Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

স্মৃতিপরব: অধ্যায় ২, পর্ব ৭

নীহারকান্তি হাজরা

 

নদ-নদীর সঙ্গমভূমে

অধ্যায় ১: পর্ব ১পর্ব ২পর্ব ৩পর্ব ৪পর্ব ৫পর্ব ৬পর্ব ৭পর্ব ৮পর্ব ৯
অধ্যায় ২: পর্ব ১ পর্ব ২পর্ব ৩পর্ব ৪পর্ব ৫পর্ব ৬

 

অহিফেনাসর

এই সময়ের গ্রামে অনেকের অভ্যেস ছিল নিয়মিত আফিম সেবন। আবগারি দপ্তর থেকে দেওয়া তাঁদের নামে একটা করে রেশন কার্ড ছিল। শহরের বিভাগীয় জানালায় এটি নির্দিষ্ট মুদ্রা-সহ ঢোকালেই কাগজে মোড়া একটা কালচে নীল বস্তু হাতে আসত। এর পরিমাণ নির্দিষ্ট থাকত। আফিমখোরদের একটা বড় অংশ আবার তখনকার চিকিৎসার অঙ্গ হিসাবে সরিষা-প্রমাণ আফিম প্রয়োগ থেকেই তৈরি হয়েছিল। শুনেছি আমার মাতামহীর একবার গুরুতর বিসূচিকা জাতীয় সন্নিপাতের সময় ডাক্তার শেষ অস্ত্র আফিম প্রয়োগ করেছিলেন। তাতেই তিনি খাড়া। কিন্তু অভ্যেস থেকে গেল। দেখেছি তিনি ভর্তি একবাটি দুধের মধ্যে এক বিন্দু আফিম ফেলে দুধ পান করতেন। তাঁর পুত্রেরা সময় ধরে এটির জোগান দিয়ে চলত। ব্যত্যয় ঘটলেই তাঁর ভাষায় পুত্রদের উদ্দেশে উইথড্রয়াল সিম্পটম নির্গত হত!

পিতৃদেবের গ্রাম এবং তার আশেপাশের গ্রামগুলিতে পুরনো লোকেদের অনেকেই অহিফেনসেবী ছিলেন। এঁদের আবার একজন করে কাপ্তেন থাকত। কোনও আটচালায় বা বৃহৎ কোনও বনস্পতির নিচে তাঁদের সান্ধ্য আসর বসত। আমাদের গ্রামে ছিলেন রাসবিহারী ঘোষাল। তাঁর আধিপত্য এতটাই রাশভারি ছিল যে অনেক বয়োবৃদ্ধরাও তাঁর অনুগত ছিলেন। দুধ সহযোগে আফিমসেবা ঘটত বাড়িতে, কিন্তু ওই বস্তুটির আর একটি প্রকার ঘটত আড্ডায় হাত ফেরি করে। আর এর জন্য ব্যবহার হত বাবলাপাতার। সদস্যরা আপন বাড়িতে জুতোর কালির কৌটোর মতো একটা চ্যাপ্টা কৌটায় বাবলাপাতার মধ্যে একটি বিন্দু আফিম ভরে কাঠের আগুনে সমর্পণ করতেন। কৌটো লাল হয়ে গেলেই বার করে ঠান্ডা করে সংগ্রহ করতেন সেই পরম বিন্দুটি। এটি নিয়ে যেতেন আসরে। কাপ্তেনের কাছে থাকত একটি মাটির পাইপ। আধুনিক পাইপের মতো। তার মুখটি বাবলাপাতা দিয়ে ঠেসে তার মধ্যে রাখা হত সেই বিন্দুটি। এর পর অগ্নিসংযোগ করে সিক করে টানলেই ফট করে একটা শব্দ করে আফিমের গুলি উপরে উঠত। সেবক এরপর নিমীলিত চক্ষু নিয়ে স্থানু হয়ে যেতেন। আর এরই সংক্রমণে গড়ে উঠত বিভোর হওয়া একটা নিঃশব্দ মানুষের মণ্ড। দেবলোকপ্রাপ্তির কিছু পরে চলত হাতফেরাই। শব্দ ধরে এই নেশাটির নাম হয়েছিল সিক আর ফট। এঁরা আবার মাঝেমধ্যেই যামিনী চাটুজ্জেদের বিস্তৃত দীঘিতে বিরাট ভেলা ভাসিয়ে তার উপরে সিক আর ফটের আর্দ্র আবেশে বিভোর হতেন।

এঁরা অকুতোভয় ছিলেন। নদীধারের গ্রামের নিবিড় ঝোপঝাপে বন্যায় ভেসে আসা বহু বিষধর সাপ আশ্রয় নেওয়ার ফলে সাপে কাটার ঘটনা আকছার ঘটত। অহিফেনসেবীরাই কেবল এর ভয় থেকে মুক্ত ছিলেন। এক অন্ধকার সন্ধের কথা বলে ছিলেন রাসবিহারী। নদীতীরের বড় মাঠ পার হয়ে আমবাগানের জমাট অন্ধকার। আর তারপরেই সার্বভৌম ডাঙার পুঞ্জ পুঞ্জ অন্ধকারের সংলগ্ন পথে খড়ম পায়ে রাসবিহারী। ভগ্ন বাস্তুর ঝোপ থেকে বেরিয়ে রাসবিহারীর পায়ে কাটলে এক সাপ। ‘‘বুঝলে বাপু প্রথমে পা-টা অবশ মনে হচ্ছিল। পরে বললুম, কেমন বিপদে পড়লি। আমাকে কাটলি তো গর্তে গিয়ে মরে পড়ে থাকবি।’’

একটা সময় আফিমখোরদের দুঃসময় নেমে এল। কার্ডে আফিমের বরাদ্দ এতটাই কমে গেল যে লভ্য বরাদ্দে সপ্তাহে একদিন চলে। হাত-পা খাড়া হয়ে খিঁচ ধরে যায়। পেট ফুলে বাদ্যযন্ত্র। কিন্তু ঈশ্বর করুণাময়! বিকল্প এনে দিলেন। শহরের সমস্ত মুদিমশলার দোকানে চলে এল মাথার খানিকটা ভেঙে ফুটো করা ঠিক ডালিমের আকারের পোস্তর ফলের খোলা। ওইটুকু ভেঙে পোস্ত বার করা হয়েছে। এগুলি মেলে ওজনে। নির্দিষ্ট দামে। কোথাও কোনও খবরদারি নেই। এর খানিকটা টুকরো করে রাতভর পাত্রে ভিজিয়ে রেখে পরের দিন সকালে নীলাভ জলটি ছেঁকে নিতে হয়। তারপর গুছিয়ে বসে মৃদু মাত্রায় বহুক্ষণ ধরে পান। একদিন একটি বিন্দু জিভে দিয়ে দেখেছিলুম— ভূমণ্ডলের সমস্ত তেতোর সারাৎসার।

 

[ক্রমশ]