঙ্গে ছড়িয়ে দিল। প্লাবন চূড়ান্ত হলে সাধারণ যানবাহন চলাচল বন্ধ হল, তারপর ভারী যানচলাচল একেবারে বন্ধ হল। শেষে একদিন উপলব্ধ হল সেতু পাশ ফিরতে চাইছে। এর পরই প্রশাসন কেবলমাত্র হেঁটে চলাচলের বিজ্ঞপ্তি সেতুটির দুই প্রান্তে সেঁটে দিল। এর বেশ কিছুদিন পরে এক প্রবল বন্যায় এটি ঘটোৎকচের মতো বিপুল শব্দ তুলে জলশায়ী হলে। অনেককাল পর্যন্ত জেগে রইল নদীগর্ভে তার শব। আমাদের কুলপুরোহিত রাসবিহারী ঘোষালের বড় ছেলে ছিল গেঞ্জিকলের টেকনিশিয়ান এবং পরে এই সেতুর কারিগর।
পুরোহিতবৃত্তি কাকে বলে তাও দেখেছিলুম রাসবিহারী ঘোষাল মশায়ের সৌজন্যে। নিখুঁত সংস্কৃত মন্ত্র উচ্চারণ শুনে প্রত্যয় হত তিনি তাঁর ভিটের কাছেই চতুষ্পাঠীর ছাত্র ছিলেন। উজ্বল কৃষ্ণকায়, তীক্ষ্ণ নাসা এই মানুষটি খড়ম পরতেন। স্বল্প এবং মৃদুভাষী ছিলেন। এই মানুষটি আমাকে একদা বললেন, ‘‘বাবু, আমার অনুগমন করবে নাকি একটি গ্রামে? এটি আমার শিষ্যগৃহ। গ্রামটির নাম বিল্ববনি। উপলক্ষ, অন্নপ্রাশন। ছটি শিশুর সংস্কারের কার্যক্রম। তবে তা নয়, তোমার পরিলক্ষ্য হবে একটি একাদশ তিলি জাতির একান্নবর্তী পরিবার।’’
পরের দিনই রওয়ানা দিয়েছিলুম বিল্ববনি। সাইকেলে আগে তিনি। পিছনে অপর সাইকেলে আমি। লাল আর ধূসর মাটির মসৃণ গুঁড়োভরা পথ। ওপরে ডানলপ টায়ারের অপসৃয়মান ছাপ। প্রায় চল্লিশ মিনিট সাইকেল চালনার পরে পৌঁছনো গেল গ্রামটিতে। ঢোকার মুখে চওড়া পাড়ের বেশ বড় পুকুর। স্নান সারছে নানা বয়সের মানুষজন। ঘাটগুলি পৃথক। শীতের সকাল।
সমস্ত পথ বন্ধ করে একটা আড়াআড়ি বিস্তৃত দেওয়াল আর তার মাঝখানে একটা প্রশস্ত খোলা দরোজার সামনে তিনি নামামাত্রই শূন্য থেকে কটা লোক এসে তাঁর সাইকেল এবং পরে আমারটা নিয়ে উধাও হয়ে গেল। পরের দৃশ্যে এক বয়োবৃদ্ধ গাড়ু আর গামছা হাতে এসে প্রথমে তাঁর পায়ে জলছড়া, তারপরে জলধারা দিয়ে ক্রমে-পিছিয়ে গৃহে প্রবেশ করলেন। গৃহ। দুই পাশে শ্রেণিবদ্ধ ঘর, মেলা চোখ যতদূর নিতে পারে। মাঝখানে, ঠিক মাঝখানে, কোনও অদৃশ্য তর্জনীসঙ্কেতে বিরাট আয়তাকার শূন্যস্থান। এরই মাঝখানে সদ্যকর্তিত সডাল শালপাতার আচ্ছাদন। নীচে শোলার চাঁদমালা, ফুল এবং বিভিন্ন মাপের আলপনা দেওয়া সরার মাঝখানে একটি মণ্ডপ। বহুবিস্তৃত এই শূন্যতা পরিপাটি গোবরলিপ্ত। তিনি এখানে উপস্থিত হতেই শুরু হল ভুক্ত বয়স নর-নারীর তাঁর পায়ে জল ঢালা এবং মোছানো, সঙ্গে সংবদ্ধ নতজানু প্রণামান্তে একটি মোড়ক। পরে জেনেছি তাঁর কৃপালাভের দক্ষিণা। এই শূন্যতার একদিকে একটি সদ্যখনিত উনান। রন্ধনের সমস্ত উপযোগ। নামাবলির বিজ্ঞপ্তি গায়ে পাচক ব্রাহ্মণ। তিনি এক্ষুনি পুরু দুধের চা তৈরি করবেন। রাসবিহারী এই চা বেশ কয়েকবার পান করেন। তারপর সমস্ত অনুষ্ঠান-শেষে তাঁর ভোজন। আমিষবর্জিত। অসংখ্য ব্যাঞ্জন। গব্যঘৃতে পক্ক সোনামুগ ডাল। সবগুলি এই পরিবারের ফসল। তিনি অল্প ভোজন করেন। বাকিটা প্রসাদ হয়ে যায়।
এর মধ্যে আমার আবার শ্রেণিবদ্ধ বসবাসের ঘরগুলির মাঝখানের চওড়া পরিসর ধরে কৌতূহলের নিবারণ: ডাইনের একটি প্রশস্ত ঘরে থমকে দাঁড়াই। গুড় জ্বাল দেওয়ার আয়তাকার একটি পাত্রে ফুটছে বার্লি। পাশে পড়ে অনেকগুলো খালি হলুদ রঙের পিওরিটি ইন্ডিয়ান বার্লির কৌটো। একটি সলজ্জ বধূ এর আয়োজনে। অসুস্থ শিশুদের পথ্য পাক হচ্ছে। পরে এর উত্তর মিলবে। আপাতত মাঝখানের অসংখ্য শিশুর বিভিন্ন ভঙ্গির কলকাকলি। আরও এগিয়ে ডাইনে বাঁয়ে শেণিবদ্ধ ঘর। বসবাসের। কতগুলি বদ্ধ দরোজা। পরে জানব চালের-ধানের বিশাল পরিমাণ সংরক্ষণের ভাণ্ডার। দু-চারটে একবারে শূন্য ঘর। কড়িবরগায় সারি দেওয়া বাঁশের আলনায় টাঙানো কম্বল, দেওয়াল-সংলগ্ন গুটানো বহুচিত্রিত খেজুরপাতার চাটাই। এই বিচিত্র আয়োজনের শেষ মাথার বড় দরোজা পার হয়ে বিরাট রাজার গোয়াল। একদিকে মোষ, অন্যদিকে গরু। দু-প্রান্তেই তাদের পৃথক ডাইনিং হল। তার সরঞ্জাম। সদ্যপ্রসবিত গো এবং মহিষ বৎস দুপাশে আলস অবসরে নানা ভঙ্গিমায়। তার বাইরে বিস্তৃত খামারে কৃষি-সরঞ্জাম। খড়ের পালই। একবার রাসবিহারীর ঘরে উঁকি দিই। বেশবাস আর অন্নভুক্ত হওয়ার তাবৎ আয়োজন-সহ ছটি শিশু। তাদের সলজ্জ মাতৃকুল। তিনি আসনে আসীন।
এবার বাইরে। যেখানে প্রথম নেমে ছিলুম সেখানে। এই দুর্গের প্রধান দরোজা দিয়ে বেরিয়ে ডানদিকে বহুবিস্তৃত প্রাচীরের শেষে একটি প্রশস্ত চালাঘর। চালার ভিতরে একটি প্রশস্ত ঘরে মুদি-মশলার থাকানো বস্তা ইত্যাদি। আওয়াজ পেয়ে যিনি বাইরে এলেন তিনি মধ্য বয়সের। ফরসা। মাথার পিছনে টাক। পরনে কাছা। অঙ্গে ফতুয়া। নাম হিতলাল। দুটো মোড়া বার করে বসার অনুরোধ। এবার প্রশ্ন-উত্তরের বাসনা। মুখ খোলার আগেই হাজির কর্তিতচুল গলায় তিন ভাঁজ তুলসির মালাধারী এক বিধবা। উঁচু বারান্দায় উঠেই অঙ্গচালনা করে অনর্গল শব্দপ্রবাহের কুলকুচি। হিতলাল উঠে তাঁর মাথার উপর চালার বাতায় টাঙানো জাল পেড়ে নেন। এ বস্তুটা এতক্ষণ আমার নজর এড়িয়ে গেছে। গভীর মনোযোগের সঙ্গে সেই বিধবা সাদা সুতোয় জাল বোনায় মগ্ন হয়ে গেলেন। মাছ ধরার জাল। দীর্ঘ সময় পর তিনি নিষ্ক্রান্ত হলেন। হিতলাল জাল তুলে আবার বাতাসন্নিহিত করলেন।
“কী বুঝলেন?”
মাথা নাড়লাম।
“আমার এক পিসি। বউদের উপর রাগ। শুনলেন তো। ব্যাপার কি জানেন মাঝবয়সে কি অল্প বয়সে বিধবা হলে সাধগুলো তো মরে না। তারই বিকার। এগুলো বেরোলে চুপ।”
আমার অবস্থানকালে এরকম তিনবার ঘটল। প্রতিবার উঠে এল জাল। কিঞ্চিৎ বয়ন। আবার তুলে রাখা। “আচ্ছা, আপনার এই জাল কতদিন বুনছেন?”
উত্তর এল, “তা প্রায় বছর দশেক। আমার এই পদে আসা ইস্তক।”
তাহলে এই পরিবার তাঁকে নির্বাচন করেছে! রাজা গোপাল!
“না, তা নয়, বুঝলেন, আমি তক্ষুণি ঠাওর করে ঠিক করতে পারি।”
বলতে বলতেই এল দুটি সমবয়স্ক যুবক। পরনে কাছা। রঙিন হাফহাতা জামা। একরকম। হাতে কাপড়ের থলি। তারা বারান্দায় উঠেই প্রণাম করে মাথা নীচু করে দাঁড়ালে। হিতলাল দোকান ঘরের চালায় গোঁজা কাগজের দুটো মোড়ক তাদের হাতে দেওয়ার পর তারা বিদায় হল।
“এরা শ্বশুরবাড়ি যাবে,” বললেন হিতলাল। কাগজের মোড়কে আনুকূল্য। প্রত্যেকের নির্দিষ্ট।
এবার আসল তথ্য, “মোট কুড়িজন ভাই। যুবক। তাদের বধূ। নানা বয়সের বর্ধমান সন্তান। গড়ে তিন। এরপর কাকা জ্যাঠা। বিধবা পিসি। মাসিও আছে। হ্যাঁ সকলের কাজ ঠিক করা আছে। যেমন ধরুন নতুন বৌ বাড়িতে এলে দফায় দফায় খেতে বসলে তারা পাতায় নুন পরিবেশনের কাজটা করে। হামানদিস্তা বা ঢেঁকিতে মশলা গুঁড়ো করে, তরকারি বনায় (এই বনান শব্দটা বাঁকুড়ার ভাষায় বর্ণহিন্দুদের নীচের থাকে সবসময় ব্যবহার হয়), কাঠের জ্বালের জোগাড় করে, পিসিদের হুকুমের নীচে অ্যাপ্রেন্টিস থাকে মুড়ি ভাজার, শেষে ভাগে ভাগে রান্নাশালায় দাঁড়িয়ে আদেশমতো নুন-মশলা দেওয়ার কাজটা করে। পোক্ত হলে রান্নাঘরের ডিউটি। পালাপার্বণে জামাকাপড় সব একরকম। শ্বশুরবাড়ি গেলে একরকম অনুদান। রংচং নিয়ে মাঝেমধ্যে যে গুঁইগাঁই হয় না তা নয়, তবে নিয়মের ভারে চলে যায়। দেখলেন কতগুলো ফাঁকা ঘর? কুটুমজন এলে ওখানে থাকে।”
“আর এই দোকান?”
“এটা থেকে মশলাপাতি সরবরাহ হয়।”
“আয়?”
“চাষবাস। সব চাষ হয়। সব। খানিকটা বিক্রি করে নগদ টাকা আসে। ডাক্তার-বদ্দির খরচ তো আছে। আবার পাশে যে ইস্কুল দেখছেন, এর অর্ধেক ছাত্র তো এই মণ্ডলবাড়ির।”
“পাশ করে কেউ কলেজে ঢোকে না?”
“আছে এ-বছর জনা ছয়েক। আগেরগুলো পাশ দিয়ে বাইরে গেছে।”
এবার হিতলাল জাল পেড়ে নেয়। একা। বুঝতে পারি অন্যমনস্ক হতে চায়। “বুঝলেন এখানটায় গিঁট”। আজ এতদিন পরে, পঁচাত্তর বছর পরে, ভাবি সেই উনিশশো চুয়ান্ন সালে হিতলাল মণ্ডল কি ম্যানেজমেন্টের মডেল হতে পারত! সে বুঝতে পারে একান্নবর্তী পরিবারের দিন দীর্ঘশ্বাস ফেলছে!
আমাদের গ্রামে বামুনদের পাড়ার পর ডানদিকে একটা গভীর, বিস্তৃত পুকুর পার হয়েই দক্ষিণ পাড়ে হীরু কামারের কামারশালা। হীরু এ-জেলার প্রথমদিকের একজন বাস ড্রাইভার। সে বেঁচে নেই। কামারশালা চালায় তার নাতি আর তার ছেলে বিশু। এখানেই এককালে চোখের ছানি শ্যাওড়াপাতার পিছন দিয়ে ঘষে তোলা হত।
এর পিছনে একটা চালতাগাছ পার হয়ে নাপিতপাড়া। এর সবচেয়ে বয়স্ক লোকটির নাম বৈকুণ্ঠ পরামাণিক। এই পাড়াটির থেকে সোজা গেলে কলুপাড়া আর গ্রামটির পশ্চিমে, শেষ মাথায় কলুপাড়ার পাশে ছিল বহু ঘরের ছুতোরপাড়া। সেখানে ঢোকার মুখে নকুল গরাইয়ের পিতা শিবু গরাইয়ের তেলের ঘানি ছিল। আমি এর শেষ পর্যায়টা দেখেছি। তখন তেলকলের সরষের তেলের সের বারো আনা। পরে দাম বেড়ে হল এক টাকা আট আনা। একটা বড় রিঠেফলের গাছের নীচে ছিল তেঁতুলকাঠের ঘানি। একজোড়া বলদ এটিকে চক্রাকারে ঘোরাত এক ছোকরার তাড়নায়। এটি কলের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় হেরে গেল। নকুল কলু দিলে এক মুদির দোকান। বৃত্তির বদল হয়ে গেল।
ছুতোরপাড়ার লোকেরা গ্রামে-গ্রামান্তরে করত দরোজা জানালা থেকে নানা ধরনের কাঠের কাজ। খড়ের, চালাঘরের উপরের কাঠের কাঠামো। অন্তত তিনজনের একটা দল হত। গৃহস্থের গাছের গুঁড়ি সোজা করে রেখে তেলকালি মাখানো সুতোয় দাগ দিয়ে দুদিকে টানাটানি করে লম্বা করাত চালাত। সূর্য মাথা ছাড়িয়ে পশ্চিমে ঢালু হলেই গৃহস্থ দিত সরষের তেলের বাটি। কানে নাকে তেল শুষে নিয়ে আর খানিকটা নাভিতে দিয়ে মেখে চলত অঙ্গাঙ্গী। তারপর পুকুরে। ফিরে এসে চূড়াপ্রমাণ ভাত কলাইয়ের ডাল আর স্বল্প তরকারি বা চুনোমাছের ঝাল সহযোগে আত্মসাৎ করে শালপাতায় তামাকের পাতার পুরিয়া ভরে পাকাত চুটিয়া। ইতিমধ্যে কনুইয়ে ভর দিয়ে আধশোয়া। উদ্গীর্ণ ধূমের পিছনে আকাশে রাখা চোখ নিমীলিত হত। চেরাইয়ের কাজ শেষ হওয়ার পরে কাঠের চেরা তক্তার রস শুকোনো। গৃহস্থের লক্ষ্য শেষ করতে মাস দুয়েক। মজুরি চাল বা ধান। চাকুরিজীবী হলে একটি আধুলি, সঙ্গে চাল। নকুলের কাছে খানিকটা চাল বেচে তেল-মশলা নিয়ে ঘরের দরোজা।
ছুতোরেরা আবার অনেকেই সব শহরে চলে যায়। ভালো ছুতোরেরা সব। নবনী, বিশ্বনাথ, আরও কয়েকজন কাজ করে বিডিআর রেলের কারখানায়। BDR – Bankura-Damodar River Railway। সে বিচিত্র রেলের কথা পরে। সেই রেলেই এরা করত বগি তৈরির কাজ। রাস্তা পার হলেই বৈষ্ণবপাড়া। সারি সারি ঘরের মঠ। মাথা ন্যাড়া নারী-পুরুষ। নাকে কপালে রসকলি। ফাটা বাঁশের মধ্যে চলা বাতাসের মতো গলায় মাধুকরী দরোজায়: রাধে… রাধে।
আর শেষে জেলেপাড়া। পদবী মেটে— মল্ল। সারা বছর মাছ ধরে। বর্ষায় দুটো নদীর বহু জায়গায় পাবাল পাটা পুঁতে তার উপর সারা রাত জাল ফেলে দাঁড়িয়ে থাকে। আর শরতের মন্দ স্রোতে কাঁটিশি দেয়। শোয়ানো V আকারে বাঁশের বেড়া স্রোতের মাঝে। জাল থাকে কোণায়। মাছ ধাক্কা খেতে খেতে জালের ভিতরে। “সে আইজ্ঞা মাছের নেশা আর আশার নেশা বড় সাঙ্ঘাতিক।” সে তো চোখেই দেখা গেল। পশুপতি মল্লের জালে পড়ে গেল একটা পুকুরভাসা আট-দশ সেরের মাছ। পাবাল পাটা থেকে লাফ দিয়ে নেমে মাছটাকে আঁকড়ে ধরে জলে উথালপাথাল। মাছ মুক্ত হয়ে চলে গেল। বুকে আঘাত নিয়ে পশুপতি ঘরে ফিরে বিছানা নিলে। ঘোর বিকার। একটিই বাক্য বলে গেল সাতদিন— এত বড় মাছটা ছেড়ে গেল্! এত বড় মাছটা…। দিন সাতেক পরে পাড়ার লোক বললে— মাছটার শোকে পশুখুড়া মরে গেল!
এই পাড়াতেই ছিল সিন্ধু মল্ল। নিম্নবর্গের ‘সিবিল সার্জেন’— ‘কেটে অপিরেশন করেন’। পরনে একটি সংগৃহীত বহু পুরনো হাফপ্যান্ট। উপরে ফতুয়া। যৎপরোনাস্তি ময়লা। আসলে অভিজ্ঞতার বিজ্ঞাপন। কোমরে ঝোলানো চটের ব্যাগ। তার ভিতর থেকে উঁকি দেয় বিশুকামারের শালায় তৈরি নানা মাপের ছুরি। ছোট চিমটে। কাস্তের ভাঙা নীচের অংশটা। টপনা। নানা মাপের ছুঁচ। আর মার্কিন কাপড়ের টুকরো। বিশেষ করে তিনি ফোঁড়া বিশারদ। গ্রামের লোকেরা অঙ্গের কোথাও পেকে উঠলেই তাঁকে স্মরণ করেন। এমনি একটি ভয়ানক ‘কেটে অপিরেশন’ দেখার অভিজ্ঞতা ঘটেছিল। রাসবিহারীর যজমান গোকুল তেলির বাড়িতে হাজির হয়েছিলাম তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্রের সঙ্গে। তখন প্রায় বিকেল। গোকুল একটি দড়ির খাটে উঠানে উপুড় হয়ে শুয়েছিল। তার পিঠে মেরুদণ্ডের বাঁদিকে একটি বহুমুখ ফোঁড়া। বেগুনি। পুঁজে টইটম্বুর। বাঁ হাত উঠছে না। গরু মোষ চরানো বন্ধ। সার্জেন তৈরি। পাশেই রান্নাঘরের কাঠের চুলায় গরম হচ্ছে কয়েকটি ছুরি আর লৌহশলাকা— টপনা। অগ্নিভ হলে সরিয়ে আনা। এরপর চড়ল গৃহপ্রণীত গব্য ঘৃত। ফোটার পর নামানো। আদেশ হল, “চুপ মেরে শুয়ে থাক খুড়া।” বেরোল মার্কিন। কোয়র্টার ইঞ্চি মাপে ফালা ফালা। চুবানো রইল গরম ঘিয়ের বাটিতে। এরপর বেশ খানিকটা মার্কিন কাপড় ঘিসিক্ত করে সজোরে চাপ সেই ভয়ানক ফোঁড়ার উপরে। বহুমুখের নির্গত রক্ত-পুঁজে বস্ত্রখণ্ড পিচ্ছিল হতেই সেটাকে সরিয়ে ছড়ানো হলো উষ্ণ ঘৃত। তারপরে অকস্মাৎ ছুরি বার করে ফোঁড়ার উপরে যুক্ত চিহ্ন্। চোখ বন্ধ আমার। পুঁজ এবং রক্তের বিস্ফার গড়িয়ে ভিজেছে খাট। চোখ খুলে দেখি, গব্য ঘৃতে ভিজানো কাপড়ের ফালা টপনা দিয়ে সেই ভয়ানক ক্ষতের ভিতরে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে— গজ। এখন আমাদের নিঃশ্বাস বন্ধ। আমরা স্থির যে গোকুল হয় জ্ঞান হারিয়েছে কিংবা মৃত। হঠাৎ সেই নিশ্চল শবের ভিতর থেকে অনয়াস প্রশ্ন উঠে এল, “হইছে ব। এবেরে উঠব?” দাঁড়িয়ে পড়ল গোকুল।
[ক্রমশ]

