Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

স্মৃতিপরব: অধ্যায় ২, পর্ব ৬

নীহারকান্তি হাজরা

 

নদ-নদীর সঙ্গমভূমে

অধ্যায় ১: পর্ব ১পর্ব ২পর্ব ৩পর্ব ৪পর্ব ৫পর্ব ৬পর্ব ৭পর্ব ৮পর্ব ৯
অধ্যায় ২: পর্ব ১ পর্ব ২পর্ব ৩পর্ব ৪পর্ব ৫

 

ফসলভরা উজাড় ক্ষেত

আমার পিতৃদেবের পাঠ্য কিছু বই বাড়িতে মিলেছিল। তিনি মিশনারি স্কুলের ছাত্র ছিলেন। এখন কেবল মনে আছে এর মধ্যে ছিল গ্রিক ক্লাসিকস। আর ছিল টমাস ডি কুইন্সির ‘কনফেসন্‌স অব অ্যান ইংলিশ ওপিয়াম ইটার’। খুব ভালো সংস্কৃত জানতেন। তাঁর কাছে শুনেছি প্রথমে মুনসেফ এবং পরে কোন কোন জজসাহেব নিজেদের রায়ের ইংরেজি তাঁকে দেখিয়ে নিতেন। বাবা তাঁর শিক্ষকদের কথা বলতেন প্রায়শ। এঁরা ছিলেন এডওয়ার্ড টমসন, ব্রাউন আর মিচেল সাহেব। এই টমসন সাহেব ইংরেজিতে রবীন্দ্রনাথের জীবনী লিখেছিলেন। পিতৃদেবের লেখা একটি কাব্যও পেয়েছিলাম। বাঁকুড়ার লক্ষ্মী প্রেস থেকে ছাপা, ‘জামদ্যগ্নের শক্তিহরণ’। তিনি প্রথমে একটি স্কুলে শিক্ষকতায় ঢোকেন। তারপর কালেকটরির সরকারি চাকুরি।

তিনি উত্তরাধিকার পেয়েছিলেন বেশ কিছু ভূ-সম্পত্তির। এগুলি গ্রামের আশেপাশে। আবার বেশ দূরে গন্ধেশ্বরী নদীর পশ্চিম তীর বরাবর। এ সবই এজমাল। তাঁর আরও দুই ভাই ছিল। পৃথগন্ন। আমার কাকা এবং জ্যাঠামশাই। তিনি আমার পিতামহের মতো প্রাথমিক শিক্ষক ছিলেন। তিনজনের মৃত্যুর পরও সে সম্পত্তির বাঁটোয়ারা হয়নি। উনিশশো তিপ্পান্ন সালের ভূমি আইন এবং তারপরের সাতষট্টি আর বাহত্তর সালের বর্গা আইন এই ভূমিখণ্ডগুলিতে কার্যকর করার প্রয়োজন হয়নি। এগুলি আগাগোড়া চাষিদেরই দখলে ছিল। এগুলির মধ্যে গন্ধেশ্বরী নদীর দক্ষিণ তীর বরাবর একটি মুসলমান-প্রধান গ্রামের পাশে বিস্তৃত চাষ-জমি ছিল। এটি পিতার গ্রাম থেকে ছয়-সাত কিলোমিটার দূরে। মোহরচাচা আর তার ছেলেরাই জমি চাষ করত। আর নদীতীর বরাবর জমিসংলগ্ন বহু খেজুরের গাছ ছিল। শীতে নলেনগুড় তৈরি করত মোহরচাচা। গরুর গাড়িতে ধান আর সময়ে গুড় আনত কলস ভর্তি। সংখ্যায় অনেকগুলি। বাড়িতে চা আর মুড়ি খাওয়া মোহরচাচার চেহারাটি আজও আমার মনে আছে। শুনেছি শহরে দাঙ্গা বাধলে মোহরচাচা ছেলেপুলে নিয়ে আমাদের বাড়ি এসে যেত। তারপরে যখন, অনেক অনেক পরে চৌষট্টি সালের গোড়ায় দাঙ্গা হল, আমি তখন কলকাতায়, মোহরচাচা তার ছেলেদের নিয়ে আমাদের বাড়িতে অনেকদিন থেকে গিয়েছিল।

গ্রামসংলগ্ন এজমাল জমি এবং পুকুরের ভাগ তো ছিলই, পিতা স্বয়ং অনেক সম্পত্তি কিনেছিলেন। তাঁর গ্রামসংলগ্ন এবং বহু দূরে। দুটো জায়গার কথা আমার মনে আছে: ওন্দা আর ছাতনার একটা গ্রামে। নাম ঝগড়াপুর। চাষিরা ছিল সাঁওতাল। জায়গাটা এখন আন্দাজ করে দেখি বিষ্ণুপুর থেকে প্রায় পঁয়তাল্লিশ কিলোমিটার দূরে। শুশুনিয়া পাহাড়ের কাছে। জমির পরিমাণ ষোলো বিঘা। চাষিরা ধান আর খড় আনত বেশ কয়েকটা গরুর গাড়ি বোঝাই। একটি ছবিই আমার মনে আছে, একজন সাঁওতাল চাষির খাওয়া মুড়ির পরিমাণ। প্রায় সাত-আট পাই। সঙ্গে গুড় আর ছাঁচি পেঁয়াজ। ওন্দায় জমি ছিল দশ বিঘা। এর উৎপন্ন কখনও বাড়িতে আসেনি। প্রত্যক্ষভাবে যে মাত্র দুটি ভূমিখণ্ডের সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটেছিল, তাদের একটির নাম কানালি আর অন্যটির নাম শালডাঙা। প্রথমটি একসঙ্গে নয় বিঘা ষোলো জমি। জমির মাথায় একটি বড় পুকুর।

দ্বিতীয়টি দশ-বারো বিঘা। সংলগ্ন একটি খাল। এটি জমিটির অংশ। পিতৃদেব এই খালটি বাঁধিয়েছিলেন। আর এ-দুটোই দ্বারকেশ্বর-গন্ধেশ্বরীর সম্মিলিত স্রোত ছুঁয়ে। জমির সঙ্গে যুক্ত ছিল একটি বড় পুকুর ওপরে উঁচু জমিতে। এখানে চাষ ছিল সব্জি আর আলুর। এ-জেলায় তখন তেমন আলুচাষ চালু হয়নি। সরু ধান ছাড়াও চাষ হত গেবিন্দভোগ চালের। আর এই গোবিন্দভোগ চালের চিঁড়ে তৈরি করে দিত যতিমাসি। জমির একপাশে ছিল বিশাল গ্রানাইটের একটি ছোটখাটো পাহাড় আর তার মাথায় একটি কুসুম বনস্পতি। এগুলিও তাঁর। এখানে একটা কথা মনে চলে আসে। উনিশশো বাহাত্তর সালে, রিভিশনাল সেটেলমেন্ট চলাকালীন আমি আমাদের গ্রামে তার ক্যাম্পে বর্গা করার উদ্যোগ নিই। এখানে কবুল করে যাই একজন চাষিও আমার কথা গ্রাহ্য তো করেইনি, আমাকে তিরস্কার করেছিল। এদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ছিল কাকা, জ্যাঠার। আমার পিতা বা মা একটি কথাও বলেননি। বলেছিল আমার আত্মীয়েরা। সম্পর্ক একরকম ত্যাগ করেছিল। পিতা বা মাকে আমৃত্যু পরম আদরে দেখাশোনা করেছিল তাঁদের চাষিপরিবার। আর আমি যখন চাকুরিতে, অনেক দূরে, ষাট পয়সা কিলো রেশনের চাল কিনতাম। লাল সাদা মোটা চাল, কিলো-পিছু একশো ধান আর পঞ্চাশ গ্রাম পাথর। আমি কখনও বাড়ি থেকে এক দানা চালও আর সংগ্রহ করিনি। আমার মাইনে তখন একশো পঞ্চাশ টাকা। আরও পরে আমার উৎসাহী আত্মীয়েরা পিতা-মাতা গত হওয়ার পরে সেটলমেন্ট ধরে ওয়ারিশ-পিছু জমির খতিয়ান তৈরি করে। আমার নামে পৃথক খতিয়ান করে দেয়। এই সব জমি বাদ দিয়ে ছিল আমার নামে জেলাসদরের লালবাজারে আর শ্রীদাম সায়রের পাড়ের উপরে বাস্তুর অংশ। আমি সমস্ত অধিকারস্বত্ব ত্যাগ করে অন্যের হাতে তুলে দিই। আর চাষযোগ্য জমিগুলি বন্দোবস্ত করে দিয়েছি চাষিদের পক্ষে। যতদিন আমার কালের চাষি মানুষেরা বেঁচে ছিল, পালাপার্বনে বিবাহে আমিই ছিলাম তাদের সমস্ত দাবি পূরণের লোক।

আমাদের গ্রামের আশেপাশে ছিল রবিশস্যের জমি। এখানে ফলত ছোলা, যব, তিল আর আখ। শীতের মাসগুলিতে সদ্য সেচ পাওয়া শস্যগুলির উপরে বহু ফসলের গন্ধমাখা একটা হালকা কুয়াশা বহু দূরের মাঠগুলি পর্যন্ত ছড়িয়ে থাকত। এমনকি অন্ধকার রাতেও বোঝা যেত তাদের অবস্থান। আর এর পরই তার চারদিক ঘিরে গ্রামটা চলে যেত শেয়ালের দখলে। বাড়ির উঠোন পর্যন্ত তাদের অধিকার।

আর ছিল ঈক্ষুর বিস্তীর্ণ ক্ষেত, আর সেই ক্ষেত দখল নেওয়া শেয়ালের পাল— গ্রামজীবনে এই শৃগালদলের একটা আবশ্যিক ভূমিকা ছিল। তখনকার বিদ্যুদহীন গ্রামের খাঁটি অন্ধকার, খাঁটি জ্যোৎস্নায় সামনে পিছনের সমস্ত ভূখণ্ডে প্রহর ধরে শেয়ালের ডাক গ্রামজীবনের বাস্তবিক দিকটাকে আড়াল করে যে রোমাঞ্চ তৈরি করে চলত, তার কোনও বিকল্প ছিল না। শীতের রাত্রে ঘুমের উষ্ণতা ছাপিয়ে নদীর স্রোতে তাদের মৎস্যশিকারের উল্লাস, তাদের কাশির শব্দ, হাসির লহর গ্রামের বাস্তবিক অস্তিত্বটাকেই সুদূরে তুলে নিয়ে যেত। পূবের আকাশে শুকতারাটিকে এনে দিয়ে তবেই সাঙ্গ হত তাদের আসর— যূথবদ্ধ হয়ে তাদের বাঙ্কারে ফিরে যাওয়া। তবে আশ্চর্য এই যে পৌষের কোনও একটা অমাবস্যার রাতে একটা রহস্যময় কারণে তাদের ডাক সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যেত। বাড়িতে শোনা যেত সেদিন ভেউমঙ্গল ডাকবে। কেবল সে। এই রাতে সন্তানদের মাথার দিক পরিবর্তন করে দিতেন জননী। আর ওইদিন বিস্তীর্ণ নদীচরে নেমে আসা অন্ধকার ফুঁড়ে ভেসে আসত কুকুরের ডাকের মতো একটা ওঠানামা ধারালো ডাক। তারপর কঠিন নীরবতা। কে এই ভেউমঙ্গল? এক প্রাচীন চাষি আমাকে বলেছিল এটা একটা বিশাল আকারের প্রাণী। শেয়ালদের দলপতি।

পরের কুড়ি পঁচিশ বছরের মধ্যে শৃগালেরা কেবল রয়ে গেল ছোটদের গল্পের বইয়ে। অথবা সেই সময়ে লেখা কবির কবিতায়। প্রফুল্লচন্দ্র সেন মহাশয় বিধানচন্দ্র রায় মহাশয়ের ক্যাবিনেটে খাদ্যমন্ত্রী থাকার সময়ে জোর দিয়েছিলেন ফলন বাড়ানোয়। জাপান থেকে এনেছিলেন তাইচুং ধানের বীজ। নব্বই দিনে ধান হয়। গ্রামে গ্রামে পড়ল বিশাল হোর্ডিং। একই সঙ্গে এর বর্ধনে এল অ্যামোনিয়া সার। আর এগুলিরই পিঠে এল কীটনাশক। তিনের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। এই কর্মসূচিকে গুরুতর করে তুললে আকাশবাণীর ‘চাষিভাইদের জন্য’ কার্যক্রম— সম্ভবত নাম ছিল ‘উনো জমির দুনো ফসল’। এ-ব্যবস্থা চলে এল যে-কোনও ফসলে। ফসলভরা ক্ষেতের পর ক্ষেতে দেখা যেতে লাগল একটা করে লাল পতাকা। রাখাল গরু-বাছুর নিয়ে যাবে না— কীটনাশক বিষ। কিন্তু এ-পতাকার মানে বুঝল না শেয়াল, সাপ, ইঁদুর। ভরা ক্ষেতের নিচে উজাড় হয়ে গেল অগণন প্রজাতির মাছ।

[ক্রমশ]