দিয়েগো আর্মান্দো মারাদোনা

বে-আদব খেলা এই ফুটবল। নব্বই মিনিটের লাথালাথির মধ্যেই থেমে থেকে যেতে চায় না কিছুতেই। একটা উড়ান, একটা উল্লম্ফন, একটা উত্তরণের বদভ্যাস তার মজ্জাগত। সেই উড়ান তাকে খেলার চৌহদ্দি থেকে নিয়ে গিয়ে ফেলে জীবনের আঙিনায়। চার নম্বর প্ল্যাটফর্মের দ্বিতীয় বর্ষের চতুর্থ মেল ট্রেন ‘সকার ইন দ্য টাইম অফ কলেরা’-র সম্পাদকীয় নিবন্ধে স্টেশন মাস্টার লিখেছিলেন “…আমাদের মনে পড়তে থাকে স্টেডিয়ামে বসে ইরানের মেয়েদের খেলা দেখার বিরুদ্ধে কীভাবে জ্বলে ওঠে মৌলবাদের সবুজ চোখ, তার প্রত্যুত্তরে কীভাবে ইতিহাসের পূর্ণবৃত্ত রচিত হয় বোরখার ঢাকনা খুলে ইস্পাহানি মেয়েদের সোচ্চার মাঠে নেমে পড়ায়— যেন হিংসুটে দৈত্যের বাগানে উড়ে বেড়াচ্ছে ঝাঁকে-ঝাঁকে রঙিন প্রজাপতি… মনে পড়তে থাকে বরফমাখা কনকনে ঠাণ্ডার বিকেলে পোল্যান্ডের কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে মৃত্যুর সুনিশ্চিত পরোয়ানা মাথায় নিয়ে ফুটবলে মেতে ওঠা ইহুদি বন্দিদের কথা— বলের পেছনে যাঁদের প্রতিটি সম্মিলিত দৌড়, বলের গায়ে আছড়ে পড়া যাঁদের প্রতিটি স্পর্ধাবান লাথিতে মৃত্যুকে অতিক্রম করে যাওয়ার অভ্রান্ত স্লোগান… মনে পড়তে থাকে চেন্নাইয়ের উপকণ্ঠে ব্যাসরপাডির দলিত খ্রিস্টান বস্তি থেকে জয়াসূতা বা ভীমাবাঈয়ের মতো মেয়েরা লাইন দিয়ে ইস্কুলে নাম লেখাতে এসেছে, কেবল প্রত্যেকে নিজস্ব স্টাড-বসানো বুট পাবে, সেই বুট পরে ফুটবল খেলার সুযোগ পাবে বলে— যে ফুটবল তাদের আজন্ম এঁদো বস্তিতে বেড়ে ওঠার মোনোক্রোম জীবনটাকেই পালটে দেবে ম্যাজিকের মতো।…”

আর এই ফুটবল যখন জীবন, আমাদের টিমের ক্যাপ্টেনের নাম অনিবার্যভাবে দিয়েগো আর্মান্দো মারাদোনা।

মানুষটার ফুটবলদক্ষতা নিয়ে কিছু বলা বাতুলতা। এই যে ওপরের ছবিটা, গত ২৭শে নভেম্বর ফিফা ওয়ার্ল্ড কাপ-এর ফেসবুক পেজের কভার হয়েছিল। সেই ফিফা, পাঠককে স্মরণ করাই, যে নিয়ামক সংস্থার মারাদোনার সময়কালের প্রেসিডেন্ট সেপ ব্লাটার বলেছিলেন তিনি নাকি আর্জেন্টিনার শেষ ভালো ফুটবলার হিসেবে আলফ্রেডো ডি স্টেফানোকেই মনে করতে পারেন! এই যে ক্ষমতার তাঁকে প্রাণপণ অস্বীকার করতে চেয়ে চেয়ে শেষমেশ গিয়ে তাঁরই কাছে নতজানু হওয়া— এটাই দিয়েগোর অভিজ্ঞান। ফিফার স্বেচ্ছাচারের সমালোচনা করেছেন দাপটে, টিভি কোম্পানির স্বার্থে দুপুর রোদে ফুটবলারদের খেলতে বাধ্য করার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন, ফুটবলারদের কেন শ্রমিক হিসেবে গণ্য করা হবে না সেই প্রশ্ন তুলেছেন। এত কিছুর পরে ক্ষমতার তো তাঁকে সহ্য করার তো কথাও ছিল না।

কিন্তু তাতে আর কী-ই বা এল গেল? লোকটা তো এরপর দাপটে পোপ দ্বিতীয় জন পলকে সন অফ দি বিচ বলে দেবেন প্রকাশ্যে, বিশ্বক্ষমতাকেন্দ্রের কাছে ব্যাড বয় ফিদেল কাস্ত্রো-হুগো শাভেজের সঙ্গে দোস্তি করবেন, প্যালেস্তাইনের পক্ষে দাঁড়াবেন…। হ্যাঁ, হ্যান্ড অফ গড থেকে কোকেন— এগুলিও তাঁর সঙ্গী হয়ে থাকবে সারাজীবন— যেগুলি আরও প্রমাণ করে দেবে দিয়েগো আসলে একটি রক্তমাংসের মানুষ, আমার-আপনার মতো, ধরাছোঁয়ার মধ্যে, বড় আপন। যে মাস-হিস্টিরিয়া আমরা প্রত্যক্ষ করছি কয়েকদিন ধরে তা প্রতি মুহূর্তে প্রমাণ দিয়ে যাচ্ছে এই কথাটার।

রক্তমাংসের সেই দিয়েগোকেই একটু ফিরে দেখার আয়োজন চার নম্বর প্ল্যাটফর্মের তরফ থেকে। রইল ফিদেল কাস্ত্রোর ২০১৪ সালের একটি বার্তার অনুবাদ। সঙ্গে প্রকাশিত হল উরুগুয়ের সাংবাদিক-সাহিত্যিক এদুয়ার্দো গালিয়ানোর একটি লেখা এবং মারিও বেনেদেত্তির একটি কবিতা। রইল কলম্বিয়ার ‘এল তিয়েম্পো’ পত্রিকার সম্পাদক পল রোমেরোর একটি শ্রদ্ধার্ঘ্যও। থাকছে ফুটবলার সুরজিৎ সেনগুপ্তের একটি লেখা। এবং এরই পাশাপাশি মারাদোনা নামক একটি কালখণ্ডকে ফিরে দেখেছেন শুভ্র মৈত্র এবং অনির্বাণ ভট্টাচার্য

জীবনকে আমৃত্যু জড়িয়ে থেকেছেন দিয়েগো। তাঁর জীবন নশ্বর হতে পারে না।

Facebook Notice for EU! You need to login to view and post FB Comments!
%d bloggers like this: